রতনের ঘুম ভাংলো প্রচণ্ড পানির পিপাসায়। রতন শুয়ে শুয়ে তার ঘরের চারপাশে দৃষ্টি দেয়, তেমন কিছুই বোঝা যায় না অন্ধকারের কারণে। বুক-গলা শুকিয়ে কাঠ, রতন যেন এক কলস সমান পানি একচুমুকেই শেষ করে ফেলতে পারবে। জ্বরের ঘরে ভ্রম হয় ওর, চোখে যেন পরিষ্কার দেখতে পায়, লাল শাড়ি পরা তরুণী বউ শিউলি হেসে ওকে একগ্লাস ঠাণ্ডা পানি এনে দিচ্ছে। কাঁচের গ্লাসটাতে ভর্তি ঠাণ্ডা পানি, গ্লাসের গায়ের ঘ্যামটাও যেন দেখে রতন। ওর এই ভ্রম দূর হতে বেশী সময় লাগে না। অনেক কষ্টে বিছানায় উঠে বসে রতন। জানে কেউ নেই ওকে পানি দেওয়ার, তাও অভ্যাস বসে বিড়বিড় করে উঠে, “শিউলি, এক গ্লাস পানি দাও.....বুকটা যেন পুড়ে যাচ্ছে! ও বউ!” অন্ধকারটা চোখে সয়ে যায়, রতন কোণার টেবিলের উপর আবছা জগ-গ্লাস সব দেখতে পায়, আর খাটের পাশের দেয়ালে হেলান দেয়ানো ক্র্যাচ দুটো দেখতে পায়। ক্র্যাচ দুটোকে দেখে একটু খুশি হয়ে যায় ও! পা-দুটো অচল হয়ে যাবার পর থেকেই ক্র্যাচ দুটো ওর কাছে সন্তানের থেকেও আপন। বিড়বিড় করে কথা বলে উঠে রতন, “বাবারা আয়, আমার কাছে আয়! তোদের কাছে যেতে আমার যে বড় কষ্ট হয়!” বউয়ের উপর রাগ লাগে রতনের , এতো দূরে ক্র্যাচ দুটো রেখে গেছে! রাগের মাথায় এইবার বেশ জোরেই বলে উঠে, “মাতারি আজ আইসা নে, তোরে সিধা কেমনে বানাইতে হয়, আমার ভালো মতোই জানা আছে!”
এইদিকে পানির পিপাসা ওকে রক্তপিপাসুদের মতোই হিংস্র করে তোলে। সবভুলে গিয়ে সমস্ত শরীরের জোর একত্র করে রতন ক্র্যাচ দুটো ধরে বা হাত বাড়িয়ে। এতেই ওর সমস্ত শক্তি নিঃশেষ হয়ে যায় যেন! ক্র্যাচ দুটো বিছানায় তুলে, ক্র্যাচের পাশে শুয়ে জিরিয়ে নেয় একটু! ওর ছোট অপুষ্ট শরীরটা যেন ঝড়-বিক্ষুব্ধ সাগরে একটা খেলনা নৌকা। উথাল-পাথাল ঢেউ যেমন করে খেলা করে নৌকাকে নিয়ে, ঠিক তেমনি ওর শরীর উঠানামা করতে থাকে অবিরাম। বেশ কিছুক্ষণ জিরিয়ে নেয়ার পর রতন শান্ত হয়।
শান্ত হয়ে রতন কথা বলে ক্র্যাচগুলার সাথে, “বাবারা, ওই যে দেখছো টেবিল আর টেবিলের উপর পানির জগ, ওই পর্যন্ত যেতে হবে কষ্ট করে। ওই পর্যন্ত গেলে, তোমাদের বাবা পানি খেতে পারবে। পানি খেয়ে আজও তোমাদের গল্প শোনাবো! কেমন করে আলাউদ্দিনের দৈত্য তাকে রাস্তার ছেলে থেকে মস্ত ধনী বানালো! খুব সুন্দর গল্প, তোমাদের ভালো লাগবে!” পরম মমতা আর ভালবাসায় ক্র্যাচগুলোকে আদর করে রতন।
পানির পিপাসা আবার ওকে পেয়ে বসে, রতনকে বাধ্য করে উঠে বসতে আর ক্র্যাচের উপর ভর দিয়ে অনেক কষ্টে খাট থেকে নেমে মেঝেতে দাঁড়াতে। মেঝেতে দাঁড়িয়ে রতন একপাও আগাতে পারে না, ক্র্যাচের আঘাতে কাঁচের কিছু মেঝেতে পরে ভেঙ্গে যায়, রতন ভালো করে কিছু বোঝার আগেই আরেকবার ক্র্যাচের বাড়ি খেয়ে আবার কিছু পরে যায়। রতন এবার বুঝতে পারে জিনিসটা পানির বোতল অথবা জগ ছিলো, কেননা, ঠাণ্ডা পানি রতনের দুইপায়ের পাতা ভিজিয়ে দেয়। রতন হতবুদ্ধি হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে বেশখানিকক্ষণ, ওর মনে পরে যায় ওর খাওয়ার সুবিধার জন্যই শিউলি খাটের পাশে মেঝেতে পানির স্টিলের জগ আর কাঁচের গ্লাস রেখে গিয়েছিলো! একেতো কাঁচ ভাঙা, তার উপর পানি দিয়ে মেঝে ভেসে যাচ্ছে। আবারো বিড়বিড় করে উঠে রতন, ক্র্যাচগুলার উদ্দেশ্যে বলতে থাকে, “বাবারা, তোরা বড়ই জ্বালাতন করিস! দেখতো কি করলি?! তোদের মা দেখলে আমাদের কাউকেই আস্ত রাখবে না! জানিসইতো মাতারির মেজাজ কতো!!”
পা যেন কেটে না যায় আর ভিজা মেঝেতে যেন হড়কে না পড়তে হয়, তাই অনেক সাবধানে রতন আস্তে আস্তে সুইচ বোর্ডের দিকে আগায় আর লাইট জালায়। মেঝেতে যেন বন্যা হয়েছে, এক জগ পানি যেন কোন জাদুতে একবালতির চেয়েও বেশী হয়ে পুরা ঘর ভাসিয়ে দিয়েছে। আর কাঁচের গ্লাসটা ভেঙে হয়েছে শতটুকরো! রতন এইবার ভয় পায়, ওর বউ শিউলি আজ ওকে মেরেই ফেলবে! কিন্তু এতো কিছুর মাঝেও রতনের পানির পিপাসা কমে না। রতন পানির আশায় টেবিলের উপর তাকায়, ভেবেছিলো যেখানে পানির জগ রাখা, ওই জায়গাটা খালি! ঘরের কোনার মাটিতে রাখা কলস, একটু আড়াল করা, ওইদিকটাতে রান্না করার ব্যবস্থা আর ঝাড়ু- ন্যাকরা সবই ঐখানে রাখা। রতন রান্নাঘরের দিকেই যাবে ঠিক করলো! শিউলি আসার আগেই, সবকিছু গুছিয়ে ফেলতে হবে, আর সবচেয়ে বেশী দরকার হচ্ছে পানি খাওয়া। নিঃশ্বাস নিয়ে রতন কথা বলে ক্র্যাচগুলার সাথে, “বাবারা, চল...এক গ্লাস পানি খেলেই সবকাজ করার শক্তি হবে আর তোদের সাহায্যে সবকিছু ঠিক করে ফেলব, মাতারি কিছুই টের পাবে না! চল বাবারা, আস্তে আস্তে পাকের ঘরের দিকে চল!”
এমন ঠাণ্ডা লাগছে মেঝেটা যেন মেঝের পানিতে কেউ মনে হয় বরফের কুঁচি মিশিয়ে দিয়েছে। রতন বুঝতে পারে ওর আবার গা কাঁপিয়ে জ্বর আসছে, কিন্তু জ্বর আসার আগেই ও কলস থেকে পানি খাবে, আহারে পানি! “চল্ বাবারা চল!” কিন্তু আগাতে পারে না রতন, ক্লান্তি যেন ওকে দুই হাত দিয়ে ধরে পিছনের দিকে টানতে থাকে। মেঝেতেই বসে পরে রতন, হাঁপাতে থাকে জোরে জোরে। মেঝের পানি ওর লুঙ্গি ভিজিয়ে দেয়। রতনের মনে হয় ঘরে মাঘ মাসের হিম পড়েছে। বিড়বিড় করে কথা বলার শক্তিও হারিয়ে ফেলে ও। কতক্ষণ এইভাবে মেঝেতে পরে ছিল জানে না ও। ওর হুঁশ ফিরে বউ শিউলির ধাক্কায়, “কি গো?! তুমি মাটিতে বইসা আসো কেন?! আর ঘর বাড়ির এই অবস্থা কেন?! তোমারে নিয়া আর পারি না, আমারে জালায়া তামা তামা বানাইলা!”
বউয়ের বিরক্তি স্পর্শ করতে পারে না রতনকে, শুধু একটা কথাই বলতে পারে, “পানি দাও! বড় পানির তিয়াস লাগসে!”
শিউলি রতনকে মেঝে থেকে উঠায়, আলগিয়ে নিয়ে যায় ঘরের দরজার দিকে, “পানি একটু পরে দিতাসি, তুমি একটু বাইরে বস, আমার বেশিক্ষণ লাগবে না। এটাই আজকের শেষ, উনি ভালো টাকা দিবেন বলসেন” । রতনকে ঘরের বাইরে রেখে, মোটা-কালো মতো একলোককে নিয়ে শিউলি ঘরে ঢুকে দরজা আঁটকে দেয়।
ঘরের বেড়ায় হেলান দিয়ে, রতন রাস্তায় পা ছড়িয়ে বসে থাকে, বুকের কাছে ধরা ক্র্যাচ দুটো। এখন রাত, কয়টা বাজে রতন বলতে পারে না। আশেপাশে অনেক আওয়াজ, কোথাও গান বাজছে, কোথাও সিনেমা চলছে, অনেক মানুষের যাতায়াত কিন্তু কিছুই ঘরের ভিতরের আদিম খেলায় মত্ত মানব মানবীর আর্তনাদকে চাপা দিতে পারছে না! রতন একটু সরে বসতে চেষ্টা করতে থাকে কিন্তু সফল হয় না। ক্লান্ত স্বরে বিড়বিড় করে ক্র্যাচ দুটোর উদ্দেশ্যে রতন বলে, “বাবারা, তোমরা তো মহা সুখে আসো, তোমাদের পানির তিয়াস লাগে না! বাবারা একটা কথা কই, মন দিয়া শুনো, আমার মতো অধম হইলে বিয়া-শাদি কইরো না! অধমদের পরিবার থাকা লাগে না!”