“অ” গ্রামের “গ”ল্প

দেশপ্রেম (ডিসেম্বর ২০১১)

জ্যোতি হাসান
  • ৩৫
  • 0
  • ৪৬
এই গল্পটি তথাকথিত নেতৃস্থানীয় দেশপ্রেমিকদের গল্প যা আমাদের দেশের সাধারণ মানুষের চিরচেনা!!!!

বাংলাদেশের অন্য হাজার হাজার গ্রামের মতোই একটা সাধারণ গ্রাম “অ”। গ্রামে ইলেক্ট্রিসিটি আছে, আছে ডিশের লাইন, প্রায় বেশিরভাগ বাড়িতেই হয় মোবাইল ফোনের ব্যবহার, আছে স্নাতক পর্যন্ত পড়ার জন্য একটি কলেজও। আর দেশের সমস্ত শহর-গ্রামের মতো “অ” গ্রামেও আছে একাধিক দেশপ্রেমিক মাথা!! এক দেশপ্রেমিক মাথা আছে ক্ষমতায়, আরেক দেশপ্রেমিক মাথা আছে বিশ্রামে। পালাক্রমে এই দুই দেশপ্রেমিক মাথাই “অ” গ্রামকে উনাদের দেশপ্রেম আর সুযোগ্য নেতৃত্ব দিয়ে উন্নতির জোয়ারে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে অবিরত!! এই দুই দেশপ্রেমিক মাথা গ্রামের মানুষকে তাদের প্রেমভালবাসা দিয়ে বাধিত করে যাচ্ছে এবং গ্রামবাসীদের কৃতজ্ঞতার জালে আবদ্ধ করে ফেলছে!! গ্রামবাসীরাও অনেক আগের থেকেই এই দুই দেশপ্রেমিকের ফুলের মতো পবিত্র স্বভাব এবং সৎ কার্যকলাপে অভ্যস্ত হয়ে গেছে এবং অধিক খুশীতে এরা এখন জম্বি হয়ে গেছে!!! কোন দেশপ্রেমিক মাথা কখন গ্রাম রক্ষার পবিত্র দায়িত্ব নিচ্ছে আবার মেয়াদ শেষে অপর দেশপ্রেমিক মাথা গ্রাম রক্ষায় নামছে, তা নিয়ে “অ” গ্রামবাসী আর মাথা ঘামাচ্ছিলো না।

দুই দেশপ্রেমিক মাথার মধ্যে সব বিষয় নিয়ে অবিরাম প্রতিযোগিতা চলে। গ্রামবাসী এইসব প্রতিযোগিতাগুলোর নীরব দর্শক। কিন্তু মাঝে মাঝে দুই দেশপ্রেমিক মাথার অসুস্থ প্রতিযোগিতায় সাধারণ গ্রামবাসীর কিছুটা ভালো হয়, তখনই এইসব নীরব দর্শকদের মাঝে কিছুটা চাঞ্চল্যতার সৃষ্টি হয়। যেমন, কুরবানী ঈদের সময়ে। দুই দেশপ্রেমিক মাথাই আশেপাশের গ্রামের হাটগুলা থেকে সবচেয়ে বড় ষাঁড়টা কিনতে চায় কুরবানি দেয়ার জন্য। মাংস ভাগের সময়ও কে কত মাংস বিলাতে পারে, সেই প্রতিযগিতায় নামে, এটাতে গ্রামের দরিদ্র মানুষের মধ্যে কিছু সময়ের জন্য হলেও উৎফুল্লতার সৃষ্টি হয়। আবার দুই দেশপ্রেমিক মাথার কারণেই “অ” গ্রামে এখন দুই-দুইটা ঈদগাঁ। দুই মাথারই লক্ষ্য থাকে ঈদের জামাত যেন সবার আগে তাদের ঈদগাঁয়ে অনুষ্ঠিত হয়।

দুই দেশপ্রেমিক মাথার ছেলে মেয়েরাই রাজধানীতে থেকে পড়াশোনা করতো। কয়েক বছর আগে এক দেশপ্রেমিক মাথা উনার এক ছেলেকে আমেরিকায় পাঠায়। উচ্চশিক্ষার নামে ওইখানে যেয়ে সেই ছেলে পড়াশোনার না করে বাবার নাম আরও উজ্জ্বল করছে। এই উজ্জ্বলতার ছটায় জলে-পুরে ছারখার হয় আরেক দেশপ্রেমিক মাথা, উনিইবা চুপচাপ বসে হিংসার আগুনে পুড়বে কেন??!!! তিন-তিনবার দেশপ্রেমের দোহাই দিয়ে গ্রাম রক্ষার মহান দায়িত্ব নিষ্ঠার সাথে উনি পালন করেছেন এবং এরফলে ভালো পরিমান সম্পদ উনার কাছে আছে, এই সম্পদ নিয়ে উনি নিশ্চয়ই কবরে যাবেন না!!! আর তাই, আরেক দেশপ্রেমিক মাথাও উনার ছেলেকে বিলাতে পাঠালেন, ব্যারিস্টারি পড়ার জন্য। কিন্তু উনার ছেলেও পড়াশোনা না করে, বাবার নাম উজ্জ্বল করছে!!! সেই থেকে দুই দেশপ্রেমিক মাথাই ক্রমান্বয়য়ে উনাদের সুপত্র আর সুকন্যাদের দেশের বাইরে পাঠিয়ে দিচ্ছেন উনাদের মূখ আরও উজ্জ্বল করতে।

এই পর্যন্ত সব ঠিকই ছিল। কিন্তু হঠাৎই গ্রামে আসে, গ্রামের সবচেয়ে শিক্ষিত ও সন্মানিত মানুষ আলী মাস্টারের ছেলে আসাদ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়য়ের কৃতী ছাত্র আসাদ, পড়াশোনা শেষ করে ঢাকায় ভালো চাকুরী করতো এক বিদেশী ব্যাংকে। ঐযে বলে, সুখে থাকতে ভূতে কিলায়, সেই ভূতের কিল খাবারই ইচ্ছা হয়েছিলো মনেহয় আসাদের। নইলে এতো ভালো চাকুরী ছেড়ে, বৌ-ছেলে-মেয়ে সহ হঠাৎ গ্রামে বাবার ভিটায় ফিরবে কেন?! আসাদ গ্রামে ফিরে জানায়, শহরে থাকতে থাকতে আসাদের নাকি দমবন্ধ হয়ে আসছিলো। তাই, গ্রামে ফিরে এসেছে মুক্ত ভাবে হাওয়ায় নিঃশ্বাস নিতে। আসাদের শহুরে বৌও এতে আহ্লাদিত হয়ে আসাদের সাথে চলে এসেছে। কিন্তু আসাদকে দেখে গ্রামের মানুষের নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসতে থাকে। আলী মাস্টারের করুণ পরিণতির কথা সবারই কমবেশি মনে আছে। আসাদকে যেন ঐ একই পরিণতি শিকার না হতে হয় তাই, “অ” গ্রামবাসী আসাদকে দুই দেশপ্রেমিক মাথা থেকে দূরে থাকার পরামর্শ দেয়। আসাদ ঠিক জানে না, কীভাবে তার বাবার মৃত্যু হয়েছে কিন্তু এটা আসাদ জানে যে, তার বাবার মৃত্যুর জন্য দায়ী এই দুই দেশপ্রেমিক মাথা। এই ব্যাপারে আসাদ গ্রামবাসীদের বারবার জিজ্ঞেস করেও কোন সদুত্তর পায় না। আসাদকে ঠিক প্রতিশোধ পরায়ন বলা যায় না কিন্তু তার বাবার মৃত্যুর কারণ যে দুই দেশপ্রেমিক ব্যক্তি, তাদেরকে মোকাবেলা করার সিদ্ধান্ত নেয় আসাদ। আসাদ ঠিক করে, গ্রামবাসীদের সহযোগিতায় আগামি গ্রাম রক্ষার নির্বাচনে অংশ নিবে। আসাদের বাবা আলি মাস্টারেরও স্বপ্ন ছিল এই নির্বাচনে অংশ নেয়ার এবং গ্রামের মানুষের সেবা করার কিন্তু নির্বাচনের মাত্র মাসেক খানেক আগেই তার লাশ পাওয়া যায় কালির ঝিল এ। ভোরের দিকে মাছের জন্য জাল ফেলতে যেয়ে আলি মাস্টারের লাশ আবিস্কার করে “অ” গ্রামের মুন্নু জেলে। তখন মুন্নু জেলের বয়স ছিল মাত্র উনিশ।

এটা বিশ বছর আগের কথা। তখন লাশের ময়না তদন্ত নিয়ে পুলিশ এতো মাথা ঘামাতো না, উপরন্ত দুই দেশপ্রেমিক মাথার প্রত্যক্ষ প্রভাব তো ছিলোই। গ্রামবাসীরা কিছু বুঝে উঠার আগেই আলি মাস্টারের লাশ কবর দেয়া হয়ে গিয়েছিলো। আলি মাস্টারের এমন মৃত্যুর পরেরদিনই আলি মাস্টারের বউ সালেহা ছেলের হাত ধরে “অ” গ্রাম ছেড়ে চলে যায়, এতকাল পরে আসাদ গ্রামে ফিরলো। সালেহা “অ” গ্রামের আত্মীয়স্বজনদের সাথে ঠিকই যোগাযোগ রেখেছিলো। আসাদের কাছে জানা যায়, আসাদের মা সালেহা বছর তিনেক আগে ঢাকায় মারা যায়, কিন্তু মৃত্যুর আগমুহূর্তেও “অ” গ্রামে না ফিরার কথা আসাদকে স্মরণ করিয়ে দিয়ে যায়।

আসাদ তার মার কথা রাখেনাই। চলে এসেছে “অ” গ্রামে সত্যিকার দেশপ্রেমিকের মতো। গ্রামবাসীদের কথাও না শুনে দেশপ্রেমে অন্ধ আসাদ গ্রাম রক্ষার নির্বাচন করার প্রস্তুতি নেয়। আসাদ জানে দুই মাথার অত্যাচারে অতিষ্ঠ “অ” গ্রামবাসী ভিতর ভিতর তার সাথেই আছে। নির্বাচনের বাকি আছে মাত্র তিন মাস, জম্বি “অ” গ্রামবাসীরা গা ঝাড়া দিয়ে উঠে নতুন দিনের প্রত্যাশায়।

“অ” গ্রামের দুই দেশপ্রেমিক মাথাকে সেই বিশ বছর আগে একসাথে দেখা গিয়েছিলো, আর আজ এত বছর পরে আবার উনারা একসাথে বসেছেন। এখন সময় রাত ১২টার কিছু বেশী। কালির ঝিলের উপরে মাছ ধরার জন্য একটা টঙয়ের মতো আছে, ওইখানে দুই মাথা ফিসফিস করে কিছু একটা নিয়ে গভীর আলোচনায় মগ্ন, দুই মাথার সাঙ্গপাঙ্গদেরও আড়ালে-আবডালে চুপচাপ ইতস্ততঃ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যাচ্ছে। গ্রামের কেউ যেন তাদের না দেখে ফেলে, সেজন্য তাদের অসীম সতর্কতা।

সপ্তাহখানেক পরের কথা। ভোরের দিকে যথারীতি মুন্নু জেলে কালির ঝিলে জাল ফেলতে যায়, আজ তার সাথে আছে তার ছোট ছেলে আবু। আবুর কাধেঁ মাছ ধরার জালটা গুটিয়ে রাখা। ধূপধাপ পা ফেলে আবু মহা উৎসাহে বাবাকে পিছনে ফেলে আগে আগে যাচ্ছে। হঠাৎ আবুর ভয়ার্ত চিৎকার শোনা গেলো, আবুকে দেখা গেলো দৌঁড়ে তার বাবার দিকে আসতে, আবুর মুখের রক্ত সরে গেছে, পরনের রবারের স্যান্ডেলজোড়া নেই, আর কাঁধে রাখা জালটাও হাওয়া। বাবাকে জড়িয়ে ধরে থরথর করে কাঁপছে আবু, অনেক কষ্টে শুধু বলতে পারলো, “বা’জান ঝিলের পানিতে কে জানি উপর হইয়া পইড়া আছে!!!”
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
জ্যোতি হাসান মোবাশ্বের আহমেদ ভাইকে ধন্যবাদ!!! :) আমি দেশপ্রেমিক শব্দটার উপর বেশ জোর দিয়েছিলাম!!! :) আর তাই বারবার ঘুরেফিরে এসেছে শব্দটি!!!
মোবাশ্বের আহমেদ ভালো লেগেছে ভাই । তবে বারবার দেশপ্রেমিক মাথা শব্দটা একটু কেমন যেন . .
জ্যোতি হাসান সূর্য সাহেবকে প্রথমেই ধন্যবাদ জানাচ্ছি গল্পটা সময় করে পড়ার জন্য!! :) আমি যেটা মনে করি, সেটা হচ্ছে, প্রকৃত দেশপ্রেমিকদের নিয়ে লেখাটা একটু কষ্টকর কেননা উনারা কিন্তু বেশিরভাগই লোকচক্ষুর অন্তরালে থাকেন!! আমি নিজেও অনেক খুঁজে পায়নি সেরকম কোনো (contemporary) দেশপ্রেমিক , যাকে নিয়ে লেখা যায়!! :( ভালো থাকবেন!!
সূর্য স্যাটায়ার ভাল হয়েছে। আমরা এবং আমাদের আগের সবাই শুধু মাথাদের নিয়েই কেন লিখি। কেন লিখিনা সত্যিকার ভালবাসার মানুষগুলোকে রক্ষা আমাদের জনগণেরই করতে হবে?
জ্যোতি হাসান শেখ এ কে এম জাকারিয়া সাহেব কে ধন্যবাদ, সময় বের করে আমার গল্পটি পড়ার জন্য!!! :)
শেখ একেএম জাকারিয়া প্রতারনা এবং দেশ প্রেম দুটি দিক সুন্দর করে ফুটিয়ে তুলেছেন মানুষের চরিত্রে। ভাল লাগল।
জ্যোতি হাসান মোহাম্মদ শামসুল আলম সাহেবকেও ধন্যবাদ !!! :)
জ্যোতি হাসান সালেহ মাহমুদ ভাইকে অনেক ধন্যবাদ!!! :) আমাদের দেশের জন্য এটাই ধ্রুব সত্য!!! :)
সালেহ মাহমুদ ভালো লাগলো ভাই। চোরে চোরে মাসতুতো ভাই। এই কথাটাই স্মরণ করিয়ে দিলেন আবার। ধন্যবাদ।

১৪ অক্টোবর - ২০১১ গল্প/কবিতা: ১৬ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "ছোটবেলা”
কবিতার বিষয় "ছোটবেলা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ ডিসেম্বর,২০২৪