ইঁদুর

গ্রাম-বাংলা (নভেম্বর ২০১১)

খন্দকার আনিসুর রহমান জ্যোতি
  • ২৪
  • ১১৫
পূর্ব দিগন্তে রাতে আকাশটা আলোকিত হতে না হতেই ঘুম ভেঙে যায় জমিরনের। রাতের দীর্ঘ আয়েশে ক্লান্তি দুর করা গোটা দুই হাই তুলতে তুলতে পেষ্টিমাখা চোখ দুটো কচলাতে কচলাতে এক সময় উঠোনে এসে দাড়ায়। আধো ঘুম জড়ানো চোখে আবছা দৃষ্টি মেলে চেয়ে থাকে বাড়ীর দক্ষিণ কানি বারবার উন্মুক্ত পাথরের দিকে। না, আজো কামলা লাগেনি... কোন জমিতে। শত আশার বাধনে বুক বেধে রেখেছে জমিরন সেই দিনের আশায়, যেদিন ঘুম ভেঙেই দেখতে পাবে মাঠে মাঠে কামলাদের কাস্তের ঝলকানি, কণ্ঠে জারি গান, তার পর দৃষ্টি ফেরারেই দেখতে পাবে গুটি গুটি আটি আটি থরে থরে সাজানো চিকন সুন্দর্য্যের সমারোহ। মাথায় মাথায় সোনালী ধানের মিছিল, পিঁপড়ের সারির মতো কোন এক দিগন্তের দিকে ধীরে ধীরে মিলিয়ে যাবার সেই দৃশ্য গুলোর আশায় জমিরন অধির হয়ে বসে থাকে। ভাব প্রবণ হয়ে ভাবতে থাকে, একদিন ওরো স্বামী ছিল ঘর ছিল, জমি ছিল, সংসারে সুখ ছিল। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে আজ অন্যের জমির পরে থাকা ধান কুড়ানোর জন্য দিন গুনতে হচ্ছে। ভাবতে ভাবতে এক সময় চোখের পাতা ভারি হয়ে দুফোটা তপ্ত অশ্রু গড়িয়ে পরে ওর বাসি ঠোটে জোরার সন্ধিস্থলে। জিহ্বার অগ্রভাগে লবণাক্ত স্বাদ ওর অনুভূতি গুলোকে সচেতন করে তোলে মুহূর্তে। করুণা বিবাগে যন্ত্রণায় কোকীয়ে ওঠে তল পেটের সবগুলো অনাহারে ক্লিষ্ট নাড়িভুঁড়ি। আর ভাবতে পারে না জমিরণ। হঠাৎ ঈদের চাঁদের মত পাথরের দিকে আঙুল উঁচিয়ে উচ্চ স্বরে মায়ের মনোযোগ আকর্ষণ করে বড় মেয়ে ছমিরন। আবেগে দৌড়ে এসে মায়ের গা ঘেঁষে দাঁড়ায় নলের ঝাড়টাকে আড়াল করে। সত্যি সত্যি এক দল কামলা কাস্তে হাতে ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছে মাঝ মাঠের দিকে। আর বিলম্ব নয় আজ থেকেই মাঠে ধান কাটা শুরু হয়ে যাবে। নতুন আশার আবছা আবরণ জমিরনের মনে গভীরে এক ফালি খুশির চাঁদের মতই খল খলিয়ে ওঠে। আবেগে কেঁদে ফেলে জমিরণ মেয়েকে বুকে জড়িয়ে।

আজ ক’দিন হয় ছোট মেয়েটির জ্বর। কাতর হয়ে পড়ে আছে মেয়েটি। নিজেদের এক বেলা খাবার সংস্থানই যাদের হয় না তাদের আবার চিকিৎসা! ঔষধ থাক দূরের প্রয়োজনীয় পথ্য পর্যন্ত দিতে পারেনি কচি মেয়েটির মুখে। দেখে দেখে দু দিনের মাথায় রোগ কাতর মেয়েটির কচি মুখের শুকনো ঠোট দুটোর দিকে তাকিয়ে আর সহ্য করতে পারে না জমিরন। কিছু অনাজপাতি আর হাঁস মুরগীর ডিম বিক্রি করা বহুকষ্টে জমানো শ’খানেক টাকা কাপড়ের পুটলিতে বেধে মাটির দেয়ালে ফোঁকলে রেখেছিলো জমিরন, উদ্দেশ্য বেশী মাত্রার সংকট কাটিয়ে উঠার জন্য, ভবিষ্যতের সঞ্চিত সম্বল এ কটি টাকা। কিন্তু হায়রে কপাল! দেয়ালের ফোঁকলে গচ্ছিত টাকা ক’টি বের করতে গিয়ে জমিরনের চোখ কপালে উঠে যায় মুহূর্তে। পলকে শরীরের সমস্ত আবেগময় অনুভূতি বিদ্যুৎ পৃষ্টের মত জমিরণের শরীরটাকে চাবকাতে থাকে... টাকার পুটলিটা দেয়ালের ফোঁকলে নেই! কিন্তু জিনসটা গেলই বা কোথায়? প্রশ্নের জবাব খুঁজে পায় না জমিরন। কম্পিত গলায় ডকতে থাকে বড় মেয়ে ছমিরণকে। ঘটনা দেখে ঠায় দাড়িয়ে ছমিরণও অবাক না হয়ে পারে না। মনে একটি প্রশ্ন টাকার পুটলি গেলো কোথায়? আর ভাবতে পারে না জমিরণ হঠাৎ মন্ত্র মুগ্ধের মত ঘর থেকে বেরিয়ে যায় জমিরন। ধান কুড়ানোর জন্য ডালি আর কোদাল প্রস্তুত করে রেখেছিল মেয়েটা, কোদালটা হাতে নিয়ে পূর্ববৎ দৌড়ে ঘারে ফিরে এসে জমিরন পাগলের মত কোপাতে থাকে মাটির দেয়ালটা। কোপাতে কোপাতে এক সময় নজরে আসে জিনিষটা, দ্বিতীয় বারের মত বিদ্যুৎ খেলে যায় ওর বিদগ্ধ ধমনিতে থেকে শিরায় উপশিরায়। মুহূর্তে শরীরে যেন দ্বিগুণ শক্তির সঞ্চার হয়। কোপাতে কোপাতে এক সময় হাতের নাগালে পেয়ে যায় পুতলীটাকে, সাহস মেলে ধনে চোখের সামনে... কিন্তু না বেদনার বালু চরে আবারও হতাশা। পুটলিটাকে হাতে নিয়ে দাওয়ায় এসে ধপাস করে বসে পরে অবশ দেহটাকে নিয়ে জমিরণ। ব্যথায় নীল হয়ে যায় ওর অন্তঃ নিহিত বিদগ্ধ মানুষ মূর্তির আয়ববটা। বোবা দৃষ্টি মেলে দু’চোখের চত্বর ঘুরিয়ে কম্পিত ঠোট জোড়া উল্টিয়ে মেয়ে ছমিরনকে জানাতে চায় এমন কেন হল? মেয়ে ছমিরনও বোবা দৃষ্টি মেলে চেয়ে থাকে ছিন্ন ভিন্ন শত কুটি টাকার পুতলীটার দিকে। সংঘাতময় মুহূর্ত অবসানে উভয়েরই বুঝতে বাঁকি থাকে না আর। সর্বনাশ ইঁদুরের জন্যই এমন হয়েছে। বাম হাতের সবকটি আঙুল ভাজ করে গালে ঠেস দিয়ে জমিরন উদাস নয়নে উন্মুক্ত পাথরের দিকে, বুক ভরে শ্বাস নেয়। আগমনী হাত ছানিতে অনেকটা সান্ত্বনা খুঁজে পায়।
কিন্তু হতাশা আর ঘেন্নায় রিরি কের ওঠে বুকের ভেতরটা। ইঁদুরের গর্তে জমানো ধান কুড়িয়ে পেট পুঁজোর আশায় ভাটি পরে যায় নিজের সর্বনাশের কথা চিন্তা করে। হাজার হাজার কৃষকের ধান গম আর অন্যান্য ফসলাদী কেটে কুটে ইঁদুরের নিয়ে যায় এর গর্তে। যেমনি কেটে কুটে সর্বশেষ করেছে এর জমানো টাকার পুটলিটাকে। গ্রামের সহজ সরল মেয়ে মানুষ জমিরন বুঝতেই পারে নি ইঁদুরের মার প্যাচ। কৃষকের গোলার ধান ইঁদুরের গর্তে কি পরিমাণ ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারে জমিরন হারে হারে টের পেয়ে গেছে। অর্ধাহারে অনাহারে মেয়ে দুটোকে নিয়ে হাফিয়ে উঠেছে জমিরন। চোখের মনি জলে আচ্ছন্ন বিধায় নজরে আসেনি, মেয়ে ছমিরনের হাঁক ডাকে চোখের পাতা হাতের তালুতে মুছতে মুছতে এই প্রথম বারের মত নজরে পরে মাঠের অগ্রণী ধান কাটা শুরু হয়ে গেছে। আবারও আশায় বুক বাধে জমিরন। আবেগে মেয়ে ছমিরনকে জড়িয়ে ধরে ডালি কোদাল নিয়ে হন্ত দন্ত হয় এ বেরিয়ে পরে ধান কুড়োবার জন্য কাল বিলম্ব না করে।

ধান কুড়াতে কুড়াতে কতকটা আনমনা হয়ে যায় জমিরন। তিক্ত অভিজ্ঞতার আলোকে ইঁদুরের এই ধরনের নোংরা স্বভাবের কারণে মনে ওর ঘেন্না জন্মে। মেয়ে জমিরন কামলাদের পেছন পেছন পরে থাকা ধান কুড়াতে ব্যস্ত। জমিরন বড় ধরনের একটা ইঁদুরের গর্ত সনাক্ত করে কোদাল দিয়ে খুরতে থাকে আর মনে মনে ভাবতে থাকে, শত প্রত্যাশিত আশার ফসল থরে থরে সাজানো ধানের শীষের গাদাটা গর্তের গভীর নজরে পরে যায়। ঠিক যেন দেয়ালের ফোঁকলে হারিয়ে যাওয়া টাকার পুটলিটার মতোই তা মনে হয় ওর। খুশিতে মেয়ে ছমিরনকে ডাকতে থাকে জমিরন। ছমিরন দৌড়ে এসে মায়ের পাশে উবু হয়ে দাঁড়ায়, জমিরনের চোখে মুখে খুশির ঝিলিক বয়ে যায়। ইঁদুরের কাটা ধানের শীষগুলো গর্তের গভীর থেকে ওদের মা মেয়েকে গভীর ভাবে আকর্ষণ করতে থাকে। বিলম্ব না করে মুহূর্তে লোভাতুর হাতটা বাড়িয়ে দেয় ছমিরন থরে থরে সাজানো গর্তে ধানে। আর যায় কোথায়, গর্তে লুকিয়ে থাকা গোখরোটাও কাল বিলম্ব না করে আক্রোশে ফাঁশ ফাঁশিয়ে ছোবল মেরে দেয় ছমিরনের হাতের কব্জিতে। ওহ মাগো... বলে ঢলে পরে ছমিরন মায়ের কোলে। জমিরনও ঘটনা বুঝে হাউ মাউ করে কেঁদে উঠে ছমিরনকে বুকে জড়িয়ে। এক মুহূর্তে দৃশ্যপট পাল্টে যায়। হেমন্তের মধ্য মাঠে। কান্না আহাজারি শুনে ধান কাটা কামলারাও দৌড়ে আসে ঘটনা স্থলে। কিন্তু করার থাকে না কিছুই, জাত গোখরোর ছোবলে সব শেষ হয়ে যায় মুহূর্তে। তালি দেয়া শত ছিন্ন শাড়ীর আচল দিয়ে ছামিরনের লাশ ডেকে দেয় জমিরন। পাথরের মতো বসে তির্যক তাকিয়ে থাকে ইঁদুরের গর্তের দিকে। এমন সময় জলে ঝাপসা দৃষ্টিতে ইঁদুরের গর্তটাকে মনে হয় যেন সদ্য খোঁড়া কবর, আর গর্তের গভীরে সাজানো ধানের শীষগুলোকে মনে হয় ছমিরনের মৃত লাশের মত।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
বিষণ্ন সুমন আপনার গল্প বলার ঢং থেকে এটা স্পষ্ট লিখার ক্ষেত্রে আপনি যথেষ্ট মুন্সিয়ানা দেখাবার সামর্থ্য রাখেন। গল্পটার বিষয়বস্তুর পাশাপাশি বর্ণনাশৈলী অসম্ভব মনকাড়া। আশাকরবো নিয়মিত লিখবেন আমাদের জন্য ।
অদিতি এখানে কি বলব বুঝতে পারছিনা। একটা কষ্টবোধ কাজ করছে। আর লেখক যদি এটাই চেয়ে থাকেন তাহলে তিনি স্বার্থকতা পেয়েছেন।
প্রজাপতি মন :( কষ্ট লাগলো পড়ে।
আহমাদ মুকুল অসম্ভব বেদনাদায়ক কাহিনী। অসাধারণ গল্প। তবে ছোট ছোট প্যারায় লিখলে পড়তে আরো সুবিধা হত। আপনি নিয়মিত হলে সাইটটি সমৃদ্ধ হবে।
মিজানুর রহমান রানা গল্পটি পড়ে অভিভূত হয়ে গেলাম গল্পকারের গল্পবলার ভঙ্গীতে। সাবলীল ও চমৎকার ভাষা। শুভ কামনা।
খন্দকার নাহিদ হোসেন ভয়াবহ করুন কিন্তু অসম্ভব সুন্দর একটা গল্প পড়লাম। রীতিমতো মুগ্ধ হলাম। আপনার কবিতার চেয়ে গল্পের হাতে ধার অনেক বেশি। আপনার জন্য রইলো সেরাটা। ও এ ভুবনে স্বাগতম।
sakil gram banglake niye oti sundor ekti golpo upohar deoyar jonno onek dhonnobad . asha kori niymito likhben
আবু ওয়াফা মোঃ মুফতি ভালো লাগলো বেশ ভালো লাগলো |
ওবাইদুল হক অনেক ভাল লাগল পড়ে তবে পুরোটা পড়তে পারিনি আরেক বার সময় নিতে হবে যতটুকু পড়ছি তত ভাল লাগছে । শুভকামনা ।

১০ অক্টোবর - ২০১১ গল্প/কবিতা: ৫২ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

বিজ্ঞপ্তি

“এপ্রিল ২০২৪” সংখ্যার জন্য গল্প/কবিতা প্রদানের সময় শেষ। আপনাদের পাঠানো গল্প/কবিতা গুলো রিভিউ হচ্ছে। ১ এপ্রিল, ২০২৪ থেকে গল্প/কবিতা গুলো ভোটের জন্য উন্মুক্ত করা হবে এবং আগামি সংখ্যার বিষয় জানিয়ে দেয়া হবে।

প্রতিযোগিতার নিয়মাবলী