উতছেদ

পরিবার (এপ্রিল ২০১৩)

মোল্লা সালেহ
“ক্যারে মজিদ! কামে যাবুনা ? কত ব্যালা হয়া গ্যাছে। ওঠ্। ওঠ্ তাড়াতাড়ি।”
দুলালের ডাকে তেমন একটা সাড়া দেয়না মজিদ। আগের মতই শুয়ে থাকে। পাশ ফিরে শোয় মাত্র।
দুলাল কর্তব্যপরায়ন লোক। কোন কাজে তার গাফলতি নাই। অন্য কারও কাজের প্রতি অবহেলা তাকে তীব্র ভাবে আঘাত করে। কাজের প্রতি সজাগ করে দেওয়া যেন তার একটা দ্বায়িত্ব। সে বিরতিহীন ভাবে ডাকতে থাকে , যেন আদাজল খেয়ে নেমেছে।
মজিদ কুলোতে না পেরে বিছানার উপর উঠে বসে। একবার হাই তোলে। একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ছাড়ে। একটু রেগে গিয়ে বলে, “ দিলি তো ঘোমটা লষ্ট করে। অত চেচাস ক্যা ? ”
“ সে কি রে ? তোর ঘোম আমি লষ্ট কইরলাম কেবা কইরা ? ঠিক সময়ে ডাইকা দিছি। মুক কইরতাছিস ক্যা ? দেরি কইরা গেলি মালিকের গাইল কেডো শুনবি ? আমি না তুই ?
ঝাঝের সাথে দুলাল কথা গুলো বলে যায়।
মজিদ অন্যমনষ্ক হয়ে পরে। একদম শান্ত হয়ে যায়। তাড়াতাড়ি করার কোন লক্ষন তার ভিতর দেখা যায় না। দুলাল অবাক হয়ে মজিদের উদাসীনতার কারন জানতে চায় । মজিদ নিরুত্তর থেকে অবজ্ঞার হাসি হাসে।

মজিদ পেশায় রাজমিস্ত্রী। এলাকার আশরাফ মিস্ত্রীর সাথে জোগালদারের কাজ করত। দিন হাজিরার টাকা সপ্তাহান্তে পেত। নিজে খুব দক্ষতার সাথে কাজ করত। অন্যকে দিয়ে কাজ করানোর ক্ষমতা তার ছিলনা। তাই রাজমিস্ত্রীর সব কাজ জানার পরও সে জোগালদারই রযে গেল। ততদিনে পরিবারের সদস্য সংখ্যা দুই থেকে তিনের ঘরে দাড়িয়েছে। পরিবারের স্বচ্ছলতা ফিরিয়ে আনার জন্য দুলালের পরামর্শ অনুযায়ী দুলালের সাথেই সে শহরে পাড়ি জমাল।
এসব সাত বছর আগের কথা।
এই সাত বছরে সে অনেক জায়গায় কাজ করেছে। মাস শেষে খরচ বাদে যা বেঁচেছে তাই নিয়ে ছুটে গিয়েছে বউ বাচ্চার কাছে। নিজে শত দু:খ কষ্ট সয়েও একটু হাসি ফোটাতে চেষ্টা করেছে ওদের মুখে। ওদের একটু হাসিতে মজিদের শ্রম সার্থকতা পায়।
বছর দু’য়েক হল সে নতুন মালিকের কাজ করছে। মালিকের হাউজিংয়ের ব্যবসা আছে। সব সময়ই কাজ থাকে। বেকার থাকতে হয়না। বেতনও ভাল। অন্যান্য দিনের মত গত কাল সকালেও সঠিক সময়ে কাজ করতে গিয়েছিল মজিদ। বেড়িবাধের পাশে একটা বিল্ডিংয়ের কাজ চলছিল। কর্মস্থলে পৌছে সে একেবারে থ বনে গেল। চারদিকে খোজাখুজি করে কাউকে পেলনা। পাশের পাানের দোকানদার বারিক চাচার কাছে জানতে পারল আসল ব্যাপার। যেখানে বিল্ডিং তোলা হচ্ছে সে যায়গার মালিকানা নাকি সরকারের। মজিদের মালিকের নাকি বৈধ মালিকানা নাই। অবৈধভাবে গড়ে তোলা হচ্ছে বিল্ডিংটা। মজিদের মালিকের বেশীরভাগ জমির মালিকানা নাই। এমন কি যে বাড়ীতে বর্তমানে বাস করছে সেটারও একই অবস্থা। সরকার এসবের বিরুদ্ধে উচ্ছেদ অভিজান চালাচ্ছে। মালিকের নামে মামলা হয়েছে। মালিক সপরিবারে পালাতক।
এই প্রথম মালিকের উপর ক্রোধ চাপল মজিদের। সাত দিনের মজুরী বাঁকী আছে। যে মালিক কে গুরুজনের মত শ্রদ্ধা করত তার প্রতি তার মন তেঁতে উঠল।
কিছুক্ষন পর স্বাভাবিক হল মজিদ। সে ভাবল , যে মালিক তাকে এতদিন রোজগারের ব্যাবস্থা করেছে , মাত্র কিছু টাকার জন্য তার সম্পর্কে খারাপ ধারণা করা নিমকহারামী ছাড়া আর কিছু না। যে অপরের আস্তানা গড়েছে সে গা ঢাকা দেয়ার জন্য সপরিবারে কোথায় আস্তানা গেড়েছে কে জানে ? সুখের নীড় ছেড়ে হয়ত কোন এক মজিদের কুড়ে ঘরে আস্তানা গেড়েছে। মজিদ তার সমস্ত স্বত্তা দিয়ে মালিকের কষ্ট অনুভব করার চেষ্টা করল।
সপ্তাহ খানেক হল মজিদ বেকার বসে আছে। কাজটাজ তেমন একটা জোটাতে পারেনি। আর কাজ বলতে জানে শুধু রাজমিস্ত্রীর কাজ। অন্য কাজে তার মুন্সিয়ানা একদম শূন্য। অবশ্য কখনো অন্য কাজের চেষ্টাও করেনি।
সন্ধ্যায় কাজ থেকে ফিরে এসে দুলাল মজিদ কে একটা কাজের সন্ধান দিল। দুলাল জানত , মজিদ কে দিয়ে অন্য কাজের সম্ভাবনা খুব কম। তাকে অভয় দিয়ে বলল , “ কামডা রাজমিস্ত্রীর-ই। তবে গড়া না Ñ ভাঙ্গা। ” দেশজুড়ে অবৈধ স্থপনা উচ্ছেদের অভিযান চলছে। সরকারী নদী-নালা-খাল-বিল দখলদারদের হাত থেকে মুক্ত করা হচ্ছে। দখলমুক্ত করা হচ্ছে সরকারী জায়গা-জমি। সড়ক ও বাধের দু’পাশ থেকে সরিয়ে ফেলা হচ্ছে অবৈধস্থাপনা। এসব অবৈধ স্থপনা গুড়িয়ে দেয়ার জন্য তাদের প্রয়োজন যারা গড়তে জানে।
মজিদ বিদ্রোহের সুরে বলে , “আমার কাজ গড়া। আমি ভাংতে যাব ক্যা। নিজের হাতে যেটা গড়াইছি , তা ভাংবো ক্যাবা কইরা ? ”
দুলাল তিরস্কারের সুরে বলে , “ কাম করবু ,টাকা পাবু। ভাঙ্গাই কি আর গড়াই কি ?”
সত্যই তো। ভাঙ্গাই কি আর গড়াই কি ? যার পেটে ক্ষুধা , সব সময় যার মাথায় বাড়ীতে বউ-বাচ্চার জন্য টাকা পাঠানোর চিন্তা ঘুরপাক খায় তার অত ভাবলে কি চলে ? অগত্যা তাকে সে কাজই করতে হয়।
নতুন কাজে যোগ দেয় মজিদ। কয়েক সপ্তাহ আগে যে হাত গড়ার জন্য প্রশংসা কুড়ায়েছে আজ তা ভাঙ্গার জন্য প্রস্তুত। এখানেও হয়ত বাহবা কুড়াবে। মজিদ ভাবে হাত দু’টো যেন তার নিজের নয়। জন্মের পর থেকেই ওর হাত দু’টো অবৈধ ভাবে দখল করে নিয়েছে কোন এক অপশক্তি।

বেশ কয়েক দিন ভালই কাজ চলছিল। মজিদ গড়তে যেমন পারদর্শী , ভাঙ্গার ক্ষেত্রেও তেমনই পরিচয় পাওয়া গেল। দু’ চার দিনেই উচ্ছেদ অভিযান টিমের প্রধানের নজর কেড়েছিল সে।
আজ সকালে একটা ঘটনা ঘটে। বাধের দু’ পাশের কুড়ে ঘরগুলো ভাঙ্গার সময় একটা পরিবারের সবাই টিমের প্রধানের পায়ে আছড়ে পরে। অনেক কাকুতি মিনতী করে। টিমের প্রধান উপেক্ষা করে বলে , “ সরকারী হুকুম। ভাংতেই হবে। ”
মজিদ কে ভাঙ্গার নির্দেশ দেয়। এই প্রথম মজিদের ভিতর মায়ার জন্ম হয়। এর আগে আনন্দের সঙ্গে ভেঙ্গেছে। মনে কোন দূর্বলতা আসেনি। কুড়ে ঘরগুলো ভাঙ্গার সময় লোকগুলোর কাকুতি মিনতীর কথা বারবার মনে পড়ছিল। বিশেষ করে ঐ ছোট মেয়েটার কথা , যে বারবার পায়ের উপর আছড়ে পড়ে বলছিল , “আমাগরে ঘর ভেঙ্গে দিয়েন না সাব। ”
সন্ধ্যায় কাজ থেকে ফেরার পর বারবার বাড়ীর কথা মনে পড়ছে। ওর বাড়ীও তো বাধের উপর। ওরও তো একটা মেয়ে আছে। উচ্ছেদ অভিযানের টিম কি ওখানেও . . . . . .
আর কিছু ভাবতে পারেনা সে। মাথাটা ঝিমিয়ে আসে। দুলালের বাধা উপেক্ষা করে রতেই বাড়ীর উদ্দেশ্যে রওনা দেয়।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
তাপসকিরণ রায় সুন্দর একটি গল্প--ছোট কিন্তু পূর্ণাঙ্গ--ভাব ভাবনায় আলাদা।ধন্যবাদ জানাই লেখককে।
মিলন বনিক সুন্দর পরিশীলিত পরিমার্জিত একটি গল্প...খুব ভালো লাগলো...শুভ কামনা....
এশরার লতিফ গল্পের পরিমিতি নজর কাড়লো। ধন্যবাদ।
জাজাফী গল্পটা ভাল লাগলো সেই সাথে বৃন্দাবন দাসের কথা মনে পড়লো। ওনার নাটক গুলোতে এ ধরনের ডায়লগ থাকে। ক্যারে মজিদ! কামে যাবোনা?
রোদের ছায়া (select 198766*667891 from DUAL) খুব সাধারন মানুষের কিছু কষ্টের কথা , যা আমরা হয়তো দেখিনা অথবা না দেখার ভান করে থাকি , তাই নিয়ে আপনার গল্প । সত্যি ভালো লাগলো পড়ে । শুভকামনা থাকলো।
F.I. JEWEL N/A # গল্পের ধীমটা ভাল । একে প্রকাশের ধরনটাও বেশ । এভারে লিখতে লিখতেই লেখা আরো প্রানবন্ত হতে থাকবে । ধন্যবাদ ।।
মোঃ কবির হোসেন সালেহ সিরাজী ভাই আপনার গল্পটি অসাধারন, ঘটনাটি হৃদয় ছুয়ে গেল. ধন্যবাদ.
সুমন বর্ণীল কষ্টময় উপাখ্যান। ভাল লাগল
জাহাঙ্গীর অরুণ সাধারণদের কথা বলতে গেলে অসাধারণ লেখনী ক্ষমতা থাকতে হয়। আপনার তা আছে।

২৭ সেপ্টেম্বর - ২০১১ গল্প/কবিতা: ৮ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "পদত্যাগ”
কবিতার বিষয় "পদত্যাগ”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ জুন,২০২৫