তিস্তা নদীর পারে

স্বাধীনতা (মার্চ ২০১৩)

মোল্লা সালেহ
  • ১২৯
একে বেকে বেয়ে চলেছে ভরা যৌবনা তিস্তা নদী। তার তাণ্ডবলীলা থেকে আবাদি জমি রক্ষা করার জন্য নির্মাণ করা হয়েছে বিশ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য বাধ। এখন হেমন্ত কাল । প্রতি বছরের মত এবারও শীত খুব যেকে বসেছে। গভীর রাতে যখন সারা পৃথিবী নীরব হয়ে যায়, তখন তিস্তা তার বুকের পর্দা সরিয়ে ফেলে। ওর বুকটা হিম উদগীরন করে। যদিও শীতকাল এখনও আসেনি, তিস্তার পার জুরে এখন শীতকাল। তিস্তার নিঃশ্বাসে যেটুকু হিম থাকে সেটুকু সামাল দিতেই হিমশিম খেতে হয় তিস্তার প্রতিবেশীদের। যারা তিস্তার প্রতিবেশী তারা গৃহছাড়া, তারা অনাহারী, তারা ক্ষুধায় কাতর, শীতে বস্ত্রহীন।
তিস্তা বাধ। ওটাকে আর বাধ বলার উপায় নেই। বিশ কিলোমিটার বাধ জুরে প্রায় লক্ষাধিক লোকের বসবাস। যেন এক যুদ্ধ শিবির। সর্বত্র ক্ষুধা, ক্ষুধা আর ক্ষুধা। ক্ষুধার দৈত্যের সাথে যুদ্ধ করতে করতে সবাই ক্লান্ত। পুরো উত্তর বঙ্গ জুরে চলছে মাক্সগার অভিশাপ। তিস্তা বাধের লক্ষাধিক লোক এ বাইরে নয়। মাঙ্গা ওদের শিরদাঁড়া কে ভেঙ্গে দিয়েছে। দিনের পর দিন অনাহারে থেকে কঙ্কালসার দেহে বড় বড় দু’টি চোখ ফ্যাল ফ্যাল করে শূন্যের দিকে তাকিয়ে থাকে। চোখগুলো এখনও স্বপ্ন দেখে। এখনও স্বপ্নের জাল বুনে।
আর দশ জনের মত মজিদ মিয়ায় ঠাই গেড়েছে তিস্তার পাড়ে। সে ছেলেবেলা থেকেই একটু গোঁয়ারা ধরনের। ধর্মে ওর কোন কালেই বিশ্বাস ছিলনা । ধর্মের কর্মকাণ্ড পালন করা তো দূরের কথা। সেই মজিদ মিয়াও এবার রোযা রাখে। মাঙ্গার কবলে পড়ে গোঁয়ারা মজিদও ধর্মের প্রতি কেমন একটু দুর্বল হয়ে পড়েছে। রোযা না রাখলে খাবেই বা কি? ঘড়ে তো কিছুই নাই। এ অবস্থা শুধু ওর একার না, তিস্তা পারের সবারই একই অবস্থ। কয়েক প্যাকেট বিড়ি ছিল সম্বল। রোযা না রাখলে হয়ত ওটাই আয়েশ কওে টানা যেত। তাতে কি আর ক্ষুধার জ্বালা মেটে?
রমজানের প্রায় শেষ। ঈদের আমেজে ভাসছে গোটা দেশ। নানা রকম আয়োজন। নতুন নতুন জামা পরে সবাই ঈদের মাঠে যাবে। সুস্বাদু খাবার খাবে। কিন্তু এরা? এদের জীবন থেকে ঈদ শব্দটা উঠে গেছে। যেখানে দু’ মুঠ ভাতের আশা করা করাই দু:স্বপ্ন , সেখানে ঈদ শব্দটা এদের মাঝে উকি দিতে সাহস পায়না। মজিদ মিয়া নিজের কথা বা বউয়ের কথা ভাবেনা। তারা এ দু:স্বপ্ন কোন ভাবে মেনে নিয়েছে। কিন্তু সাত বছরের মেয়ে শিখার কথা মনে পড়লেই ওর মুখ ফ্যাকাসে হয়ে ওঠে। ঈদের দিন সেমাই গরুর গোশত না হলে কি চলে? একটা নতুন জামা তো ওর চাই-ই।
পড়ন্ত বিকেলে তিস্তার পাড়ে বসে এ কথাই ভাবছিল মজিদ মিয়া। একটা গাছের সাথে হেলান দিয়ে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তিস্তার পানির দিকে । সূর্যের শেষ আলোটুকু পড়ছে তিস্তার বুকে। পাখিরা হল­া করে নীড়ে ফিরছে। মজিদ মিয়ারও বাড়ী ফেরা প্রয়োজন। কিন্তু কোন মুখ নিয়ে বাড়ী ফিরবে সে। সারা দিন অনেক ঘোরাঘুরি করেছে সে। কিছুই যোগার করতে পারেনি। নিজের অজান্তেই ও নিজেকে ধিক্কার দেয়। প্রচণ্ড ঘৃণা জমে জীবনের প্রতি। যে বউ বাচ্চার মুখে ভাত তুলে দিতে পারেনা সে কা-পুরুষ ছাড়া আর কি?
পরেক্ষনেই শান্ত হয় সে। দু’ মুঠো ভাতের জন্য ক্ষুধার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে পরাজিত সৈনিক শুধু সে একা নয়। এ তিস্তা পাড়ে যারা আস্তানা গেড়েছে তারা সবাই ওর মত পরাজিত সৈনিক। ভিতরে একটু সুখ অনুভূত হয়। ও শুধু একা নয়। ওর মত আরো অনেকে আছে। ওরা কেউ-ই দুর্বল নয়। কাজ করার সামর্থ্য আছে। কিন্তু কাজ দিবে কে? ওর প্রচণ্ড ক্রোধ জমে। মাতব্বর, মেম্বর, চেয়ারম্যান এমন কি দেশের সরকারও ওর ক্রোধের আওতা হতে মুক্ত হতে পারেনা। মনে মনে খুব বিশ্রী ভাষায় গালি দেয় সেই সব চেহারাগুলোকে যেগুলোকে শুধু ভোটের আগে দেখা যায়। বাঁকী সময় তাদের কোন খোজ পাওয়া যায়না।
অনেক রাতে বাড়ী ফেরে মজিদ মিয়া। একটু একটু শীত পড়েছে। চারদিক নীরব। যে তিস্তার পার দিনের আলোতে কোলাহলে মুখর থাকে রাতের আধারে সে তিস্তার পাড় কে মৃত্যুপূরী মনে হয়। অনাহার আর পরিশ্রম এদের কে সন্ধ্যা নামার সাথে সাথেই ঘুমের রাজ্যে নিয়ে যায়।
ঘড়ের ভিতর টিনের বাতি জ্বেলে অপেক্ষা করছিল মর্জিনা বিবি। ছোট মাছের তরকারী রেঁধেছে। মজিদ মিয়া খুব খুশি হয়। ওর একটা বিশ্বাস ছিল। তার বউ চুপ করে বসে থাকবেনা। কিছু একটা জোগার করবেই। হাত মুখ ধুয়ে এসে পাতের গো-গ্রাসে সাবাড় করে সে। মাঝে শুধু একবার জিজ্ঞেস করে , চাল কোথায় পেলে? জরিনা বিবি ঝিমাতে ঝিমাতে উত্তর দিল , বিদেশী লোকেরা রিলিফ দিচ্ছিল। ময়নার মার সাথে আনতে গেছিলাম । সারা দিনের অনাহারী পেটকে কোনোমত ভরে নেয় সে। হাড়িতে দু’দিনের চাল আছে। একটু দু:চিন্তা মুক্ত হয় সে। পেট একটু ভার হতেই দু’ চোখে রাজ্যের ঘুম হানা দেয়। দু:সময়ের একটা দিনকে বিদায় জানিয়ে পরম তৃপ্তিতে ঘুমায় মজিদ মিয়া।
সকালে নদীর ঘাটে বসে দাঁত মাজতে ছিল মজিদ মিয়া। জরিনা বিবি ছাই দিয়ে মাজা কড়াই ধুতে ধুতে বলল , ঈদ তো এসে গেল। কিছু একটা ব্যবস্থা কর। শিখা তো কতরকম বায়না করছে। মুখের ভিতরের কুলির পানি নদীতে ফুকে দিয়ে মজিদ মিয়া বলল , বিকেলে মাতব্বরের কাছে যাব। দেখি কিছু টাকা পাওয়া যায় কিনা।
মজিদ মিয়া একরোখা মানুষ। রেগে গেলে ভয়ঙ্কর রূপ ধরে। এজন্য তাকে খুব পছন্দ করে মাতব্বর। দল করতে গেলে মাঝে মাঝে এরূপ লোকের দরকার হয়। মাতব্বর ওর চাহিদা পূরণ করে দেয় এবং ভবিষ্যতে সব ধরনের সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দেয়। বিনিময়ে একটা দাবী রাখে , সে যেন মাতব্বরের দলে থাকে এবং ডাকলে কাছে পায়।
ঈদ উৎসব শেষ হয়েছে। উপবাস ও সংযমের দিন শেষ হয়েছে। তিস্তা পাড়ের লোকদের উপবাসের শেষ কোথায়? তারা আজীবন সংযম করে করে নিজেকে সংশোধন করার জন্য। তারা কি তা পারে? সত্তরের ঘড়ে পা দিয়েও আক্কাস আলী লোভ সামলাতে পারেনা। রিলিফের কাতারে দুই বার দাড়ায়।
মাতব্বারের টাকায় কোন মত ঈদ পার করেছে মজিদ মিয়া। আবার হাহাকার। আবার অনাহার। আবার বুভুক্ষা। মজিদমিয়া ধন্না দেয় মাতব্বরের কাছে। জানতে চায় সরকারের কাছ থেকে কোন সাহায্য আসছে না কেন? মাতব্বর সাহেব মজিদ মিয়াকে আশ্বস্ত কওে বলে , “ মজিদ মিয়া একটু সবুর কর। আমাদের সরকার তোমাদের কথা মাথায় রেখেছেন। সার্ক না কি যেন একটা সম্মেলন চলছে। ওটা শেষ হতে দাও। আমাদের সরকার ঠিকই চলে আসবে। আমাদের দেশের মর্যাদা কত জান? অনেকগুলো দেশের প্রধানরা এখন আমাদের দেশে। তোমাদের জন্যই তো এত কিছু। ”
মাতব্বরের কথা শুনে মজিদ মিয়া আশ্বস্ত হয়।
শেষের দিকে মাতব্বর সাহেব তাকে সতর্ক করেদিয়ে বলে , “ শোন , তোমাকে একটা কথা বলি। ঐ যে আমজাদ আছে না_ হিড়িকের সময় রাজাকার ছিল। এখন নাকি মুক্তিযোদ্ধা। শুনলাম ও নাকি খুব খাটাখাটি করছে। ওদের নেতারা রিলিফ দিতে আসবে। খবরদার! ও ডাকলে যাবেনা। আমাদের সরকার একটা মহৎ কাজে ব্যস্ত আছে। ওরা এটাকে সুযোগ হিসেবে কাজে লাগাচ্ছে। সবাই কে এ কথা জানিয়ে দিবে। আর যদি কেউ যায় তাহলে কিন্তু .....
মজিদ মিয়ানগদ কিছু পায়না তবে একটা আশা নিয়ে ফেরে।
ঈদের সপ্তাহ খানেক পর। দিন যেন আর কোন ক্রমেই চলছে না। দু’ দিন হল অনাহারী মজিদ মিয়ার পরিবার। কাজ কাম কিছু নাই। মাতব্বরের কাছে ধরনা দিয়ে সান্ত্বনা ছাড়া আর কিছুই মেলে না। অনর্থক ঘোড়াঘুড়ি করে এক প্রহরের দিকে বাড়ী ফেরে মজিদ মিয়া। অনেক ডাকাডাকি করেও বাড়ীতে কাউকে পায়না। ক্রোধে সে অগ্নিমূর্তি ধারন করে। ক্ষুধা ওর ক্রোধে ইন্ধন যোগায়।
সমাবেশের নির্ধারিত স্থানে ময়নার মার সাথে বসে অপেক্ষা করছিল জরিনা বিবি। কখন সমাবেশ শেষ হবে কে জানে? মাইকের শব্দে কান ঝালাপালা হয়ে যাচ্ছে। “ উত্তর বঙ্গের লোকেরা ভাতে মরছে আর উনি সম্মেলনের নামে কোটি কোটি টাকা খরচ করছেন। এদের দিকে নজর দেবার সময় ওনার নাই। নিরাপত্তার নামে শহরে নীরব কার্ফ্যু চালাচ্ছে। এটাই প্রমান করে উনি ব্যর্থ সরকার। আপনারা সামনে এর জবাব দিবেন। ”
এ রকম আরও কত কথা ভেষে আসে। ওসব কথার কোন দরকার নেই জরিনা বিবির। ওর দরকার দু’ মুঠো চাল। সমাবেশ শেষে রিলিফ পেয়ে আর দেরী করে না। এক হাতে রিলিফের ব্যাগ অন্য হাতে শিখাকে ধরে ময়নার মা’র সাথে দ্র“ত রওনা হয়।
জরিনা বিবি বাড়ীর ভিতর ঢুকতেই মজিদ মিয়া রাগাšি^ত স্বরে ,চোখ দু’ টো বড় বড় করে জিজ্ঞেস করে , কোথায় গিয়েছিলি?
জরিনা বিবি বিজয়ের হাসি মুখে এনে বলে ,“ রিলিফ আনতে। এই দেখ চাল।”
মজিদ মিয়ার বোঝার বাঁকী থাকেনা। ক্রোধ ওকে অমানুষ করে তোলে। রিলিফের ব্যাগটা কেড়ে নিয়ে ছুড়ে ফেলে দেয়। চাল , ডাল , নুন মিশে একাকার হয়ে ছড়িয়ে যায় উঠানের উপর। গাছের ডালে বসে তখন কয়েকটা কাক প্রতীক্ষায় আছে একটা সুযোগের আশায়। হয়তো বা কাকাগুলোও অনেক দিন হল কিছু খায়নি।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
মোঃ কবির হোসেন গল্পটি হৃদয় ছুয়ে গেল অথবা মুগ্ধ হলাম. ধন্যবাদ.
তানি হক খুব সুন্দর করে লিখেছেন ..গল্পের ভেতরের আবেগে আবেগী হলাম ...তিস্তা পারের সুখ দুখ অনেক দিন মনে থাকবে ..খুব ভালো লাগলো ..নিয়মিত আমাদের লিখা উপহার দিবেন এই কামনা করছি ...ধন্যবাদ
তাপসকিরণ রায় গল্পটি ভালো লাগলো--কাহিনী ভাব ভাষার সুন্দর বুনন।লেখককে জানাই ধন্যবাদ।
রোদের ছায়া ক্ষুধার কাছে আসলে সব কিছুই পরাজিত গল্পের থিম হয়ত এটাই । সুন্দর করে তিস্তা পারের মানুষের ভিতরের কথা তুলে আনার জন্য শুভেচ্ছা । বানানে আরও জত্ন নেয়া দরকার । মাক্সগার=মঙ্গার ,ঘড়ে=ঘরে . গল্পে তিস্তা পাড়ের আঞ্চলিক সংলাপ থাকলে আরো ভালো হত...
এশরার লতিফ অসামান্য লাগলো এই তিস্তা পাড়ের বৃত্তান্ত। মনে হলো লেখক অনেক জেনে শুনেই লিখেছেন।
মিলন বনিক সংসারের টানা পরেনের সুন্দর সাবলীল গল্প...খুব ভালো লাগলো....শুভ কামনা....
নাইম ইসলাম তিস্তা পাড়ের মজিদ- জরিনার সংসারের অভাব-অনটনের গল্প। অনেক স্বাবলিল বর্ণনা করেছেন সালেহ ভাই ।
এফ, আই , জুয়েল # বর্ননা বেশ সাবলীল । একটি নদী ও এর অববাহিকার বিভিন্ন ঘটনার প্রকাশ ঘটিয়ে অনেক সুন্দর একটি গল্প ।
জালাল উদ্দিন মুহম্মদ অনেক পরিচ্ছন্ন কথার সাহিত্য । ভাল লাগলো খুব ।

২৭ সেপ্টেম্বর - ২০১১ গল্প/কবিতা: ৮ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "ছোটবেলা”
কবিতার বিষয় "ছোটবেলা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ ডিসেম্বর,২০২৪