গল্প বলি শোন
আমাদের সেই সময়ে খেলার একটা ছড়া কাটতাম
আটার রুটি কলের পানি রাত পোহালে টানাটানি
দেড় মনি বস্তা চেয়ারম্যানের নাস্তা “
শুধু খেলার ছড়াই,এর যে কোন অর্থ হয় তখন বুঝতাম না।
কারণ মা জননীদের কল্যাণে রাত পোহালে টানাটানি যেমন চোখে পড়তোনা, তেমনি চেয়ারম্যানের নাস্তার খোঁজখবর নেওয়ার সময় কোথায়। তবে লোকটা যে সারাদিন চেয়ারেই বসে থাকেন তাহাতে আমাদের কোন সন্দেহ ছিলনা।
সন্দেহ কোন কিছুতেই ছিলনা......
যখন দুপুরে ভাতের সাথে আলুর কুচি আর আটার গুটি মেশানো হত, কিংবা প্লেটে ছাতু নিয়ে তার মাঝখানে গর্ত করে লবণ আর পানি ঢালতাম তখনো ওই কথার মানে বুঝতাম না,শুধু মনটা খারাপ হত, জিবে উঠতে চাইতনা। উঠতে চাইবে কি, আমাদের গ্রামে একটা ফকির আসত আতিয়া থেকে (আতিয়া জামে মসজিদ),আমরা তাকে দেখলেই বলতাম “আতিয়ার পাগলা –ছাতু দিয়া মিঠাই দিয়া খামনা” তখন সে হাতের লাঠিয়ে উঁচিয়ে, আর আমরা দিতাম এক দৌড়, তো সেই সেই আতিয়ার
ফকিরই যখন ছাতু খেত না, তখন আমাদের জিহ্বার আর দোষ কোথায়?তবু খেতে হত, কারণ......রাত পোহালেই টানাটানি।
আজ আর সেই টানাটানির চিহ্ন কোথাও নেই। কোথাও নেই?
আছে, এই চোখটাতে, এই মনটাতে।
এই সমেয় আটার রুটি আর কলের পানি তার পরিবর্তন স্থান করেছে, চেয়ারম্যানের নাস্তারও পরিবর্তন হয়েছে।তার সেই দেড় মনি নাস্তার ওজনটাও আর দেড় মনে নেই।এখন তার ক্ষুধা মেটাতে দরকার জমি। তার ক্ষুধা মেটাতে দরকার নদী।
ও তোমাকে বলা হয়নি,আমাদের সেই টানাটানি চোখে না পরার কারণ, আমাদের ছিল নদী, আমাদের ছিল ফাকা মাঠ। যাও না , সারাদিন খেল, দৌড়াও,নদীতে ঝাঁপাও,টানাটানি আর চোখেও পড়বেনা। এখনো আমি সেই লৌহজং নদী দিয়ে বাড়ি যাই,নাকটা চেপে, যে নদী একদিন আমাকে অহর্নিশ ভুলিয়ে রাখত। চেয়ারম্যানদের ক্ষুধা তাকে আমার কাছে পর করে দিল।আমার স্মৃতি আমাকে আজ ক্ষুধিত করে।
চোখটা টাটায়, চেয়ারম্যানের ক্ষুধা বুকে ভয় ঢেলে দেয়। এক সময় তার ক্ষুধা মেটাতে আমাদের শুধু আটার রুটিতেই টান পড়ত,এখন মনে হয় এরা বিধাতার কাছ থেকে সমস্ত জমি ইজারা নিয়ে এসেছে, এক টুকরো মাটিও এরা খালি রাখবে না।
এদের ক্ষুধা মেটাতে এখন ইট, পাথরের বহুতল ভবন দরকার,আস্ত নদী না গিললে এদের উদর স্ফীত হয়না।
নাহ! তোমাকে শুধু দুঃখের কথাই বলছি, জানো তোমার মত আমার একজন বন্ধু ছিল,বসুন্ধরা, সে শুনত আমার কথা। আর একদিন তোমাকে তার কথা শোনাব, এবার তোমার গল্প বল।
আমার গল্প?আমার তো তোমার মতো বলার লেখার ভাষা নাই। তবে বুঝতে পার তো বুঝে নাও। আমার খুব সুন্দর একটা নাম আছ “বসুন্ধরা”,সুন্দর না নামটা! শুধু নাম নয়, আম দেখতেও খুব সুন্দর, শকুন্তলাও বলতে পার, ভালোবেসে (মুখটা লাল হল কি?), যদি দুষ্মন্ত হও। চোখ হারানো সবুজ, নদী, আকাশ, বাতাস, পাহাড়, যেন কারো “ভালোবাসার কবিতা”। বুঝতে পারছো তো তুমি আমার কথা? একটু ঝাপ্সা,তবু মনে পড়ছে, সেখানে কে তোমারই মত একটি ছেলে ছিল, তার একটি বোনও ছিল, প্রতিদিন তারা আকাশের তারা গুনত......
এক তারা, দুই তারা, তিন তারা, তারারা সাত ভাই....।
আমার মাটি দিয়ে তারা ভাত রান্না করত, তা খেয়ে তাদের পেটও ভরতো,তাদের হাসি মুখ দেখে আমি তা বুঝতে পারতাম।
তাহলে তো তোমার কোন দুঃখই ছিল না, তাই না? তাহলে?
না, আমার কোন দুঃখ ছিল না, তোমার মত টানাটানিও ছিল না, কিন্তু কিছু “ক্ষুধার্ত” ছিল আমার বুকে,তারা আমার বুকেই কুড়াল চালালো, সেই সবুজ, নদী, পাহাড়......... তুমি যদি দেখতে............ কি হিংস্রতা......... কি ক্ষুধা...... তাদের চোখে।
আমার ভাবতেই ঘৃণা হত ওরা আমারই অংশ থেকে তৈরি। অথচ ওদের কেউ কেউ আমার নাম দিয়েছিল “সর্বংসহা”।
দেখো আকাশটা কেমন কালো হয়ে আসছে? বাতাসটাও কেমন যেন ফুসলে উঠেছে মনে হচ্ছে?
হ্যাঁ, সেদিনও! সেদিনও আকাশ হয়েছিল ক্রোদ্ধ,বাতাস তার সমস্ত অস্তিত্বকে যেন করেছিল একত্রিত, সমস্ত নদী, সাগর, আর সেই ছেলেটি একসাথে করেছিল প্রার্থনা............
“হে প্রভু এই ক্ষুধার্ত দের উদরকে তুমি ভরিয়ে দাও”আর সেদিন আমার সেই “সর্বংসহা” হয়ে উঠে “সর্বনাশী”।