সরল রেখা

গ্রাম-বাংলা (নভেম্বর ২০১১)

ইয়াসির আরাফাত
  • ৮৩
  • 0
মরুভূমির বুকে যাযাবরের মত থেকে বালুর পর্বত সমতল করে পাহাড় কেটে পাওয়ার প্লান্ট , গ্যাস প্লান্ট , বিল্ডিং নির্মাণ করে সৌদি আরবের মরু অস্তিত্ব পদতলে মাড়িয়ে , কৃত্রিম রঙে সৌদি আরবকে সাজাতে সাজাতে অনেক টা ক্লান্ত হয়ে গেছি ।


মাঝে মাঝে বাংলাদেশের রূপ ভেসে উঠে চোখের পাতায়, পরিবারের মুখে হাসি মুক্ত হয়ে ঝড়ে মনের খাতায় ।তাই ধীরে ধীরে মরে যাচ্ছি মরা নদীর মত ।সবার সুখের কথা ভেবে ।সময়ের ব্যাবধানে কষ্টরা গলে যায় বরফের মত ।মান অপমান বোধ ঘামের সাথে মিশে যায় চোরাবালিতে । রক্ত মাংসের মানুষ রুপি আমরা প্রবাসীরা যেন এক একটি রোবট।


এভাবে হাটি হাটি পা পা করে কেটে যায় দুটি বছর । বাংলা মায়ের কোলে ফিরে যাবার সুযোগ হয় ৫৫ দিনের জন্য । সাধ্য মত কাছের দূরের অনেকের জন্য উপহার কিনলাম এক বিন্দু ভালবাসা পাবার আশায় । আমি ও সবুল নামের এক বন্ধু এক সাথে ছুটি তে গেলাম । সবুল গ্রামের ছেলে খুব গল্প বাজ । তার মুখে সব সময় গ্রাম বাংলার সরল সাধারন মানুষ , জীন ভূত , সাপ মারার গল্প শুনতাম ।


দেশে এসে উপহার দিয়ে কারো মন পেলাম না , নতুন করে জানলাম উপহারের মুল্য এখন দাঁড়িপাল্লা দিয়ে মাপা হয় । সকলের চাহিদা স্বর্ণ কে কেন্দ্র করে ঘুরছে পৃথিবীর মত ।


সবুলের আমন্ত্রনে পা বাড়ালাম তার গ্রামের দিকে কয়েক দিনের জন্য । বাস, রিক্সার পথ শেষে তিন কিলো পথ পাড়ি দিতে হবে আম্র কাননের ভীতর দিয়ে বা ধুলাউড়া মেঠো পথ দিয়ে যেতে হবে মাতা বৃক্ষের ঘাট । ঘাট পার হয়ে যেতে হবে শীতল মাঠ পায়তাল ছাড়া যাবার উপায় নেই । পায়ে হেটে ৪ কিলো দূর মেঠো পথ দিয়ে ২১ কিলো দূর হয় । জানিনা, হাঁটতে হাঁটতে আমার পায়ের স্প্রিং গুল ঠিক থাকবে নাকি খুলে যাবে ? তবু চলে যাচ্ছি একটি গ্রামে বেড়াতে, গ্রামের আহবান আমি শুনতে পাচ্ছি খুব স্পষ্ট ভাবেই । নিজের পোশাক ও কিছু উপহার নিয়ে আমার ব্যাগটি লাশের চেয়েও ভারী করে ফেলেছি । তবু ভীতরে অজানা এক সুখ কাজ করছে ।




বাস, রিক্সার পথ শেষে, একটি স্টলে এক কাপ চা পান করতে করতে এক জনকে বললাম -শীতল মাঠ কতদুর ?সে বলল “ ওই যে মাতা বৃক্ষের ঘাট , ঘাট পার হয়ে এক কদম হাঁটলেই শীতল মাঠ ।এমন ভাবে বলল যেন দুই মিনিটের পথ । সে আবার বলল “ কারঘে বাড়িতে যাবেন ?”

আমি বললাম “ হগু মেম্বারের বাড়ি ।”
সে বলল “ হাগু মেম্বার কেডা হয় আপ্নারঘে ?”

হাগু শব্দ টি শুনে আমার খারাপ লাগল । মানুষের নাম নিয়ে রসিকতা আমার ভাল লাগেনা । কি এমন ক্ষতি হয় মানুষের নাম সুন্দর করে বললে । পৃথিবীর সবচেয়ে খারাপ মানুষের নামটি ও সুন্দর করে বলা উচিৎ বলে আমি মনে করি ।

আমি উত্তর দেবার আগেই আরেক জন বলল “ তুই বেশী বকিস কেন বে ? জানিস না হাগুর ব্যাটা মদনা বিদেশ থ্যকা অ্যাসছে , হারঘে গাঁয়ের মুরগী গালাও যানেবে, শালা খালি আল কাপ গান , কবি গান , পালা গান শুইন্যা বেড়াবি র্যা ত চোরা বদমাইশ ”।

এক বিদ্ধ বলল “ তোরা চুপ বে অইদ্যা হ্যাগার কামলা আসছে বাবাজানের লাইগ্যা ।ওহ কালু মিয়া তোমার ঘে কুটুম আস্যছে গো , বাড়িতে আসর জমবে না কি গো কালু মিয়া আইজ রাতে ?”


কালু মিয়া এসে হাত মেলাল সবার সাথে । আসে পাশে অনেক মানুষ জমেছে আমাকে দেখার জন্য হয়তবা । এক পিচ্চি তার মায়ের আঁচল মুখে নিয়ে চাবাতে চাবাতে প্রসাব করছে । দেখে মায়া হল ব্যাগ থেকে চকলেটের প্যাকেট বের করতে গিয়ে করলাম না । কারন সব এখানেই শেষ হয়ে যাবে ।এই গ্রামের বধুরা যেন এক একটি বাচ্চা নেবার মেশিন একটি কোলে তো একটি পেটে । আল্লাহ খেতে দেবে এমন একটি ভুল ধারনা তাদের মস্তিককে বিকল করে রেখেছে ।তারা সহজ ভাষায় বলে আল্লাহ দিচ্ছে আমরা নিচ্ছি । কত মানুষ একটি বাচ্চার জন্য কাঙ্গাল হয়ে থাকে আল্লাহ দেইনা । জন্ম নিয়ন্ত্রণ মহাপাপ ।

দোকান থেকে চকলেটের একটা বয়োম নিয়ে বুড়োর হাতে দিয়ে বললাম - সব পিচ্চিদের দিয়ে দিন চাচা ।

দোকানদার টাকা নিলনা হগু মেম্বারের লোকদের সব টাকা হগু মেম্বার পরিশোধ করে দেয় । নিজেকে খুব ছোট মনে হল । মনে মনে ভাবছি সবুলের আব্বা মানে হগু মেম্বার কি মনে করবে আমি তার ৩০০ টাকার ১২ টা বাজিয়ে দিলাম । কালু মিয়া বলল “ ভাই বিরোধীরাও হগু মেম্বারের নামে ফ্রি খায় , গুজরে পয়সা দেইনা । পোলাপানদের চকলেট দিচ্ছেন শুইন্যা মেম্বারে খুশি হবে । আপনি মেম্বারের বাবার মত মানুষ জি ভাই । হারুন মেম্বারের কথা ভেবে আজো দশ গাঁ য়ের মানুষ কাঁদে । কেন যে আল্লাহ ভাল মানুষ গুল নিয়ে নেই ? থাক এ কথা ,গরুর গাড়িতে যাবেন নাকি ট্রলি তে যাবেন ? ”
আমি বললাম – পায়ে হেঁটে ।
কালু মিয়া বলল- “ না ভাইজান , মদনা হামার পিঠে তাল ফেলবে , কাঁচা আম ভাঙবে হামার মাথায় । ভাবছিনু বিদ্যাস থেকে আইস্যা মদনা ভাল হবে কিন্তু পোলাপানের মত হইয়া গ্যাছে । পোলাপানের লগে গুলি , দান্টা পতি ,কানামাছি , গোল্লা ছুট খেলছে , ম্যাইয়া মানসের সাথে বদ্দন খেলছে । ম্যানসে কি কইব , মেম্বারের ইজ্জত রাখবেনা মদনা । নিজেরঘে সারি সারি ডাব গাছ আছে তার পরেও ক্যাল্ক্যা পরের গাছের ডাব চুরি করে মদনা ।মেম্বার ওকে সাঠা নিয়ে বাজার বাজার তেরে নিয়ে বেরিয়েছে মারার জন্য । ”

আমি হাসিতে ফেটে পড়লাম ।অনেক দিন পর একটু নিষ্পাপ হাসি হাসলাম। পৃথিবীর সাথে তাল মেলাতে অনেক সময় পাপী হাসি হাসতে হয় আমাকে । আমার হাসির শব্দে গাছের পাতারাও পূব হাওয়ায় দুলে দুলে হাসতে লাগল । আমের মুকুলের মৌ মৌ গন্ধে প্রান ভোরে যাচ্ছে । ফুটকি পোকারা মাঝে মাঝে ছুঁয়ে যাচ্ছে আমাকে । আম গাছের ছায়ায় বেড়ে উঠেছে অনেক ওল গাছ । মানুষের পদতলে মৃতিকার অঙ্গ ক্ষয় হয়ে সাদা পথ হয়েছে । সেই পথে একটি ও দূর্বা ঘাস নেই ,যেন কেউ দূর্বাদের কানে কানে বলে দিয়েছে এটি পথ এখানে তোদের মাথা চাড়তে নেয় ।কালু মিয়ার সাধু ,চলিত , আঞ্চলিক মিশ্র ভাষা শুনতে মন্ধ লাগছেনা । দেখলাম, কোন কোন গাছে আম বেশ বড় বড় হয়েছে । হটাত থমকে দাঁড়ালাম লম্বা আকৃতির সিঁদুর মাখানো আম দেখে । বলেই ফেললাম কালুদা এটা কি আম গো ?

এটা লব্ধ সুন্দরী এখন খুব টক ,পাকলে মিষ্টি হয় , খাবেন , বলেই চিৎকার মারল – “ভুশ্যা কুণ্ঠে বে তুই ?”
ভুশ্যা –“ গরুর জন্য চারা কাটছি বে ক্যলা , কিছু কহবি নাকি ? ”
কালু-“ তোর গাছের দুটা আম পারতুন ......”
ভুশ্যা –“ শালা বোকা আম পাড়ার লাইগ্যা কোহতে হইবে বে ক্যলা ভূত ।”
দুটি আম পেড়ে নিল কালু , আমিও মদনার মত মদন হয়ে গেছি মনে হল ।
আম্র কাননের ভেজা মাটির পথ দিয়ে চলতে চলতে ৩৮ পদের অচেনা আমের সাথে পরিচিত হলাম ।সবুলদের বাগানের কয়েকটি কাঁচা মিঠা আম পেড়ে নিল আমার জন্য কালুদা । সবুলদের নার্সারি দেখলাম ৪৭৮ পদের ওষুধী গাছের সাথে পরিচিত হলাম । ত্রিফলার গাছ দেখলাম (হরতিকি ,বহেরা , অর্জুন )।নানা রকম দেশী বিদেশী আজব আজব গাছ দেখলাম । সুন্দরবনে এত পদের গাছ আছে বলে মনে হলনা । আমাদের দৃষ্টিতে অকেজো ঘাস ,বুনো লতা , কুকুর শুঙ্ঘা , কাক্রা , সইলতা , ডরপি , মোরগ টুপি , ইত্যাদি ছোট ছোট গাছ আছে । তাছাড়া ৫০০ জাতের ফুল গাছ দেখলাম ।এটি হারুন মেম্বারের স্বপ্নের নার্সারি ।হারুন মেম্বার গত হবার আগে বলে গেছে যে গ্রামে যত পদের গাছ বেশী থাকবে সে গ্রাম তত ধনী । গাছ তোমাদের দৃষ্টিতে কাজের হোক বা অকাজের হোক । গাছ আমাদের দেশের মাতা , গাছ আমাদের দেশের স্বর্ণালংকার ।


মাতা বৃক্ষের ঘাটে আস্তেই দেখি মদনা রঙ মেখে সং সেজে বসে আছে । বুকে বুক মিলিয়ে বললাম “ তুই সং সেজে আছিস কেন ?”
সবুল – “আর বলিস না লক্ষণা ডোমের মেয়ে পার্বতীর বিয়ে । ওরা ভালবেসে রঙ মাখিয়ে দিল তাই মেখে একটু নেচে নিলাম । ওরা ডোম হলেও মানুষরে । মানুষে মানুষে তফাৎ আমার ভাল লাগেনা । সাম্প্রদায়িকতার লেজ ধরে কেন যে আমরা পাগলা ঘোড়ার মত ছুঁটে বেড়ায় ?”



মহানন্দার তীরে মাতা বৃক্ষের ঘাটের সেই মাতা পাইকড়ের গাছ, হাজার শিকড়ের ছড়াছড়ি তাতে । নানা রকম চেনা অচেনা পাখি দেখে আমি মুগ্ধ। আমাকে গান শোনাতে তারা প্রান পনে চিৎকার করে যাচ্ছে বাদ্যযন্ত্র ছাড়া । চারিদিকে সবুজের সমারহ আসেপাশে কিছু মাটির ও খড় ও বেত দিয়ে বানানো ঘর দেখা যাচ্ছে । পাল তোলা নৌকা দেখে মনে হচ্ছে কোন এক বাঙ্গালী শিল্পীর রঙ তুলিতে আঁকা ছবি । একটি মাছ রাঙ্গা ছো মেরে মাছ ধরে নিল ।নদীর ওপারে সারি সারি বলাকা ও নাম না জানা নানা প্রজাতীর হাঁসেরা খেলা করছে । যেদিকে তাকায় শুধু অবাক হয়ে থমকে দাঁড়ায় কাকতাড়ুয়ার মত ।

৬/৭ বছরের একটি শিশুকে জাল দিয়ে মাছ মারতে দেখে আমি তার কাছে গেলাম । বেশ কিছু মাছ ও পেয়েছে । আমাকে দেখে জেলে শিশুটি বলল – “হামি বেশী মাছ পাইনি জি পুলিশ ভাই ওই শালারা কারেন্ট জাল দিয়ে সব মাছ মেরে নিচ্ছে । শালারাকে ধরেন না কেন ? খালি হামারাকে একটু মাছ মারতে দেখলে বকাবকি ...। এই নদী হামারঘে বাড়ি খেয়েছে, তার পরেও নদীকে হামরা ভালবাসি ,বেশী লই একটু মাছ ধরি । হার বাপ তো কাম করতে পারেনা ।

সবুল অর্থাৎ গ্রামে যার ডাকনাম মদনা এসে আমার পাশে দাঁড়াতেই ছেলেটি আমার নামে নালিশ করল ।
মদনা আমার সাথে ছেলেটির পরিচয় করিয়ে দিল ।

একটি নৌকাতে গিয়ে বসলাম নৌকাটি দুলে উঠল ঠিক যেমনটা ভ্রমরের ছোঁয়ায় ফুলেরা দোলে উঠে । মাঝি নৌকা চালাতে চালাতে গান ধরল –
মহানন্দার কান্ধায় কান্ধায় রে ,ও নানি যায় গরু চড়াইতে
ওই ছুড়িটা হাঁকে দেইখ্যা ভেংচি ক্যাইটা দিল নানি গে ।।
কলসি কাঁখে তাকায় হার দিকে ,ও নানি দুধে আলতা রঙ তার
তাকে দেইখ্যা বুকটা হামার তিরিং বিরিং করে না নি গে ।।

মদনা ধমক দিয়ে বলে –“ কি তিরিং বিরিং গান ধরেছিস বে , কালাইরুটির গান ধর, বন্ধুকে খুশি করতে না পারলে এক লাত্থি মেরে নদীতে ফেলে দিব । হামাকে হাল দে তুই নাছতে নাছতে গান কর । কালু চাছা বাজাও তোমার তবলা । ” কালু চাচা মুখ দিয়ে শুরু করল টু দুগ টু দুগদুগ । মাঝি ঝুমুর তালে নাচতে নাচতে গায়তে শুরু করল , সাথে মুক অভিনয় –
ওঠ স্যকালে
ও নানি দেখ কত ব্যালা উঠ্যাছে
কালাইরুটি বানাবি কখন তুই, খ্যাইয়া যাব কামেতে ।

নদী তীরে বানানো পাখির বাসা থেকে পাখিরা উঁকি মেরে শুনছে যেন তার গান । দখিনা বাতাস নৌকার পালে আঁটকে গান শুনতে শুনতে নৌকাটি টেনে নিয়ে যাচ্ছে ।কচুড়িপানারা ছুটে আসচ্ছে আমাদের নৌকার কাছে । অনেকে নদীতে গোসল করছে , গরু মহিষ গুল ,গোসল করাচ্ছে , কেউ কাপড় কাঁচাতে ব্যস্ত । নদীতে গোসল করতে আসা একটি শ্যমা কন্যাকে মদনা বলল – “ওহ তারা তোরঘে ছাগলের কয়টা বাচ্চা হয়্যাছে ?”
তারা – “৩ টা , জানিস হারগে ১২ টা মুরগীর বাচ্চা উঠ্যাছে ,হেবি সুন্দর ,দেখবি তো আয় ।”
মদনা – “ বাচ্চা গালার ল্যাইগা হামি খুদি লিয়া আসব ।বাচ্চা গালা বড় হলে বেশী লই দুটা ছুরি করব ?”

নদী তীরের সবাই হাসতে লাগল , আমি হাসতে হাসতে কালু দার সাথে হাত মেলালাম । সবাই মদনার কথা শুনে হাসল অতছ তার মুখে কোন লজ্জার ছায়া দেখলাম না । মনে হল সে যেন লজ্জার হাটে লজ্জাকে বিক্রি করেছে ।

পাট দিয়ে বানানো ঘর দেখে বললাম এই ঘর গুলতে কারা থাকে ?
কালু দা উত্তর দেই এগুল পানের বরজ । মদনার নামে তিনশ বিঘ্যা জমির পানের বরজ আছে । এই এলাকার সবচেয়ে বড় বরজ মদনার । মদনা লজ্জা পেয়ে কালুদা কে থামিয়ে দেয় । একটি বরজে ঢুকলাম আমরা ।কি ঠাণ্ডা ,সুন্দর করে লাইন করে লাগান পান গাছ । মনে হচ্ছে যেন পাতা বাহারের যাদু ঘরে প্রবেশ করেছি ।দুটি বাঁশ দিয়ে বানানো পায়ে চালিত টিউবওয়েল দেখলাম । এর পানি বরজে দেয়া হয় ।



মদনদের বাড়ি এসে অবাক হলাম । মাটির তিনতলা বাড়ি । কি সুন্দর আলপনা আঁকা মনে হচ্ছে যেন বিদেশী শিল্পী দিয়ে আঁকানো আলপনা । এমন ভুতুড়ে গ্রামের মানুষ আলপনার মুল্য বোঝে শহরের কোন বাবু বিশ্বাস করবে কি ?

ভীতরের আসবাব পত্র গুল মনে হচ্ছে যেন যাদুঘর থেকে চড়া দামে কেনা । দেয়ালের এক সাইডে হরিণের চামড়া রাখা আছে । উল দিয়ে নানান চিত্র আঁকা আছে বেতের চালুনিতে । আমাদের ফেলে দেয়া উপাদান গুল দিয়েই চারু কারু শিল্পের সমাহার । একটি হুকাও রয়েছে । জানালা দিয়ে চোখ গেল কলাবতী ফুল গাছের দিকে হালকা বাতাসে দোলে দোলে যেন আমায় হাতছানি দিয়ে ডাকছে । একটি কাঁচের বক্সে কাঁসা - পিতলের তৈরি গরুর গাড়ি , হরিণ , ফুল গাছ ইত্যাদি মুগ্ধ হয়ে দেখছি ।পঞ্চ কবির পাথরের ভাস্কজ্য দেখে আমি তো আকাশ থেকে পড়ছি ।দেয়ালের এক কর্নারে দেখলাম একটি নগ্ন শিশু পতাকা হাতে নিয়ে দৌড়াচ্ছে শিশুটির মা সবুজ আঁচল পেতে অধীর অপেক্ষায় আছে । মনে হচ্ছে জীবন্ত ,কিন্তু আসলে মাটির তৈরী ।

।সুবলের বোন দুরমিতা এসে বলল মুক্তি যুদ্ধের সময় আমার দাদাকে জেনু কুমার এটি উপহার দিয়ে বলেছিল আমি সপ্নে দেখেছি বাংলাদেশ স্বাধীন হবে ।দুঃখের বিষয় হল জেনু কুমারের দেখা হইনি স্বাধীন পতাকা দাদুকে বাঁচাতে গিয়ে দাদুর কোলে মাথা রেখে মারা গিয়েছিল মুক্তি যুদ্ধের সময় । আজ জেনু কুমার নেয় দাদু ও নেয় ।টেবিলের উপর রাখা কলের গান টি দেখিয়ে বলে এতে আর সুর উঠেনা । নষ্ট হয়ে গেছে তবু ফেলতে পারিনা । এই ঘরের প্রতিটি পুরনো আসবাব পত্রের উপর আমাদের খুব মায়া ।

আমি শুধু শুনে গেলাম । ভালবাসার কত রঙ গননা করে ও শেষ করতে পারলাম না । আমার মনে শুধু একটি প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে এদের এত টাকা জমি অতছ এরা গ্রামে কেন ? পুরনো ঐতিহ্য আঁকড়ে ধরে এরা কষ্ট পাচ্ছে কেন ? দুই বছর মদনের সাথে থাকলাম একটি বার ও তো সে বলেনি তাদের এত অর্থ সম্পদ । আদি যুগের রাজা মহারাজাদের মত প্রভাব রয়েছে তাদের । সে শুধু তার দুষ্টুমির গল্প শোনায় , আমাদের মাঝে সে বাচাল ও গল্পবাজ ।তার দাদু একজন মুক্তিযোদ্ধা তবু তো সে গর্ব করেনি । অতছ অনেকে মুক্তিযোদ্ধার নাম বেচে যাচ্ছে নিলজ্জের মত ।

আমাকে দেখার জন্য গ্রামের অনেক মানুষ এসেছে । মজার কথা হল কেউ এক কাপ চায়ের আশায় আসেনি ।এসেছে গ্রামের নতুন মানুষ টি দেখতে । গ্রামে নতুন বধু আসলে এভাবে এরা নাকি ভীর জমায় । পুজা দেখার মত নব বধুর রূপ দেখে আলোচনা সমালচনায় মেতে উঠে । তবে গ্রামের মানুষের কাছে রূপবতীর চেয়ে গুণবতী বধুর কদর বেশী ।

সুবলের বোন দুরমিতা একজন ডাক্তার । তার ছোঁয়ায় জীন ভূতের ব্যামো গ্রাম থেকে বিদায় নিয়েছে । গর্ভবতী মায়েদের মৃত্যুর হার অনেক কমেছে । তার ঘরে গিয়ে আমি অবাক হয়ে গেলাম । একপাশে একটি বুক সেলফ এ নানা রকম বই সংগ্রহ করে রেখেছে । চার শ্রেনীর বাদ্যযন্ত্র রয়েছে ১।তত ও বিতত (তানপুরা ও বেহালা )২। সুষির বাদ্য (বাঁশি , হারমোনিয়াম ) ৩। অবনন্ধ বাদ্য (তবলা ,খোল ) ৪। ঘন বাদ্য (ঝাঁঝ , করতাল )। দেয়ালে ঝুলানো রবি ,নজরুল , লালন , হুমায়ন আজাদ সহ অনেকের ছবি । শোলা কেটে কেটে বানানো একটি সুন্দর প্রাকৃতিক দৃশ্য নিচে লেখা দুরমিতা ।তার ঘরে নকশী কাঁথা ও সুচ সুতার কারুকাজ ও আমার দৃষ্টি এড়াইনি । তার আঁকা ছবি ও তার সংগ্রহীত ডাক টিকেট দেখলাম । খুব সাহস করে দুরমিতার মুখের দিকে তাকিয়ে বললাম আপনাদের গ্রামে এসে খুব ভাল লাগছে ।

সুবলের ছোট ভাই অক্সফোড ইউনিভারসিটিতে লেখা পড়া করছে । তার ঘরে তালা ঝুলছে ।
মেম্বার চাচার সাথে আলাপ করে জানা গেল সুবল লেখাপড়ায় অমনোযোগী ছিল কিন্তু কেউ যেন বলতে না পারে সুবল বাবার হোটেলে বসে খাই ও জীবনে লেখাপড়ার গুরুত্ব কত বোঝানোর জন্য বিদেশে পাঠানো হয় তাকে। লেখাপড়ায় অমনোযোগীতার ও পরীক্ষায় ফেল করার জন্য ওর নাম মদনা ।



ওরা আমার জন্য নানা রকম পিঠা পুলি , ফলমূলের ব্যবস্থা করেছে । পুকুর থেকে শাপলা , পদ্ম , রক্ত পদ্ম এনে চেনার উপায় শিখিয়েছে ।পানি সিঙ্গারা ও শালুক ফল পানিতে ডুব দিয়ে তুলে এনে দিয়েছে কালুদা।মাত্র দুই দিনে কালু দা আমাকে সাঁতার শিখিয়েছে । মদনা ও আমি মহিষের পিঠে চড়ে ঘুরে বেরিয়েছি । সাঁওতাল দের সাথে বোন বিড়াল মারতে, ইদুর ধরতে গিয়েছি । বেদেদের কাছে সাপ বেজীর লড়ায় দেখতে গিয়ে খুব ভয় পেয়েছিলাম । মদনার চুরি করে পাড়া তালের রস পান করেছি । চাঁদনিরাতে নৌবিহার করলাম ।চাঁদনিরাতে নৌবিহারের অনুভুতি বলে বোঝানোর নয় । লাল কোচ পাড়তে গিয়ে গুই সাপ দেখে ভয়ে চিৎকার দিয়েছি । মদনা হেসে কুটিকুটি হয়েছে । সে বলে গুই সাপ ভয় করলে দসলা , গহামা, ডাঁরাস দেখলে কি করবি তুই ? তার সাথে বাঁদরের মত বান্দ্রামু করতে মন্দ লাগছিলনা । কিন্তু আমাকে একটি জোঁক কামড়ে ধরে । জোঁক টি কে ছুটিয়ে ফেলে মদনা । সাপে কামড়ালে মানুষ যেমন ভয় পায় আমি ঠিক তেমন ভয় পেয়েছি । বাসায় গিয়ে মদনা দুরমিতাকে বলে বন্ধুকে সাপে কেটেছে । ওষুধ দিয়ে দে ডাক্তার । বলে সে হাসতে লাগে । খালাম্মা ওর কান ধরে বলে সাপে কেটেছে আর তুই হাসছিস । খালাম্মা চিৎকার দিয়ে বলে “কালু কই গেল্যা ভাই ,সুধন গুণী কে ডেকে নিয়ে আস ।” জোঁক কামড়েছে শুনে সবাই বলল ওকে নিয়ে কেন জঙ্গলের দিকে গেছিস কেন ? জঙ্গলে কত পোকা মাকড় থাকে তুই জানিস না ?
দুরমিতা ডেটলের মত কিছু একটা আমার পায়ে লাগিয়ে বলল জোঁক সামান্য রক্ত খেলে মানুষ মরেনা । এই জোঁকের চেয়ে দৌপেয় জোঁক বেশী ভয়ঙ্কর ।দুই দিনে চেহারাটা কত কাল করেছেন, আয়নায় মুখ টি দেখেছেন ?মদনার সাথে আর নয় আপনাকে আমি গ্রাম ঘুরে দেখাব ।
আমি চুরি করা করমচা দেই দুরমিতাকে ,সে হেসে বলে - করমচার দাম আব্বা লালু গোয়ালকে দিয়ে দিয়েছে । মদনা চুরি করে আর আব্বা দাম দেয় । আমাদের সব কিছু আছে তবু মদনা চুরি করে কি যে মজা পায় জানিনা । ভাইটি আমার মানুষ হলনা । মদনাকে গ্রামের মানুষ চোর নয় ভ্রমর মনে করে । সে যখন বিদেশে ছিল গ্রামের মানুষ বলত মদনা নেই বলে আমার গাছে ফুল ,ফল বেশী হয়না । আম্মার জন্য ও বেশী খারাপ হয়েছে ।৪/৫ দিন আগে আব্বা ওকে শাসন করতে গেলে আম্মা বলে ওর বয়স এখনো ১২ পেরোয়নি । কেন ওকে বকছ ? বড় হলে ভাল হয়ে যাবে ।ও আদ্যও বড় হবে কিনা জানিনা । ও এখনো আমাকে চিমটি কেটে চুল টেনে পালিয়ে যায় । ১০০ টাকা নেবার জন্য আমার পিছে ঘুর ঘুর করতে থাকে । আমার মাটির ব্যাংকে জমানো টাকা গুল ও চুরি করে । ডাক্তার ডাক্তার বলে বিরক্ত করে মারে ।

আমি বললাম – বিদেশ থেকে ও আপনার জন্য বেশী উপহার নিয়ে এসেছে ? দুরমিতাকে এটা ভাল লাগবে ওটা ভাল লাগবে । সবুজ রঙ দুরমিতার খুব প্রিয় । সে এটা খেতে ভালবাসে ওটা ভালবাসে ।আপনার কথা বলতে বলতে আমাদের পাগল করে দিত ।

দুরমিতা গর্বের সাথে বলে আমি দুটি ভায়ের একটি বোন । আমার কথা বলবে না তো কার কথা বলবে ।

দুরমিতার সাথে ,পুকুর পাড়ে বসে গল্প করতে করতে ছিপ দিয়ে মাছ ধরতে অনেক মজা হল ।তার সহকারীর মত তার সাথে রোগীদের বাসায় যেতে মন্দ লাগেনি ।তাঁতি পাড়ায় গিয়ে দেখলাম কিভাবে তারা সুন্দর করে সাড়ি লুঙ্গি বানাচ্ছে । কামার , কুমারদের কাজ করার পদ্ধতি দেখলাম । তেলি দের বাসায় গিয়ে ঘ্যান দিয়ে খাঁটি সরিষার তৈল কি ভাবে তৈরি করা হয় দেখলাম । চাক ভাঙ্গা খাঁটি মধু পান করলাম ।এক চুমুকে ৫ কিলো মধু পান করতে পারব বলতেই দুরমিতা খিল খিল করে হেসে উঠে কদম ফুলের মত । কিন্তু আমি চেষ্টা করেও বেশী পান করতে পারলাম না ।
বাইস্কপে ষড়ঋতুর রুপ বৈচিত্র দেখলাম । দারুন ছন্দে কিছুটা পুঁথির মত সুরে গাইছে –দেখ দেখ ,গ্রীষ্মের পরে বর্ষা এল গোসল ও করাতে ,খাল বিল নদী নালা পানিতে ভরেছে ।বর্ষা যখন চলে গেল শরতও আসিল্‌ ,ফুলের ও গন্ধে এ দেশ ভরিল । দেখ দেখো মজা দেখ হেমন্ত আসিল ,গোলা ভরা ধান পেয়ে কৃষক হাসিল । আনন্দে সকলে পিঠা, উৎসবে মাতিল , এরই মাঝে শীত বুড়ি এসে হাজির হল ।খেজুর রস আর দুধের পিঠা সকলে খেল । দেখতে দেখতে শীত বুড়ি চলিয়া গেল । মহামারি রূপ নিয়ে এল বসন্ত – দুরমিতার ভয়ে রোগ পালিয়া গেল ।কোকিলও ডাকিল কুহু কুকু সুরে ।ফুলে ফুলে প্রজাপতি মজা করে উড়ে । গ্রাম বাংলার, রুপের কথা , বলে শেষ হবার নয় , তবু আমার বাইস্কপ শেষ করতে হয় । এই গ্রামের মহা পুরুষ হারুন মেম্বার নাম । তাকে আমরা গ্রামের সবায় , জানায় সালাম । ভাল করে দেখে নাও সোনার পতাকা , এই পতাকা আমার ভায়ের রক্ত দিয়ে আঁকা । সবুজ শ্যমল একটি দেশ সোনার বাংলা নাম ।এই দেশেতে জন্ম নিয়ে ধন্য হলাম ।


দিন গুল খুব সহজে কেটে যাচ্ছে । সাধ্য থাকলে দিন গুলোর কোমরে দড়ি বেঁধে রাখতাম ।গ্রামের একটি পুরনো মন্দির দেখতে গেলাম দুরমিতার সাথে । ঠাকুরের মন্দির সংস্কারের নিবেদন এল । দুরমিতা বলল আমি আব্বাকে বলতে পারি তবে ,নিচু শ্রেণীর হিন্দুদের মন্দিরে প্রবেশ করতে দিতে হবে । আমাদের মসজি্দে দেখেন ধনী গরীব সবায় কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ইবাদত করে । ঠাকুর মাথা নিচু করে রইল । দুরমিতা আবার বলল কাজ শুরু করে দিন আমরা আপনার পাশে আছি । ঠাকুর বলল ভগবান তোমার মঙ্গল করুক মা ।



খুব সকালে ঘুম ভেঙ্গে গেল পাখিদের কলকাকলিতে । পাখিদের মত সুমধুর সুর ভেসে আসছে দুরমিতার কণ্ঠ থেকে ।

কুহুকুহু কুহুকুহু গায় কোয়েলিয়া
বনান্ত দখিনায় উঠে দুলিয়া
ফুলে ফুলে ফেরে অলি কি খেলা খেলিয়া ।।
বুঝিনা সে কার তরে , মন নাহি রয় ঘরে
শিমুল পলাশ হিয়া ওঠে চনচলিয়া ।।

আমি তার ঘরের দরোজার কাছে দাঁড়াতে সে থেমে যায় । আমি বললাম আপনি তো সুন্দর খেয়াল করেন । রাগ বাহারে ঠাট কাফি । সৈয়দ শামসুল হুদার কথায় ওস্তাদ মুনশী রইসউদ্দিনের সুর যেন মনে হচ্ছে আপনারই সুর । অসাধারন সুর আপনার কণ্ঠে ।
দুরমিতা বলল তবলা টি বাজান ?
আমি – আমি ত্রিতাল বাজাতে পারিনা তো ।
দুরমিতা – (+সম) ধা ধিন ধিন ধা ( ৩ তৃতীয়) না ধিন ধিন ধা (০ ফাঁক) না তিন তিন তা (১ প্রথমা) তেটে ধিন ধিন ধা এই ছন্দে বাজান ।
আমি বাজাতে শুরু করলাম । সে খেয়াল শুরু করছে সম থেকে, কিন্তু এটি শুরু হবে ফাঁক থেকে । সে কয়েক বার মিশ করছে শেষে আমি ধরে দিলাম কুহুকুহু কুহুকুহু গায় । কোয়েলিয়া থেকে সে শুরু করল ।
ণ ধ ণ প ম প জ্ঞ মা ণ ধ া ন র্স র’ ন র্স ণ ধ ন র্স ম প জ্ঞ মা জ্ঞ া জ্ঞ মা র র সা া স স ম ম ম প জ্ঞ ম ম ণ ধ ন র্স র’ ন র্স

দুজনে ডুয়েট গানের মত করে গায়ছি । শেষে আমি তাল ভুল করে দিয়েছি দুজনে হাসতে লাগলাম ।


দুরমিতার সাথে ফুল গাছ গুলোতে পানি দিতে গিয়ে লজ্জাবতী আমার হাতের ছোঁয়ায় মুখ লুকিয়ে নিল । দুরমিতার হাতের ছোঁয়াতেও লজ্জাবতী মুখ লুকিয়ে নিল । আমি মজা করে বললাম গাছ গুলকে একটু ওষুধ দিয়ে দিন তাহলে ওদের লজ্জা ভেঙ্গে যাবে । মুচকি হেসে দুরমিতা দূরে চলে গেল ।আমার সাথে আর কথা বলেনা দূর থেকে শুধু মুচকি মুচকি হাসে ।হয়তবা সে নিজেয় লজ্জাবতী লতা হয়ে গেছে ।



রাতে অনেকে কৌতুক অভিনয় করল । সুমন নামের একটি ছেলে প্রায় ২৫ টি পশু পাখির শব্দ শোনাল মুখ দিয়ে । আম , কাঁসা , পিতল , লাক্ষা , রেশম , কামার , কুমার , জেলে ,তাঁতি , মহানন্দা ,ব্রিজ , ইলামিত্রের শ্বশুর বাড়ি ,জমিদার বাড়ি , গৌড় নগরী , সোনা মসজিদ , তহাখানা , বাবু ড্যাং , ষাঁড় বুরুজ , ম্যাড়া ও কালায় রুটি , বড়ি , আঁচার , তিন প্রান ( মহানন্দা , পাগলা , পুনর্ভবা ) প্রতিবেশী দের প্রতি মমতা ইত্যাদি বিষয় তুলে ধরল গানে গানে । এখানে এসে জানা হল রনবী কাটুনিস্ট সহ অনেক চাঁপাই ববাবগঞ্জের কৃতি সন্তানদের নাম । ছোট্ট করে কবিগান , আলকাপগান ,মনসার অভিনয় করে দেখাল । সব শেষে এল গম্ভীরা গান ।
গম্ভীরা গান আমার খুব প্রিয় এটি আমাদের আঞ্চলিক গান । অনেকে নাটক মনে করে থাকে কিন্তু এটি একটি গান । নানা নাতি দুজনে হাসির ছলে কথার ছুড়ি বসিয়ে দেয় । (আমার মতে এই গান না বুঝলে তরমুজ মনে হবে )

এই গানে গুধ্যা নামের নাতি থাকে সে সবসময় উল্টা বুঝে আবার বিয়ে করার আশায় থাকে । বিয়ের অর্থ নাতি ঠিক মত বোঝেনা । আর নানা জ্ঞানী মানুষ যে বিষয়ের উপর গান হয় । নাতিকে বোঝানোর মাধ্যমে সকলকে বুঝিয়ে থাকে । আজ ওরা গান বেঁধেছে গ্রাম বাংলার রূপ লেখাপড়ার গুরুত্ব , বাল্য বিবাহ নিয়ে ।

নানা নাতিকে খুঁজে বেরাচ্ছে ।
গরু চড়াতে গিয়ে নাতি গল্প কবিতার বন্ধুদের সামনে দুঃখে গান ধরেছে –
হামার নানা নানিকে লিয়া, পড়ে গল্প কবিতা
ছিঁড়া কাঁথায় শুয়া থাকি হামি , দ্যাইনা হামার বিহা ।

নানা চুপি চুপি এসে নাটকীয় ভঙ্গিতে নাতিকে একটি লাঠির বাড়ি মেরে বলে – তুই এই নানারঘে সামনে হামার ঢোল পিটাচ্ছিস কেন ? তুই ৭ বসসরের ছোট্ট ছ্যলা বিহা করতে চাহছিস শুনলে নানা রা হাসবে বে ?
নাতি – তুমি খালি মিচ্ছা কথা কহ ক্যানে জি ? হামি সেদিন আম গাছে উথ্যা নানিকে কহিনু , নানি হামি বড় হইয়্যাছি জি ? নানি কহিলে হ্যাঁ বড় হয়েছিস গাছ থ্যাকা ন্যাইমা আয় ।
নানা – ( দর্শকদের উদ্দেশ্য করে ) দেখছেন জি নানারা , ফ এর পা কি ভাবে আটকালছে ফটকে শালা । ( নাতিকে উদ্দেশ্য করে ) তোর বিহা দিব , কহা কি কি কাজ করতে পারিস তুই ?
নাতি – হামি গল্প লেখতে পারি , কবিতা লেখতে পারি , গরু চড়াতে পারি ,এক কাপ চা খ্যাবার ল্যাইগা বদনা চিয়্যারম্যানের মিছিলে গিয়্যা পুলিশের কাছে লাথি খ্যাতে পারি , গান শুনিয়ে নানারাকে হাসাতে পারি ,গাছে উঠতে......
নানা – থাম থাম থাম থাম তোর কথার গাড়িতে একটু ব্রেক মার । একটা কবিতা নানারা কে শোনা । নানারা যদি কহে তোর কবিতা ভাল হয়েছে তাহলে তোর বিহা পাক্কা ।
নাতি – শোন গল্প কবিতার নানি নানা , এটা হামার বুড়া নানা ,নানা একলায় বিহ্যা করেছে হার বিহ্যা দিচ্ছেনা ।
নানা – থাম থাম থাম থাম তোর কবিতা শুইন্যা সব নানারা পালিয়্যা য্যইবে । ঐ দ্যাখ তোর সবুল নানার বন্ধু নতুন নানা হারঘে গাঁয়ে আইসাছে । দেশের বড় বড় ভাল মন্দ , রুই কাতলা নানারঘে সঙ্গে এ নানার পরিচয় আছে বে । বিহার কথা না শুনাইয়া যদি হারা যদি হারঘে গাঁয়ের সুন্দর রূপ , হিন্দু মুসলিম , পাড়া প্রতিবেশীরা কি ভাবে মিলে মিশে থাকি । ঝড়ে যদি পাড়ার কারো ঘর ভেঙ্গ্যা যায় । হামরা সভাই মিল্যা ঘর ঠিক কর্যা দি, কামার কুমার তাঁতিরা কি সুন্দর সুন্দর জিনিস বানায় , পাটের তৈরি শিকা দেখতে কত সুন্দর লাগে । হারঘে গাঁয়ের নার্সারিটার কথা কহতে হবে যেন অন্য নানারা , গাছ লাগাতে আগ্রহী হয় , হগু মেম্বার , দুরমিতা ,সুবল গাঁয়ের ছ্যালা পিলারঘে লেখা পড়া যেন ভাল হয় এ ল্যাইগা ইস্কুল , কলেগ করতে চাহছে , সাস্থ সেবা সহজ করার জন্য একটি হাসপাতাল বানাতে চাহছে । অথচ হারঘে শোরের বাচ্চা নানা রা ভোটে পাশ করেও গাঁয়ের জন্য কিছু করেনা । অইদ্যা দ্যাখ একটা শোরের বাচ্চা নানা ভুরি ফুলিয়া বস্যা আছে । গাঁয়ের রাস্তার বাজেটের সব টাকা খ্যায়া লিয়াছে । ব্রীজের ড্রইং ফ্রইং হইয়া গ্যাছে । কিন্তু কাজ শুরু করছে না ।

নাতি – তুমি শালা খ্যাপা হইয়া গ্যছ নানা ।অট্যা শোরের বাচ্চা নানা লই, কুদ্দুস চিয়ারম্যান মহা শোরের বাচ্চা কহ তাহলে তো বুঝব । জনগণের টাকা ম্যাইরা হাতির মত দেহ খান বানালছে । দাঁত গালা কত বড় কর্যাহইয়াছে কোদাল ছাড়া ওর দাঁত দিয়া মাটি কোপা য্যাবে । শালা কুদ্দুস নানা ,জোঁকের মত গাঁয়ের রক্ত চুস্যা খ্যাইছে । কুদ্দুস নানার তো ৬ টা বহু আছে । হাঁকে একটা দিতে কহনা ? ও নানা হার বিহা কখন দিবা কহনা ?
নানা – দিব ১৫ বছর পর নব্বানে দিব । সাড়া গাঁয়ের মানুষকে খাওয়াব । তোর সবুল নানাকে দ্যখত কত বড় হইয়াছে তাও বিহা করেনা । শুন ম্যাইইয়া দের ১৮ বছরের ও ব্যটা ছেলেদের ২৫ বছরের নিচে বিহা করা ঠিক লই । তোকে এখুন যদি বিহা দিতে যায় ,পুলিশে ধরার আগেই ,তোর হগু নানা সাঠা দিয়া গরম্যাবে বে হামরাকে।

নাতি – ওহ বুঝেছি ,ব্যাইচা থাকতে তুমি আর হগু নানা হার বিহা দিবানা , বিহাই আর করবনা । এক কাজ কর হাকে স্কুলে ভর্তি কইরা দাও হাবুলের মত বিদ্যাস যাব লেখাপড়া করতে ।বড় চাকুরী কইর্যা টাকা কাম্যাইয়া হগু মেম্বার কে লিয়া নদীতে বাঁধ দিব । যে ভাবে নদী ভাঙছে হারঘে গাঁ তো নদীর প্যাটে চল্যা জ্যাইবে ।তখন ভাত জুটবেনা । হার ছোট ছোট নানা নানিরা কে লেখা পড়া করতে কহ । চাকুরীর আশায় নয় । সুন্দর দেশ গড়ার প্রত্যায়ে ল্যাখা পড়া করতে কহ । হারঘে গাঁয়ের সব ছ্যলা যদি লেখাপড়া করে, কেহ কহতে পারবেনা – গেও ভূত গোবরে সুত , আমন ধানের ক্ষীর খাবিত টপকর্যাপ উঠ ।

নানা – গুধ্যাবে আইজ তুই হার কৈলজাটা ভরাইয়া দিলিবে । আয় ভাই হার বুকে আয় । তোর ভিতরের সুন্দর মানুষটাকে দেখতে পাইনিরে ভাই ।
নাতি – হামার বিহা দিল্যাইনা আদর করতে হবেনা । গান টা ধর তো । আইজ নানা নানি রা কে পাগল কইরা দিব ।
নানা নাতির গান – হে নানা গ্রাম বাংলার রুপের কথা বলেও তো শেষ হবেনা । ছয় টি ঋতুর লিলাখেলা বিশ্বের কোথাও পাবেনা । হে নানা দেশকে যত দেখি ,দেখেও তৃষ্ণা মেটেনা । হে নানা সুন্দর একটি দেশ গড়তে হলে লেখাপড়া ছাড়া হবেনা । হে নানা লেখা পড়ার গুনের কথা সব নানা কে বোঝাও না । বাংলাদেশের রুপের কথা সব নানাকে শোনাও না ।
নাতি- যারঘে ল্যাইগা হামরা আজ স্বাধীন । এই মাটি যারঘে দেওয়া উপহার ওরাকে একবার এক মিনিট দাঁড়িয়ে শ্রদ্ধা করতে কহ ?
নানা – সুন্দর কথা কহেছিস । ওরা কেউ মরেনি জেগে আছে হামারঘে অন্তরে । মুক্ত নদী , ফুল পাখি , পতাকা ওদের দান । দুঃখের কথা এই পতাকা নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে কিছু নানা নানি। দরকার হলে আবার যুদ্ধ করব ।কিন্ত , পতাকা মাটিতে মিশে যেতে দিবনা । ( দর্শকদের উদ্দেশ্য করে ) হামি কি ভুল কহিনু ।
নানা নাতির গান – হে নানা গ্রাম বাংলার রুপের কথা বলেও তো শেষ হবেনা । ছয় টি ঋতুর লিলাখেলা .........

বীণের সুরে নাচতে নাচতে নানা নানি মঞ্চ থেকে নেমে গেল ।



ওরা সবায় আমাকে এত আপন করে নিবে ভাবিনি কখনো আমার উপহার পেয়ে সবায় অনেক খুশি হল । আমি চলে আসার সময় ওদের ছলছল নয়ন আমার দৃষ্টি এড়িয়ে যায়নি ।
দুরমিতার কাছে বিদায় চাইতে সে বলে -থেকে যান একসাথে লজ্জাবতীর লজ্জা ভাঙ্গাব ।আমরা একসাথে রাগ , খেয়াল , ঠুমরী গায়ব সপ্ত সুরের সমুদ্রে অবগাহন করব । রাতে জোনাকি পোকা ধরে বেড়াব । সন্ধায় বাদুড় গনার খেলা খেলব ।শীতের রাতে খেজুরের রস পেড়ে পান করব । অনেক বড় একটি গরু , ছাগল , হাঁস , মুরগীর খামার বানাব । চারপাশে অনেক চেনা অচেনা গাছ লাগাব । পাখিদের অভয় আশ্রম হবে আমাদের খামার । পাখিদের গান শুনে আমার রোগীদের রোগ ভাল হয়ে যাবে ।খামারের পাশে একটি শিশু-বিদ্ধাশ্রম হবে । চাঁদনিরাতে ডিঙ্গি............।

আমি বললাম- আমার ও ইচ্ছে হয় কিন্তু , ভাঙ্গা কুলা ঘরে রাখতে নেই ।আপনার ও আমার অনেক তফাৎ আমার পরিবার, আমার উপর নির্ভরশীল । আমি ,দুই মাসের মুসাফির এসেছি পৃথিবীতে, আবার চলে যাব সেই মরু পথে । এই তো ভাল আছি, সরল রেখায় আমরা সবায় । বক্র রেখা টেনে কাউকে আমি হারাতে চাইনা ।
দুরমিতা কি যেন বলছিল শুননলাম না । মনকে সান্তনা দিলাম দুরমিতা সুবলের বোন , সুবল আমার বন্ধু , আমি যদি দুরমিতার আহবানে সাড়া দেই । পৃথিবীর কোন বন্ধু আর বন্ধুকে বিশ্বাস করতে পারবেনা । গ্রামের প্রাকৃতিক দৃশ্য উপভোগ থেকে বঞ্চিত হবে শহরে বন্ধু ।



( এটি চাঁপাই নবাবগঞ্জ শহর থেকে কিছু দূরের একটি গ্রামের গল্প । এই গল্পটিতে চাঁপাই নবাবগঞ্জ এর আঞ্চলিক ভাষা ব্যাবহার করা ও সংস্কৃতি তুলে ধরা হয়েছে । কোন শব্দের অর্থ বুস্তে সমস্যা হলে জানাবেন । এবার ও একটি ভাল গল্প লিখতে পারলাম না তবু আমি খুশি আমি আমার জেলাকে পরিচিত করালাম আপনাদের সাথে । আমি গল্প কবিতার বন্ধুদের কাছে ঋনি তারা আমাকে মন্তব্য করে বাতরা পাঠিয়ে ভাল লেখার কিছু টিপস দিয়েছে , লেখার ভুল গুল তুলে ধরেছে । গল্পটি ,গল্প কবিতার বন্ধুদের উৎসর্গ করলাম )
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
ইয়াসির আরাফাত আপনাদের সকলকে ধন্যবাদ কষ্ট করে গল্পটি পড়ার জন্য । মুকুল ভাই আপনার মন্তব্য টি জোস হয়েছে ।
মনির মুকুল চাঁপাই নবাবগঞ্জ এলাকার মানুষদের কাছে যদি জিজ্ঞেস করা হয়- আপনার বাড়ি কোথায়? সে বলবে- চাঁপাই। নবাবগঞ্জ আর বলে না হাঃ..হাঃ..। আরাফাত ভাই বিশ্বাস করবেন কিনা জানি না, এই এলাকার ভাষাটা শুনতে আমার খুবই ভালো লাগে। যদিও লিখিত রূপটায় সেই টান পাওয়া যায় না তারপরও নিজে নিজে সেই সুরটা খোঁজার চেষ্টা করেছি। আপনার লেখাতে গ্রামের অনেক কিছুই উঠে এসেছে। দারুণ লিখেছেন। অবসরে আরেকবার পড়ার ইচ্ছে আছে।
দুষ্ট মন খুব ভালো লেগেছে ! ভোট দিলাম .কিন্ত একে নাম্বার দিয়ে নয় ভালোবাসা দিয়ে পরিমাপ করলাম .
মাহবুব খান ভিসন ভালো গল্প ,খুব ভালো লাগলো অসাধারণ দ্দিলাম .
ইয়াসির আরাফাত সুর্য কিরণ -হাহাহা পরে বলব । এখানে পদ্ধতি প্রকাশ করলে আলোচনা সমালোচনার ঝড় বইতে পারে ।
ইয়াসির আরাফাত প্রজ্ঞা মৌসুমী -আপনার সুচিন্তিত মতামত খুব ভাল লাগল । দুর্বলতা গুলো বুঝতে পারলাম । আর এখানে যে মেম্বারের কথা বলা হয়েছে । সে কিন্তু জনভোটে নিবাচিত নয় ।জন্সাধারনের ভালবেসে দেওয়া উপাধি মাত্র । অনেক ভাল লাগল আপনার মন্তব্য ।
ইয়াসির আরাফাত হোসেন মোশাররফ -ভাই অনেক ধন্যবাদ ।
ইয়াসির আরাফাত tani hoqe-শুভ কামনা পেয়ে ধন্য হলাম । কিন্তু লেখার দুর্বল দিক গুলো তুলে ধরলে বেশী খুশি হতাম ।
হোসেন মোশাররফ সময় সাপেক্ষ লেখা.......
সুর্য কিরণ মৃত্যুর পরেও আপনি কিভাবে লিখে যেতে চান ঠিক বুঝলাম না ভাই! !!!

০৪ আগষ্ট - ২০১১ গল্প/কবিতা: ২৫ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "অভিমান”
কবিতার বিষয় "অভিমান”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ মার্চ,২০২৪