নিস্ফল সেতুবন্ধন

বন্ধু (জুলাই ২০১১)

Dr. Zayed Bin Zakir (Shawon)
  • ৫৮
  • 0
  • ৬১
“তোমার নাম কি?”
প্রশ্ন শুনে মাথা ঘুরিয়ে প্রশ্নকর্তাকে দেখল হাসপাতালের বিছানায় শায়িত অসুস্থ শিশুটি। চোখে কেমন যেন ভাবলেশহীন দৃষ্টি। চিন্তে পারছে না প্রশ্নকর্তাকে। চেনার কথাও না। আগে কখনোও দেখেনি তাকে। কতই বা বয়স? ৪ কি ৫ হবে। “আমার নাম ফাহিম খান”।
বাচ্চাটার মুখে নিজের নামটা শুনে চমকে গেল ফাহিম। আবার জিজ্ঞাসা করল “কি নাম বললে বাবু তোমার?”, যেন বিশ্বাসই হতে চাইছিল না।
“ফাহিম খান। কেন? তোমার নাম কি?”, পাল্টা প্রশ্ন করল তাকে।
“আমার নামও তো ফাহিম খান। তোমার আর আমার নাম একদম এক। কিভাবে হল বলতো বাবা? দারুন মজা তাই না?”
“হুম”, ক্লান্ত স্বরে বলল ছেলেটি। “আমাদের ক্লাসে আরো একটা ফাহিম আছে। তবে ওর নাম ফাহিম আরমান”।
“দারুন তো! অনেকগুলা ফাহিম হয়ে গেল, তাই না সোনা?”
রুগ্ন মুখে ক্লান্ত একটা হাসি ফুঁটিয়ে তুলল ছেলেটা।
“তোমার আব্বুর নাম কি বাবা?”
“আমার আব্বুর নাম আবিদুর রহমান”।
“আবিদুর রহমান”! নামটা শুনেই কেমন যেন একটু ধাক্কার মত খেল ফাহিম। প্রায় মুখ ফসকে বলতে যাচ্ছিল “তোমার আম্মুর নাম কি......”? তার আগেই প্রশ্ন করল বিছানায় শুয়ে থাকা ফাহিম, “আঙ্কেল তুমি কি জান যে আমার ক্যান্সার হয়েছে? কিন্তু ডাক্তার বলেছে আমি ভাল হয়ে যাব”।
“উম?” যেন শুনতেই পায় নি এমনভাবে বলল, “কি বললে বাবু?”
“ডাক্তার বলেছে আমি ভাল হয়ে যাব”।
“তোমার কিছুই হয় নাই তো। তুমি তো ভালই আছ”, কোনমতে বলে উঠল ফাহিম। বাচ্চাটার মুখের দিকে তাকিয়ে ভাল করে খুঁজল কি যেন। না আর কোন সন্দেহ নাই। নিজের ভেতরটা কেমন যেন গুমরে উঠল তার। মন চাইছে একছুটে বের হয়ে যায় এই হাসপাতাল থেকে। চোখের কোনায় পানি জমে উঠল। বাচ্চাটা যেন দেখতে না পারে এমন ভঙ্গি করে মুছে ফেলল সে।

আজকে অফিস থেকে বের হবার ঠিক আগ মুহুর্তে শর্মি ফোন করে। গলায় উদ্বেগ, “তোমার রক্তের গ্রুপ কি বলত? AB -VE না?”
“হ্যাঁ। কেন?”
“মাত্র টিভিতে দেখলাম একটা বাচ্চার রক্ত লাগবে। খুব জরুরী। তুমি প্ল্রিজ যাও না রক্ত দিয়ে এস। বাচ্চাটার ক্যান্সার হয়েছে শুনে মন খারাপ হয়ে গেল। সুমন-রুমনের জন্মের সময়ের কথা এখন মনে পড়ে আমার। রক্তের জন্য কি হাহাকার...”
“থাক না ওসব কথা এখন। তুমি আমাকে ঠিকানা বল। আমি এখনি যাচ্ছি”। ঠিকানা কাগজে লিখে নিয়েই সোজা হাসপাতালে হাজির হয় ফাহিম। কিন্তু ভাগ্যের এ কেমন পরিহাস? যে পরিস্থিতিতে কখনোই আর পড়তে চায়নি আজকে ঠিক তেমন অবস্থার শিকার হতে হল। পুরানো কথা মনে পড়ছে সব যদিও কিছুই মনে করতে চায় না।

“তোমার আব্বু আম্মু কোথায় বাবু? কাউকে যে দেখছি না”?
“আম্মু তো একটু আগেই ছিল এখানে। তুমি আসার একটু আগেই যে কই গেল! আর আব্বু গেছে বাসায় কি যেন আনতে। দাদীও আছে। তুমি কি আমাকে রক্ত দিলে আঙ্কেল? আমাকে না কয়েকদিন পরপর রক্ত দিতে হয়। আমার অনেক কষ্ট হয়”।
এবার চোখের পানি আটকাতে অনেক কসরত করতে হল ফাহিমের। কথা তাড়াতাড়ি ঘুরানোর জন্য বলল, “তোমার দাদী কোথায়?”
“জানি না। দাদীও তো ছিল এখানেই”। বলেই একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল বাচ্চাটা। “ঐ তো দাদী”। আঙ্গুল উঁচিয়ে দেখাল দরজার দিকে।

মনেপ্রানে চাইলো ফাহিম যেন ওর দাদী ওকে চিনতে না পারে। না পারারই কথা। ক’বার ই বা দেখেছেন। ভদ্রমহিলার মুখে গ্লানির ছাপ স্পষ্ট। বোঝাই যাচ্ছে নাতিকে নিয়ে অনেক মানসিক কষ্টে আছেন। ফাহিমের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, “আপনাকে মনে হয় কোথায় দেখেছি? আপনিই রক্ত দিয়েছেন তাই না?”
“জ্বী। দেখে থাকবেন হয়ত”। এড়িয়ে যেতে চাইল ফাহিম। “আমি এখন উঠি” বলেই বিছানা থেকে উঠে দাঁড়ালো। বাচ্চাটার মাথায় হাত বুলায়ে দিল।
“সে কি? একটু বিশ্রাম করলেন না? কিছু খেলেন ও না। আপনাকে এভাবে যেতে দিব না”।
“না না। আমার কিছুই লাগবে না। জরুরী কাজ আছে আমার। এখনি উঠতে হবে। পরে না হয় আবার সময় করে এসে ওকে দেখে যাব”, বলেই উঠে পড়ল।

দরজার কাছে যেতে না যেতেই বাচ্চাটার বাবা হাতে একটা ব্যাগ নিয়ে ঘরে ঢুকল। যে পরিস্থিতিতে ফাহিম পড়তে চায়নি ঠিক তাই হয়ে গেল। ওর দিকে নজর পড়তেই আবিদুর রহমানের মুখ হা হয়ে গেল। কিছু বলাও মনে হয় যেন ভুলে গেল। ভীষণ অস্বস্তিকর একটা পরিবেশ তৈরি হল। আবিদের দিকে তাকিয়ে মুচকি একটু হাসি দিয়ে পর্দা সরিয়ে কেবিনের বাইরে বের হয়ে এল ফাহিম।

করিডোর দিয়ে দ্রুত হেঁটে সরে যেতে চাইল। দম মনে হয় বন্ধ হয়ে আসছে। মাথাটাও কেমন যেন একটু ঘুরছে। আগে অনেকবারই রক্ত দিয়েছে। এমন হয়নি। কিন্তু এবারই কেমন যেন সব ওলট পালট লাগছে। রক্ত দেবার আগ মুহুর্তে শর্মি ফোন করে জানায় ও গাড়ি নিয়ে হাসপাতালে আসছে। ফাহিম কে নিয়ে যাবে। এতক্ষণে তো চলে আসার কথা। এখনও আসছে না কেন? অস্থির লাগতে থাকে ফাহিমের। এমন সময় মোবাইল বেজে ওঠে। শর্মির ফোন। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে ফাহিম। “কোথায় তুমি?”
“পার্কিং লটে চলে আস”। শর্মির উত্তর দিল ওপাশ থেকে।
দ্রুত সিঁড়ি দিয়ে নামতে থাকে ফাহিম। পেছন থেকে পরিচিত একটা কন্ঠ ডাক দেয়, “ফাহিম, দাঁড়া। প্লিজ একটু দাঁড়া”।

পেছন ফিরে তাকায় ফাহিম। দেখে আবিদ ডাকছে তাকে। আবার দ্রুত নেমে যায়। নীচতলা দিয়ে নেমে দ্রুত কাঁচের দরজা ঠেলে বের হয়ে আসে। গেটের বাইরে বের হতে দেখে শর্মি ড্রাইভিং সিটে বসা। পিছনে সুমন রুমন। মা কে গাড়ি ড্রাইভ করতে দেখতে খুব পছন্দ করে ওরা। নিজের ছেলেদের দিকে তাকিয়ে দেখে। আবিদের বাচ্চার থেকে বছর দুই বড়ই হবে ওরা। দ্রুত গিয়ে শর্মির পাশে গিয়ে বসে। “কি হয়েছে? খারাপ লাগছে নাকি?” ফাহিমের মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে শর্মি।
“একটু মাথা ঘুরছে। বাসায় চল”। গাড়ির জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে উত্তর দেয় ফাহিম। হাসপাতালের গেটে তাকাল না। জানে ওখানে দাঁড়িয়ে আছে আবিদ। হয়ত নিতুও আছে সাথে। কে জানে? আর দেখা না হোক। কি দরকার আছে?
“উনারা কারা বলত?” গাড়ি ঘুরাতে ঘুরাতে বলল শর্মি।
“কাদের কথা বলছ?”
“ওই যে তোমার পেছনে পেছনে এল এক লোক আর এক মহিলা”।
“কি জানি; দেখিনি আমি। জানি না। বাসা না, একটু সাভারের দিকে চল তো। ঘুরে আসি। দম কেমন বন্ধ বন্ধ লাগছে”।
“তোমার কি হয়েছে বলত? বেশী খারাপ লাগছে নাকি?”
“না না। চল একটু ঘুরে আসি। ভাল লাগবে”। বলে পেছনের সিটের দিকে তাকিয়ে দুই ছেলেকে দেখল। সুমন গেমস খেলায় ব্যস্ত আর রুমন পেন্সিল দিয়ে খাতায় কি যেন আঁকছে। বাবার দিকে তাকালে দেখতে পেত যে চশমার আঁড়ালে বাবার চোখে ছলছল করছে।
............
এক মাস পরে, অফিসের পিওন এসে একটা খাম দিয়ে যায় ফাহিমকে তার রুমে। খামের উপরে কোন নাম না থাকায় বুঝতে পারে নি কে লিখেছে। খামটা খুলে চিঠিটা পড়তে শুরু করে-

ফাহিম,

লিখে হয়ত নতুন করে তোকে আবার কষ্ট দিলাম, কিন্তু না লিখেও যে পারলাম না। তোর সাথে যে অন্যায় করেছি আমি আর নিতু তার পরিণতি আমাদের জানা ছিল না। কিন্তু সারাজীবন হয়ত সেই অপরাধের খেসারত দিয়ে যেতে হবে। কিছুই করার নেই ভাগ্যকে মেনে নেয়া ছাড়া। ফাহিমের আগেও আমাদের একটা ছেলে এরপর একটা মেয়ে হয়। কিন্তু কেউ বেঁচে নেই। ছেলেটা এক বছর বেঁচে ছিল আর মেয়েটা জন্মের পরপরই মারা যায়। ডাক্তাররা এর কোন কারণ বলতে পারে নি। এখন বুঝতে পারি হয়ত তোকে দেয়া কষ্টটাই অভিশাপ হয়ে আমাদের কাছে আসছে আমাদের প্রায়শ্চিত্ত নেবার জন্য। সেদিন হাসপাতালে রক্ত দেয়ার সময়ই নিতু তোকে দেখে ফেলে, কিন্তু তোর সামনে আসতে পারেনি। আমি তোর পিছন পিছন গেলাম কিন্তু তুই আমার কথা শুনলি না। তোর উপকার এর কোন মুল্য আমরা দিতে অক্ষম। তোকে ধন্যবাদটা দেবার অধিকারও আজ নেই আমাদের কাছে। আমরা কেউ ‘খান’ না। কিন্তু তার পরেও ছেলের নাম কেন ‘ফাহিম খান’ রাখলাম সেই প্রশ্ন অনেকে অসংখ্য বার করলেও উত্তর পায় নি কেউ। তোর সাথে শেষবার যখন কথা হয়, তখন তুই বলেছিলি যে, যদি ছেলে হয় যেন তোর নামে নাম রাখি। তোর মনে আছে কি? কত কষ্ট নিয়ে বলেছিলি তুই কথাগুলো। তোর বন্ধুত্বের মুল্যায়ন করতে পারি নাই, আজো পারবো না। হয়ত তোর সামনে আর কোনদিন আর আসতেও পারব না। যদি পারিস তো ক্ষমা করে দিস।
এক সপ্তাহ আগে আমার শেষ সম্বলটুকুও আমাদের ছেড়ে চলে গেছে। ওকে সবসময় বলতাম ও ভাল হয়ে যাবে। অনেক চেষ্টা করেও কিছু করা গেল না। যাবার আগে তোর শরীরের রক্ত নিয়ে গেল কিছুটা। হয়ত একটা নিস্ফল সেতুবন্ধন হল। তোর কাছে শেষ সম্বলটুকু দিয়েও বাঁধা পড়ে থাকলাম।

আবিদ
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
Dr. Zayed Bin Zakir (Shawon) @সূর্য : ধন্যবাদ আপনাকে. আগামী সংখ্যাতেও একটা গল্প থাকছে. আশাকরি ভালো লাগবে.
সূর্য গল্পের ক্ষেত্রেই তুমি বেশ সফল দেখলাম। গল্প মন ছুয়েছে। আমাদের এমন কিছু গল্প আগামীতেও পড়ার সুযোগ করে দিবে। আহবান রইল।
Dr. Zayed Bin Zakir (Shawon) @নিরব: আপনার কথা গুলা কাকে বললেন বুঝলাম না!
Dr. Zayed Bin Zakir (Shawon) @Tahajul Islam ফায়সাল: ধন্যবাদ. ছোট গল্পে সব কি বলা যায়?
নিরব নিশাচর ................কারো লেখা পরে আনন্দ পেলে দেই ধন্যবাদ আর কষ্ট পেলে দেই ভোট... আপনি কি দিয়েছেন, আপনি নিশ্চয় জানেন... দুঃখিত, ধন্যবাদ দিতে পারলাম না... !!!
Tahajul Islam Faisal আবিদের সাথে সম্পর্কের ফাটল ও দুরুত্বের কারণ স্পষ্ট করলে ভালো hoto
Dr. Zayed Bin Zakir (Shawon) @Tahajul Islam Faisal : ধন্যবাদ ভাই! একটু আইডিয়া দিন তো ভাই কিভাবে কষ্টের মাত্রাটা একটু বাড়ানো যেত? তাহলে না হয় পরে কোনো গল্পে দিয়ে দেব.
Tahajul Islam Faisal গল্পটা ভালো লাগলো/ গল্পে কষ্টের বিসয়টা একটু বেসি থাকলে মনে হয় ভালো হত/ শব্দের প্রয়োগ দারুন/
Dr. Zayed Bin Zakir (Shawon) @Akther Hossain (আকাশ): অনেক ধন্যবাদ আপনাকে
Akther Hossain (আকাশ) পরিপূর্ণ একটা সুন্ধর choto গল্প ! অনেক ভালো লাগলো !

০১ ফেব্রুয়ারী - ২০১১ গল্প/কবিতা: ৭৪ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "স্থিতিশীলতা”
কবিতার বিষয় "স্থিতিশীলতা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪