মিতু একটু পর পর টিস্যু দিয়ে ঘাম মুছসে। এসি রুমের মধ্যে বসেও সে প্রচন্ড ঘামছে। এর মধ্যেই অনিন্দ্য এসে তার বিখ্যাত গা জ্বালানো হাসি দিয়ে অতিষ্ট করে দিচ্ছে। ওরা সবাই মেডিকেল প্রথম বর্ষের ছাত্র। আজকে ওদের অ্যানাটমি ক্লাস নিবেন স্বয়ং ম্যানেজিং ডিরেক্টর ডাঃ আফজাল মাহমুদ স্যার। ছাত্র ছাত্রীদের সবার মধ্যেই তাই একটা মিশ্র প্রতিক্রিয়া কাজ করছে। পারতপক্ষে কেউ আফজাল স্যারের ছায়াও মাড়াতে চায় না। মাসুদ রানা সিরিজের মেজর রাহাতের সাক্ষাত রূপটাই হলো আফজাল স্যার। ঠান্ডা দৃষ্টিতে জরিপ করেন আর মনে হয় যেন মনের ভেতরের সবটুকু এক নিমিশেই পড়ে ফেলছেন। এইতো সেদিন তুষার কে ডেকে নিয়ে বললেন, ‘গাঁজার দরদাম এখন কেমন? খালি কি গাজাতেই হয় নাকি ইয়াবাও লাগে? পকেটে ইয়াবা থাকলে আমাকে একটা দিয়ে যাও’। এই বলে টানা দুই মিনিট তুষারের দিকে তাকিয়ে রইলেন। এরপর হাতের ইশারায় বললেন চলে যেতে।
‘মিতু আজকে স্যারকে বলবো, তোরে দিয়ে কাটাকুটি খেলা শুরু করতে’... অনিন্দ্য আবার শুরু করেছিল, শাম্মি’র অগ্নিদৃষ্টির সামনে ওকে চুপ হয়ে যেতে হল। সবাই হলরুমে অপেক্ষা করছে। স্যারের আসতে দেরি হচ্ছে। স্যার আগে নাকি লেকচার দেবেন, এরপর শুরু হবে ডিসেকসন। তুষার বসেছে একদম পিছনে। মনে মনে প্রমাদ গুনছে। আজকে আবার কি শুনতে হয় কে জানে!
প্রায় পনেরো মিনিট পরে আফজাল স্যার এলেন। সবাই নিঃশব্দে উঠে দাঁড়ালো। নিঃশ্বাস ফেলতেও মনে হয় সবাই ভুলে গেছে। স্যার সবাইকে গমগমে কন্ঠে বললেন ‘বস, সবাই’। নিজেও বসলেন। প্রজেক্টর অন করা, শুধু নীল স্ক্রীন দেখা যাচ্ছে। সাপোর্টিং স্টাফ তারিক ল্যাপটপ ঠিক করতে গেলে স্যার হাতের ইশারায় তাকে চলে যেতে বললেন। অনিন্দ্যই শুধু হাসিমুখে তাকিয়ে রইলো যেন এখনি কোন হরর মুভি শুরু হবে।
আবার শুরু হল সেই ভয়ঙ্কর নীরবতা যা কোন ছাত্রের পিলে চমকানোর জন্য যথেষ্ট। শ্রুতির ধারণা, অনিন্দ্যর ভ্যাক্সিন নেয়া আছে। তাই আফজাল স্যারের
কোন কথা ওর উপর প্রভাব ফেলে না। অনিন্দ্য কিছু বললে স্যার হ্যাঁ হু করে পার হয়ে যায়।
বাজ পড়লেও মনে হয় ওরা এত অবাক হত না, স্যার এখন যা বললেন তা শুনে। ‘আমি আজকে তোমাদের একটা গল্প বলবো। আমার নিজের জীবনের গল্প। তোমারা মন দিয়ে শুনবে। এরপর আমি যদি কাউকে কিছু জিজ্ঞাসা করি, উত্তর দিতে হবে’। বলেই ঠান্ডা চোখে ছাত্রদের চোখের দিকে তাকালেন’।
‘আজকে কি অ্যানাটমি ক্লাস হবে না স্যার’, ফস করে বলে বসলো ক্লাসের ক্যাবলাকান্ত মুরাদ।
‘ইয়ং ম্যান- Time will say’, ঠান্ডা জবাব আসে স্যারের। মিতু দুই হাত জড় করে বিড়বিড় করে কি যেন বলতে থাকে। মনে হয় দোয়া দুরুদ কিছু পড়ছে। ‘তোরে ডাক্তার হইতে বলসে কে?’ চাপা গলায় মিতুর উদ্দেশ্যে হুঙ্কার দেয় বামপাশে বসা অনীতা। স্যার সেটা দেখে ফেললেন। ‘ইয়্যাং লেডি, তুমি বল পার্থিব মানে কি?’
অনিতা উঠে দাড়ানোর আগেই অয়ন দাঁত কেলিয়ে বলল, ‘শীর্ষেন্দুর উপন্যাস স্যার’।
‘আমি কি তোমাকে বলতে বলেছি?’
‘সরি স্যার, বলে মুখ কালো করে বসে পড়লো অয়ন। হাতের ইশারায় অনিন্দ্য তাকে মধ্যাঙ্গুলি দেখিয়ে দিল।
অনিতা স্মার্টলি জবাব দিল, ‘স্যার,পার্থিব মানে হল এমন কিছু যা পৃথিবীর সাথে সম্পর্কিত’।
‘গুড, বসো’। সংক্ষিপ্ত দুটো শব্দ শুনেই অনিতা হাফ ছেড়ে বাচলো।
‘যা বলছিলাম, বলেই স্যার আবার শুরু করলেন। আমার এই গল্পের মধ্যে তোমরা হয়ত পার্থিব কিংবা অপার্থিব কিছু খুঁজে পেলেও পেতে পারো’। ছাত্র ছাত্রীরা সবাই মুখ চাওয়া চাওয়ি করতে লাগলো। পানির বোতলে কয়েক চুমুক পানি পান করে আবার শুরু করলেন বলা- ‘আমি তখন মেডিক্যাল কলেজে ফার্স্ট ইয়ারে পড়ি। পরীক্ষার মাস খানেক আগের কথা, ছুটি ছিল তাই বাড়ীতে ছিলাম। আমার এক ফুফু’র বাসাতেই থাকতাম কারণ আমার বাবা মা কেউ ছিলেন না এক রাতে, আমাদের প্রতিবেশী বিলাল ভাই হাঁপাতে হাঁপাতে আমার কাছে এসে বলল, বাদল ভাই এখনি একটু চলেন, আপনার ভাবীর যেন কি হইসে, কইলো বুকে ব্যথা করে, ছটফট করে। আমি একথা শুনে আর একটুও দাঁড়ালাম না। সাথে সাথে দৌড় দিলাম বিলাল ভাই এর বাসায়। কিন্তু ততক্ষণে সব শেষ। ভাবী মারা গেলেন।
বিলাল ভাই আমাদের গ্রামের এক খ্যাপাটে ধরণের লোক ছিল। যার কাজই ছিল সারাদিন মানুষের খোজ খবর নেয়া আর পরোপকার করা। গ্রামে কেউ মারা গেলে বিলাল ভাই সেখানে থাকবেই থাকবে। মৃতদের সবার জন্য কবর খুঁড়ে দেয়া ছিল বিলাল ভাই এর নেশা। আমার স্পষ্ট মনে আছে, আমার মায়ের কবরটাও বিলাল ভাই একাই খুড়েছিলেন। মাকে বিলাল ভাই খালা বলতো। মা খুব স্নেহ করতো উনাকে। আমাদের সংসার এর কোন কিছু শুধু মুখ দিয়ে উচ্চারণ করলেই হত। উনি সেটা সাথে সাথে হাজির করে দিতেন। পাগলা কিসিমের এই লোকটা তার স্ত্রীকে খুব বাড়াবাড়ি রকমের ভালোবাসতো। একটা মেয়ে ছিল দুই বছর বয়স। স্ত্রী মারা যাবার পর সারাক্ষণ মেয়েকে নিজের কাছে রাখতো। মেয়ের নানী তাকে নিয়ে যেতে চেয়েছিলো কিন্তু বিলাল ভাই তাকে দেয়নি। মেয়েটা ছিল তার যক্ষের ধন। স্ত্রী মারা যাবার পর উনার মধ্যে পাগলামির ভাব দেখা দেয়। মাঝে মাঝে দেখা যেত বিড়বিড় করে কি যেন বলছে। কেউ জানতে চাইলে বলতো, পারুলের মা’র লগে কথা কই। পারুল উনার মেয়েটার নাম।
মানুষের কষ্ট যখন আসে তখন মনে হয় চারপাশ থেকেই আসে। মা মারা যাওয়ার ছয় মাসের মধ্যে ছোট্ট পারুল ও মারা গেলো। হাসপাতালে বিলাল ভাই এর কোলের উপরেই মারা গেল তার বাচ্চাটা। এরপর উনার মধ্যে পাগলামি ভালো রকম দেখা দিল। কেউ ভাবতে পারে নাই যে মানুষটা এমন পাগলামিও করতে পারে। যেদিন বাচ্চাটাকে কবর দেয়া হল, ঐ দিনই কয়েক ঘন্টার মধ্যেই উনি বাচ্চাটার লাশ আবার কবর থেকে উঠায়ে আনে। নিজের ঘরে রেখে দেয়। এটা উনার বাসার পাশের একজন দেখতে পেয়ে মাসজিদের ইমাম কে খবর দেয়। ইমাম সাহেব হন্তদন্ত হয়ে ঘরে ছুটে গিয়ে ভীষণ হতবাক হয়ে যান। উনি গ্রামের গন্যমান্য অনেকের সাথে বিলাল ভাই কে বুঝানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু বিলাল ভাই নাছোড়বান্দা। কিছুতেই উনি উনার মেয়েকে কাছ ছাড়া করবেন না। উপায় না দেখে গোপনে পরামর্শ করে উনাকে জোর করে একটা ঘরে বন্দী করা হয় এবং ছোট্ট মেয়েটার লাশ নিয়ে নতুন করে দাফন করে দেয়া হয় পাশের গ্রামে এবং ঠিক করা হয় এই কথা বিলাল ভাই কে কেউ জানাবে না।
মেয়ের শোকে উন্মাদ হওয়া লোকটা কাউকে কিছু না বলেই পরদিন থেকে বেমালুম গায়েব হয়ে গেল। কথায় গেল কি হল কেউ কিছুই জানলো না। এরপর মনে কর প্রায় সাত মাস পরের ঘটনা, তখন আমি ইয়ার ফাইনাল পরীক্ষা দিয়ে আবার বাড়িতে গেছি। একদিন খুব ভোরে কোত্থেকে যেন বিলাল ভাই আবার আমার কাছে হাজির। আমি ভুত দেখার মত চমকে উঠলাম। একি চেহারা হয়েছে তার! কোথায় ছিল জিজ্ঞাসা করলে কিছুই বলে না। শুধু কাঁদে। আমার দুই পা জড়িয়ে ধরলো, বললো, ভাইজান আমার মাইয়ার কবরটা আমারে একটু চিনায়ে দেন... এই বলে বিলাপ করে কাঁদতে লাগলো। উনার এই বিলাপ সহ্য করতে পারলাম না। নিয়ে গেলাম সাথে করে। দেখিয়ে দিলাম। মেয়ের কবরের উপরে যেন শুয়ে পড়লো পাগলাটে লোকটা। চিৎকার করে কাঁদতে লাগলো। মেয়ের জন্য বাবার এই শোক তোমরা কি পার্থিব কোন হিসাব দিয়ে মিলিয়ে দিতে পারবে?”
বলেই আফজাল সাহেব একটু থামলেন। ছাত্র ছাত্রীরা বুঝতে পারলো যে স্যারের কথা শেষ হয় নাই এখনও। সবাই চুপ করে আছে বাকী কথা শোনার জন্য। একেবারে উৎকর্ণ। অনিন্দ্য একফাকে আড়চোখে মিতুকে দেখে নিল। দেখলো এবার ঘাম নয় টিস্যু দিয়ে চোখ মুছসে। এই মেয়েটার মন ভীষণ নরম। মনে মনে বলল, আহারে বেচারী!
‘আমার কথা এখনো শেষ হয়নি। আর অল্প একটু বাকী। পরদিন ভাবলাম বিলাল ভাই কে ডেকে নিয়ে কিছু খাওয়াই। কিন্তু ঐ উনার সাথে আমার শেষ দেখা। আবার কোথায় যেন উধাও হয়ে গেলো লোকটা। কেউ কোন হদিস এবারো বলতে পারলো না। আমার মনে একটু ক্ষীণ সন্দেহ দেখা দিল। উনার মেয়ের কবরের কাছে গেলাম। আমার সন্দেহ বাস্তবে পরিণত হল। গল্পের প্রথম অংশ এই পর্যন্ত’।
অনিতা উঠে দাঁড়িয়ে বলল, স্যার! আপনি কি দেখেছিলেন ওখানে গিয়ে? বিলাল সাহেবকে পেয়েছিলেন?
‘না পাই নি’। সংক্ষিপ্ত জবাব আফজাল সাহেবের।
‘তাহলে স্যার?’
‘আমি ওই বাচ্চার কবরটা দেখলাম খোড়া হয়েছে’।
‘কি সাংঘাতিক স্যার!’ মারুফের চোখ বড় বড় হয়ে গেলো। ‘উনি উনার মেয়ের হাড়গুলো তুলে নিয়ে গেছেন?”
‘হ্যাঁ’।
হলরুমের মধ্যে ছাত্রদের গুঞ্জন শোনা গেলো। এর আধা মিনিট পরে আফজাল সাহেব বললেন, ‘এবার আমি আমার গল্পের বাকী অংশটা বলি। শুনে নাও। মাত্র দুইদিন আগেই বিলাল ভাই এর সাথে আমার দেখা হয়েছে। চিনতে অনেক কষ্ট হলেও চিনতে পেরেছি। এত বছর কোথায় ছিল, জানা হয় নি। তবে এত বছর নিজের সাথে করে মেয়ের হাড়গুলো বয়ে নিয়ে বেড়িয়েছে এই মানুষটা। কখনও নিজের কাছ ছাড়া করে নি। এই এত বছর পরে বিলাল ভাই এর সাথে আমার যোগাযোগ হয়েছে, এখানে পার্থিব কিংবা দৈব কিছু আছে কিনা আমি জানি না। কিভাবে উনার সাথে আমার দেখা হয়ে গেল, অদ্ভুত ভীষণ অদ্ভুত’। তোমাদের একটা সুখবর দেই। তোমাদের কোন ক্লাস আমি আজ নেব না। ধরে নাও তোমাদের ছুটি। আজকে বিলাল ভাই এর সাথে আমার অনেক বোঝাপড়া বাকী আছে’। বলেই আফজাল সাহেব উঠে দাঁড়ালেন।
অনিন্দ্য মরিয়া হয়ে বলে উঠলো, স্যার এমন অদ্ভুত একজন বাবাকে দেখতে কেন জানি ইচ্ছা করছে স্যার। এইটুকু অন্তত বলেন, বিলাল সাহেব এখন কোথায়? আপনার বাসায় স্যার?
‘না’।
তবে কোথায় স্যার?
‘তোমাদের অ্যানাটমির ডিসেকসন টেবিল এ’।
০১ ফেব্রুয়ারী - ২০১১
গল্প/কবিতা:
৭৪ টি
সমন্বিত স্কোর
৫.৩৯
বিচারক স্কোরঃ ২.৯৯ / ৭.০
পাঠক স্কোরঃ ২.৪ / ৩.০
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪