সে রাতে কবিতা লিখতে বসেছিলাম। মেরুদন্ডের ভেতর দিয়ে একটি চঞ্চল চলন টের পেলেই আমি কবিতা লিখতে বসি। এটাকে অনেকে বলে থাকে ‘ভাব আসা’।
সে রাতে চঞ্চল চলনের গতি এবং তেজ তীব্রতা পাচ্ছিল। রাত তার প্রথম প্রহরের দুয়ারে আধারঘন চাদরে মুড়ে অপেক্ষা করছিল। বারোটা বাজবে চাদর টেনে ধরে হেলেদুলে রাত প্রথম প্রহরে ঢুকে যাবে। ওরা দু’জনেও হয়তো ফুল শয্যার গৃহে ঢুকে যাবে, ঢুকে দরজা ভিজিয়ে দেবে, কেউ একজন টেনে দেবে সিটকিনি। মন মস্তিষ্কের পর্দায় তেমন এক দৃশ্য আলো ফেলতেই মেরুদন্ডে চঞ্চল চলনের সোজা পথ যেন এঁকেবেঁকে গেলো।
তারপর সুস্থির হয়ে বালিশের পাশে রাখা সিগারেটের প্যাকটটা হাতে নিলাম। একটা সাদা বেনসন বের করে ঠোঁটে ধরলাম। নাড়া চাড়া করলাম দু’ঠোঁটের ফাঁকে। খাতাটা টেনে নিয়ে লিখলাম প্রথম লাইন -
‘সে অমলিন, শক্ত পাথরে জীবশ্ম, অক্ষয় স্মৃতি
টুপটাপ ঝরে পড়া সিগারেট বৃষ্টি ক’টি
কুড়ানোর সুখ, চেপে ধরা আঁধারের বুক
ছিঁড়েছুঁড়ে টেনে ধরে রমণীর হাসি-- বড্ড ভালোবাসি...
ওটুকু লিখেই হাসলাম। ভাবলাম আজ আমি অসাধারণ সব কবিতা একের পর এক লিখে যাব। খুব গভীর ভাবে মনে হচ্ছে শ্রেষ্ঠ কবিতা আমার ‘প্রসিবে এই রাতক্ষণ’। নতুন কিছু নয়, এমন গভীর ভাবে আমার অনেক কিছুই মনে হয়। একটা গল্প বলি , জীবনের গল্প। বাসে বসে ঝিমুচ্ছি একদিন। পেছনের সিট। প্রচন্ড ঝাঁকি, তবুও আমি ঘুমাচ্ছি। রাতে সিগারেট কুড়াতে গিয়ে দ্বি প্রহর পেরিয়ে গিয়েছিল। সে যাক। অফিস আমার দুপুরের পরে। একটা ক্ষুদ্র দৈনিকে সাব-এডিটরের পার্ট টাইম চাকুরী। যা বলছিলাম, বাসে বসে ঘুম ঘুম ঝিম ঝিম। হঠাৎ তীব্র চ্যাঁচাম্যাচি। যাত্রীটিকে আমি চেহারায় চিনি। মাঝে মাঝে সহযাত্রী হতে দেখেছি এই বাসগুলোতেই। রোজই এক দুটাকা নিয়ে তার বাহাস চলেই। সেই গদবাধা কথা- ‘তুই বেশি জানাসো, কবে থেইক্যা কনডাকটারী করস, কাল দিলাম ৮ টাকা আজ দুই টাকা বেশি নিবি কেন।’
অথচ গতকালই দশ টাকা ভাড়া দিতে দেখেছি ও ব্যাটাকেই ঝগড়া শেষে। অবশ্য মাঝে মাঝে ৮ টাকায় পার
পায় ঠিকই। আজও পার পাবে বলে মনে হচ্ছিল না, কন্ডাকটর গজ গজ করতে করতে বলছিলো, ‘না দিবার পারলে কইবেন নাই , না থাকলে আর কি করনের আছে, হুদা ঝগড়া করতাছেন কেন।’
লোকটা খ্যাপে উঠলো, ‘কি কইলি ফকীরনিপুত। থাকবো না মানে, ফকীর নি রে আমি, তুই বেশি নিবি কেন এইডা ক আগে।’
কনডাক্টর এক পা সামনে বাড়িয়ে মুখ খুলতে যাচ্ছিল ঠিকই তারআগেই আমার সামনের সীচের এক ভদ্রলোক খ্যাপে গেলেন। ‘আরে মিয়া সবাই দিতাছে দশ টাকা আপনি দিবেন না কেন। এই গরমে ক্যাচক্যাচ করতাছেন মিয়া। ফাউল কইতাছেন।’
লোকটিও খ্যাঁপছে। বলল, ‘এই আপনাদের মত লোকের জন্যই এরা ভাড়া বেশি বেশি নিতে পারে।’ শুরু হলো এভাবেই। তারপর গদবাধা আজাইরা তর্ক শুরু হয়ে গেলো। ভাড়া থেকে বিষয় চলে গেলো রাজনীতিতে আধা মিনিটেই।
আমার তখনই মনে হলো, খুব বেশি মনে হলো আমি রেগে চোখ খুলব। সিট ছেড়ে উঠব। দুই ব্যাটার হাতে পঞ্চাশ টাকা করে ধরিয়ে দিয়ে বলব, যা নিচে নাইম্যা রিকশায় উঠে যা। তারা আমার কথা শুনবে না। নড়বে না। আমি দুই হাতে দু’জনকে টেনে গেটের কাছে নিয়ে যাব। ড্রাইভারকে ধমকে বলব, ব্রেক কর। তারপর ফাজিল দুই ব্যাটারে এক ধাক্কায় দেবো নিচে নামিয়ে। আমার হাতে সুপার হিরোর শক্তি, তরা একটুর গাইগুই করতে পারবে না। দ্ ুব্যাটাকে নামিযে ফিরে এসে কনডাকটর কে বলব, সবাইকে এক টাকা করে ফেরত দে। আর কানে ধর কোন যাত্রীকে কখনও বিরক্ত করবি না। সেও শুনবে কথা।
কিন্তু মনের মনে হওয়া ইচ্ছা গুম হয় মনেই। আমি চোখ বন্ধ করেই থাকি। কনডাক্টর ডাকতে এলে চোখ বন্ধ অবস্থাতেই দশটাকা ধরিয়ে দেই।
মনে হলেই তাই শ্রেষ্ঠ কবিতাও রচনা হবে না। আমি শ্রেষ্ঠ কিছু পাবার যোগ্য না। তাহলে শ্রেষ্ঠার আজ বিয়েটি হতো না। একটু দুঃখবোধ আসে। কবিতাখানার লাইন ক’টা আবার পড়ি। দূর কি ছাই লিখলাম ভেবেই ছিড়ে ফেলি। ছুঁড়ে দেই জানালা দিয়ে বাইরে। বাতাসের গতি যেদিকে নিয়ে যায় সেদিকে মোটেও শ্রেষ্ঠাদের বাসা নয়। হলেও কি , আজ রাতে ওখানে শ্রেষ্ঠা নেই। বরং ছেড়া কবিতা যেদিকে যাচ্ছে সেদিকেই একটু উপরে দোতলায় সে এখন স্বমাীর সাথে একই ঘরে। এই দালানের উপরেই। আমি তার স্বামীকে চিনি। সে আমার বড় ভাই। চৌধুরী সাহেবের বড় ছেলে। আর আমি ছোট।
সেদিন মানে শ্রেষ্ঠার বাসরের সে রাতের আগের সকালেই শ্রেষ্ঠাদের বাসায় যেতে হয়েছিল। একটা বড় আকরের লালটুকটুকে আমেরিকান টুরিস্টার ব্যাগ হাতে নিয়ে আমি আর আমার এক কাজিন পুষ্প আপু ও বাড়িতে হাজির হয়েছিলাম। এইতো একটা গলি পেরোলেই হাতের বামে মসজিদেও পাশের বাড়িটাই শ্রেষ্ঠাদের। কনের যাবতীয় পন্য ভর্তি সে ব্যাগ। পুষ্প আপু ও বাড়ীর আয়োজন দেখার পায়তারায় ছিল। একটু সুযোগড় হয়েছিল শ্রেষ্ঠাকে একা পাবার। ওই ডেকেছিলো নিরালায়। আমি চুপ ছিলাম। বলেছিলো শেষ একবার ভেবে দেখবো কিনা। আমি বলেছিলাম, ‘দেখবো না।’
‘কি দেখবে না। ভাবী হবো তোমার রোজ তাকিযে তাকিয়ে দেখবে। দেখবে তোমার ভাইয়ের লোমশ বুকে আমার মুখ গোজা রাত দিন। তুমি না কবি, কবিরা কি এমন হয়? তুমি আমাকে ভালোবাস না।’
‘আমি কবি কি না জানি না। তবে কবিরা নিঃস্বার্থ হয়। আমি নিঃস্বার্থ হাবার পথে এক ধাপ পেরোলাম।’
‘তবে কেনো ভালোবেসেছিলে? বল কেনো?’
‘গভীর রাতে সিগারেট কুড়ানোর জন্য ভাবতে পার। যদি ভাবার আর কোন কারণ নাই পাও।’
‘মঞ্জু, আমি যদি রঞ্জু ভাইকে বিয়ে না করি, তুমি ভালোই জানো আমি চাইলে এখনই হৈচৈ করে মাথায় তুলতে পারি।’
‘না, তুমি সেটা করবে না। আমি বলেছি না করতে, তুমি স্টো করবে না। তুমি লক্ষ্মী মেয়ের মত ভাইয়াকেই বিয়ে করবে। কথা দিয়েছেলে না আমার কথা শুনবে। ’
‘ভুল করেছিলাম। বিশ্বাস করেছিলাম। এখন কেনো শুনবো, তুমি তো ভালবাস না। কেনো তবে শুনবো। ’
‘ভালোবাসলে তো শুনবে। তাহলে ভালবাসি। অনেক ভালবাসি।
চোখ দিয়ে শ্রেষ্ঠার হু হু করে পানি ঝরছিলো। আমার আমার ঝরছিলো মনে। ওকে কেনো দেখাবো। হালকা হতেই বললাম, ‘আর তো রাতে তোমার জানলায় সিগারেট বৃষ্টি হবে না। এক প্যাকেট বেনসন গিফট করো না। মাত্র এক প্যাকেট।’
ও সত্যি কাজের ছেলেটাকে পাঠিয়ে এক প্যাকেট সাদা বেনসন এনে দিয়েছিল। শ্রেষ্ঠ কবিতা রচনার রাতে সেই সিগারেটের পাছায় আমি আগুন লাগাতে পারছি না। কষ্ট হচ্ছে। ভীষণ কষ্ট। রঞ্জু ভাইয়া হাসছে নিশ্চয়। শ্রেষ্ঠা হাসছে তো?
না হাসলে বলব সকালেই -আমি কিন্তু হাসতে বলেছি। আমার কথা শুনতে হবে। আমি যে ভালবাসি।
বাহ্! বেশ কবিতা হলো তো !
‘আমার কথা শুনতে হবে আমি যে বাসি ভালো
আমার মুখটা ভুলতে হবে আমি যে বড্ড কালো।’
তারপর গোটা গোটা গোল বৃত্ত একে লাইনদুটো অপাঠযোগ্য বানালাম। আমি কি সে রাতে আসলেই খুব বেশি অস্তির ছিলাম। একটুও ঘুমাইনি। শ্রেষ্ঠার মিষ্টি মুখটা একমুহূর্তের জন্যও বিস্মৃত হয়নি। রাত যখন তিনটে বাজে বাথরুমে বেসিনের সামনে আয়নাটার সামনে দাঁড়িয়ে প্রাকটিস করছিলাম দুটি ছোট শব্দ বারবার। ‘শ্রেষ্ঠা ভাবী।’ পরে কেটে নিলাম, শুধু ভাবী ই ভালো। ভাবী ও ভাবী আমাকে এক প্যাকেট সিগারেট কিনে দেবে। না আর কথনও ওর কাছে সিগারেট চাবো না। আনকোড়া প্যাকেটের এক সিগারেটও টানবো না।
ঠিক সে সময় দাড়োয়ান কাকু যাচ্ছিল ঠিক আমার জানালার পাশ দিয়েই। একটা বাড়ি দিলো লাইট পোষ্টে। আমি বললাম, ‘ও মোকসেদ কাকু, বিয়ে বাড়ি, একটু আস্তে বাড়ি দাও।’
উত্তর এলো, ‘দূও বোকা সে জন্যেই তো বেশি জোরে বাজাচ্ছিরে। তুমি ঘুমাও নি কেনো, মনটা বেশি খারাপ।’
‘কাকু তুমিই কিন্তু একমাত্র স্বাক্ষী, তুমি দয়া করে চেপে যেও। একটা বিড়ি হবে তোমার কাছে।’
‘তুমি বিড়ি খাবে। চৌধুরী সাহেবের ছেলে হয়ে তুমি বিড়ি খাবে। আমি বরং তোমার জন্য বেনসন এনে দেই, ওপাশের রাস্তায় দোকান খোলা আছে দেখে এলাম।’
‘না, না দিতে চাইলে থাক। চৌধুরীর ছেলে! কাকু তুমিই না আমাকে এনেছিলে কুড়িয়ে। তুমিই না সেই নষ্টের গোড়া। তবে তুমি গভীর রাতে সিগারেট কুড়ানোর গল্প কাউকে করো না কিন্তু। আমাকে কুড়িয়ে পাবার গল্প সবাই বিশ্বাস করতে পারে, এ গল্প করবে না কিন্তু।’
মোকসেদ কাকু হাত টা বাড়িয়ে মাথায় রাখে। বলে, ‘এই তো জীবনরে বাপধন। ওসব ভুলে যাও। পড়াশুনায় মন দাও। কি যেন এমবিএ না কি করছিলে, সেটা শেষ। ’
‘বিড়ি দেবে?’
‘এই প্রথম এই শেষ কিন্তু বাপধন।’
‘ঠিকাছে কাকু। অনেক ধন্যবাদ। কাইকে কিন্তু বলো না। ’
‘কি করে বলিরে বাপ, তোকে যে আমিই কুড়িয়ে পেয়েছিলাম। ’
চৌধুরী সাহেব যখন আমাকে ছেলে হিসেবে গ্রহণ করেছিলো তখন এই এলাকায় হাতে গোণা মাত্র কয়েকটি বাড়ি ছিলো। তাই এলাকায় পরে আসা অনেকেই আকার পিতৃমাতৃহীন পরিচয়টা অনেকেই জানে না। শ্রেষ্ঠারও তাই ওটা জানা ছিল না। ও আরও অনেক কিছুই জানতো না। রঞ্জু ভাইয়া ডাক্তারী পাশ করার পর এলাকাতে বড় রাস্তার পাশে বাবার যে পাঁচতল আরেকটা বাড়ি তার দু ফ্লোর নিয়ে একটি আধুনিক ক্লিনিকি খুলে ফেললেন। সেখানে প্রাকটিস করেন সন্ধ্যার পরে। আর দিনের বেলায় উচ্চতর কোর্স করেন পিজিতে। ক্লিনিকেই শ্রেষ্ঠাকে দেখেন ভাইযা প্রথম। প্রথম দেখেই মুগ্ধ হয়েছিলেন। শ্রেষ্ঠার বাবা ভাইয়ার পরিচয় জানতেন। ভাইয়ার সাথে বেশ একটা খাতির করে ফেললেন। ভাইয়াও তাই চাচ্ছিলো। ভাইয়া আমাকে অবশ্য সে দিনই রাতে বলেছিল আমার জন্য ভাবী পছন্দ করেছেন। কিন্ত নাম বলতে পারেন নি। আমিও অত খোঁচাই নি। তবে বাবার কানে তুলেছিলাম খাবার সময়। বাবাতো মহাখুশি। ভাইয়াতে সে টেবিলেই জিজ্ঞেস করে ফেললো মেয়েটা কে। কি নাম ধাম। কোথায় থাকে। শ্রেষ্ঠার নাম না বলতে পারলেও তার বাবার নাম বলতেই বাবা চিনে ফেললেন। চিনলাম আমিও। হৃদয়ে বিলিয়ন টনের চাপটা লেগেছিল সেই প্রথম প্রচন্ড ভাবে। তারপর চাপ সরে যেতেই বুঝে ফেললাম, আমিতো পালিত। আমিতো পোষ্য। ঋণ শোধের এইতো সুযোগ। আমি সুযোগ লুফে নিলাম।
শ্রেষ্ঠাকে আমি ঘুনাক্ষরেও কিছু জানালাম না। বাবা দেরী করেন নি। পরের শুক্রবারেই হাজির হলেন বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে। ভাইয়ার মত ছেলের হাতে মেয়ে দিতে কেউ মানা করতে পারবে না। যেমন সুন্দর তেমন লস্বা আর হ্যান্ডসাম রঞ্জু ভাইয়া। শ্রেষ্ঠাকে দুষ্টামী করে অনেক আগে একদিন বলেছিলাম, ‘শহীদ কাপুরের মত লাল্টুরে এত পছন্দ তোমার আমার মত কাল্লুরে কেমনে ভালবাসলে বলো তো।’ ও বলেছিলো, ‘আমি কি এমন প্রিয়াঙ্কা বলো , তোমাকেই পেয়েছি সেই তো ঢেড়।’
সেদিন বলেছিলাম, ‘তুমি রঞ্জু ভাইয়াকে দেখেছো? ভাইয়া কিন্তু শহীদ কাপুরের অবিকল কপি।’
‘সত্যি, তাহলে তো না দেখাই ভালো, তোমার কপালটা আবার পুড়ে না যায।’
কপাল তো পুড়েছেই। বাসার সবার মিষ্টি হাসি সে পোড়া দাগে হয়েছে উপশম। মা তো শ্রেষ্ঠাকে আগেই চেনে। সে তো মহাখুশি। ছোট বোনটাও খুশি। আসলে শ্রেষ্ঠার মধ্যে আকর্ষণ ওমনই। কে না খুশি হয়ে পাড়ে। এই আমিও তো খুশি হবার ভান করছি। ভান হবে কেনো, ঋণ শোধের সুযোগ অবশ্যই এক মহা খুশির বিষয়।
ওদেও বিয়ের রাতটা ভেবেছিলাম কখনও আর পারহবে না। তবে সত্যি পেরিয়েছিলো। দাড়োয়ান কাকুর থেকে নেয়া বিড়ি টানার পর সেই আযনার সামনে ভাবী ডাকার প্রাকটিসে কোন উন্নতি হলো না। ও আমি আদৌ বুঝি পারব না । তারপর বেনসনের পুরো প্যাকেটটাই শেষ হয়েছিল মাত্র ঘন্টা দুয়েকেই। কখন ঘুমিয়েও পড়েছিলাম। রাত পেরিয়ে সকাল টের পাইনি। যখন গুম ভাঙলো দেখলুম টেবিলের উপর সিগারেটের ছাইয়ে মাখামাখি। সকাল তখণ দশটা। হাতমুখ ধুয়ে টেবিলটা পরিষ্কার করে একটা ফ্রেস গোসল দিয়ে রুম থেকে বের হয়েছিলাম।
মা ডেকে বললেন, কিরে রাতে কটা সিগারেট টেনেছিস? টেবিল জুড়ে ছাই ছড়িয়ে কি করেছিস ?বাদ দিতে না পারিস কমানোর চেষ্টা কর না। যদি তোর বাবা দেখতো ...ভাগ্য ভালো বাবা ঢোকেনি। তিনি আজ নতুন বৌমার হাতের চা খেয়েই সকাল থেকে প্রশংসায় অষ্টমুখ হতে ব্যস্ত। শ্রেষ্ঠা মার সে কথা শুনেই হয়তো আড়চোখে তাকিয়ে ছিলো। আমি ওর চোখের দিকে তাকাতে পারলাম না। মাকে বললাম, ‘ভাইয়া কই?’
শুনলাম ভাইয়া নাকি সাত সকালে উঠেই নতুন বউকে ফেলে পিজি হাসপাতালে ছুটেছে।
সে সকালও পেরিয়েছে। বৌভাতের অনুষ্ঠানের দিনও পেরিযেছে। তারপর পেরিয়েছে আরও দশ টি সকাল। ভাইয়া আর শ্রেষ্ঠার সংসার দূর থেকে বেশ স্বাস্থ্যকরই মনে হচ্ছে। পরিবারের সবাইকে প্রফুল্ল দেখাচেছ । বিকালে ভাইয়া ভাবীকে নিয়ে শ্রেষ্ঠাদের বাসায় গেছেন। আজ প্রাকটিস্যে যাবে না জানিয়েছে। আমি বাজার থেকে সবচেয়ে ভাল মানের পাঁচ কেজি মিষ্টি আর দই কিনে এনে ভাইয়ার হাতে ধরিয়ে দিয়েছিলাম বাবার আদেশে। এর মধ্যে আমি কবিতা লেখা ভুলে গেছি। আমি টিভি দেখা শিখেছি। আমি রাত দ্বি প্রহর এমনকি তৃতীয় প্রহর অবধিও টিভি দেখি। টক শো গুলো আমাকে বেশ মজা দিচ্ছে। দেশের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গরা যে জ্ঞানের চাদর মুড়ি দিয়েও এত বেশি এন্টারটেইন করতে পারে কল্পনায় ছিল না। যেকোন ভাড়ামী হাসির অনুষ্ঠান থেকে অনেক বেশি এনজয়েবল কথার মারপ্যাচ আর যুক্তি তর্ক। আমার সময় কাটছে। চ্যানেরের অভাব নেই। আমারও রাত কাটানোর উপযোগীতার অভাব হচ্ছে না। রাত বাড়ে টব শোর কথার গভীরতা বাড়ে। তেমনই এক টক শো দেখছিলাম মনোযোগ দিয়ে। হঠাৎ ফোন এল। এই প্রথম খেয়াল হলো মোবাইল থেকে শ্রেষ্ঠার নাম্বার টা মোছা হয়নি। যদি কখনও ভাইয়া দেখে ফেলে। কি বিচ্ছিরি ব্যাপার হবে। তারউপর ওর নম্বর সেভ করা সিগারেট নামে। উফ্ কিন্তু এত রাতে ফোন! ভাইয়াও তো সাথে আছে।
ধরবো কি ধরবো না ভাবতে ভাবতে ধরেই ফেললাম। হ্যালোর বেশি কিছু বলতে পারলাম না। ওই বললো, ‘কেমন আছ জিজ্ঞেস করবো না। শুধূু একবার আমার জানালার নিচে আসবে। প্লিজ আসবে। ’
আমি কি বলব বুঝতে পারছি না। শুধু বললাম, ‘ঠিক হবে না। ভাইয়া আছে। তারোপর তুমি আমার ভাবী...’
‘প্লিজ আসো, ফোনটা কেটো না, কানে ধরেই আসো, প্লিজ...’
আমি অনিচ্ছাতেও বাহিরের গেইটটা খুলে ঠিকই বের হয়ে গলি ধরে হাঁটতে লাগলাম। কান্নার আওয়াজ পাচ্ছি মোবাইলের ভেতর। আমি নিশ্চুপ। জানালার নিচে গিয়ে দাঁড়ালাম। মুহূর্তে সেই সিগারেট বৃষ্টি...
বললাম, ‘আমি সিগারেট ছেড়ে দিয়েছি, দয়া করে আমাকে আর এই বিষের অর্ঘ্য দিও না ...ভা ভা বী। আমি চললাম।’
‘ঋণ শোধ করার জন্য আমাকে ভাইয়ের হাতে তুলে দিলে, আর আমি যে ভালবাসলাম সে ঋণ ...’
‘সাথে যে অনেক অনেক বিষ দিলে, সিগারেটে দিলে, ওতেই কাটাকাটি। ’ বলেই আমি মোবাইল কেটে দিয়ে বাসার দিকে হাঁটা দিলাম। একবারও পেছনে ফিরে তাকালাম না। মেবাইল অফ করে দিলাম। তার আগে ডিলিট করে দিলাম ওর নম্বর। ডিলিট করতে করতে কল আসছিলোই। আমি তো আর ধরবো না কখনই। ফিরতে ফিরেতে চোখে ভাসছিল সেই সে স্মৃতি-একটু দূরে গিয়েছিলাম এক বিকেলে লুকিয়ে দুজন। দিগন্তের কাছে- সবুজের কাছে, সামনে ছিলো বিশাল ধানক্ষেত, ধানক্ষেতের আগে বড় খাল, খাল ধেয়ে নৌকা এগিয়ে যাচ্ছিল। আমরা তাকিয়ে ছিলাম উদাসী দিগন্তে। পকেট থেকে সিগারেট বের করে ধরাতে যাব, ওর ডান হাতটা এগিয়ে এসে একটানে সিগারেটটা নিয়ে ফেলে দিয়েছিল খালে। আমার রাগ হয়েছিল। কথা বলছিলাম না। ওর জিদও কি কম। সেই জিদের ফল ছিলো গভীর রাতে সিগারেট বৃষ্টি। সে দেখতে চেয়ছিল আমি কত টানতে পারি।
জানালার নিচ থেকে নিচু মাথায় ঘরে ফিরে আর কিছু ভালো লাগছিলো না। অনেকদিন পর কবিতার খাতা তুলে নিলাম। টক শো খুব বিরক্ত লাগছিলো। এক ঘেয়েমি প্যানপ্যানানি মনে হচ্ছিল। ভাবছি ঋণ শোধের কথা কে জানাল শ্রেষ্ঠাকে? -ভাইয়া, বাবা, মা?
সকালেই জানতে পারলাম কাজিন পুষ্প আপু কথায় কথায় শ্রেষ্ঠা ভাবীকে জানিয়েছে আমার অনাথ পরিচয়। পুষ্প আপু দুঃখ করলেন আবার বললেনও শ্রেষ্ঠা ভাবীর জানাও উচিৎ। সেও পরিবারের সদস্য এখন। আমি বললাম, ‘অবশ্যই , আমার ই বলা উচিৎ ছিলো। ’
ভাবলাম ভালোই হলো।