অসভ্য আলোক সম্পাত

অন্ধকার (জুন ২০১৩)

মামুন ম. আজিজ
  • ১৮
  • ১৩০
আমরা মানুষগুলে বেসিকেলি সভ্য নই। বারবার মনে এই ধরনের এক বাক্য আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের মত মাটি ঠেলে ঠেলে বের হচ্ছে, আমরা মানুষ নাকি আবার মাটিরই তৈরী। টিভি নিউজ, টক শো আর পত্রিকার পাতা দেখতে দেখতে আমার মাঝে এই এক বাক্যের বন্দীশালা অহর্নিশি আবাস গাড়ছে মনে হয়।

আচ্ছা দৃষ্টির অগোচরে যৌণ ক্রিয়াই কি কেবল বন্য পশু থেকে মানুষকে সভ্যতার ফাঁদে ফেলে পৃথক করে তোলে?- মনে সামান্য আলো থাকলেও এমনটা ভাবার অবকাশ পাবার কথা নয়, তাহলে?

মস্তিষ্ক নির্ঘাত অলসতায় ডুবে যাচ্ছে, না হলে মানুষের সভ্যতার বিশ্লেষণ করতে বসেছি, উফ্! কি বিভিৎস দৃশ্য! বাসে আগুন জ্বলছে দাউ দাউ, তার ভেতরে দাউ দাউ জ্বলছে একটা সচল মাটি, মাটির ভেতর এক আত্মা, একজন মানুষ। একটা ভিডিও চিত্র। এই মাত্র দেখলাম একটা টিভির টক শোর ব্যাকগ্রাউন্ড ভিডিও ফুটজে। দু’জন বিশিষ্ট টক শো ব্যক্তিত্ব তাই নিয়ে আলোচনায় লিপ্ত হচ্ছেন। মানুষ পোড়ার করুন দৃশ্যে, বাস পোড়ার দাউ দাউ দৃশ্য- দুজনকেই বিমর্ষ করলো, কিংবা বিমর্ষ হবার দারুণ অভিনয়টা করলেন দু’জন। ঘটনা ঘটেছে সন্ধ্যায়। কাল একখানা হরতাল, সেই হরতাল যে ডাকা হয়েছে সেটা মুর্খ জনগণ যাতে বোঝে সে কারণে দাউ দাউ আগুন জ্বেলে সংকেত দেয়া আর কি! কিন্তু মানুষ যে একজন পুড়ে মরে গেলো। গান পাউডার নাকি দেয়া হয়েছিল, বেচারা বের হতে পারেনি।

গভীর ধর্মানুভূতির কাউকে জিজ্ঞেস করলে হয়তো বলতেও পারতেন, মৃত্যু ছিল কপালে, কে ঠেকাবে। অতটা এরা বললেন না, তবে...


খানিক বাদেই দেদারছে দু বক্তা ঝগড়ায় লিপ্ত হলেন। এতদিনের দর্শন অভিজ্ঞতায় বুঝে গেছি, তর্ক আর ঝগড়া সবচেয়ে জটিল গুন এই বিশিষ্ট টক শো ব্যক্তিত্ব হবার জন্য। এ দু গুন বিনে তেমন কদর কে দেবে?

একজন বলছে, একি হত্যার রাজনীতি, মানুষ খুন করে আবার ক্ষমতার লোভ? ওদিকে অন্যজন বলছে , মানুষটা তো খুন হতো না, পুলিশ রাবার বুলেট ছুড়ছিল আগুন দিয়ে দৌড়ে পালানো যুবক ক’টির দিকে , লোকটা তো সে কারণেই বের হতে পারে নি। সে আরও একটু উষ্কানী দিয়ে বললো, এমনও হতে পারে হরতাল সমর্থকদের হেয় করার জন্য অন্য পক্ষ নিজেই এই আগুন লাগিয়েছে। পেপারে এসছে দেখেন নি , বাসের হেল্পার ড্রাইভার নিজেরাই বলে টাকার বিনিময়ে আগুন দেয়...

শুরু হলো... পেছনে ব্যাকগ্রাউন্ডে ভিডিও ফুটেজে আবারও দাউ দাউ আগুন, আত্মা আর মানুষ পুড়ছে। অসহ্য! আমরা অসভ্য! আত্মা কি পোড়ে? তবে মাটি পুড়লে কি যায় আসে, বরং এ লোক ভাড়াক্রান্ত দেশে একটা মাটির দেহ কমে। আত্মার বলে মৃত্যুই নেই...তাহলে মানুষ অমর আর মাটির দেহ মরণশীল, অবশ্য আত্মা আর মানুষ যদি সমার্থক হয়! এক নয় তলা বিল্ডিং ধ্বসেই হাজার ছাড়িয়ে যায় দেহের মৃত্যু...ঐ দেহ হারানো আত্মা গুলো আমদের কাছে কোনদিন আমাদের অসভ্য মানবতার বিচার চাইবে কি?

আবার চোখ গেলো দাউ দাউ আগুন। উফ্! লেলিহান শিখা, চারপাশে ঘন আঁধার। ঘন আঁধার আর দাউ দাউ আগুনের মাঝে গভীর ভালবাসা। হিরণের কথা মনে হলো হঠাৎ। তার সেই বিখ্যাত ঘটনা। এখনি ফোন করতেই হবে।


ঢাকা ভার্সিটি ভর্তি হবার পরের কথা। হলে সিট বরাদ্দ ছিল কিন্তু শোয়ার জায়গা থাকতো না। আমার এক আত্মীয়ের পাঁচতলার ছাদে একটা চিলেকোঠায় আমার আর হিরণের ঠাঁই হলো। আত্মীয় তো কি বাড়ি ভাড়া মাফ নেই। আমি ব্যস্ত থাকি বাড়ি ভাড়ার টাকা জোগাড়ে। কয়েকটা টিউনি করতে হয়। কিন্তু হিরণের কোন টেনশনের বালাই নাই। সে দিব্যি ফুর্তি আর মৌজ নিয়ে আছে। ছাদ লাগোয়া সামনের পাঁচতলার মেয়েটাকে পটিয়েই ফেললো। শুধু কি তাই রাতে প্রথম প্রহরের খানিক আগে, তখনও ঢাকা জেগে থাকে, আমি ঘুট করে একটা শব্দ পাই, একদিন দুদিন, তিনদিনে আবিষ্কার করি হিরণ ছাদ হতে ছাদ টপকায় আর সে আওয়াজ চলে আসে ঘুট শব্দ হয়ে কানে। মেয়েটাও ছাদের তালা লাগানো গ্রিলের দরজায় এসে দাঁড়ায়, আর কি করতে পারবে সে তারা জানে তবে হাত চারটে তো এক হয়...তখন আবার ঘোর অমাবশ্য চলছে, আমি উঠে গিয়ে টের পাই, তবে দর্শনটা হয় না ঠিক। কিন্তু এমনি করে ক’দিন। আমি বন্ধু হবার দায়িত্বটা পালন করি, সাবধান করি। বলি ও কিন্তু ও বাড়ির বাড়ি ওয়ালার ভাতিজি। কে কার কথা শোনে।

চোরের দশ দিন গেরোস্তের একদিন। সেই একদিন আসতে দেরী হলো না। হিসেব করিনি। তবে এগারতম দিন হলেও হতে পারে। আকাশে ঘন মেঘ ছিল। মেঘের ঘনঘটা যাকে বলা যেতে পারে। কবি সাহিত্যিকরা এমন মেঘ দেখলে উতলা হয়। আর উতলা হয় ঘন প্রেমিক প্রেমিকারাও। তারাও উতলা হয়েছিল বোধহয়। উতলা হয়েছিল আকাশের মেঘও। হঠাৎ পরপর দুবার তীব্র আলোর বান মেরে বিদ্যুৎ চমকালো। আশেপাশে ছয়তলা বিল্ডিংও কয়েকটা। কপাল খারাপ, সে সবের একটার ছাদেও লোক দেখা গেলো। জানালাও কয়েকটা কেউ লাগাচ্ছিল সেই সকল চোখ বড় বড় হলো ক্ষণিক। হিরণ আর মেয়েটার মাঝে কোন সীমানা ছিল না ঠিক তখন ছাদের গ্রীলের দরজা সত্ত্বেও। দুজোড়া ঠোঁটের মিলন সেই রাত দশটার দিকে অনেকেরই স্মৃতিতে রেকর্ড হয়ে গেলো।

তারপর যা হয়। অনেক কষ্টে পাওয়া বাসাটাও হারাতে হলো। তবে হিরণের খুব শীঘ্রআ সেই মেয়ের সাথে বিয়ে হয়ে যাওয়ায় তার ঘর জামাই হয়ে পড়াশুনার ক’বছর বেশ কেটেছিল। আমার আর লজ্জায় আত্মীয়র চিলোকাটায় ফেরা হয়নি। হলের মেঝেতে কষ্টে দিন কেটেছে। তবুও হিরণ আমার আজও ঘনিষ্ট বন্ধু। সেই মেয়েটা এখনও তার বউ, তারা বেশ আছে। একটা মেয়েও হয়েছে। মেয়েটাকে তারা ছাদে উঠতে দেয় না।

হিরণকে কল করেই ফেললাম। বললাম, দোস্ত মনে পড়ে সেই ছাদের উপর সেই সে রাতে তুই আর ভাবী আর সেই অসভ্য আলোক সম্পাত। ভাবী কি পাশে , জিজ্ঞেস কর না ভাবীর এখনও মনে পড়ে।

বন্ধু খ্যাপে গেলো। বলল, মনটারে এমন আঁধার বানাইছোস কেন। নিজের সংসার নাই , আমার সংসার ভাঙবার চাস?
আমি বললাম, সরি বন্ধু, বউ নাইতো, প্রেমিকাও নাই, নারীর মন অত বুঝি না, তবে সেই বোধের কাল থেকে দেশের প্রধানমন্ত্রী হইতে দেখতাছি দুই নারীরেই তো কেবল--একটা জিনিস বুঝছি, বুঝছি, নারীগোরে বোঝান যায় না সহজে। থাক ভাবীরে কইছনা। আবার কি ভাবে। তয় কোন একদিন সুযোগ হইলে কইস, আমি কিন্তু ভুইলা গেছি। হে হে হে। আচ্ছা দোস্ত ক তো আমরা মানুষগুলান বেসিকালি সভ্য নই কেনো?

মজা করছ । একটা বিয়া কর। এইসব উল্টা পাল্টা চিন্তা বাদ দে।

কিন্তু দোস্ত, টিভিতে দেখ বাসে আগুন দিয়া এক মানুষরে মাইরা ফেলাইছে, হেইডা নিয়া দুই বিশিষ্ট টক শো ব্যক্তিত্ব ঝগড়া কইরা পুরা পরিবেশ আন্ধার বানাই ফেলাইছে, তোর ও ভাবীর সেই ঘটনার মত, সেই অন্ধকার হঠাৎ বিদূরীত করার মত একটা টাসকি লাগানো আলোক সম্পাত কি হতে পারে না, একটা অসভ্য আলোক সম্পাত, যে আলোয় ফাঁস হবে সাধারণ মানুষের চোখে অন্ধকারে ঢাকা সব নিগুঢ় বাস্তবতা।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
মিলন বনিক সময়ের আবোল তাবোল বেহিসেবী চালচলনের বিপক্ষে সাহসী উচ্চারণ....আর এত মধুর উপস্থাপনা....গোগ্রাসে গিললাম....খুব ভালো লাগলো মামুন ভাই....খুব েভালো লাগল....
এফ, আই , জুয়েল # অপরাজনীতি আর অধর্মের বেসামাল আচরন ---সমাজে যে মুর্খতা ও উগ্রতার সৃষ্টি করেছে---তার বিরুদ্ধে এক বলিষ্ঠ উচ্চারন এই গল্পে উচ্চারিত হয়েছে । সত্য -ন্যায় - ইনসাফের ক্ষেত্রে আজ চরম অবস্থা বিরাজ করছে । সবাই মিথ্যার বেসাতী গাইতে বিভোর হয়ে আছে ।
নাজনীন পলি " দেশের প্রধানমন্ত্রী হইতে দেখতাছি দুই নারীরেই তো কেবল--একটা জিনিস বুঝছি, বুঝছি, নারীগোরে বোঝান যায় না - " নারীদের আগে একজন চাচা মিয়া যে দেশের প্রধান ছিলেন তারে কি কেউ বুঝছিল ? আসল কথা হল 'যে যায় লঙ্কায় সেই হয় রাবণ ।'
মোহাম্মদ ওয়াহিদ হুসাইন ...প্রকৃতি মানুষ নিয়ে মাথা ঘামায়না আর মানুষ প্রকৃতি নিয়ে মাথা ঘামায়না (ঠেকায় না পড়লে)। ঠেকায় যতদিন না পড়ছি...। শুভেচ্ছা রইল।
সূর্য বিদ্যুতের আলো হয়তো ব্যক্তির সমাজের বাইরের আচরণ প্রকাশ করতে পেরেছে সেটা অন্ধকারে ঘটেছে বলে। তবে যা আলোয় ঘটে, সে অন্ধকার দূর করার ক্ষমতা কোন আলোক সম্পাতের পক্ষেই সম্ভব না। তোমার গল্পগুলোতে সমাজ রাষ্ট্রের সব অনৈতিকতাগুলো উঠে আসছে একটা জোড়ালো আবেদন নিয়ে। এটা বেশ ভালো লাগছে। সমাজ সংস্কারে এগুলো ভুমিকা রাখবে একদিন।
অদিতি ভট্টাচার্য্য আপনার সব গল্পেই (অন্তত আমি যেক’টা পড়েছি) অন্য রকম স্বাদ থাকে, অন্য রকম হয়। এটাও তার ব্যতিক্রম নয়। ভালো যে খুবই লেগেছে সেটা তো বলাই বাহুল্য।
ইন্দ্রাণী সেনগুপ্ত দারুন লাগল। একদম অন্য একটা স্বাদ :)
তাপসকিরণ রায় আপনার গল্প লেখার ধরনটা দেখেছি একটু অন্য রকম।ভাষার চৌকস ভাব চোখে পড়ে।লেখায় অনায়াস একটা গতি লক্ষ্য করা যায়।কাহিনীটি ছোট হলেও সুন্দর লেগেছে।

০১ ফেব্রুয়ারী - ২০১১ গল্প/কবিতা: ৭৮ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

বিজ্ঞপ্তি

“মে ২০২৪” সংখ্যার জন্য গল্প/কবিতা প্রদানের সময় শেষ। আপনাদের পাঠানো গল্প/কবিতা গুলো রিভিউ হচ্ছে। ১ মে, ২০২৪ থেকে গল্প/কবিতা গুলো ভোটের জন্য উন্মুক্ত করা হবে এবং আগামি সংখ্যার বিষয় জানিয়ে দেয়া হবে।

প্রতিযোগিতার নিয়মাবলী