এক.
তিনি নামের বানানটি লিখতেন-ভূষণপ্রিয় ভানু ভটচায্যি। বেস কেতাদুরস্ত মানুষ ছিলেন। শহরের স্কুল হলেও সব সময় ধূতি পাঞ্জাবি পড়েই আসতেন। স্যার মাধ্যমিকে আমাদের বাংলা পড়াতেন। ভট্টাচার্য বানানটি ভুল না হলেও আমরা যদি তদ্রুপ লিখেই ফেলতাম কিংবা বলেই ফেলতাম মুখে, ভি কিউব স্যার চটে যেতেন। নামের তিনটি শব্দই ভ দিয়ে মানে ভি ধরলে ‘ভি কিউব’, এ নামটাই আমরা অগোচড়ে আওড়াতাম। কে এই নামকরণ করেছিল তা আমরা জানি না, কিন্তু আমরা নিজেদের মধ্যে ব্যবহার করে চলছিলাম।
স্যার যে জানতেন না ঠিক তা না, তবে তার সামনে কেউ কখনও ধরা পড়েনি। হাসিখুশি মানুষটির শাস্তি প্রদানের পদ্ধতিগুলো ছিল বেশ বিপত্তিকর। আমাদের ক্লাশে ফার্স্টবয় ছিল ইমরান। তার খাতাতেই বড় বড় করে স্যারের নামটি সে লিখেছিল স্বগর্বে। কিন্তু প্রথম বেঞ্চে বসার কারনে স্যারের চোখ গেলো যখন খাতায় দেখা গেলো সেখানে দু দুটো ভুল, মধ্য ণ আর দন্ত্য ন দুটো ওলট পালট হয়ে গিয়েছিল। আর যায় কোথায় স্যার সবার খাতা পরীক্ষা করতে শুরু করে দিলেন। অধিকাংশের খাতাতেই স্যারের নামের বানানের কোথাও না কোথাও ভুল ছিলোই। কেবল মাত্র সাত জন পুরো সঠিক লিখেছিল এবং সেই সাত জন প্রথম সারির ছাত্রও ছিলনা। সে কারনেই বোধহয় তাদের ভুল হয়নি, হুবুহু কপিতে তারা ছিল ওস্তাদ। আর আমি ছিলাম এক মাত্র অধম যে খাতাতে স্যারের নামই লিখিনি। এই মোট আটজন বাদে বাকী সকলকে স্যারের নাম পরের দিন এক হাজার বার লিখে জমা দেয়ার আদেশ দিলেন। আমি ভাবলাম বেঁচে গেলাম। কিন্তু ওমা! আমার শাস্তি হলো আরও ভয়াবহ, সবার খাতায় ঐ দিন স্যারের নামটি আমাকে শুদ্ধ করে লিখে দিতে হলো এবং শুধু তাই নয় পরবর্তী এক মাস প্রতিদিন ক্লাশে স্যারের নামটি বোর্ডে আমাকে লিখে রাখতে হতো যাতে কেউ আর কোনদিন এই বানান ভুল না করে। লাভের লাভ আমি বানানটি আজও শুদ্ধ করেই লিখতে পারি।
স্যার ভি কিউব নাম শুনলে নামের বেজ্জতি করার কারনে যতটা না ক্ষ্যাপার কথা তার চেয়ে বেশি ক্ষ্যাপতেন সম্ভবত শব্দ দুটি ইংরেজী হওয়ার কারনে। হয়তো ‘ভ ত্রয়’ ব্যবহার করলে উনি অতটা ক্ষ্যাপতেন না। আমরা তখনও নিজেদের মর্ডান মানে আধুনিক যুগের ইয়াং শ্রেণী মনে করতাম, সংগত কারনইে ‘ভ ত্রয়’ কেনো বলব। যদিও অধুনার ইয়ো শ্রেণীর হওয়ার মত জ্ঞান আমাদের তখন হয় নাই। সে যা হোক একদিন ভি কিউব স্যার পেছন থেকে আমাদের ক্লাশে এক ছাত্রের মুখে তার এই সংক্ষিপ্ত নামকরণ শুনে ফেললেন। তিনি রেগে মেগে অগ্নিমূর্তি ধারন করলেন। ভি কিউব স্যার দেয়াশলাইয়ের কালো মুখ ঠিক নয়, ফস করে জ্বলে তিনি ওঠেন না ঠিক বরং রসগোল্লার মত রসালো মুখেই সদা কথা বলেন, জ্ঞান দেন এবং মাঝে মাঝে কিছু ভালগার রসিকতা ছড়ানোর মতন বাক্যও আওড়ান।
কিন্তু সেদিন তিনি পুরাই ফায়ার মানে আগুন হয়েছিলেন। ছেলেটি সম্ভবত ভি কিউব বলেই ক্ষান্ত ছিলনা, স্যারকে কিংবা স্যারের ভালগারিজম নিয়ে কোন কূট কথা বলেছিল। আমদের পাঠ্য ছিল লাল সালু, সেখানে নারী দেহের একটা বর্ননা ছিল, ঐ যে নগ্ন পা দেখে মজিদের মনে উচাটন হয়েছিল, স্যার সেটাকে একটু রসিয়েছিলেন, ছেলেটা ভি কিউব নাম ধরে বন্ধুর সাথে তারই আরও একটু উর্ধ্বে উঠছিল, পা বেয়ে হয়তো হাঁটু ছাড়িয়ে আরও উপরে উঠে যাচ্ছিল-পরে আমরা তেমনই জেনেছিলাম। স্যারকে আমি রাগি বলবো না কখনই। তিনি বাংলা ভাষাকে বেশ রসে ডুবিয়ে পড়াতেন। আমরা মনে রাখতাম। রসে ডুবাতে গিয়ে কখনও কিছুটা মজা নিয়ে আসতেন। মধু সূদন দত্ত বানানটি সদাই সকলে ভুল করত। উনি বাস্তব অভিজ্ঞতার কথা বলতেন। পরীক্ষার খাতায় হর-হামেশাই ছাত্ররা নাকি সূদন কে লেখে চুদন, ছুদন, সদন, সুধন এমনকি চোদন ও; আর মধু কে মধূ, মুধু কিংবা মদু। উনি বলতেন আর বাঁকা হাসি দিতেন। সে হাসি ওনার ধবধবে সাদা পাঞ্জাবি আর ধূতি বেয়ে নেমে মেঝেতে হেঁটে হেঁটে আমাদের ঠোঁটেও এসে যেত। আমরা হাসতাম, আমরা বানানটি সেই হাসির ফাঁকে ঠিখই শিখে ফেলতাম।
স্যারেরর ক্লাশে আমাদের প্রতি স্যারের অনুরোধ ছিল যতদূর সম্ভব বাংলা সব শব্দ ব্যবহার করতে হবে আর পরিহার করতে হবে ইংরেজী বা ভিনদেশি শব্দ। তিনি বাংলার খুব কদর করতেন। ব্যাকরণে খুব ভালো দখল ছিল তার।। তিনি বলতন গরীব জাতি, টাকাও যেমন ধার করে চলে ভাষাটাও তেমন ধার করে করে দৈন্য করে তুলেছি। অথচ কোন এক বইতে পড়েছিলাম এক ভাষায় অন্য ভাষার শব্দ উড়ে উড়ে আসে, আর এসে ভাষাকে সমৃদ্ধ করে তোলে, বাংলা ভাষা তাই প্রচন্ড সমৃদ্ধ। এক ছেলে ক্লাশে উঠে সে কথা স্যার কে শুনিয়েও দিলো। স্যার বললেন, তাহলে আর ভাষা আন্দোলনের কি দরকার ছিলো, সবগুলো উর্দু শব্দ বাংলাতে ঢুকিয়ে দিলেই হতো, নামটা থাকত কেবল বাংলা। তারপর তিনি আবার নিজেই বলতেন, বাবারা উর্দুকে রক্ত দিয়ে তাড়ানো গেলেও ইংলিশকে তাড়ানো আর যাবেনা, বাংলা বর্ণগুলো একটু প্যাঁচানো তো, দুশবছর ধরে ইংরেজি শব্দ সেই সব প্যাঁচে প্যাঁচে ঢুকতে ঢুকতে বাচ্চা প্রসব করে ফেলেছে। এসব বাচ্চারা আজ তাই বাংলারই সন্তান, বাংলা শব্দ, তবুও তোরা বাংলা ক্লাশে অন্তত খাঁটি বাংলার ব্যবহার করতে চেষ্টা করিস।
তবু আমরা বাংগালীরা আজও ইংরেজীতে বড্ড কাঁচা। সারা বিশ্ব ইংরেজীর কুয়া খুঁড়ে রেখেছে, আমরা ঝপাঝপ ঝাঁপ দিচ্ছি, অধিকাংশই ডুবে যাচ্ছি, কেউ ভাসছি খুব কষ্টে সিস্টে। ইংরেজী শেখার জন্যও কোন একদিন আমাদের আন্দোলন করতে হতে পারে। না হলে এই যে পোলাপানগুলারে এত এত ইংরজেী বই গিলাচ্ছে তবুও অধিকাংশের মুখ দিয়ে প্রয়োজনের সময় আর ইংরেজী বের হয়না। ভি কিউব স্যারকে খুব জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করে- স্যার, ইংরজেী না পারুক বাংলা পারছে তো!
আসলে বাংলাও হচ্ছেনা। বাংলা এত সোজা না। কথা বলতে পারলেই ভাষা শেখা হয়ে গেলো--বিষয় এত সহজ নয়। এমনই বলতেন ভি কিউব স্যার।
স্যার অগ্নি মূর্তি ধারন করবার পর যখন ক্লাশময় দাবানল ছড়ানোর পায়তারা করছিলেন তখন টের পেলেন তার এই নাম কোন একক ছাত্র হতে উদ্ভুত হয়নাই, তা ছিল সার্বজনীন। তিনি মুচকি হাসলেন তারপর সকলকে উদ্দেশ্য করে বললেন, সকলে খাতায় লেখ কিউব এর বাংলা কি হবে? এক দু’জন বাদে সত্যি বাকীরা সেদিন লিখতে পারিনি। আমরা পারতাম না । আমরা স্যারের মুচকি হাসিটিরি রহস্যও উদ্ঘাটন করতে পারলাম না। আসলে আমরা সম্পূর্ণ পরাজিত হলাম স্যারের কাছে। স্যার বললেন, যারা বাংলা এবং ইংরেজী কোনটাই ঠিক মতো পারে না সে সব গর্দভদের ক্লাশ তিনি আর নেবেন না। সত্যি এরপর বাকী যে একটা বছর আমরা স্কুলে ছিলাম তিনি কোনদিন আমাদের কোন ক্লাশ নেননি। তিনি প্রধান শিক্ষীকাকে বলে শিফট পরিবর্তন করে নিয়েছিলেন। আমাদের তিনি বলেছিলেন, তোদের মধ্যে বিদ্যা দ্বারা প্রোদ্ভিন্ন হবার মতো কোন লক্ষ্মন নাই , তোমরা শিক্ষকের নাম বিকৃত করিস, বাংলার অপমান করিস, বিধাতা তোদের সু বুদ্ধি দেক।
কেউ কেউ ক্লাশের বেজায় খুশি হয়েছিল। ভেবেছিল যাক ব্যাটা পন্ডিত গেছে । অথচ কিছুদিন পরেই আমরা সকলেই স্যারের সেই সকল আনন্দঘন ক্লাশ খুব মিস করলাম। আমরা আজও বোধহয় সকলেই মিস করি। আমি তো করি বটেই। কারও কারও সুবুদ্ধি বিধাতা কর্তৃক প্রাপ্ত হয়েছিল বোধহয়, কারন মাত্র মাস তিনেকের মধ্যে পুরো স্কুল হতে ভি কিউব শব্দটি হারিয়ে গিয়েছিল।
দুই.
যত কষ্টই হোক সকল ছাত্র দেখতাম স্যারের নাম ভূষণপ্রিয় কিংবা ভানু স্যার বলেই ডাকত। ভট্টাচার্য বলতো না, কারন স্যার যে ভটচায্যি লিখতেন তা উচ্চারণ করা সঠিকভাবে খুবই দুষ্কর্ম ছিল।
স্যারের মত ভালো বাংলা শিক্ষক আমাদের স্কুল নয় আশেপাশের কোন স্কুলেও ছিল না। স্যারের পিতা শ্রী নিশ্চয় স্যারের জন্ম লগ্নেই বুঝতে পেরেছিলেন এই শিশু ভবিষ্যতে বাংলার পন্ডিত হবে, সে কারনেই এমন বাংলা ব্যাকরণ সমৃদ্ধ নাম রেখে থাকবেন হয়তো। শুনেছিলাম স্যারের পিতাও একজন শিক্ষক ছিলেন। আমরা তাকে কোনদিন দেখিনি।
এসএসসি পরীক্ষার মাস দুয়েক আগে অনেকেরই বাংলা ব্যাকরণ পড়ার রোগ ঢুকলো। প্রতি বছর একটা গ্রুপ এই কাজ করে। কারও কারও মনে হয় এই কাজটি না করলে তাই নিজেকে সম্পূর্ন মনে হয়না। পরীক্ষার হলে সেই অসম্পূর্ন বিষয় হৃদয় পোড়াতে থাকে। যদিও ভূষণপ্রিয় স্যার বাড়িতে ছাত্র পড়ানোর বিষয়টিতে সিদ্ধহস্ত নন, কেবল পরীক্ষার আগেই তিনি একটা দুটো ব্যাচকে একটু ফিনিশিং টাচ দিতেন, খুব বেশি টাকাও তিনি এর পারিশ্রমিক হিসাবে নিতেন না। ফলে একদলের সুবিধা হতো বাসা থেকে অন্যান্য স্যারদের চাহিদার মত টাকা নিয়ে কিয়দাংশই পকেটে ঢোকানোর।
আমিও স্যারের কাছে পড়তে চাওয়ার দলে যোগ দিলাম। কিন্তু শত চেষ্টাতেও আমাদের শ্রেণীর কোন ছাত্রকে ভূষণপ্রিয় স্যার পড়াতে সম্মত হলেন না। আমরা ব্যথিত হলেও সুবোধ ছাত্র হয়ে পরীক্ষায় ভালো ফলের আশায় প্রতিটি সূক্ষ্ম বিষয় পরিগ্রহণ করার মানসে স্যারের কাছে একদিন দলবলে গিয়ে ক্ষমাও চেয়ে নিলাম। স্যার মুচকি হাসিটি দিয়ে সেদিনও বলেছিলেন, মানুষ হ- মানুষের মত মানুষ, বাংলার গর্ব হয়ে ওঠ, তবেই আমার ক্ষমা তোদের জন্য আপনাতেই হয়ে যাবে।
সম্ভবত সেই ক্ষমা আমরা পেয়েছিলাম। স্যার মানুষ হিসেবে মধুর ছিলেন, মজার ছিলেন, নিষ্ঠাবান ছিলেন। ছাত্রদের ক্ষমা তিনি করবেন এটাও তাই সহজাত ছিল। আমি তো নিশ্চিত ক্ষমা পেয়েছিলাম। না পেলে স্যারের সেই প্রিয় শব্দ- প্রোদ্ভিন্ন আমাতে আজ প্রতিফলিত হতো না। আমি, আশ্চর্যজনক ভাবে ক্লাশের খুবই স্বল্প মেধাবী ছাত্রটি, আজ প্রোদ্ভিন্ন হয়েছি, আমি একজন জনপ্রিয় গল্পকার হয়েছি, সাহিত্য জগতে আমার প্রোদ্ভিন্ন হওয়ার পেছেনে স্যারের প্রতিটি ক্লাশ আমার জন্য সর্বোত্তম পাথেয় আমি বিনা দ্বিধায় মেনে নিতে পারি । কিন্তু সেই প্রিয় স্যারের নামে দুই দুটি বই উৎসর্গ করেও স্যারকে আমি একটিও প্রদান করতে পারিনি। আমি স্যারের নামের বানান শুদ্ধ করেই লিখেছিলাম। আমি স্যারকে খুঁজে বেড়াই। স্যারের ঠিকানা হারিয়ে ফেলেছি। চাকুরী শেষে স্যার কোথায় চলে গেছেন স্কুলে গিয়েও কোন হদিস করতে পারিনি ।
কেউ বলতে পারল না। জানতাম স্যারের দুটি ছেলে ছিল। বড় ছেলেটির নাম ছিল নিখিলপ্রিয়, সে তখন ডাক্তারি পড়ত। বিনয়প্রিয় ছিল ছোট ছেলে, আমাদের স্কুলেই আমাদের এক ক্লাশ নিচে পড়ত। সেই ছেলেকে খোঁজার চেষ্টা করলাম। পেলাম না। আমি বেদনায় ভারাক্রান্ত হলাম । যে শিক্ষকের সেই প্রোদ্ভিন্ন শব্দটি আমি ধারণ করেছিলাম। আমার মত সাধারণ মানের একটা ছাত্র বিদ্বান বলে ভূষিত হয়েছি, বিসিএস দিয়ে একখানা সরকারী কলেজের আমি বাংলার শিক্ষকও হয়েছি সেই শিক্ষককে আমি মরবার আগে আরেকবার কি দেখা পাবো না?
সম্প্র্রতি আমি ’প্রোদ্ভিন্ন’ নামে একটি উপন্যাসও লিখছি। উপন্যাসটিতে স্যারের হাতে লেখা দু লাইন বক্তব্য আমার বড্ড কাম্য। স্যারকে আমার ভীষণ প্রয়োজন। স্যারের সেই কথাগুলো কতটা জ্ঞান গর্ভ এবং রসবোধকও বটে। মনে পড়ে স্যার বলেছিলেন, এই তোরা কেউ প্রোদ্ভিন্ন শব্দটা জানিস? কেউ উত্তর কি দেবো, মুচকি মুচকি হাসছিলাম। উনি বুঝেছিলেন। বলেছিলেন, প্রো প্রোদ, আবার পোদ ভেবে কেউ ভিন্ন মোর নিস না। পোদ ভিন্ন না, এটা কিন্তু প্রোদ্ভিন্ন। জীবনে প্রোদ্ভিন্ন হও। বিকশিত হও। ফুলের মত বিকশিত হও, প্রস্ফুটিত হও, পরের অনুকরণ নয়, নিজের সংস্কৃতি নিজের ভাষায় নিজেকে সমৃদ্ধ করো, সরাা পৃথিবী পায়ে লুটাবে তবেই।
...কিন্তু আমি ভটচায্যি স্যারকে আরেকবার ভি কিউব বলে ডাকতে চাই, বলতে চাই স্যার ইংরজেী আর হিন্দী আমাদের গিলে ধরেছে। ছোট ছেলেমেয়েরা ‘তুমারা নাম কেয়া হ্যায়’ শেখে আগে পরে শেখে ‘তোমার নাম কি’। আর ইংরেজী-ও না জানলে যে সকল বিদ্যা বৃথা। আমদের অনেক শক্ত খোলস বিদীর্ণ করে বের হতে হবে আলোতে, আমাদের স্যারের সেই প্রিয় শব্দ প্রোদ্ভিন্ন হতে হবে।
তিন.
আমার প্রোদ্ভিন্ন উপন্যাস লেখা শেষের পথে। স্যারকে এখনও খুঁজে পাইনি। আমি নানান ভাবে খোঁজ লাগিয়েছি। স্যারের একটি মেয়েও ছিল , সে সম্পর্কিত তথ্য অবশ্য খুব একটা আমার কাছে নেই। মেয়েটা সবার বড় না ছোট তাও জানতাম না।
হঠাৎ একদিন একটা নিমন্ত্রণ পেলাম। বাংলাদেশে থেকে একটা সাহিত্যিকদল আমেরিকায় একটা সম্মেলনে যাবে। ১২ জনের সে দলে আমার নামটা দেখে অভিভূত হলেও ভাবতে ভুললাম না, এ আমার যোগ্যতা নয় বরংআমার এক রাজনীতিবীদ সহপাঠীর দয়া । সেও সেই স্যারেরই ছাত্র। সেই ভি কিউব নাম বলে ধরা পড়া সেই ছাত্র। মূলত তার কারণেই স্যার আার আমাদের ক্লাশ আর নেন নি। ছেলেটা আমাকে খুব ভালবাসে। এ তার ভালবাসার নিদর্শন। আমি নিদর্শন পরিত্যাগ করি না। এতটা অহমিকা এ যুগের বাস্তবতায় লেখকদেরও মানায় না। আমি আমাতেও মানালাম না। আমি আমেরিকায় চলে গেলাম রাষ্ট্রীয় খরচে দিন পনেরর জন্য ।
একদিন বিকেলে নিউওয়ার্কেও রাস্তার অনেকক্ষণ ধরে একা একা হাঁটছিলাম। তারপর ক্লান্ত হয়ে পার্ক থেকে বেরিয়ে কাছের একটা শপিং ষ্টোরে ঢুকেছিলাম এক বোতল পানি কিনবো বলে। পানি নিয়ে বোতলের মুখ খুলতে যাব ঠিক সে সময় কানে আসল সেই শব্দটা... সেই ‘ভি কিউব’। কে যেন কাকে ডাকল - মিঃ ভি কিউব। আমি এগিয়ে গেলাম। চেহারাই বলে দিচ্ছিল উনি বাঙ্গালী। যদিও মুখের একটা বড় অংশ সাদা দাঁড়িতে ঢাকা পড়ে ছিল। আমি আরেকটু আগালাম তারপর আর আমার চিনতে একটুও কষ্ট হলো না। এ আমার সেই ভূষণপ্রিয় ভানু ভটচায্যি, এ সেই প্রিয় ভি কিউব স্যার।
আমি এগিয়ে গেলাম। উনি দোকানের ক্যাশে বসে ছিলেন। আমি আরও কাছে গিয়ে বললাম, স্যার একটু শুনবেন। উনি তাকালেন। আমি আবার বললাম, স্যার আমি কিউব অর্থ এখন জানি, আপনি কি আমার ক্লাশ নেবেন এখন।
উনি উঠে আসলেন। সত্যি কাছে এসে জড়িয়ে ধরলেন। বললেন, তুমি কী সেই ব্যাচ?
আমি মাথা নাড়ালাম। ওনার চোখ ছলছল করে উঠল। আমি বললাম, সার আপনি এখানে?
সে সব তো অনেক কথা। অনেক বেদনার, অনেক কষ্টের, সো মাস ট্রাজিক। ভি কিউব... না, ভি কিউব! দেখো আজ কপালে এ নামই জুটেছে। তোমাদের শাস্তি দেয়ার অভিশাপ! এরা আমার নামের সুন্দর বাংলা শব্দগুলো উচ্চারণ করতে পারে না। তিনটি ভি.. তোমরাইতো দিয়েছিলে। তোমরাই কত এগিয়ে ছিলে আসলে।
না স্যার। আমরা তো দুষ্টুমী করেই দিয়েছিলাম। আমাদের শাস্তি প্রাপ্য ছিলো। স্যার, আপনার মুখে কতদিন তুই ডাক শুনিনা, তুমি বাদে ওটাই ...
আরে দূর , তোমরা আজ কত বড় হয়ে উঠেছ, সো মাচ টাইম অলরেডি পাসড, ভুলে যাও ওসব দিন। আর তোমাদের আসলে ভুল ছিলনা। এখন মনে হয় আমিই ভুল করেছি। পদে পদে ভুল করেছি। বাস্তবতা বড্ড কঠিন। তা তুমি কি এখানে থাক নাকি?
না স্যার, কেমনে যে বলি আপনাকে, বিষয়টা হাস্যকর। আমি আসলে, আসলে স্যার আমি একজন লেখক হয়েছি। একটা লেখক সম্মেলনের নিমন্ত্রণে আমার এখানে আসা।
শুনে খুব খুশি হলাম। আমি তো বাংলাকে আঁকড়ে থাকতে পারলাম না। শুনে খুব খুশি হলাম।...
...তারপর সেদিন আর বেশি কথা বলা হয়নি। স্যারের কষ্টের কথা শোনা হয়নি। আমার তাড়া ছিল। স্যারের ডিউটি ছিল। আমি আবার আসব বলে বিদায় নিয়ে চলে এসেছিলাম।
স্যারের কাছে আবার চলে গেলাম একদিন পরেই। স্যুটকেসে কোন এক অজানা কারনে আমি স্যারকে উৎসর্গ করা দুটো বই ই রাখতাম। একটা পেলোম না । কাউকে দিয়েছি মনে হয়। মনে করতে পারলাম না। অন্যটা এবং পোদ্ভিন্ন উপন্যাসটার পান্ডুলিপি নিলাম সাথে।
স্যার খুব খুশি হলেন। প্রোদ্ভিন্ন উপন্যাসটি হাতে নিয়ে নেড়ে চেড়ে কয়েক পাতা পড়লেন। তার পর সবচেয়ে আশ্চর্যজনক ভাবে যে কথাটি বললেন সেটি শুনে আমি জীবনে সবচেয়ে বিস্মিত হলাম। বললেন, দেখো অনেকদিন বাংলা চর্চা করি না। বই টইও পড়া হয়ে ওঠে না। এই প্রোদ্ভিন্ন শব্দটার অর্থ ঠিক মনে করতে পারছিনা। অর্থটা টা কি যেন?
আমি বললাম, স্যার লজ্জা দিচ্ছেন।
উনি মাথা নাড়ালেন। বললেন, না সত্যি ভুলে গেছি।
আমি বললাম স্যার শব্দটার শাব্দিক অর্থ বিদীর্ণ করে উদগত, প্রস্ফুটিত, বিকশিত ।
স্যার কিছু একটা ভাবছিলেন। বললাম, স্যার কি ভাবছেন।
শব্দটির ইংরেজী কি হবে ভাবছি? বাসায় আমার নাতিনটাকে তোমার কথা বলেছিলাম, ওতো বাংলা পারেনা। ওকে ইংরেজীতে শব্দটা বুঝাতে হবে...
আমি সেদিনের মত বিদায় নিতে নিতে বললাম স্যার, ওকে বলবেন এটার কোন ইংরেজী নেই।
চার.
স্যারের কাছে দু লাইন ভূমিকা চাওয়ার সাহস সঞ্চয় করতে পারিছিলাম না। মনে মনে স্যারের এই অবস্থার কারণ জানারও খুব ইচ্ছে জাগ্রত হচ্ছিল। আমেরিকা ত্যাগ করার আগের দিন সন্ধ্যায় স্যারের সাথে শেষ বার দেখা করতে যাব বলে একটা সময় করে নিলাম। দোকানে পেলাম না। ডিউটি ছিলনা। সম্ভবত ছুটি নিয়েছিলেন।
ঠিকানা নিয়ে বাসায় গিয়ে হাজির হলাম। জানলাম ওনার বড় ছেলে ডঃ বিনয়প্রিয় আর তার ফ্যামিলির সাথে উনি এখানে থাকেন। বড় ছেলে অনেক আগেই আমেরিকা এসেছে, ডিভি পেয়েছিল। অনেক বছর কষ্ট করে বর্তমানে ডাক্তারী করার লাইসেন্স সে পেয়েছে। অবস্থা এখন খুব একটা খারাপ বলা যাবে না। স্যারকে সে কাজ করতে মানা করেছিল। স্যার শোনেনি। শুনলাম স্যার বিছানায় শুয়ে আছেন। গতকাল সকালে স্যারের একটা মাইল্ড হার্ট এট্যাক হয়েছিল।
স্যারের স্ত্রী গত হয়েছেন আরও বছর পাঁচেক আগেই। তখন স্যার দেশেই ছিলেন। স্ত্রী মারা যাবার কয়েকমাস পরেই স্যার আমেরিকা এসেছেন। আমি নিখলদার কাছ থেকে এসব জানতে জানতে আরও জিজ্ঞেস করলাম আপনার ছোট ভাই কোথায়, একজন বোনও ছিল আপনার? বললাম, আপনার ছোট ভাই বিনয়কে আমরা চিনতাম। আমাদের জুনিয়র ছাত্র।
তারপর যা শুনলাম তা না শুনলেই ভাল হতো। বিনয় নাকি খুন হয়েছিল। ভার্সিটিতে পড়ার সময় বিনয় সক্রিয় রাজনীতিতে যুক্ত হয়ে পড়ে। একটি প্রধান দলের লেজুর ছাত্র সংগঠন ছিল সেটা। স্যাররা যে এলাকায় বসবাস করতেন সে এলাকায় কমিশনারও একই দলের নির্বাচিত ছিলো। স্যারদের ওটা চৌদ্দ পুরষের ভিটে। পুরাতন ঢাকার এক বনেদী হিন্দু পরিবার ছিল স্যারদের।
এলকার কমিশনার এলাকায় ২১শে ফ্রেব্রুয়ারী উপলক্ষ্যে একটি শহীদ মিনার তৈরী করতে চেয়েছিলেন। সরকারের কাছ থেকে টাকাও পেয়েছিলেন। ঐ শহীদ মিনার নিয়ে শুরু হয় ঐ দলের দুই মহল্লার দুই গ্রুপের রেষারেষি। এক মহল্লায় বিনয় থাকে, সে ভার্সিটিতে রাজনীতি করত, শিক্ষকের ছেলে, তার উপর আরও বড় পরিচয় ছিল তার দাদা বায়ান্নর ভাষা সৈনিক ছিলেন। তাদের মহল্লার মুখে একটা ফাঁকা জায়গা ছিল, ওখানেই বানানোর পরিকল্পনা হচ্ছিল। কিন্তু অন্য গ্রুপ চাচ্ছিল এদুটো গলি পরে যে প্রাইমারি স্কুল কমিশনারের মায়ের নামে সেখানেই হবে। সামান্য বিষয়, কমিশনার নিজেই সমাধান করে দিতে পারতেন। কিন্তু দফায় দফায় এই নিয়ে এ মহল্লা আর ও মহল্লা অস্ত্রের শো ডাউন দিতে লাগল। একদিন শো ডাউন আর ডাউন থাকল না, সত্যি সত্যি রক্তারক্তি হয়ে গেলো। বিনয়ের মাথায় একটা কোঁপ লেগেছিল। হাসপাতালে বেঁচেছিল মাত্র তিনদিন। তারপর প্রাণবায়ু চলে গেলো। কিন্তু পরবর্তীতে পুলিশের চার্জশীটে ঘটনা যা লেখা হয়েছিল তাতে ভূষনপ্রিয় স্যারের যতটুকু সম্মান টিকে ছিল সেটাও গেলো। বিনয় নাকি একটা মেয়েকে উঠিয়ে নিয়ে গিয়েছিল, ধর্ষণের চেষ্টা করেছিল। সে টা নিয়ে মেয়েটার মহল্লার রাজনৈতিক ছত্র ছায়ায় লালিত ছেলেদের সাথে গন্ডগোল, তারা মেয়েটাকে উদ্ধার করতে গিয়েই তার সাথে হাতাহাতি আর বাঁশের আঘাতে মাথা ফেটে যায়। মরেও বেচারা দূর্ণামের ভাগি হয়ে থাকল। অথচ যে মেয়ে স্বাক্ষী হলো তারাও একই গোত্রের , তারাও হিন্দু ছিল, তারাও সংখ্যা লঘুই ছিল, মেয়েটার সাথে বিনয়ের অনেকদিনের প্রেমও ছিল বলে নিখিলদা জানাল।
এসব শুনে খুব কষ্ট পেলাম। বিচার তো স্যার দারে দারে ধরনা দিয়ে পেলেন ই না বরং হুমকি দেয়া হচ্ছিল। নিখিলদা তখন আমেরিকায়, বারবার স্যারকে নিয়ে যেতে চাচ্ছিলেন। স্যারের স্ত্রী ও তখন পুত্র শোকে বিয়োগ হলেন। স্যারদের প্রতি বিপরীত গ্রুপের আক্রোশ বাড়ছিল। স্যারের পৈত্রিক বাড়িটা তারা হরপ করতে উদ্যগ হয়েছিল। ঘটনা এতই জটিল হয়ে উঠেছিল যে স্যারর এক ভাইয়ের মেয়েকেও ধরে নিয়ে ধর্ষণ করা হলো। সংখ্যা গুরুদেরই বিচার সম্পন্ন হয়না আর তারাতো সংখ্যা লঘু। বিচারও মনে হয় ক্ষমতা আর টাকার কাছে দূর্বল হয়ে উঠেছে। স্যারের সে ভাই মুখ লুকাতে মেয়ে আর পরিবার নিয়ে ওপারে ইন্ডিয়ার চলে গেছেন, স্যারের মেয়েটার অনেক আগেই এক বিদেশ প্রবাসীর সাথে বিয়ে হয়েছিল। অষ্ট্রেলিয়াতে সে ভালোই আছে। স্যারও বাধ্য হলেন। জমি বাড়ি যাক, সম্মানটুকু আর জীবনটা যদি থাকে, বড় ছেলের কথা আর ফেল্লেন না, পাড়ি দিলেন পরাজিত শিক্ষক আমেরিকায়।
পাড়ি দেয়ার সময় হয়তো বাংলা ভাষা প্রীতিটা ফেলে গিয়েছিলেন ঢাকার বাসায়। স্যারের ঘরে ঢুকেলাম নিখিলদার সাথে কথা শেষে। খুব অসুস্থ। বললাম, স্যার কেমন আছেন?
বললেন, আজ ভালো। কাল তো হঠাৎ পড়েই গেলাম রাস্তার মধ্যে। বিনয়ের কথা খুব মনে পড়ছিল তখন। ছেলেটা রক্তাক্ত অবস্থায় চিৎকার করছিল, বাঁচাও, সাহায্য কর। কেউ ধরতে আসছিলনা। আমরা খবর পেয়ে যেতে যেতে অনেক রক্ত ক্ষরণ হয়েছিল। না হলে হয়তো বাঁচানো যেত। আর দেখ, কাল এই ভিনদেশে, বিজাতির দেশে আমি কেবল মুখ দিয়ে একবার উচ্চারণ করতে পেরেছিলাম- হেল্প মি। হেল্প করার লোকের অভাব হয়নি। দ্রুত এমবুলেন্স হাজির হয়ে গিয়েছিল, নিয়ে গেলো হাসপাতালে। আমাদের ভাষা ছিনিয়ে নিতে হয়েছে রক্ত দিয়ে, দেশটাও স্বাধীন করতে রক্ত দিতে হয়েছে, সভ্যতা অর্জন করতেও আর যে কত রক্ত দিতে হবে, কত রক্ত !
খুব আফসোস করছিলেন স্যার। আমেরিকার সে বাসায় স্যারের বিছানা পাশে দেয়ালে একটা সাদাকালো ছবি টানানো দেখে জিজ্ঞেস করেছিলাম, স্যার ঐ ছবিটা?
জানলাম ওটা স্যারের বাবার, ৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের সময়কার ছবি। সেদিন সেই ১৪৪ ধারা ভঙ্গের মিছিলে তিনিও ছিলেন। পরে মুক্তিযুদ্ধেও গিয়েছিলেন স্যারের বাবা এবং শহীদ হয়েছিলেন।
আমি ব্যথিত হৃদয়ে বিদায় নিলাম। স্যারের পায়ের ধুলো নিলাম। স্যারকে এক কপি ‘প্রোদ্ভিন্ন’ পাঠিয়ে দেবো কথা দিয়ে চলে আসতে বাধ্য হলাম। গভীর রাতেই বিমানে উঠতে হবে, ফিরে যেতে হবে নিজে দেশে বাংলার মাঝে যেখানে ভাষা পেয়েছি, দেশ পেয়েছি কিন্তু প্রোদ্ভিন্ন হবার মত মন আমরা আজও পেলাম না।