এক.
প্রায় পনের মিনিট হয়ে গেছে আমি আর মিহির ভাই গোয়েন্দা বিভাগের অফিসে বসে আছি।
এ নতুন কিছু নয়। গোয়েন্দা বিভাগের অফিসার মহব্বত আমিনের অফিসে মিহির ভাইয়ের সাথে এর আগে আরও অনেকবারই আসতে হয়েছে। প্রতিবারই এই অপেক্ষার বিষয়টি ঘটেছে। আমি বিরক্ত হয়েছি। মনে হয়েছে মহব্বত সাহেব আমাদের দুজনকে ইচ্ছে করেই এই অপেক্ষাজনিত কষ্টে ভোগান। কোথায় যেন একটা মানসিক ইনফিরিওরিটি কাজ করে লোকটার মনে।কিন্তু মিহির ভাইয়ের মাঝে কোন বিরক্তি নেই। উনি চুপচাপ এই অপেক্ষার ক্ষণে ভাবতে থাকেন।ওনার ভাব দেখে মনে হয় এই সময় টুকই যেন তার ভীষণ আরাধ্য। অফিসারের টেবিলে বরাবরই খবরের কাগজ পাওয়া যায়। তাও একটা নয়, বেশ কয়েকটা। আমি একটা নিয়ে চোখ বোলানোর চেষ্টা করি। মিহির ভাই ভাবতেই থাকেন। আজ অবশ্য ভাবনার মাঝে ডুবে যাবার আগে আমাকে বললেন,নিমিখ মাউসটা একটু হালকা নাড়া দেতো।
হাতটা বাড়িয়ে মহব্বত সাহেবের বসার চেয়ারটার বাম পাশে রাখা পিসিটার সামনে মুথ থুবড়ে পড়ে থাকা মাউসটা একটু নাড়া দিলাম। এলসিডি মনিটরটির কালো স্ক্রীণ ধীরে ধীরে আলোয় ভরে উঠল। আমরা তাকালাম। ভেসে উঠল একটা ওয়েব পেজের সাইন ইন উইন্ডো। চিনলাম, একটা ব্লগ সাইট। আমার নিজেরও সেখানে একটা আইডি আছে। ডাব্লিউডাব্লিউডাব্লিউ.এভরিহয়্যার ব্লগ.কম। মিহির ভাই পকেট থেকে মোবাইল ফোনটা বের করে নোট অপশনে কিছু একটা টুকে নিলেন। ডিজিটাইজড টোকা যাকে বলে। টোকা শেষ করেই আমকে চুপচাপ পেপার পড়ায় মনোযোগ দিতে বললেন।
কিন্তু আমার মনে অন্য ভাবনা। মহব্বত সাহেব সরকারী গোয়েন্দা। যদি এসে মনিটরে ডিসপ্লে দেখে বুঝে যান সেখানে হাত দেয়া হযেছে! মিহির ভাইকে বলেও ফেলি, ভাই যদি মহব্বত সাহেব এসে দেখে ফেলে... মুখের কথা কেড়ে নিয়ে মিহির ভাই বললেন, আমরা প্রাইভেট গোয়েন্দা, আত্মবিশ্বাসটা আমাদের একটু বেশি থাকাটাই কি ভালো নয়?
মিহির ভাইয়ের আত্মবিশ্বাস যথার্থ প্রমাণিত হলো। মহব্বত সাহেব রুমে ঢুকে বরাবরের মত ‘দুঃখিত মিঃ মিহির, আপনদের অনেকক্ষন বসিয়ে রাখতে হলো’...টাইপ সরি টরি বলতে শুরু করার খানিক আগেই স্ক্রীন আবার কালো কৃষ্ণ গহ্বর হয়ে গেছে। সেখানের আবছা আয়নায় ফুটে ওঠা মিহির ভাইয়ের নির্লিপ্ত মুখটা দেখতে পাচ্ছি খুবই স্পষ্ট।
দুই.
মহব্বত সাহেবের হাতে একটা ল্যাপটপ। খোলা অবস্থায় রয়েছে। সেটা নিয়ে বসতে বসতে আমাদের দিকে এগিয়ে দিলেন। বললেন, মিঃ মিহির এভরিহয়্যার ব্লগ.কম এর এই আর্টিকেলটা পড়ুন।
মিহির ভাই চোখ বুলাচ্ছেন। পাশ থেকে আমিও পড়তে লাগলাম।
লেখাটির শিরোনাম-‘ভাষা আন্দোলন, একুশে ফেব্রুয়ারি ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস এবং ইউনেস্কোর ওয়েবপেইজ’; মামুন আজিজ নামে একটি আইডি থেকে লেখা হয়েছে।
বেশ গুছিয়ে লেখা। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের গৌরবময় সেই অতীত ইতিহাসের সামান্য বর্ননা দিয়ে সূচনা করা হয়েছে। তারপর সরাসরি বাংঙ্গালী জাতির অমর একুশে ফেব্রুয়ারীর দিনটিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘোষনার পেছনের ইতিহাসের মূল বক্তব্যে চলে গেছেন লেখক। ...‘কানাডার ভ্যানকুভার শহরে বসবাসরত দুই বাঙ্গালী রফিকুল ইসলাম এবং আবদুস সালাম প্রাথমিক উদ্যোক্তা দিসেবে একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণার আবেদন জানিয়েছিলেন জাতিসংঘের মহাসচিব কফি আনানের কাছে ১৯৯৮ সালে। ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর অনুষ্ঠিত ইউনেস্কোর প্যারিস অধিবেশনে একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয় এবং ২০০০ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি থেকে দিবসটি জাতিসংঘের সদস্যদেশসমূহে যথাযথ মর্যাদায় পালিত হচ্ছে।’
২১শে ফেব্রুয়ারীকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘোষনা করা হয়েছে জানি, কিন্তু এই উদ্যেক্তাদ্বয়ের নাম তো আমি জানতামই না। ছিঃ ছিঃ! আমি তুখোড় গোয়েন্দা মিহির ভাইয়ের অঘোষিত সহযোগী। আমার তো এত তথ্যহীন থাকা ঠিক হয়নি! বাকীটুকু পড়তে শুরু করলাম। মিহির ভাই নীরবে পড়ে যাচ্ছেন। তার ভ্রুর দিকে তাকালাম। এখনও দুই ভ্রুর মাঝে কুঞ্চন দৃষ্টিগোচর হলোনা। তারমানে হলো খট্কা লাগার মত কোন বিষয় এখনও তার চোখে পড়েনি।
লেখক শেষের অংশে জাতিসংঘের ওয়েবসাইটে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের আলোকাত নিয়ে আলাদা যে ওয়েবপেজ রয়েছে তার প্রথম পাতার ভূমিকাংশের পুরোটা বাংলায় অনুবাদ করেছেন। ওয়েবসাইটার লিংকটি হলো- http://www.un.org/en/events/motherlanguageday/
ইউনেস্কোর মহা-পরিচালক ইরানা বোকাভোর বাণী দিয়ে শুরু হয়েছে ওয়েবপেইজটা ।
‘মাতৃভাষার জাগরণে তথ্য এবং যোগাযোগ প্রযুক্তি বিশেষভাবে ব্যবহার করা যেতে পারে। বিশ্বের স্থানান্তরিকরণ লক্ষ্যমাত্রা রক্ষায় এবং জ্ঞানের সকল উৎস এবং প্রকাশের সকল রূপের জাগরণে উন্নয়নের সকল শক্তিকে সংঘবদ্ধ করতে হবে। এগুলোই সেই সূতো যা মানবতার কারুকার্য বুনবে।’ ---ইরিনা বোকোভা, ইউনেস্কোর মহা-পরিচালক। আন্তর্জাাতিক মাতৃভাষা দিবস ২০১১ এর বাণী।’
উপসংহারে লেখক লিখেছেন-‘দুঃখের বিষয়, যে বাংলা ভাষার ঐতিহ্যময় আন্দোলনের দিনটিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস করা হয়েছে সেই ভাষাতেই ওয়েবসাইটটি পড়া যায়না , যদিও ইংরেজী, রাশিয়ান, ফ্রেঞ্চ, স্পেনিস , আরবী , চাইনীজ ইত্যাদি ভাষায় ওয়েবসাইটটি পড়া যায় ঠিকই। তবুও আমরা ভীষণ গর্বিত নিঃসন্দেহে।’
লেখার উপসংহার থেকে ব্লগ পোষ্টটির আসল উদ্দেশ্য বোঝা গেলো। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস নিয়ে তৈরী জাতিসংঘের ঐ সাইটটি মোট ছয়টি ভাষায় লেখা। ইংরেজী ছাড়াও রাশিয়ান, স্পেনিশ, আরবী, চাইনীজ এবং ফ্রেঞ্চ ভাষায় কনভার্ট করে পড়ার ব্যবস্থা রয়েছে। কিন্তু যে বাংলা ভাষার ঐতিহ্যময় এবং অনন্য ভাষা আন্দেলনের অমর দিনটিকে উপজীব্য করে মাতৃভাষা দিবস ঘোষনা করা হয়েছে এবং যে কথার গুনকীর্তনও করা হয়েছে সাইটে সেখানে বাংলা ভাষারই অবহেলা। লেখকের এই বিষয়টির প্রতি ব্লগে আলোকপাত সত্যিই প্রশংসনীয় । কিন্তু এই আলোকপাত নিয়েই কি কোন সমস্যা? সে কারনেই কি ডেকেছেন মহব্বত আমিন?
মিহির ভাইয়েরও মূল লেখা পড়া শেষ। স্ক্রোল করে তিনি এখন নিচের মন্তব্য গুলো পড়ছেন। মন্তব্য পড়তে ইচ্ছে করছেনা। ভাইয়ের ভ্রুর দিকে তাকাতেই এবার ভাঁজ দেখলাম। হুম মন্তব্যটা সত্যিই মারাত্মক ...
‘বাংলা ভাষা নিয়ে দাবী দাব- আবার! মুসলমান জাতি , আরবী ভাষায় তো সাইট পড়াই যায়, বাংলা ভাষা কয়জন বোঝে, এত মাথাব্যথা কেনো...বুঝবা একুশ তারিখে যখন শহীদ মিনার চত্বরে বোমার ফুল ফুটবো , সেদিন বুঝবা তোমার আত্ম দাবী কেমনে আত্ম ছিদ্রদিয়ে প্রবেশ করব। ...
মন্তব্যটি যে আইডি থেকে করা হয়েছে সেটার নামটা কিন্তু বেশ,‘পিস লাভার’।নামটা জানি কোথায় দেখলাম?
তিন.
মিহির ভাই ল্যাপটপ থেকে চোখ সরালেন। ভ্রুর মাঝ ভাঁজ আর নেই। বরং মুখে হাসি। রহস্য সমাধান করার পর ঠিক এমনতর হাসি আমি দেখেছি ওনার ঠোঁটে অনেকবার। খুব সীমিত। অচেনা লোক প্রথম চাউনিতে সে হাসি ঠাওর ধরতে পারেবনা। আমি পারলাম।
মহব্বত সাহেব একটা বেনসন ধরিয়ে আয়েস করে পেপারে চোখ বুলাচ্ছিলেন। মিহির ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন , সিগারেট চলবে, নাকি একা একা সিগারেট খাওয়ার পুরনো অভ্যাসেই আছেন?
মিহির ভাই সে কথার জবাব না দিয়ে মহব্বত সাহেবের দিকে ফিলে বললেন, সম্ভবত এই মন্তব্যটিই আপনি দেখাতে চেয়েছেন?
হুম মিঃ পথিক, ঠিক ধরেছেন।
ব্লগে এমন নানান উট্কো মন্তব্য যে কেউ করতেই পারে। সেটা আপনাদের বিচলিত করছে কি কারনে?
না ঠিক বিচলিত নয়, ভাবনা বেড়েছে। আসলে একুশে ফেব্রুয়ারী বোমা বিস্ফোরণ হতে পারে এমন তথ্য আমাদের কাছে এসেছে।
হুম! এ তো গদবাধা তথ্য। বড়জোড় সতর্কতা অবলম্বনটা জোরদার হয় এতে। আমাকে যদি তথ্য দিতে বলা হতো আমিও বলতাম একদল পরিকল্পনা করছে। উগ্রবাদীর সংখ্যা এত বেশি যে...
আহ নিমিখ! চুপ কর, মহব্বত সাহেবকে বলতে দে।
হ্যাঁ যা বলছিলাম। একেতো খবরগুলোর পেছনে কোন উগ্রবাদীরা আছে, তাদের ট্রেস করা যাচ্ছেনা। তার উপর এই মন্তব্য। শুধু তাইনা। এই মন্তব্যের নিচে দেখেন এর স্বপক্ষে আরও গোটা দশেক ছদ্ম আইডিও সমর্থন করে গেছে। নিচে দেখেন। এই একটা কমেন্টের সূত্র ধরে আরও কয়েকটা ব্লগেও পতিক্রিয়া মূলক পোষ্ট হয়েছে। ফেসবুকেও আলোচনা হয়েছে। সেখানেও উগ্রবাদীদের তৈরী ছদ্ম আইডি একুশে ফেব্রুয়ারী নিয়ে বিরূপ মন্তব্য করে গেছে। এদিন বলে বাঙ্গালীর পুজোর দিন-কি ভয়াবহ কথা ভাবুন মিঃ পথিক। বিগত কয়েক বছরে ব্লগ বিষয়টা জনপ্রিয় হবার পরে ভার্চুয়াল এ জগতেও উগ্রবাদী বা জঙ্গীবাদীরা সমানে জাল বিছিয়ে ফেলেছে। আবার ছদ্ম নাম ব্যবহার করার অপ্রতিরোধ্য সুযোগ থাকায় দেখা যাচ্ছে একই মানুষ ঠিক সেই ‘ডক্টর হাইড এন্ড জ্যাকিল’ এর মত নিজেই দ্বৈত ভুমিকয়া অবতীর্ণ হচ্ছে। মামুন আজিজ নামে যে ব্যক্তি এই পোষ্টটি দিয়েছে। দেখা যাবে সেই হয়তো তার পোষ্টকে জনপ্রিয় করার উদ্দেশ্যে নিজে বক্তব্যের বিরুদ্ধে নিজেরই আরেক ছদ্ম আইডি দিযে মন্তব্য করছে। আসলে বাস্তব জগতের চেয়েও এই সাইবার জগতের ক্রাইম বেশ জটিল। গোযেন্দাদের জন্য ফিল্ড আরও বাড়ল, গোযেন্দাগিরির টেকনিকেও পরিবর্তন আনতে হবে। শালর্কহোমস, ফেলুদার মত বসে বসে বুদ্ধি খরচ করলে ভাবলেই সমাধান হবেনা। গোয়েন্দাকেও ওয়েব স্পেশালিস্ট হতে হবে। নতুন করে সব ভাবতে হবে। সাইবার ক্রাইম বিষয়টা ধীরে ধীরে একটা বড় ভাবনার বিষয় হয়ে উঠেছে।
তা আমাদের কি ওয়েব গোয়েন্দা বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেয়ার জন্য ডেকেছেন নাকি?...
মিহির ভাই আবারও আমাকে থামিয়ে দিয়ে নিজে বলা শুরু করলেন, মহব্বত সাহেব, আপনি যে মামুন আজিজ বা অন্য আইডি গুলোর আইপি ট্রেস করার চেষ্টা করেননি সেটা নিশ্চয় বলবেন না। এবং নিশ্চিত ফেক আউডিগুলো বেশির ভাগ দেশের বাইরের কোথাকার। সে সব কারনে ডাকেন নি সেটা নিশ্চত কিন্তু এতক্ষন আলোচনায় পরও এখনও মূল বিষয়টা আপনি আনেননি। এত দেরি করে মূল বিষয় ঢোকার মানুষ কিন্তু আপনি নন।
ওহ! নো মাই ডিয়ার জিনিয়াস ডিটেকটিভ। আমি সেদিকেই যাচ্ছি। মামুন আজিজ এবং অন্যান্য আইপিগুলো ট্রেস করেছি। মামুন আজিজ রিপোর্টারের চাকুরী করে। ফোনে কথা হয়েছে। বেচারা খুবই সাধারণ দেশপ্রেমিক টাইপ একটা ছেলে। বাকী আইডিগুলোর বেশির ভাগই বাইরের। দুএকটা তো ট্রেসই করা যায়না। ব্লগ সাইটটির মডারেটরের সাথে কথা বলেছি। পিস লাভার আইডির কমেন্টটা তারা মুছে দিতে চেয়েছিল। আমি মানা করেছি। কারনে এটাকে কেন্দ্র করেই অনেক তথ্য পাচ্ছি। মডারেটর আমাকে নিশ্চিতও করেছে এটা দেশেরে ভেতরেরই কারও আইডি ।
আমি বললাম, মহব্বত সাহেব তাহলে আইএসপি কোনটার আইপি সেটা সে ব্যবহার করে সেটা ট্রেস করে তাকে ধরছেন না কেনো?
নিমিখ তুমি মুল পয়েন্টেই এসেছো। খেয়াল করেছে এইসব নিয়ে পত্র পত্রিকায় কোন খবর কিন্তু আসেনি। সেটাও আমাদের এখান থেকে বন্ধ করিয়েছি। আসলে আইপি ট্রেসে যা জানা গেছে তাতে আইপিটি ব্যবহার করে একজন ফরেনার। লোকটির নাম জাবির হাইনান। মধ্য প্রাচ্যের কোন দেশের থেকে এসেছেন। সম্ভবত তুরষ্ক। সাউথ নর্থ ইউনিভার্সটিতে বর্তমানে শিক্ষক হিসেবে পড়াচ্ছেন। এই লোকটার উদ্দেশ্য কি সেটাই বুঝতে পারছিনা।
মিহির ভাই ভ্রুটা এতক্ষণ পর একটু কুঁচকালো। বললেন, তারপর...
মিঃ মিহির হয়তো বলবেন আমি সরাসরি তাকে ডেকে এনে কেনো জিজ্ঞাসা করছিনা। সেটা করা যাচ্ছেনা কারন লোকটার প্রভাব প্রতিপত্তি নিয়ে আমি সংশয়ে আছি। আর আরও কিছু ডিপার্টমেন্টাল সমস্যাও আছে। আর তার চেয়ে বড় কথা শুধু এই লোকের বিষয়ে তথ্য সংগ্রহের জন্য এবং তার উদ্দেশ্য জানতে হলে আমি কখনই তুখোড় ডিটেকটিভ পথিককে ডাকার প্রয়োজন পড়ত না সেটা আপনারা দু’জন ভালোই জানেন । ভার্চুয়াল জগতের এই অপ্রমাণিত তথ্যের বাইরে বাস্তবে একুশে ফেব্রুয়ারীতে শহীদ মিনার বা ঐ এলাকায় বোমা বিস্ফোরণের তথ্য রয়েছে । একটা নিষিদ্ধ সংগঠনের কিছু পরিকল্পনা কথা জানা গেছে। ঐ সংগঠনের সদস্য মনে করে সন্দেহভাজন দু’টি ছেলেকে ধরা হয়েছিলি। তাদের কাছে কিছূ জঙ্গীবাদী বই আর লিফলেট পাওয়া গেছে। এর মধ্যে একটি ছেলে ভাস্কর্য তৈরীর সিভিল ওয়াকে শিল্পীদের সাথে কাজ করে। একাডেমিক শিক্ষা নেই। কিন্তু শিল্পীদের সাথে কাজ করতে করতে ভাস্কয তৈরী করা শিখে গেছে। তার কাছ থেকে তেমন তথ্য পাওয়া যায়নি। আদালত তাকে জামিনও দিয়ে দিয়েছে। আমাদের কাছে আরও উড়ো খবরএসেছে একুশে ফেব্রুয়ারীতে নতুন করে নির্মানাধীন কোন এক ভাষ্কর্যের ভেতরেও বোমা থাকতে পারে। ছেলেটিকে জামিন নিতে এসেছিল পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন আর্ট টিচার। সেই শিক্ষক আবার সাউথ নর্থে পার্টটা ক্লাশ নেন। জাবিরের সাথেও তাকে দেখা গেছে কয়েকবার। একুশে ফেব্রুয়ারীতে ভাস্কর্য তেরীর কাজ পেয়েছেন তিনিও। সব মিলিয়ে বিষয়গুলোর মধ্যে একটা যোগসূত্র তো রয়েছেই। ছেলেটার প্রতি আমাদের অদৃশ্য নজর রয়েছে। জাবিরের আসল উদ্দেশ্য আর এই সূত্রগুলো আরও স্পষ্ট জানার জন্যই আপনারকে ডাকা। সময় কম। আপনার উপরেই তাই ভরসা করা যায়।
কিন্তু মিঃ মহব্বত আমার মনে হয় আপনারা যেরকম সর্ম্পকের কথা ভাবছেন সেরকম ঠিক বাস্তব মনে হচ্ছেনা।। কোথাও একটা সূত্র মিলছেনা। আপনার কাজ যখন হাততো দিতেই হবে, তবে এই মুহূর্তে শুধু দুটো তথ্য দরকার। অন্য যে ছেলেটা ধরা পড়েছিল সে কি এখনও জেলে এবং দুই ছেলে কি দু’জনের পরিচিত? আর আরেকটি বিষয়,যদিও সেটা আপনাদের গোপনীয়তার কারনে হয়তো নাও বলতে পারেন। ভাস্কর্যকে বোমা ফাটানোর জন্য ব্যবহার করা হবে এই তথ্যেরে ভিত্তিটা কি?
মিহির ভাইয়ের কথায় একটুখানি ভাবিত হতে দেখলাম মহব্বত সাহেবকে। তারপর বললেন, না ছেলেদুটো আসলে কেউ কাউকে চেনে না। সেটা নিশ্চিত করা হয়েছে। ইনফেক্ট দু;জনের কারও নামে কোনও ক্রিমিনাল রেকর্ডও নাই। ভাস্কর্যের বিষয়টা ভিত্তি আসলে নেই। আপনার মাধ্যমেই হয়তো একটা ভিত্তি পেয়ে যাব আমরা। হো হো হো...
মিহির ভাই তার অসাধারণ সহ্য শক্তি দিয়ে সে কিম্ভূত হাসি হজম করলেন। আমি ঠোঁটটা বেঁকিয়ে একটা উত্তর দিতে যাচ্ছিলাম। তার আগেই মিহির ভাই বললেন, হুম, বুঝলাম। ঠিকাছে মহব্বত সাহেব আমরা তবে উঠছি। আর কিছূ জানার থাকলে ফোনে জেনে নেব।
শিউর মিঃ পথিক। ধন্যবাদ।
চার.
নিমিখ, তোর নিলিকার কথা মনে আছে। আমার ছোট বোনের মত।
হুম। মনে আছে। খুব মনে আছে।
নিলিকা কিন্তু ঐ ব্লগ সাইটাতে জব করে। ডেভেলোপার। আমি বেশ কয়েকবার ও অফিসে গিয়েছিও। চয়ন নামে একটা ছেলে আছে মডারেটরের দায়িত্বে। চয়নের সাথে একটু দেখা করে আসি। তুই অফিসে যা, আঙ্কেলকে একটু খুশি কর। এই কেস তেমন কিছু জটিলতা নেই। সন্ধ্যায় চিলেকোঠায় দেখা করিস।
মিহির ভাই সেই কথাই বলতে চাইছিলাম আসলে । মহব্বত সাহেব কোন একটা গেম খেলছে মনে হয়। শেষ বার যখন ওনাদের একটা কাজ করে দিলে, ঐ যে সোনা চোরাচালানীর কেসটা। মহব্বত সাহেবের এক আত্মীয়ও জড়িত ছিল। উনি কিন্তু চেয়েযছিল সেই আত্মীয়ের নামটা যাতে না আসে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত যখন তুমি সেই আত্মীয়ের তথ্য প্রমাণ যোগার করেই দিলে, মহব্বত সাহেব ক্রেডিট নিতে কিন্তু নিজেও পিছুপা হলেনা। লোকটা বড্ড ধুরন্ধর।
তাতো বটেই। ওমন একটা সরকারী পদে দায়িত্ব পালন করেন। সে যা হোক। ধরেও নেই যদি আমাদের সাথে কোন গেমই খেলছেন, খেলুক না। ধর এটা একটা প্রাকটিস সেশন । গোয়েন্দাগিরির লাইসেন্স দিয়েছে সরকার, কিছু উটকো চাহিদাকো মেটাতেই হবে।
কিন্তু এই কাজের জন্য তোমার মত গোয়েন্দাকে, না মিহির ভাই। এতো তারা নিজেরাই পারত।
তুই যত সহজ ভাবছনি ঠিক কিন্তু তা না। ধর যদি বলি ‘পিসলাভার’ আইডটা মহব্বত সাহেবের নিজের, তখন কি বলবি?
তাই নাকি?
খেয়াল করে দেখ পিসির স্ক্রীণে সাইন ইন উইন্ডো। সেখানে আইডিতে পিসলাভার লেখা ছিল।
ও হ্যাঁ। তাইতো , মনে পড়েছে।
তুই এখন যা; না গেলে আঙ্কেল চিলেকোঠা থেকে সত্যিই এবার আমাকে বের করে দেবে।
পাঁচ.
সাত সকালে পেপার খুলেই খবরটা চোখে পড়ল । ছুটে গেলাম চিলেকোঠায় মাহির ভাইয়ের কাছে।
ঘুম থেকে ওঠেননি তখনও। টেবিলে ল্যাপটপটা তখনও চলছে।এভরিহয়্যার ব্লগ.কম এর পেজ স্ক্রীণে ভেসে রয়েছে।কাল ব্লগ সাইটটার অফিসে গিয়ে মডারেটরের কাছ থেকে একটা নতুন আইডি একটিভেট করে এনেছেন মিহির ভাই। আইডিটা বেশ-‘মন ভোলাব বলে’। এই সাইটে আইডি খোলার পর একটিভ হতে এক সপ্তাহ কম করে সময় লাগে। মিহির ভাইয়ের কোন কিছুতেই সময় লাগেনা। ঐ অফিস থেকে আরও অনেক মজার মজার তথ্যও তিনি নিয়ে এসেছেন। চয়ন নিজেই বলেছে তাদের নিজেদেরই দেশের বাইরে থেকে প্রচুর ফেক আইডি খোলা আছে। তাদেও কাজই হলো মন্তব্যে খোচাখুচি করা। এটা সাইটটাকে গরম রাখার অন্যতম অস্ত্র। এতে হিটও বাড়ে হু হু করে। তবে কিছু বিষয়তো সাইটকে টিকিয়ে রাখতে তাদের খেয়াল করতেই হয়। সরকারের বিরাগভাজনতো হওয়া যাবেনা। এই যেমন ‘মামুন আজিজ’ আইডিটার ওমন সুন্দর পোষ্টটাতে যখন প্রথম ‘পিস লাভার’ আইডি থেকে বোমা বিস্ফোরন টাইপ কমেন্ট করা হয়, সেটা সাথে সাথে চয়ন নিজেই ডিলিট করে দেয়। এতটা উগ্র বিষয় পরিস্থিতি কোন দিকে যাবে, কিভাবে সামাল দেবে সে বুঝে উঠতে পারছিলনা। মজার বিষয় হলো কমেন্টটি ডিলিট করার এক মিনিটের মধ্যেই মহব্বত সাহেবের ফোন কল যায় চয়নের কাছে। জানতে চায় ‘পিস লাভার’ আইডির আইপি লোকেশন। চয়ন জানায়-সে তো মুছে দিয়েছে। তবে আইপিটার ট্রেস জানিয়ে দেয়। ঢাকা থেকেই ব্যবহার করা হয়েছে। মজার বিষয় হলো মহব্বত সাহেব চয়নকে বলেছেন এরপর আর কোন মন্তব্য ঐ আইডি থেকে করা হলে সেটা যেন মোছা না হয়। এবং খানিক বাদে একই কমেন্ট পুনরায় ঐ আইডি থেকে করা হয়। মহব্বত সাহেবই যে ঐ আইডটি ব্যবহার করছেন সেটা মিহির ভাইয়ের মত চয়নও নিশ্চিত। মহব্বত সাহেবের কাছে অনেক আইএসপিরই নেট সংযোগ রয়েছে। পিস লাভারের এক এক কমেন্ট তাই এক এক আইপি থেকে করা হয়। কিন্তু কেনো, কারণটাকি? মহব্বত সাহেব মিথ্যে কেনো বলেছেন? আমাদের তদন্তের মূল বিষয় এখন মূলত সেটাই।
আমার পায়ের শব্দেই মিহির ভাই চোখ মেলে তাকালেন। খবরের কাগজটা তার চোখের সামনে মেলে ধরলাম। সেই ছেলেটা, যার কথা মহব্বত সাহেব বলেছিলেন। জঙ্গী সন্দেহে ধরা হয়েছিল। পরে জামিনে ছাড়া পায়। ছেলেটা মারা গেছে। গুপ্ত হত্যা। কে বা কারা রাতের আঁধারে মেরে ঝিলের পারে ফেলে রেখে গেছে। আর্টিস্ট শিক্ষকেরও একটা ছোট্ট বক্তব্য আছে খবরটার নিচে। তিনি প্রতিবাদ জানিয়েছেন। বলেছেন এ কাজ আইন শৃংখলা রক্ষা বাহিনীর, নিরীহ ছেলেটাকে জঙ্গী প্রমাণ না করতে পারার ক্ষোভে গুপ্ত হত্যা করা হলো।
মিহির ভাই ভ্রু কোচকালেন। বললেন, নিমিখ ভেবেছিলাম ছেলেটাকে দিয়ে শুরু করব। গুপ্ত হত্যা বিষয়টা ধীরে ধীরে ভয়াবহ হয়ে উঠছে। যদি মৃদৃল সাহেবের এতে কোন হাত থাকে তবে বিষয় কিন্তু আরও জটিল। তবে নিমিখ আমাদের জন্য বিষয় আরেকটু সহজ পথ পেলেও পেয়ে যেতে পারে, কি সেটা বলতো?
ঠিক বুঝতে পারছিনা।
বুঝবি, পরে সব বুঝবি। আপাতত আর্টিস্ট টিচারের কাছে যাওয়া লাগছেনা। তোর আজকে আবার কোস্পানীতে কোন মিটিং নেইতো। আজ কিন্তু আমার সাথে যেতে হবে জাবির সাহেবের বাসায়। ঠিকানা যোগাড় হয়েছে। একাই যেতামা। কিন্তু একজন রিপোর্টার সেজে যাব তো , সাথে ক্যামেরাম্যান লাগবে। আঙ্কেলকে বলতে হলে ...
না, বাবাকে কালই বলেছি। আর কত বকবেন! তোমার উপর তিনি এখন ভীষণ প্রসন্ন। তা সারা রাত জেগে নেটে কি করলে?
পিস লাভারের মন্তব্যের নিচে কমেন্ট করেছি-‘তোমাদের কাজে সমর্থন। আমরাও পরিকল্পনা করেছি। সময়মত বিস্ফোরণ শুনতে পাবে।’
কি সর্বনাশ। আইডিতো ট্রেস করা শুরু করবে। ইতিমধ্যে করেছেও । চয়ন জানিয়েছে ওটাও দেশের বাইরে থেকে।
ছয়.
জাবির হাইয়ান নর্থ সাউথের বেশ ফেমাস শিক্ষক। আর্টিটেকচার ডিপার্টমেন্টে পড়ান। ফেমাস বলেই বোধহয় ইন্টারভিউ প্ল্যানটা সহজে কাজে লেগেছে। এ দেশে যেসকল বিদেশি শিক্ষক পড়াচ্ছেন তাদের উপর একটা সিরিজ আর্টিকেল করার পরিকল্পনা নিয়েছে দৈনিক জনগন পত্রিকা। এমনই এক পরিকল্পনা ফেঁদেছেন মিহির ভাই।
বিদেশি শিক্ষক বারিধারায় একটা ফ্লাটে থাকেন। আমরা যখন পৌঁছালাম তখন বিকেল ৪টা। দীর্ঘাকায এক যুবক জাবির হাইয়ান। ধবধবে ফর্সা। তুরষ্কেরই অধিবাসী। সাদরে ঝরঝরে বাংলায় স্বাগতম জানিয়ে আমাদের ভেতরে নিয়ে গেলেন। শিক্ষক ব্যক্তি সত্যিই সুন্দর বাংলা বলতে পারেন। মদ্যপ্রাচ্যের দিকের লোকজনের মুখে সচারচর এত শুদ্ধ উচ্চারণে বাংলা শোনা যায় না।
মিহির ভাই সোফায় শরীরটা এলিয়ে দিয়ে বসলেন। আমি অতি শখের নিকন এন ৯০ ক্যামেরাটা নিয়ে মুখোমুখি একটা টুল দেখতে পেয়ে সেখানে বসে পড়ে ফটোগ্রাফার বনে গেলাম।
মিহির ভাই বললেন , মিঃ জাবির আমরা কি তাহলে এখনই ফরমাল ইন্টারভিউ শুরু করতে পারি।
ঠিক সে সময় পাশের রুম থেকে বেশ নজরকারা এক তরুণী একটা ট্রলিতে নানান পদের মিষ্টি এবং স্ন্যাকস নিয়ে ঠেলতে ঠেলতে এগিয়ে এল। মেয়েটা বাঙ্গালী।
মিঃ জাবির পরিচয় করিয়ে দিলেন-এ হইলো আমার ছাত্রী কাম এ দেশে সবচেয়ে কাছের বন্ধু। ও মৃন্ময়ী। মৃন্ময়ী আমিন। আর্কিটেচারে ফাইনাল ইয়ালে পড়ছে। এত বড় পত্রিকা থেকে আপনারা আসিবেন শুনে ও চলে এসেছে। ওর ধারনা আমি খুব কম কতা বলি, তাই ওকে আসতেই হবে। ও কিন্তু খুব ভাল কবিতা লেখে।
তা বেশ হয়েছে। নিজের গুণকীর্তন কি আর নিজে করা যায়?
মৃন্ময়ী খাবার এগিয়ে দিতে দিতে বললো, জাবির স্যারের আমাদের বাংলা ভাষার প্রতি নিবিড় ভালোবাসা। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস স্মরণে ঢাবির হাসিব সুপান্থ স্যার নতুন যে ভাষ্কর্য একুশে ফেব্রুয়ারী স্থাপন করতে যাচ্ছেন সেটার মুল আইডিয়া কিন্তু জাবির স্যারের। কিন্তু নিজের নামটা তিনি প্রকাশ করতে চাননা। বলুন তো এটা কি ঠিক? আরও দেখেন এই দিবস করার পেছনে মূলত কানাডা প্রবাসী যে দু;জন বাঙ্গালী তাদের সাথেও স্যার বক্তিগতভাবে কয়েকবার যোগাযোগ করেছেন। পুরো বিষয়টা তিনি জেনেছেন। একটা বইও লিখছেন স্যার। সেই ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘোষিত হবার পর্যন্ত এই আমাদেও বাংলা ভাষার ঐতিহ্য নিয়ে বইটি লেখা হচ্ছে। আমি গর্বিত স্যারের এই কাজে আমি সাহায্য করতে পারছি। স্যার খুব আফসোস করেন যে ভাষার সূত্র ধরে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘোষনা হলো সেই ভাষাই এখনও অনলাইনে অবহেলিত। বাংলা ভাষার সমৃদ্ধ সাহিত্য সম্ভারের কোন বিদেশি অনুবাদও হচ্ছেনা। এসব নিয়ে স্যার খুব ভাবেন। আমি আর স্যার মিলে ভাবছি একটা অনুবাদ প্রতিষ্ঠান দেবো। আমাদের বাংলা ভাষার ভাল ভাল সাহিত্যকর্মগুলো সেখান থেকে অনুবাদ করা হবে অন্যান্য ভাষায়।
হুম, খুবই ভাল উদ্যেগ। সম্প্রতি একটা ব্লগে আর্টিকেল পড়ে জানালাম জাতিসংঘের ওয়েবসাইটে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের যে পেইজ আছে সেটা আরও কিছু ভাষায় পড়া গেলেও বাংলাতে পড়া যাযনা। বিষয়টা...
মিহির ভাইকে বলতে না দিয়েই মৃন্ময়ী আবার শুরু করল, আপনি পড়েছেন? ওটা আমার কাজিনের লেখা। মামুন আজিজ। ও কিন্তু একটা মিডিয়াতে ডেস্ক রিপোর্টারের কাজ করে। ওদের টিভি চ্যানেল স্যারের একটা ইনটাভিউ করতে চেয়েছে। কিন্তু স্যারকে রাজীই করাতে পারছিনা। আপনাদেও এটা ছাপা হলে এবার আর স্যারকে মামুন ছাড়বেনা।
মিহির ভাইয়ের চোহারার এক্সপ্রেসন আমার চেয়ে ভাল আর কে বোঝে। সেই অভিজ্ঞতা থেকে বুঝলাম যা জানার, জানা হয়ে গেছে। কিন্তু ইন্টারভিউ বলে কথা। ফরমালিটিস পূরণ করা হলো। কবে এসেছেন , কতদিন থাকবেন, বিয়ে শাদি এই এইসব। একটা বিষয় ডায়েরীতে টোকার সময় মিহির ভাই সরল রেখায় নিচে আন্ডারলাইন করে রাখলেন। বিষয়টা হলো একুশে ফেব্রুয়ারীর দুদিন আগে জাবির ছুটিতে তুরষ্ক যাচ্ছেন। সাথে তার এই বন্ধু কাম ছাত্রীও ঘুরতে যাবে। তাদেও সম্পর্কটা কি কেবলই বন্ধু না আর ও বেশি কিছু সে প্রশ্নের উত্তরে স্মিত হাসি ছাড়া দুজনের মুখ থেকে আর যতটুকু জানা গেলো তা হলো তারা এই বিষয়ে তুরষ্ক হতে ফিরেই সবাইকে জানাবেন। আপাতত মিডিয়াতে এটা না জানাতেই বলা হলো।
মিহির ভাই আশ্বস্ত করতেই বললেন ইন্টারভিউটি ছাপানোর আগে মিঃ জাবিরকে দেখিয়েই নেয়া হবে।
মিহির ভাই সোফা ছেড়ে উঠতে যাবেন হঠাৎ বলে উঠলেন,মিঃ জাবির ইফ ইউ ডোন্ট মাইন্ড আমার একটা জরুরী মেইল চেক করা দরকার, আপনার এখানে কি ...
ওহ! শিউর মিঃ জার্নালিস্ট। মৃন্ময়ী ওনাকে একটু ল্যাপটপটা এনে দাও।
মিহির ভাই দেরী করলেন না। মাত্র মিনিট দুয়েক। তারপর আমাকে বললেন, ওকে নিমিখ চল উঠি।
জাবির আর মৃন্ময়ীকে ধন্যবাদ জানিয়ে আমরা বের হয়ে এলাম।
সাত.
নিমিখ,তদন্ত কিন্তু শেষের পথে। আর কেবল একটা তথ্য জানা দরকার। তাহলেই সব খোলাশা হয়ে যাবে।
সব জেনে গেছো? কখন জানলে? হাসিব সুপান্থ নামের ঐ আর্টিস্টের কাছেও কি গিয়েছ? আর ঐ মহব্বত সাহেব কেনো মিথ্যে বলল সে বিষয়?
কেনো মিথ্যে বলল সেটা এখনও বুঝতে পারিছনি। জাবির হাইয়ানের ওখানে যে মেয়েটিকে দেখলি তার চেহরা কি পরিচিত মনে হলোনা তোর একটুও কিংবা নামটা। নামের শেষে আমিন। ভাবতে থাক।
মিহির ভাইয়ের মেবাইলটা বেজে উঠল।
এই যে শেষ খবর টাও চলে এসেছে। তুই ভাবতে থাক। আমি কথা সেরে নেই।
মিহির ভাই একটা কৃষ্ণচূড়া গাছটার তলায় দাঁড়িয়ে কথা বলছেন। আমি রাস্তার ও পাশে টঙ দোকানটাতে বসে সিগারেটটা ধরিয়ে আমিন নামের অর্থ বোঝার চেষ্টা করছি। পথিকভাই ছুটে এসে বলতে লাগলেন, যা ভেবেছিলাম। দে একটা বেনসন ধরিয়ে দে।
গুরু শিষ্য হাঁটতে লাগলাম। দু’জনের হাতে দুটো সিগারেট। তদন্ত কাজ শেষে হলে মিহির ভাই একটা সিগারেট ধরিয়ে থাকেন। সেটা অবশ্য একলা নিরিবিলি। সিগারেটের অভ্যেস কমাতে কমাতে এই এক জায়গায় এনে থেমেছেন উনি। আজকে অবশ্য আমার সাথেই ধরাচ্ছেন।
বুঝলি নিমিখ, যা ভেবেছিলাম। জেলখানে থেকে তথ্য নিলাম। জেলার সাহেবের সাথে একটু খাতির ছিল। সেটা আজ কাজে লেগেছে।
তোমার খাতির নেই কার সাথে?
জঙ্গী সন্দেহে অন্য যে ছেলেটিকে ধরেছে তার কাছ থেকেই জানা গেছে একুশে ফেব্রুয়ারী বোমা বিস্ফোরণের পরিকল্পনা বিষয়ে। পরিকল্পনা মাফিক আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষ্যে যে ভাস্কর্য তৈরী হবে সেখানে কারিগর হিসাবে জঙ্গীরা দু’জন যোগ যুক্ত হবার কথা। তারা বিশ তারিখ গোপনে ভাস্কর্যের নিচে বোমা পেতে রাখবে। কিন্তু সেটা ফাঁস হয়ে গছে। পত্রিকায় না আসার কারন বোধহয় জঙ্গীদের এই ফাঁসের বিষয়ে না জানানো। গোয়েন্দা বিভাগকে থেকে ভাস্কর হাসিব সুপান্থকে জানানো হয়েছে কোন লোক কাজে রাখলে সেটা গোয়েন্দা বিভাগ বা পুলিশ কে জানিয়েই তবে রাখার জন্য। সেভাবেই তিনি কাজ করছেন।
আর ঐ যে ছেলেটা মরল?
এই রহস্যটা অবশ্য আমাদের তদন্তের সাথে সম্পৃক্ত না। তবে জঙ্গীরা তাদের পরিকল্পনা ফাঁস হয়ে যাবার বিষয় না জানাটা ওর মৃত্যুর কারন হতে পারে। ছেলেটাকে প্রথমে জঙ্গী দলে ভেড়ানোর প্রচেষ্টা করা হয়েছে। বন্দী ছেলে তেমনই তথ্য দিয়েছিল । সম্ভবত পরিকল্পনা ছিল তাকে রাজী করাতে পারলে তো ভালোই, না হলে তাকে কোন ভাবে সরিয়ে দিয়ে ...
তাহলে সরানোর জন্যই মেরে ফেলা হয়েছে।
হতে পারে। ওটা এই মুহূর্তে না জানলেও চলবে। তবে ভাস্কর্যটি একুশে ফেব্রুযারী স্থাপন করার সিদ্ধান্ত বাতিল করা হয়েছে।তোকে এখন একটু মহব্বত সাহেবের অফিসে যেতে হবে। ওনাকে গিয়ে বলবি আমি তোকে পাঠিযেছে। তদন্ত কাজ শেষে হয়েছে।ওনার মেয়ে মৃন্ময়ীর সাথে জাবির হাইয়ানের সত্যি সত্যি প্রণয় চলছে। দুজন শীঘ্রই বিদেশেও যাচেছ একসাথে ঘুরতে। সেটা একুশে ফেব্রুয়ারীর আগেই। এই বিষয়টিই উনি আসলে আমাদের মারফত জানতে চেয়েছিলেন। আর বলবি, জাবির সাহেবের আইডি যে পিসলাভার নয় সেটা আমরা আগেই জেনেছি। বলবি আমি বলেছি ‘পিসলাভার’ আইডির কমেন্টগুলো মোছার ব্যবস্থা করতে। না হলে বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে, জঙ্গীরা এটাকে অপব্যবহার করতে পারে।
তা তুমি ওনার মেয়ে যে ঐ মৃন্ময়ী সেটা এতটা শিউর হলে কি করে?
আরে বাবা ফেসবুকের যুগে এতটুকু খোঁজখবর কোন বিষয়? নেটে ঢুকেতো ওটাই কনফার্ম হলাম রে। তোরই তো উচিৎ ছিল আমাকে এই তথ্য খুঁজে দেয়া, তাইনা?
আমাকে বললেই খুঁজে দিতাম। তা, খুব ভাল করছ আমাকে পাঠিয়ে । বেচারা মহব্বত গোয়েন্দার মুখটা শুকিয়ে যা হবেনা।
হুম,সেটা দেখার ইচ্ছে তোর মত আমারও ছিল। কিন্তু আমকে একবার হাসিব সুপান্থ স্যারের কাছে যেতেই হবে। জঙ্গীদের জন্য আন্তর্জাতিক মাতৃভষা দিবসের স্বারক ভাস্কর্য বন্ধ কেনো হবে? এটা বন্ধ যাতে না হয় সেটার একটা বন্দোবস্ত করতেই হবে।
এ কাজ কে দিলো?
এটা প্রাণের টানে। একজন বাঙ্গালী গোয়েন্দা হিসেবে একুশে ফেব্রুয়ারীর দিনটি যাতে সুষ্ঠুভাবে পালন হয় সে বিষয়ে নিশ্চয় কিছু করণীয় আছে।