এক.
আনাচে কানাচের এই সব রেল ষ্টেশনগুলোর চেহারা মোটামুটি একই। নামটি বড় বড় করে লেখা না থাকলে চিনে নেয়া আসলেই কঠিন।
সময় ভূতের বিলম্ব না হলে সেই রাত দশটাতেই পৌঁছে যেতাম। দুঘন্টা দেরী হয়ে গেছে। গ্রাম্য এলাকা। ঘন তমসার ছড়াছড়ি। গাম্য এক বাড়িতে থাকার একটা ব্যবস্থা করার কথা, আদৌ সেটা হয়েছে কিনা বুঝতে পারছি না। এক বন্ধুর আত্মীয় বাড়ি। বন্ধুটির বলে দেয়ার কথা। সে হয়তো বলেছে, কিন্তু আমি সারা পথে সেই বাড়ির কর্তার নম্বরে ফোন করেও কোন কথা বলতে পারিনি। কেউ ফোনই ধরেনি। বন্ধুটিকে যখন সে কথা জানাব, তার আগেই আমার মোবাইলের চার্জ শেষ হয়ে গেলো। শেষ হতো না, অফিসে সুন্দরী কলিগ লায়লা ম্যাডাম কম করে হলেও পঞ্চাশটা কল করেছে। প্রতিবারই অনেকক্ষন ধরেই কথা হয়েছে। উনি আমাদের মিডিয়া অফিসটির একজন সিনিয়র এডটির। একটা আর্টিক্যাল নিয়ে ঝামেলায় ছিলেন, আমার উপর তার অগাধ ভরসা। ফোনে পারলে লিখেই দিতে হত।
এমনতর রাত বিরাত আর মোবাইল বিহীন চলাফেরা আমার অভ্যাস আছে। ভয়হীন হৃদে ষ্টেশনে নেমে লাল বিল্ডিং পেরিয়ে গেলাম। নিরিবিলি একটা এলাকা। আমার সাথে আর মাত্র একজন মধ্য বয়স্ক লোকই দেখলাম কেবল এই ষ্টেশনে নেমেছিল।
ষ্টেশেনের বাইরে বেরিয়ে কিছুক্ষণ পরই সেইলোকটাও হাঁটতে হাঁটতে একদিকে আঁধারে হারিয়ে গেলো। একটা বড় পাকুর গাছ ষ্টেশনের উঠোনের সাথেই লাগানো। সে গাছে একটা ১০০ পাওয়ারের বাতি জ্বলছে। আলোর পরিধি কমতে কমতে আঁধারের সাথে যেখানে মিশে গেছে সেখানের পরিবেশটা চমৎকার। পেটে ক্ষুধা চো চো না করলে পরিবেশটা আরও ভালো লাগত। আমার আর যাই থাক ভুতের ভয় নেই। এটা নীরবতা এনজয় করার একটা বাড়তি সুবিধা।
চারপাশে তাকালাম। উদ্দেশ্যে কোন দোকানপাট এখনও খোলা আছে কিনা তা খুঁজে বের করা । উদ্দেশ্য সফল হলো। ষ্টেশনের ডামন কোনায় একদম শেষপ্রান্তে একটা দোকান দেখা যাচ্ছে। এগিয়ে গেলাম। দোকানদার ছেলেটা বাদে আরও দু’জন লোক সেখানে। চা বিস্কুটে পেট পূজো হলো ভালো। বিদ্যুৎ আছে বলে মোবাইলে খানিকটা চার্জও দেয়া গেলো। যে বাড়িতে থাকার কথা সেখানে আবার ফোন দিলাম। এবারও কেউ ধরলো না। বন্ধুকে ফোন দিলাম। ঢাকায় এটা আর তেমন কি রাত। সে প্রথম রিংয়েই ধরল। কয়েকটা বন্ধু সুলভ গালি না দিয়ে পারলাম না। বলল, ওগ্রামে নেটওয়ার্ক পাওয়া যায় না ঠিকমত। তবে সমস্যা নেই। একটা ভ্যানে করে ঠিকানা অনুযায়ী পৌঁছে গেলেই হবে। বলা আছে।
ফোন কেটে ভাবলাম দোকানে বসা অন্য দুজন লোকের মত বসে বসে ঝিমিয়ে ঝিেিময় রাত পার কওে দিলেই তো হয়। তারপর কি মনে করে ভাবলাম না যে গ্রামে যাব সে গ্রামেই তো বাহাদুর নামের লোকটি থাকে। যদি ভোরেই সে কাজে চলে যায়। রাতেই একটা খোঁজা নিতে হবে। দোকানদার ছেলেটাকে গ্রামের ঠিকানাটা বললাম, সে বলল-মাত্র দুই কিলোমিটার। চিনলে তো হেঁটেই চলে যাওয়াা যেতো। ছেলেটা অবশ্য আঙ্গুল দিয়ে দেখালো কাছেই একটা গাছের নিচে হালকা অন্ধকারে একটা ভ্যানে একজন লোক শুয়ে শুয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে বিড়ি ফুঁকছে। বলল, ঐ যে নিজামুদ্দীন ভাই, হের বড়িও একই গ্রামে। বললেই লইয়া যাইব। দুর থেকে লোকটার বয়স আন্দাজ করা গেলোনা। সে দিকে এগিয়ে যাবার আগে দোকানদার ছেলেটাকে ধন্যবাদ আর টাকা দিতে ভুললাম না। একবার মনে হলো বাহাদুরের কথা এর কাছে জিজ্ঞেস করি। কিংবা ঝিমানো লোক দুটিকে...কিন্তু হাসান মানে আমার পরিচিত যে পত্রিকা সাংবাদিক কযেকদিন আগে এসেছিল তার অভিজ্ঞতা তেমন সুখময় ছিল না। বাহাদুরের কথা তাই ষ্টেশনে জিজ্ঞেস করতে মানা করেছিল। আমি সে উপদেশ শুনলাম। সে সফল হয়নি। ইনফেক্ট সে আমাকে আসতেও মানা করেছিল, কিন্তু আমাকে সফল হতেই হবে। ...
দুই.
নিজামুদ্দীনের কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,এই যে ভাই আপনার বাড়ি কি অচিন্ত্যপুর গ্রামে? আমাকে একটু নিয়ে যাবেন।
বিড়ির ধোঁয়ার ফোঁকড় গলে লোকটার পোড় খাওয়া দৃষ্টি আমার দিকে নিক্ষেপ করল। অন্ধকারে তেমন বোঝা না গেলেও বয়স যে পঞ্চাশের উপর তা আন্দাজ করতে পারলাম। সাদা দাড়ি অন্ধাকরে মুখটাকে আলোকিত করে তুলেছে যেন। সৌম্য এবং পোড়া একটা ভাব একসাথে তার চেহারায় সে আঁধারেও টের পেলাম। বলল, আপনি , ঢাকা থেইক্যা আইছেন? কোন বাড়ি যাইবেন?
বললাম, এনামুল মাষ্টারের বাড়ি।
এবার সে ডান হাত থেকে বিড়িটা ফেলে পা টা ভ্যান থেকে নামাতে নামাতে বলল, আগে তো কুনুদিন আপনেরে দেহি নাই। মাষ্টার সাবে কি আপনের আত্মীয়?
না, বন্ধুর বড় ভাইয়ের কি যেন হয়।
আজীব মানুষ তো আপনে, কি হয় কইতে পারেন না, আর এত রাইতে চইল্যা আইছেন। অন্য কোন মুতলবে আহেন নাই তো?
ভ্যানে উঠে বসেছি এর মধ্যে। সে চালাতে শুরু করেছে। আমি উঠে বসেছি পেছনে। দুজনের মুখ এখন দুদিকে। রাতের গ্রাম্য পথ। পথটা পাকাই। বেশ লাগছে। নাজিমুদ্দীনের প্রশ্নে একটু বিরক্ত হয়েছি তবুও এই রাতে তার উপকারের কারণে বললাম, তাতে তোমার কি নিজামুদ্দীন?
না মানে, ছোট্ট গ্রাম তো সবাই সবাইরে চেনে। চুন থেকে পান খসলেও এখানে মুহূর্তে তা চাউড় হইয়া যায়। গ্রামে ইদানীয় কানা ঘুষা চলতাছে আমাগো চেয়ারম্যানরে বলে হের ভাই খুন করার লাইগ্যা পেলান করছে। হেয় ঢাকায় থাকে। ঢাকা থেইক্যা হেই খুনিরে কবে চেয়ারম্যানের ভাই পাঠাইবো সেই অপেক্ষায় আছে গ্রামের লোক। দোকানে যে লোক দুইটারে দেখলেন, হের মধ্যে একটা চেয়ারম্যানের খাস লোক। হে রাত জাইগ্যা প্রতিদিন খুনিরে পাহারা দেয়। আপনে যে ঐ গ্রামে যাইবেন হেই খবর এতক্ষণে চেয়ারম্যান সাবের কাছে পৌঁছাই গ্যাছে। এনামুল মাষ্টাররে এতক্ষণ জিজ্ঞাসাবাদও শুরু করা হইছে আমি শিউর। হের লাইগ্যাই মাষ্টার আপনের মোবাইল ধরে নাই।
তুমি আমারে এইসব কেনো বলতাছ?
প্রথম কারণ আমি জানি আপনি কেন আইছেন। আর দ্বিতীয় কারণ আমি আরও জানি চেয়ারম্যান আর হের ভাই হইলো একই গাছের শিকড় আর পাতা, একটা ছাড়া আরেকটা মইরা যাইব। হেরা এইগুলা সব বানাইছে। মানুষরে বোকা বানাইতাছে। হেরা দুইভাই দুইদল করেতো, কিন্তু তলে তলে পিরিত। সব লোক দেখাইন্যা। জমি জমা লইয়্যা যে বিবদ হেরা দেখায় হেইডাও মানুষরে দেখানোর লাইগ্যা।
তাতে তাদের কি লাভ?
হেই সব আপনে বুঝবেন না। আপনে আইছেন বাহাদুররে খুঁজবার , হেরেই খুঁজেন। নিজের চাকরী বাঁচান।
আপনি সত্যি সত্যি জানলেন কেমন করে?
বাহাদুরের লগে থাকি তো কিছু বুদ্ধি আমারও হইছে। কিন্তু বাহাদুররে খুঁইজ্যা আপনের কোন লাভ নেই। হেয় কোন ইন্টারভিউ টিউ দিবো না।
তাহলে তুমি আমাকে ঐ বিপদের মধ্যে নিয়ে যাচ্ছ কেনো।
আপনি যাইতে চাইছেন, নিয়া যাইতাছি। অবশ্য এখন না যাইতে চাইলেও নিয়া যাইতে হইবো। না হইলে চেয়ারম্যান আমারে...
তোমারে কি করবে, হেইড্যা আপনে বুঝেন না। আচ্ছা কন তো আপনি কি সাংবাদিক?
আমি আসলে ঠিক সেই অর্থে সাংবাদিক না। এটা টিভি মিডিয়াতে কাজ করি। আমার কাজ হচ্ছে এক্সক্লুসিভ খবর খুঁজে বের করা। এই যেমন তোমাদের এখানে বাহাদুর অতগুলো মানুষের জীব বাঁচাল। অথচ সে খবর কেউ জানবে না, বল তা কি হয়, এটা জানাতেই হবে।
বুঝবার পারছি। আপনাগো টিভির সুনাম হইবো...এইতো। তা দেশে খবরের কি কুনো অভাব আছে নি। কয়দিন ধইরাতো টিভিতে দেখবার আছি ঐ ঢাকার এ কোনায় সাভারে কি এক রানা বিল্ডিং ভাইংগা পড়ছে...খুব কষ্ট পাইছি কয়দিন এইসব দেইখ্যা। কত কষ্ট, কত লাশ, টিভি ওযালা লাইগ্যা তো এইসব খুব গরম গরম খবর, না ভাইজান।
কেনো মিডিয়ার লোকেরা যে মানুষকে এইসব জানাইলো, তারপর কত জন তো সাহায্যও করল ...এইসব দেখেন নাই।
দেখছি ভাই আর খালি আফসোস করছি, যদি একবার যাইতে পারতাম, কতগুলান মানুষরে বাঁচাইতে পারতাম।
আপনি এই বয়সে...
বয়স আবার কি ভাই, মইনের শক্তি আসল। শ্রমিক বিপদে পড়ছে, আমরাও শ্রমিক, সব শ্রমিকের এক আত্মা...
তা আপনদের বাহাদুর, সে বলে মানুষের বিপদ দেখলেই ঝাঁপাইয়া পড়ে...হে যায় নাই কেনো সাভার? আচ্ছা তার বয়স কত?
আরে সাব, হে যাইবার লাইগ্যা ট্রেনেও চরতে চাইছিল, কিন্তু একটা হাত নাই ...ঐখানের যে করুন অবস্থা, দ্ইু হাত লইয়াই মানুষগোরে বাঁচাইতে যে কষ্ট, বাহাদুর কেমনে সাহায্য করব?
হাত নাই মানে, তাইলে ট্রেন লাইন ঠিক করলো কেমনে?
ও মা! আপনে দেহি কিছুই জানে ন না। তা বাহাদুর সম্পর্কে কতটুকু জানেন কন দেহি?
তেমন কিছু না আসলে। শুনেছি বীর মুক্তিযোদ্ধা ছিল।
তা তো ছিলোই। যুদ্ধেই তো হাতখান হারায়, এক হাতের বিনিময়ে পুরো গ্রাম বাঁচাইছিলো...
কী রকম?
সে সব চল্লিশ বিয়াল্লিশ বছর আগের কথা। ওসব শুইনা কি করবেন। ওসব আমরা ভুইলা গেছি কবেই। ট্রেন লাইনে মিস্ত্রির কাজ করতো বাহাদুর। ট্রেন ভইরা আইছিলো পাকিস্তানি হানাদার...পুরা ট্রেনই উড়াই দিছিল বাহাদুর...
তুমি কি ওর সাথে যুদ্ধ করছিলা।
যুদ্ধ, হায়রে যুদ্ধ, আমরা একগ্রামের একলগে থাকি না, সব জানি তো। কয়দিন আগে এক সাংবাদিক আইছিলো...
বাহাদুরকে সে খুঁজে পায়নি...কেনো বলোতো..
ট্রেন বাঁচাইছে তো ষ্টেশন মাষ্টার। আপনি হের কাছে যান, বহাদুররে কেনো খুঁজেন? বাহাদুর হইলো কামলা, আপনাগো ভাষায় শ্রমিক, কাম করাডাই কেবল কাম।
আমাকে ঐ সাংবাদিকই বলেছে বাহাদুর নাকি তার আসল নাম না। সে নাকি অনেক অনেক বাহাদুরি কাজ করেছে জীবনে, সে কারণেই তার নাম বাহাদুর? কথা কি সত্যি।
ভ্যান চালক সে কথায় হাসল। বলল, হইতে পারে। তয় তাতে কি হইবো। মন চায় তাই সে ঝাঁপাই পড়ে।
তাও এক হাত নিয়ে।
যাগোর দুইহাত আছে তারা মনে হয় খুব কামের। কাম করতে মন লাগে, মন...আর কিছু না, আর সাহস।
দু একটা সাহসীকতার কথা শুনাও না।
কেন সংবাদিক ভাই কয় নাই।
না মুখে কুলুপ আটছে।
আপনিও আটবেন।
কিছু কইল্যা।
ষ্টেশন মাষ্টারের কাছে গেছিল হেই ভাই পেত্থমে। ভালো করে বুঝাই দিছে। আমাগো চেয়ারম্যান সাব, বিরাট মুক্তিযোদ্ধা, বিরাট তার সাটিফিকেট, দেয়ালে টাইন রাখছে, হের এলাকায় হরতালে বিরোধী পক্ষ ট্রেন লাইন উপড়াইছে এই খবর কোন কাগজ টিভিতে কেনো যাইবো, চেযারম্যান সাব এসপষ্ট কইরা কইয়া দিছে। আমাগো এই এলাকায় কোন কিছুই ঘটে নাই।
কিন্তু ট্রেনের লোক দেখছিল। দূর থেকে অবশ্য। তারা ভাবছিল কেউ লাই উপড়াচ্ছে। কিন্তু একটু পরেই বুঝেছিল দুইজন উপড়ানো লাইন দ্রুত ঠিক করছিলো। সেই ট্রেনে আমার এক সহকর্মী ক্যামেরামান ছিল। অন্ধকারে একটা ছবিও উঠিয়েছিল, খুব একটা কিছু অবশ্য সেই ছবিতে বোঝা যায় না।
ভুলেও এই কথা কইয়েন না কাউরে। আপনে তো চেনেন না। চেয়ারম্যানের ভাড়াটে খুনি দল আছে, বাড়ি ফিরা যাইতে পারবেন না।
আচ্ছা এক হাত নিযা বাহাদুর লাইন এর স্লিপার ঠিক করলো কেমনে?
না, হেয় ষ্টেশন মাষ্টাররে দৌড়াই আইসা জানাইছিল, মাষ্টার মালামাল সাপ্লাই দিছিল, কোন মিস্ত্রি ছিল না সেই রাত দুটোর সময়...কি করবে, অবশ্য বাহাদুর সেই ছোট বেলা থেইক্যা এইসব কাম দেইখ্যা আর কইরাই বড় হইছে, তার জন্য এক হাতই যথেষ্ট, সে এক হাতে আস্ত একটা স্লিপার সরাই ফেলাইতে পারে এখনও। তার মত দক্ষ মিস্ত্রি এখনও নাই। খালি হাত নাই দেইখ্যা চাকরীডা ফেরত পায়নাই যুদ্ধের পরে। চাকরী না থাকলেও দিন চুক্তিতে লাইনের সব কামেই বাহাদুরের ডাক পড়ত।
তুমি দেখ্যি সব জান।
এক লগে থাকি না, কি যে কন।
তাইলে হের দুই একটা বাহাদুরীর কথা শোনাও না।
শুইনা লাভ নাই। আপনে হের ইন্টরভিউ নিবার পারবেন না। চেয়ারম্যান সাব অনুমতি দিবো না।
অনুমতি আমি পরে নিয়েই আসব। তুমি ঘটনা বল।
তিন.
দিবো না অনুমতি। হেরে চেয়ারম্যান সাব ডরায়। একবার কি হইছে জানেন, গ্রামে এন্তাজ মোল্লার বাড়িতে আগুন লাগছে এন্তাজ মোল্লা পুরান চেয়ারম্যান। সবাই বাইর হইয়া আইছে। দুইটা বাচ্চা খুঁইজ্যা পাওয়া যাইতাছিলো না। কেউ যাবার সাহস পায় না। বাহাদুর দুইডা চাদর ভিজাইয়া গায়ে প্যাঁচাই নিলো, তারপর দৌড়াইয়া আগুনের মদ্যে ঢুইক্যা গেলো। একে একে দুই বাচ্চারে খুইজ্যা আগুন থেইক্যা হেয় এক হাতে ধইরা বাইর কইরা আনল। ভেতরে আরেকজনরে পাইছিলো। যদিও তার গায়ে আগুন লাইগা অনেকটা পুইরা গেছিল। হেই মোল্লা বাড়ির একডা বউ। কানাঘুষা আছিল হের লগে চেযারম্যানের শালার পিরিত চলতাছিল। ধরাও খাইচিল। শালিস বসবার কথা ছিলো। মাইড্যারে বাহাদুর বাইরা কইরা আনছিলো। আসলে কিন্তু হেই মাইয়ারে মারার লাইগ্যাই মোল্লা বাড়িতে আগুন দিছিল।
কে দিয়েছিল আগুন। চেয়ারমান না তার শালা?
হেয় দিয়া আপনের কাম কি? যা কইতাছি শুনেন। চেযারম্যানের শারা গেলো বাহাদুরের উপর খেইপ্যা। ধইরা লইগা গেলো। কইলো আরেকটা হাত ও খোয়াইবার চাস। বাহাদুর কোন কা কয় নাই। তয় চেয়ারম্যানের কানে যাবার সাথে সাথে হে ছুইটা আইলো। অন্য হাতটা বাঁচল। তয় শাস্তি হইলো এর পর থেইক্যা কোনদিন ট্রেনের লাইনে কোন কাম হে করবার পারবো না। চেযারম্যান জানত ট্রেন লাইন ছাড়া হের পঙ্গু জীবন অচল। হেয় কামলা, হেয় মিস্ত্রি, হের জীবনই তো লাইনে কাম করার লাইগ্যা। খবু কষ্ট পাইছিলো। কাউরে কইবারও পারে নাই। চেয়ারম্যান ষ্টেশন মাষ্টারকে কইছে হে যেন কোন কাম না করে লাইনে।
তাইলে হে করে কি?..আর চেয়ারম্যান হেরে এমন শাস্তি দিলো কেনো?
হে কি করে, হেইডা শুইনা কি করবেন। আর চেয়ারম্যান মানুষ তো...বাহাদুর যে একদিন হেরে বাঁচাইছিল, যুদ্ধের সময় চেয়ারম্যানরে অন্য মুক্তিযোদ্ধা সাথীরে মাইরা ফেলতে চাইছিলো। ওইডা একটা দুমুখো সাপ ছিলো। কি ভুলডা যে ছিলো হেইরে বাঁচাই রাখা...হেরে বাঁচাইয়া...
তুমি এত কিছু আসলেই কেমনে জান। তোমারে সে কি সব বলে।
ঐ যে গ্রাম দেখা যাইত্যাছে। আলো জ্বলতাছে। লোকজন আপনার জন্য অপেক্ষা করতাছে। চেযারম্যানের শালাডা একটা কসাই, আপনার ডান হাতটা কাইট্যা ফেলতে পারে। অথবা পুরো জীবনটা নিয়া নিতেও হেগোর হাত কাঁপবো না। তিনদিন আগেই এক মাইরে রেপ কইর্যাব ধইঞ্চা ক্ষেতে ফেলাই রাখছিলো...
থাম। থাম, কি বলতাছ এইসব? এইখানে কি এইসব অনাচার মিডিয়াকে জানানোর মত একটা লোক নাই। এত বাহাদুর যে সেও কিছু কয় না কেনো?
কি কইবো। ঐ ট্রেনের কাম , আর তেলের কল, চালের কল, জমি জমা আসলে কামের যা সব কিছু ঐ দুই পরিবারের দখলে। কৃষক শ্রমিকগো শোষন কইরা হেরা ঢাকায় প্রসাদ বনায়, হেগোরে চটাইয়া অকালে কেডা মরতে চায়। হেগোরে চটাইলে পুরা গ্রামই রানা প্লাজা বানাই দিবো। আপনারে কই ঐ মোল্লা বাড়িতে আগুন দেয়ার ফন্দীতে মোল্লারও হাত আছে। তলে তলে হেরাও খালি টাকাই চেনে। ওসব বাদ দেন। বিড়ি আছে, খাবেন।
না! আচ্ছা ঠিকাছে দাও।
ভ্যান থেকে নেমে রাস্তার এক পাশে দাঁড়িয়ে এখন দু’জন। হাত বাড়াতে গিয়েই চোখে পড়ল বিষয়টা। কিছুটা ধাক্কা খেলাম। নিজামুদ্দীনের বাম হাতটা নেই। ময়লা ধুলো মাখা শার্টের হাতাটা ঝুলছে কেবল। অবাক তাকিয়ে রইলাম।
না জিজ্ঞেস করে পারলাম না। তুমিই তাইলে বাহাদুর।
সে মুচকি হাসল। দাঁড়ি ছাপিয়ে সে হাসি আমাকে অনেক কিচু বলে গেলো গোপনে।
আপনারে আমার ভালা লাগছে ভাইজান। আপনেরে আমি টিভিতে দেখছি। হেইর লাইগ্যাই চিনছি। আপনে আসলেই ভালা মানুষ। হের লাইগ্যা গ্রামের পথে আপনারে নিয়া আসি নাই। এইডা শহরে যাওনের পথ। আপনি গ্রামে যাইয়েন ন্যা। হেরা আপনেরে ...সে থাক, আপনার লগে আমিও ঢাকায় যামু। আমারে নিয়া চলেন। হেরা গ্রামের মাইয়াগ্যে ইজ্জত নিয়া খেলা শুরু করছে আমি হুনছি আমগো গ্রাম আর আশেপাশের অনেক গ্রামেরই প্রচুর মাইয়াগ্যো হেরা ঢাকায় নিয়া দেহ ব্যবসা করায়। অনেক সহ্য করছি, আর না ভাইজান। আর না...