\\এক\\
'তাড়ি মেইরে যাচ্ছি আমরা, টাল হতিছি আমরা আর ওদিকে শোনলাম বুড়ো নেপু গাজী ভুল বুকতেছে। কাল রাত্তি বুড়ো জিন দিখেছে। ঘরের বাইরি বারান্দায় চকিতে শুয়েছেলো। বিলের কানাদে বড় বড় পা ফেলে জিনডা এই গ্রাম পেরুয়ে নদীর ওদিকে নাকি উদাও হুয়ে গেলো। এক এক পা পড়তেলো আর এক একখান মাছের ঘের যাচ্ছিল পেরুয়ে...'
হারুন মোল্লার মুখের সে কথা কেড়ে নিয়ে জব্বার ঢালী বলে উঠল, 'দূর দোস্ত ! বুড়োর দেড়খানা পা কবরে। কি দেখতি কি দিখেছে। বিলের চারিপাশ ঘিরে এত বাড়ি, ঘেরের চৌকিদার- কারু চোখে পুড়লনা, আমরাও তো এইখানি বসেই তাড়ি গিলতেলাম, কই আমাগো চোখে পুড়লনা তো। বুড়োর ভিমরুতি হুয়েছে। বাদ দাও। এই নাও, ধরদিন, আরেক গেলাস মারো...'
'মালডা নুরু আজ বেশ ভালা বানাইয়েছে। গেলাসে ! দূর! দেওদিন, পুরো বোতলডা ভুরে দেওদিন। '
বিলের দিকের দরজাটার খুব কাছে খোলা একটা চকির উপর বসেছিল দুই বন্ধ হারুন আর জব্বার। শরতের আকাশে মেঘের বড্ড অভাব। প্রায় পূর্ণ চাঁদের আলোটা অন্ধকারকে অনেকটা গ্রাস করলেও এই নির্ভৃত গ্রাম্য রাতে চেহারা চেনার মত অবস্থা নেই। দরজার বাইরে একটা পায়ের শব্দ এগিয়ে আসছে। বিলের দিক থেকে ঘেরের মাঝের সরু পথ দিয়ে আসতে হয় বলে এদিক দিয়ে কাষ্টমার খুব কমই আসে। পায়ের শব্দ শুনে হাতের পাঁচ ব্যাটারীর টর্চ লাইটা তাই সেদিকে মারে এই চত্বরের মালিক নুরু। আগন্তুকের লম্বা ছায়া পেছনের জমি ছাড়িয়ে মাছের ঘেরের উপর গিয়ে পড়ে। সে ছায়ার বিল আর ঘের জুড়ে এক নিরব মনভীতি কারও কাছে ধরা পড়বে যদি হঠাৎ তাকায়।
'এই দেখো, নাসেরও চলে এইয়েছ। তা দেরী হুলো কেন নাসু। রাতির প্রথম প্রহরতো শেষ হুলো...'
'জব্বার ভাই, ঐ ছোড মাইয়্যেডার একটু জ্বর হুয়েছে, ওর জন্যি ডাক্তার দেখাতি ঈশ্বরীপুর বাজার গেলাম। বাড়ি এইসে বউডার আবার নখরা শুরু হুলো-আসতি দিবে না। এইসব করতি করতি দেরি হুয়ে গেলো।'
'তা নাসের তোমার সুংগে কোন জিন-ভূতিগো দেখা হুলো না রাসত্দায়?'
'হঁ, আমিও হুনিছি। নেপু চা নাকি জিন দিখেছে। পেছনের বিলে ঘেরের পানির উপর দে হেঁটে গেছে বনের দিকি। আসতি একটু গাডা ছমছম করতেলো বৈকি। গোল-তাড়ির টানে ভয় কই গেছে উইরে। তার উপর আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ উঠে গেছে আশি ভাগ। আজ আর তেনারা আসে নাকি। অনেক কথা কওয়ালে। ঐ নুরু , কৈ গেলি পুরান মাল থাকলি দেদিন এক বোতল।'
\\দুই\\
রাতে আজকাল খুব একটা ঘুম আসেনা নেপু গাজীর। অতীতের দীর্ঘ জীবনের নানান স্মৃতি ঘুরে ফিরে আসতে থাকে বারবার। সব কিছুর উপর মেয়েটার বিয়ের চিন্তা ক্রমাগত মাথাটা ব্যাথা করে তোলে। কিছুতেই কিছূ বুঝে উঠতে পারে না। স্কুলের গন্ডিটাও মেয়েটা পার করতে পারলনা। সুন্দরবন সংলগ্ন এই এলাকায় কোন হাই স্কুল নেই। ৭/৮ মাইল দূরে ঈশ্বরীপুর গিয়ে পড়তে হত। নাইনে ওঠার পর আর পারা গেল না। বোরখার পর্দা ভেদ করেও পুরুষের লোভের দৃষ্টি ঠিকই পড়তে লাগল মেয়েটার উপর।
দু'গ্রাম পরের এক বেয়াড়া ছেলে পিছে লেগে গেলো জোকের মত। রোজ পথ আগলে ধরে। সে আবার চেয়ারম্যানের কেমন জানি ভাগ্নে হয়। মেয়েটার স্কুল যাওয়া বন্ধ হলো। সেই থেকে মেয়ে ঘরে একা। রাতে তিনি বাইরে বারান্দায় ঘুমান। মেয়েটাকে বুকের ভেতর আগলে রাখতে মন চায়। একমাত্র ছেলেটা তার সেই যে বছর তিনেক আগে ঢাকায় গেলো রিকশা চালাতে আর ফিরলো না। বিয়ে করে বুড়ো বাবা আর ছোট বোনকে ভুলে গেছে। রোযার ঈদের সময় একবার আসে বাড়িতে, তা দুটো কাপড় আর হাজার খানকে টাকা দিয়ে জন্মের ঋনটাকে কিঞ্চিৎ দুর্বল করতেই বোধহয়।
বন এলাকার মানুষ নেপু। ভয় ডর অতটা ছিল না কখনও। কিন্তু আজ বয়স হয়েছে। শরীরের সাথে দূর্বল হযেছে মনটাও। এক সময় বনে গিয়েছে অনেক। কখনও কাঠ কাঠতে আবার কখনও গোলপাতা সংগ্রহের জন্য। সে সব পুরাতন কথা। কিছু পৈত্রিক জমি জমা ছিল। ঐ সামনের বিলেই সে সব জমি। নিজেই চাষ করত। ফসল যা হতো ভালোই চলে যেত। সোনালী ধানে ভরে যেত বিল। দেখতে দেখতে জমি সব জলের তলে হারিয়ে গেল। মাছের ঘেরে বদলে গেলো বিলের বেশির ভাগ জমি। এমনেতেই নোনা এলাকা। ঘের করায় মাটিতেও ধরল নোনা। ফসল আর হয় না। বাধ্যহয়ে ঘেরের ভিড়ে তাকেও মিলে যেত হলো। এক জীবনে কত রূপ। কাঠুরে, কৃষক তারপর জেলে। তারপর আরও আছে- কন্যা দায়গ্রস্থ এক অসহায় পিতা।
এসবই বারবার মাথায় ঘুরতে থাকে তার। বিলের কোনায় বাড়ি। এদিকে বাঘের উপদ্রব ছিল বেশ কয়েকবছর আগে। এখন বনেই বাঘ কম, উপদ্রব করবে কি আর। বাঘের ভয়ে প্রায় গৃহস্থ বাড়ি উঁচু করে মাটির দেয়ালে ঘেরা থাকে। তার বাড়ির বিলের দিকটা এখন পুরো খোলা। আর্থিক অবস্থা ভালো না। ভাঙা দেয়াল নতুন করে গড়ার ক্ষমতা নেই আর। ঘেরে মাছও নেই। দেখারই তো নেই কেউ। অসহায় দুটো চোখ মেলে বিলের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে মাথার ভেতরে ভাবনার রাজ্যে কেটে যায় সন্ধ্যা এবং সন্ধ্যার পর রাতে একের পর এক প্রহর।
ঐ দূরে সবটুকু তার চেনা। বিলের ওপারে একটা ছোট গ্রাম। তারপর একটপা ছোট খাল। খালের পরে আবারও একটা ছোট গ্রাম। বড় বড় গাছ। ওটা সুন্দরবনেরই অংশ আসলে। খালটা সুন্দরবনের নদী থেকে কেটে এসে ঢুকেছে তাদের এদিকে। দিনের বেলায় ওদিকে তাকালে সবুজের পর সবুজ এক দিগন্ত চোখে পড়ে। কিন্তু মাঝের সেই সবুজ বিলটা নেই। কেবল পানি আর পানি।
উঁচু আইল দিয়ে বিচ্ছন্ন করা ঘেরগুলো যেন আলাদা আলাদা দর্পন। প্রায় পূর্ণ চাঁদটার প্রতিবিম্ব দেখতে পাচ্ছে বরান্দায় শুয়েই নেপু গাজী। জিন-ভূতের ভয় তার সেই অর্থে নেই। কিন্তু মনে এদের প্রতি একটা অশনি সংকেতের সুনির্দিষ্ট মাত্রা ঠিকই স্থান করে আছে আজন্ম। এটা এলাকার আর সবার মতই তারও উত্তরাধীকার সূত্রে পাওয়া। তার ভয়-যদি তার সমত্ত মেয়েটার উপর ভর করে! জীবনে অনেক জিনে পাওয়া মেয়ে দেখেছে সে। ভয়টা সেখানেই বেশি। সে কেনো দেখলো কাল। ঐ ঘেরের কুঁড়ে ঘরে থাকা কোন চকিদারের চোখেও পড়ল না। সব তো ঘুমিয়েই থাকে। পাহাড়া দেয় নাকি। একজন অবশ্য তার কথায় সাই দিয়েছে, সে ঐ দূরের শেষ ঘেরটার চকিদার। সে টের পেয়েছিল। জিনটা ঐ ঘেরের একটা অংশের পানিতে পা দিয়েছিল। শব্দ শুনেছে। সকালে সেখানে অনেক মাছ মরে পড়ে থাকতে দেখেছে সে। গাজী তাইতো আরও নিশ্চিত।
আর আজকে আবার যখন দেখল আর কি অনিশ্চিত হয়ে পারে। ঐ তো স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে। চাঁদের আলোয় অনেকটা দূর দৃশ্যমান। ছায়ার মত । লম্বা দেহ। কালো শরীর। দক্ষিণ দিকে চলে গেলো। ঐ দিকে নুরুর বাড়ি। নুরু বাড়ির পেছনে পুরো জমিতে গোলপাতার গাছ লাগিয়ে ভরে ফেলেছে। সেদিক দিয়েই নদীর দিকে চলে গেলো জিনটা।
\\তিন\\
নুরুর গোলপাতা গাছের বাগান করা দেখে অনেকেই হেসেছিল। নেপু গাজী অবশ্য বলেছিল, ' নুরুরে তুই এককান ভালো কাম করিছিস। জমিতে ধান হুতেছ না, মাছ চাষ কি আমাগো কাম, গোলপাতাই লাগা, গোলপাতাই আমাগো সোনার ফসল হুয়ে যাবেনে..'
নুরু কারও কোন কথার কোন উত্তর দেয়নি। সোনার ফসল বিষয়টা নেপু গাজীর আক্ষেপ সুর হয়ে থাকলেও নুরু সে স্বপ্ন ঠিকই দেখেছিল। হতে পারে সে স্বপ্নের কিছুটা নেতিবাচক, সামাজিক বিবেচনায় হয়তো নষ্ট। তবুও সে স্বপ্ন নিয়েই কঙ্বাজার থেকে ফিরেছিল। সে স্বপ্ন বাস্তব করে তুলেছেও। ঘরটা বেশ ঠিকঠাক করেছে ইতিমধ্যে। তিনবেলা পেট ভরে পরিবারের সবাই খেতেই শুধু পাচ্ছেনা বরং ছেলেটাকে থানা সদরে কলেজে পড়াতেও পারছে। ছেলেটা ওখানেই থাকে।
কাজের অভাবে গতবছর শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয়ে সুদূর কঙ্বাজারে মাটি কাটার কাজে চলে গিয়েছিল নুরু। রামুতে মাটি কাটার সময় একদিন এক স্থানীয় শ্রমিকের সাথেই সেই গোলপাতার রসে তৈরী তাড়ির আস্তানায় হাজির হয়। যে গোলপাতা গাছ বুকে নিয়ে কেটেছে শৈশব সেই গাছ রামুতে এক নির্ভৃত বিলে দেখে সে অবাক না হয়ে কি পারে। তাও গোলপাতার রস দিয়ে তাড়ি বানিয়ে গোপনে দেদারসে পয়সা কামিয়ে যাচ্ছে । সে নিজেও পান করেছিল। প্রায়ই যেত পান করতে। আফসোস হচ্ছিল এই রসের এত উন্মাদনা লুকানো সে খবর তারা জানে না। অথচ তাদের কত গর্ব গোলপাতা শুধু তাদের সুন্দরবন এলাকার গাছ। গোলপাতা গাছে রস হয় এটুকুই জানে তারা। কাজে লাগানোর চিন্তা মাথায় আসেনি কখনও। বাড়ি ফিরে গিয়ে এই ভুল আর করবেনা ভেবেছিল। গোলপাতাই তার জীবনেন নতুন জীবিকার পথ খুলে দেবে।
বাড়ি ফিরে আসে মাস চাারেক বাদে। ততদিনে গোলপাতার রস আহরন, তাড়ির তৈরীর পদ্ধতি সব তার শেখা হযে গেছে। বাড়ির পেছনে নিজের যে অল্প কিছু জায়গা ছিল সেখানে এখন আর ফসল হয়না। মাটি কেটে উঁচু করে একটা চত্বর বানালো, সেই চত্বরের চারপাশে গোলপাতার বাগান গড়ে তুলল। চত্বরটা ঢেকে গেলো আড়ালে। সেখানেই তার রসের তৈরী তাড়ির আসর বসে রোজ রাতে। গোপন আসর। কিন্তু যাদের দরকার তারা ঠিকই খুঁজে খুঁজে চলে আসে। খারাপ খবর ছড়াতে সময় লাগেনা। তাড়ি বানিয়ে যে বাড়তি রস থাকে সে অংশ দিয়ে গুড় বানায় সে। সে গুড় হাটে পাঠায় বেঁচতে। নতুন স্বাদের গুড়ের আড়ালে অনেকেই তাড়ির গোপন আসরের খোঁজ নিতে ভুলে যায়। অথচ হাতে হাতে তার তাড়ি থানা সদর ছাড়িয়েও পৌঁছে গেছে ঠিকই জেলা শহর পর্যর্ন্তও। থানার পুলিশের জন্য একটা মাসিক বখড়াও বন্দবস্ত হয়েছে। টাকাটা সে সময় মত পৌঁছে দিতে দেরী করে না। এলাকার তরুন যুবা ছেলেপেলেগুলোকেও সে হাত করেছে। নিয়মিত খরচপাতি আর তাড়ির মজা তাদেরও সে ঠিকই পাইয়ে দিয়েছে।
দু'গ্রাম পরের এনতাছ আজ আসরে এসেছে। এনতাজ তাদের ইউনিয়নের চেয়ারম্যানের ভাগ্নে। সাথে তার দুইজন সাঙ্গপাঙ্গও আছে। ভোর হবার আগেই আসরের সবাই কেটে পড়ে। সকালে টলতে টলতে কেউ বের হবে সেটা নুরু হতে দেয় না। পুলিশের নিকট থেকে সেরকমই গ্রীণ সিগন্যাল দেয়া আছে।
নাসের আসার পর তার সাথে এই গ্রামেরই জব্বর আর হারুনের কথা হচ্ছিল নেপু গাজীর জিন দেখা বিষয়ে। এনতাজও কাছেই এক চকিতে বসে সে সব শুনছিল। নেপু গাজীর নাম শোনায় কানটা তার আর একটু খাড়া হয়। অনেকদিন হলো নেপু গাজীর মেয়ে নিপার দেখা পায় না সে। মাঝে মাঝে গোলপাতার তাড়ির টানে রাত বিরাতে এই গ্রামে আসে ঠিকই কিন্তু ভোরের আগেই আবার গ্রাম ত্যাগ করে। মনে মনে নিপার প্রতি একটা অমোঘ আকর্ষন আর জিদ সে ভুলতে পারে না। ভুলতে পারে না মেয়েটার হাত ধরায় যেদিন একটা চড় খেতে হয়েছিল ঈশ্বরীপুর হাটে। তারপর থেকে মেয়েটা স্কুলে যাওয়া বন্ধ করেছে। প্রতিশোদের আগুন মনে শিখা চিরন্তন হয়ে হয়ে গেছে। নেপু গাজীর নাম শুনতেই তাই নিপার কথা মনে পড়ে যায়। মনে মনে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ একদিন এই মেয়েটাকে সে নিয়ে পালাবেই।
\\চার\\
হাটবার আজ। পুরো হাটে নেপু গাজীর জিন দেখার চর্চা চলছে। পর পর দুইদিন জিন দেখেছে সে। কেউ বিশ্বাস করছে কেউ করছে না। বিশ্বাসী দলের সংখ্যাই বেশি। পুকুরের মাছ মারার বিষয়টি বিশ্বাসকে আরও আলোকিত করে তুলেছে অনেকের মনে। যে যার জীবনে জিন সম্পর্কিত নানান শোনা কথা বলায় ব্যস্ত হয়ে উঠেছে । সবার কথার শেষ সুর এক জাযগায় থেমে যায়- 'জিন দেখা দিতেছে রোজ, না জানি নেপু গাজীর কপালে কি খবরডাই না রুয়েছে।'
হারুন এর সাথে হাটেই দেখা হয়ে যায় নেপু গাজীর। হারুন বলে , 'নেপু চা রাতে আমরা দুজন ঐ বিলের ওদিকেই ছেলাম তো, ঐ নুরুর বাড়ি গেছেলাম গোলপাতার রসের গুড় কিনতি। কই আমাগো তো তেনায় দেখা দিল না। ?'
'নুরুর বাড়ির উপর দে তো লম্বা পা ফেলায়ে ঐ নদীর দিকে চলি গেলো, দেখবা কি কুরে ...'
'চাচা, চলেন আইজ রাতি আমি আর জব্বার আপনার সাথে থাকবানে, দেখি ...'
মেয়ের কথা মনে পড়তেই ভয় হয়। হারুন অত সুবিধার মানুষ না সেটা নেপু গাজী জানে। দু'দুটো বিয়ে করেছে। অন্যের জমি জমা নিয়ে কেস কাম করে একাকার। খালি অন্যর ক্ষতি করতে ব্যস্ত সে। তাকে তো বাড়ি রাখা যাবে না।
'তা লাগবে না বাবা, জিন আমার কি করবেনে আর এই বুড়ো বয়সে...যাই ঐ ওদিকে একটু যাতি হবে' বলেই সে কোনমতে কেটে পড়ে।
সন্ধ্য হতেই সত্যি সত্যি ভয় করতে থাকে নেপু গাজীর । আজ তৃতীয় দিন। মেয়েকে নিয়ে চিন্তিত হয়। মেয়েটাকে ভাল করে পর্দা করতে বলে। নামায রোজা করতে বলে বারাবর। মেয়ে অবশ্য বাবাকে আশ্বাস দেয়। বলে, 'বাবা, তুমি ভুল দিখেছো। বয়স হুয়েছে না। ঐ কেওড়া গাছ গুলোর ছায়া দিখেছ আর ভেবেছো জিন। এই আলোক যুগে জিনরা সব পালাইগেছে কবেই। '
বাবা তার মানে না। মেয়েও বাবাকে আর বারান্দায় শুতে দেবে না । জিদ করেছে। দুজনেই ঘরের দরজা লাগিয়ে সন্ধ্যায় সন্ধ্যায় খেয়ে দেয়ে ঘুমের চেষ্টা করতে থাকে।
মেয়েটা ঘুমিয়ে পড়ে দ্রুত। নেপু গাজীর ঘুম আসে না। চোখ বুজতেই কেবল তার স্মৃতির সুন্দর গ্রাম্য প্রকৃতির মাঝে ভয়ংকর সব কল্প অঘটন ভেেেস ওঠে। ... সর্ষের ক্ষেতের হাঁটছে সে আর তার মেয়ে নিপা। মিষ্টি বাতাস বয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ হলুদ ক্ষেতের আড়াল থেকে একটা বিশাল রয়েল বেঙ্গল বাঘ লাফ দিয়ে এসে পড়ল তার মেয়েটার উপর। ... মুহূর্তে চোখ খুলে যায়। মেয়েটা পাশে নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে। দেখে একটু শান্তির নির্ভেজাল বাতাস বয়ে যায় প্রাণে।
কিছুক্ষণ পর চোখ বন্ধ করতেই আবার দেখে... তার বাড়ির উঠোনে এক পা পড়েছে । বড় শিষ্টফুল গাছের গুড়ির মত বিশাল এক পা। চেহারা দেখা যাচ্ছেনা। আরেকটা পা ঐ বিলের ওপারে নুরুর গোলপাতা বাগানে। তার মেয়েটাকে ধরতে বিশাল হাত নেমে আসছে। জিনের হাত...আবার চোখ খুলে যায়। ভয় করতে থাকে একটু একটু।
কানে কয়েকটা পায়ের শব্দ আসে। সত্যিকারের শব্দ। এবার স্বপ্ন নয়। ভযে হাতপা অসাড় হয়ে যায় মূহুর্ত ক্ষনের জন্য। মেয়েটাকে ফিসফিসিয়ে ডাকতে থাকে। কাঠের দরজাটা খোলার ক্যাঁচকঁ্যাচ শব্দ হয এবং কিছু বুঝে ওঠার আগেই অন্ধকার ফুরে সত্যিকারের দুটো মানব হাত চেপে ধরে তার মুখ। সে আর চিৎকার করতে পারে না ...
\\পাঁচ\\
নুরু তার তাড়ির নাম দিয়েছে গোল-তাড়ি। প্রচলিত তাড়ি বানানো হয় মূলত তালের রস থেকে। গোলপাতার রস থেকে থেকে তৈরী তাড়ির নামে ভিন্নতা আনার জন্য সে নাম দিয়েছে গোল -তাড়ি। এই নামেই চলছে তার ব্যবসা। নাম ছড়িয়ে পড়েছে দূর থেকে দূরান্তে।
সচরাচর দূর দূরান্ত থেকে কেউ তড়ির খোঁজে এলে তাদের মনে অনেক প্রশ্ন থাকে। খুব আনন্দের সাথে সেই সব প্রশ্নের উত্তর দেয়ার চেষ্টা করে নুরু। রাতে গোলপাতা গাছের পাতার কিছু অংশ কেটে সেখানে হাড়ি পাতে। সেই হাড়িতে জমা হয় রস। পুরো বিষয়টা প্রায় খেজুরের রস সংগ্রহের মতই ব্যাপার। তাড়ির এই মূলনীতি আরও নিঁখুত করে সে ব্যাখ্যা করে। তার তাড়ির স্বাদ বেশ মিষ্টি। এই সুস্বাদু করার রহস্য অংশটুকু সে কাউকে বলে না। এটা কঙ্বাজার রামুর ওস্তাদই শিখিয়েছে তাকে। একটু পুরাতন হলে তাড়ির আছড় হয় ভালো । পুরাতন তাড়িই তাই বিক্রি হয় বেশি। শহর থেকে যারা আসে তারা প্রথম প্রথম নতুন পরিষ্কার তাড়িই নেয়। ধীরে ধীরে কয়েকবার খেলে বোঝে পুরাতন মালেই মাতাল হওয়া যায় বেশি।
আজও নতুন দু'জন তরুন এসেছে নুরুর কাছে। নিলয় আর নোমান। দু্ই বন্ধু। থানা সদরে নোমানের মামার বাড়িতে বেড়াতে এসেছে তারা। বেড়ানো অযুহাত মাত্র। মূল উদ্দেশ্য এই গোল-তাড়ি। সমবয়সী গ্রাম্য এক পরিচিত তরুণের মাধ্যমে সাত সকালে চলে এসেছে নুরুর বাড়ি।
নুরুর মনটা ভার। খুব একটা গল্প করতে মন চাইছেনা। নতুন দু'কাস্টমারকে বসার জন্যও বলল না। দু'টো হাফ লিটার পানির বোতল ভর্তি তাড়ি দিয়ে পয়সা নিয়ে বিদায় জানাল। নিপার লাশ পাওয়া গেছে বিলের পূর্ব দক্ষিণ কোনে বিশাল এক কেওড়া গাছের উপর। এক ডালে পা আরেক ডালে হাত ছড়িয়ে শুয়ে আছে তার লাশ। নেপু গাজীর লাশও পাওয়া গেছে বাড়ির উঠোনে। সকালে এই দুই লাশের খবর ছড়িয়ে পড়েছে দ্রুত। নুরু সেদিকে যাবার জন্যই রওয়ানা হচ্ছিল। নিলয় আর নোমানকে তাড়াতাড়ি এই গ্রাম থেকে চলে যেতে বলল। লাশের ব্যাপার । পুলিশ টুলিশ আসবে। ঝামেলা হবে।
সকালে খবর শুনেই তার আসর পরিষ্কার করে ঝকঝকে করে ফেলেছে। এখানে যে নেশার এত বড় আসর বসে তা এখন দেখে বোঝার উপায়ও নেই।
রাতের আসর ভেঙেছিল চারটার আগেই। সবাই যখন যাবার জন্য উঠছিল তখনই হাজির এনতেজ আর তার এক চামচা। তাড়ি চাইল। যত পুরাতন হয় তত ভাল। এক সপ্তাহ পুরাতন তাড়ি ছিল। তাই এক বোতল দিয়ে বসতে মানা করল। আযানের সময় হয়ে গিয়েছিল। এনতেজরাও বসার জন্য তাগাদা ছিল না। বোতল নিয়েই দ্রুত কেটে পড়েছিল। আবছা আলোতে এনতেজের গায়ের সদা কাপড়ে ছোপ ছোপ লাল দাগ চোখে পড়েছিল। দু'জন বেশ পরিশ্রান্তও ছিল। কিন্তু তখন অতটা ভাবেনি নুরু।
খবর শোনার পর থেকেই নুরুর মনে তাই এনতেজকে নিয়ে একটা সন্দেহের দানা বেঁধেছে । কিন্তু এনতেজ অন্য গ্রামের । এত সাহস পাবার কথা না। আর সবার মত জিনের কাজ ভাবতেই তার স্বাচ্ছন্দ্য বোধ হতে লাগল।
\\ছয়\\
কেওড়া গাছ থেকে নিপার লাশ নামানো হয়েছে। রক্তাক্ত মাথা। কিছুর সাথে বাড়ি দেয়া হয়েছে জোড়ে। গাছের গায়ে রক্তের দাগ স্পষ্ট। মেয়েটর সারা দেহ উদোম। এক টুকরো কাপড়ও নেই মেয়েটার গায়ে। নাভীর নিচের গোপন অংশে জমাট জমাট রক্তের ছোপ। প্রায় পুরো গ্রামবাসীই চলে এসেছে। ঘিরে আছে লাশটা। কিন্তু কেউ কাছে যাচ্ছে না। বরং যে দু'জন গাছ থেকে নামিয়েছে তাদের কে লোকজন বকা বকি করছে। জিন গ্রামের আরও অনেকের ক্ষতি করবে। তারা ভীত প্রায় সকলেই। নানানজন নানান মন্তব্য করছে কিন্তু এ কাজ যে কোন বদ জিনের সে বিষয়ে প্রায় অধিকাংশ গ্রামবাসীই নিশ্চিত। তারা আরও নিশ্চিত মানুষের বেশে এসে এই অঘটন ঘটিয়েছে জিনটা।
নেপু গাজীর উচিৎ হয়নি জিনটাকে চটানো। এবার বুঝুক। মেয়েটাকে তো গাছে উঠিয়ৈ নিয়ে গেলো। বেচারা বুড়োটা মরল ঘরের উঠোনে। বাধা দিতে গিয়েছিল বোধহয়। এক আঘাতেই কুপোকাত হয়ে গেছে। মেয়ের লাশের পাশে এনে নেপু গাজীর লাশটাও রাখা হয়েছে। মাথায় নেপু গাজীর একটা দাগ দেখা যায়। কোন রক্তপাত নেই। মাথাটা কেবল ফুলে আছে। ভীষণ রকম ফোলা।
নিলয় আর নোমান ফিরে যেতে গিয়েও যেতে পারেনি। নুরুর পিছু পিছূ গিয়েছে লাশ স্থানের কাছে। নুরু মানা করছিল। শেষে তারা বলল, 'একটু দেখেই যাই। দেখেই চলে যাব।'
গ্রামের চেনা চোখ গুলোর সাথে অচেনা দুটো মানুষের চোখও উদোম দেহটা একবার স্ক্যান করে নেয়। তারো দু'জন স্পষ্ট বুঝতে পারে মেয়েটার সাথে রাতে কি পাশবিক নির্যাতন হয়েছে। নির্মম ধর্ষনের ছাপ স্পষ্ট। তারপরও গ্রামের এত মানুষের লালিত জিন ভীতি তাদের অবাক করে। নুরুকে জিজ্ঞাস করে জানে নেপু গাজীর জিন দেখার কথা। অবাক হয়। নোমান বলে, 'এই যুগেও মানুষ কেমনে এইসব কুসংষ্কারে ডুবে থাকতে পারে! যেখানে চোখের সামনে নৃশংস লাশ। আশ্চর্য না- মানুষের চেয়ে চেয়ে দূর্বল এক প্রাণী জিন সে এই বড় বড় পা ফেলে চলে গেল অদৃশ্য হয়ে। আর মানুষ সেটা বিশ্বাসও করে নিচ্ছে। আকারও বলে বদলায় জিন। অদৃশ্য হয়ে যায়। শুনেছিস না নিলয়। পদার্থ বিজ্ঞান এখানে পুরো বদলে গেলো । আজব! কোন কিছূ অদৃশ্য হলে তার ভর শুন্য হতে হবে। সে কি সম্ভব? '
নুরু ওসব বিজ্ঞানের কথা বোঝে না। কিন্তু নিলয় তাদের মত করে বুঝিয়ে দেয়র চেষ্টা করে, 'জিন মানুষকে ধর্ষন করবে কেনো? জিনের জন্য তো আছে পরী। আগুনের জন্য আগুন। মাটির মানুষের জন্য মাটির মানুষ।। ভালো করে দেখেন নুরু ভাই, এ মানুষেরই কাজ। ক্লিয়ার ধর্ষণ, তারপর হত্যা।...'
নুরু পোড় খাওয়া লোক। বুঝে যায় এ ঐ এনতেজেরই কাজ। কিন্তু সে তো কাউকে বুঝতে দেবে না। থানা পুলিশ হলে তার আসর নিয়েও টান পড়বে। তখন আর এত সহজে পার পাওযা যাবে না। নুরু দ্রুত নিলয় আর নোমানকে কেটে পড়তে বলে। তারা নতুন মানুষ। সে চায়না তার কাস্টমার এখানে কোনরকম বিপদে পড়ুক। এসব বুঝিয়ে সে দ্রুত দুই বন্ধুকে রওয়ানা করিয়ে দেয়। বিদায়ের করমর্দন করেই নুরু লাশের আরও কাছে এগিয়ে যায়।
'আর দেরী করলি হবেনা। তাড়াতাড়ি লাশ দু'টার ব্যবস্থা করতি হবে। জিনে মারা লাশ বেশিক্ষণ মাটির উপর ফেইল্যে রাখতি পারবানা। কখন আবার জিন ক্ষ্যাইপে যাবেনে তার ঠিক আছে। জিনে মারা লাশ দুপুরের আগেই দাফন করতি হয়। কঙ্বাজার যখন ছেলাম। বন পাহাড়ের দেশ। ঐখানে তো জিনরা যাতায়াত করে আরও বেশি বেশি। এইরকম এক মেইয়্যেরে মাইরে ঐ উঁচু এক পাহাড়ের উপর ফেইল্যে দে গেছে। তারপর হুজুররে ডাকা হুলো। উনি বুলে দিলেন দ্রুত লাশ দাফন করতি...
নিলয় আর নোমান বাজারের দিকে হাঁটতে থাকে। মনটা খারাপ হয়েছে বেশ দুজনের। নিলয় বলে ওঠে, 'মেয়েটার লাশটার সারা দেহে বিভৎস নির্যাতনের চিহ্ন। নিশ্চয় একজন ছিলনা। কিন্তু এরা এ কি করছে। পুলিশ কে তো অন্তত জানানো উচিৎ...'
'অন্ধবিশ্বাস যে আইনের চেয়ে বড় ওদের কাছে। আর নুরুর মত লোকদের পকেটে দু'একটা পুলিশ এমনেতেই থাকে। তার উপর আমরাও কিন্তু ফেসে যেতে পারি। আমাদের তাড়ি কেনার বিষয়টাও কিন্তু অবৈধ, বন্ধু...।'
'তাই বলে...'
'চল, মামার বাড়ীতে গিয়ে ল্যাপটপটা নিয়ে বসি। নেট কানেকশন ঠিকমত পেলেই হয়। মোবাইলে আমি ছবি তুলে এনেছি। ব্লগে তো ছদ্মনামে আমরা ছবি সহ লিখে দিতে পারি পুরো ঘটনাটাই, কি বলিস?'
'গোল-তাড়ির কথাটা কেবল চেপে চাইস।'
০১ ফেব্রুয়ারী - ২০১১
গল্প/কবিতা:
৭৮ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ ডিসেম্বর,২০২৪