সবুজ পৃথিবী

সবুজ (জুলাই ২০১২)

Shahitaz Aktar Nupur
  • ৩৫
  • ৮৯
প্রতিদিন বিকালে স্কুল থেকে ফিরে অয়ন দৌড়ে চলে আসে বারান্দায়। রেলিং এর ফাঁক দিয়ে তাকিয়ে থাকে বাসার সামনের বট গাছটার দিকে। বিকাল হলেই কত পাখির কিচির-মিচির শব্দ। অয়নের শুনতে খুব ভালো লাগে। মনে হয় যেন পাখিরা সব মিটিঙে বসেছে। একটা পাখিকে ঘিরে অনেকগুলো পাখি গোল হয়ে কিচির-মিচির করে। মনে হয় যেন মাঝখানের পাখিটা নেতা পাখি। অয়নের স্কুলের শিক্ষক যখন কোন ক্লাস নেন অয়নরা তখন খুব মনোযোগ দিয়ে শোনে। এখন এই নেতা পাখিটা যা বলছে ঠিক তেমনি অন্য পাখিগুলো মনোযোগ দিয়ে শুনছে। অয়নের খুব মজা লাগে। পাশেই মাঠে কতগুলো ছেলে ক্রিকেট খেলছে। কিন্তু অয়নরা যেমন দামী ব্যাট-বল দিয়ে খেলে স্কুলে এরা মোটেও তেমন খেলছে না। এরা খেলছে লাল রঙের টেপ দিয়ে পঁ্যাচানো বল আর সস্তা কাঠের একটা ব্যাট দিয়ে। অয়ন একবার ওর মাামণি কে বলেছিল মামণি আমাকে ওদের মতো একটা ব্যাট কিনে দেবে। শুনে মামণি ওকে অনেক বকা দিয়েছিল। অয়নের অনেক ইচ্ছা করে মাঠে খেলতে যায়। কিন্তু মামণিটা যে কী রাগী। একটুও খেলতে যেতে দিতে চায় না। বলে বিকেলে তোমার টিচারের কাছে গিটার শিখতে হবে। অয়নের মন পড়ে থাকে খেলার মাঠে। সে বটগাছটার দিকে তাকিয়ে থাকে। অনেকগুলো পাখি কিচমিচ শব্দ করছে। কোন কোনটা আবার লেজ তুলে লাফিয়ে এক ডাল থেকে অন্য ডালে উড়ে বেড়াচ্ছে। যেন কোন মজার খেলায় মেতেছে। নিচ দিয়ে বাদামওয়ালা ডাক ছেড়ে যায় এই বদেম নেবে, বদেম। এক লোক মাঠের এক কোণে বেঞ্চিতে চুপচাপ শুয়ে আছে। অয়ন দৌড়ে ছুটে যায় বুয়ার কাছে। বুয়া, এই বুয়া। বুয়া তাড়াতাড়ি ছুটে আসে। কি হইছে অয়ন বাবা? অয়ন আবদারের সুরে বলে আমাকে বাদাম কিনে দেবে? অয়ন বুয়ার শাড়ির অাঁচল ধরে টানতে থাকে। বুয়া আমি ওদের সাথে খেলতে যাব। বুয়া এবার খানিকটা বিরক্ত হয়। কাদের সাথে অয়ন বাবা? ঐ যে নিচে যারা ক্রিকেট খেলছে তাদের সাথে অয়নের কণ্ঠে আকুতি। ও রে বাবা! সে আমি পারব না। আপনার মামণি জানলে আমাকে শেষ করে ফেলবে। কিন্তু মামণি তো বাসায় নেই। এমন সময় কলিং বেল বেজে ওঠে। বুয়া যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচে। দেখি তো কে আসল? বুয়া চলে যায়। অয়ন মন খারাপ করে তার ঘরে ফিরে আসে। অন্যমনস্ক ভাবে গিটার হাতে তুলে নেয়। তাতে টুংটাং সুর বেজে ওঠে। কিন্তু সে সুর ছাড়া ছাড়া, তাতে প্রাণ নেই।
কখন যেন অয়নের শিক্ষক দরজায় এসে দাঁড়ান, সে টের পায় না। কি হয়েছে অয়ন? সে চমকে মাথা তুলে তাকায়। তার চোখে জল ছলছল করছে।
শরীফ স্যার এই মাসেই মাত্র নতুন এসেছেন অয়নকে গিটার শেখাতে। এর আগে যে স্যার ছিলেন তিনি পড়ালেখার কাজে দেশের বাইরে চলে গেছেন। যাওয়ার আগে অয়নকে শরীফ স্যারের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়ে গেছেন। শরীফ স্যার অয়নের কাছে এগিয়ে আসেন। তার মাথার চুলগুলো এলোমেলো করে দেন, বলেন চল আজ আমি তোমাকে ঐ মাঠে নিয়ে যাব। আমরা আজ মাঠে বসে গিটার শিখব। অয়ন খুশীতে স্যার কে জড়িয়ে ধরে। এভাবেই চলতে থাকে কিছুদিন। হঠাৎ একদিন অয়নের মা অয়নকে ডেকে বলেন শোন আজ থেকে তোমার শরীফ স্যার আর আসবেন না। আমি তোমার জন্য অন্য টীচার ঠিক করেছি। আমি চাই না তুমি আর ঐ মাঠে যাও। তুমি এখন থেকে তার কাছে গিটার শিখবে। কিন্তু মা! অয়ন প্রতিবাদ করতে চায়। মার চোখের দিকে তাকিয়ে সে চুপ করে যায়।
বসার ঘরে নতুন শিক্ষক বসে আছেন। চোখে চশমা, রাশভারী গম্ভীর। মা অয়নকে নতুন শিক্ষকের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন। অয়নের হাতগুলো গিটারের তারের উপর খেলা করে, কিন্তু সেখানে সুর খেলা করে না। এখনও সে প্রতিদিন স্কুল থেকে ফিরে রেলিং ধরে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। ঐ বটগাছ, ঐ মাঠ তাকে ডাকে। দিন দিন সে কেমন যেন চুপচাপ, গম্ভীর, অনর্্তমুখী হয়ে যাচ্ছে। তার মন খারাপ দেখে গতকাল তার বাবা তাকে খুব সুন্দর একটা ডানাওয়ালা পরী পুতুল কিনে দিয়েছেন। পুতুলটার গায়ে সবুজ জামা। হাতে জাদুর দন্ড। নাম তার আনুশকা। কিন্তু অয়ন তাকে এখনও পর্যন্ত ছুঁয়েও দেখেনি। সে চুপচাপ রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে থাকে। হয়ত মনে মনে শরীফ স্যার কে খুঁজে। হঠাৎ অয়ন দেখতে পায় মাঠের পাশে দুটা গাড়ি এসে থামে। অয়ন বুঝতে পারে না তারা কেন এসেছে। লোকগুলো গাড়ি থেকে নামে। তাদের হাতে অনেক বড় একটা কাগজ। অয়ন বুঝতে পারে না লোকগুলো কী চায় কিন্তু তারা আঙুল দিয়ে মাঠের দিকে ইশারা করে, গজ ফিতা দিয়ে কী যেন মাপে। তারপর চলে যায়। অয়নের কৌতুহল বাড়তে থাকে। এরপর একদিন আবার লোকগুলো আসে। আজ কিন্তু ছেলেগুলো মাঠে ক্রিকেট খেলছে না। সপ্তাহখানেক পরে অয়ন দেখতে পায় একদল লোক মাঠের ভেতর ইট, সুড়কি, কাঠ ফেলে কী যেন করছে। আর চার পাঁচজন লোক বটগাছটার নিচে গাছটাকে কাটার চেষ্টা করছে। অয়ন তার ছোট্ট মাথার বুদ্ধি দিয়ে বুঝতে পারে যে তারা আর কিছুক্ষণের মধ্যেই গাছটাকে কেটে ফেলবে। সে ভেবে পেল না এই গাছটা কেটে ফেললে পাখিগুলো কোথায় যাবে? তার খুব ইচ্ছে করলো শয়তান লোকগুলোকে খুব শাস্তি দিতে। সে ওখান থেকে চিৎকার করার চেষ্টা করল। কিন্তু পারল না। শুধু তার চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়তে লাগল। সে তার বুকের মধ্যে একটা চাপা কষ্টের তীব্রতা টের পেল। সে ছুটে গেল সবুজ পরীটার কাছে। যেন সে তার বুকে মুখ লুকাতে চাইল। তাকে জড়িয়ে ধরল।
পরদিন স্কুল থেকে ফিরে সে আবার ফিরে গেল রেলিং-এর কাছে। তার বটগাছটা আজ আর নেই। মাঠের ভেতর ছেলেগুলো আজ আর খেলছে না। বাদামওয়ালা হাঁক দেয় না। বেঞ্চের উপরে লোকটা আজ আর শুয়ে থাকে না। আজ ওখানে শুধু একটানা কাজ চলে। মিস্ত্রীরা ঝুড়িতে করে ইট, সুড়কি আর সিমেন্ট নিয়ে যায়। তারা একটার পর একটা ইট ফেলে গড়ে তোলে ইমারত। অয়ন কারো সাথে ঠিকমতো কথা বলে না। নির্বিকার আর ভাবলেশহীন ভাবে তাকিয়ে থাকে মাঠটার দিকে যেখানে একসময় ক্রিকেট খেলা হতো, বাদামওয়ালা আসত। বটগাছটা ছিল যেখানে পাখিরা গল্প করত কিচির মিচির করে। সে শুধু মনে মনে বলে তোমরা ভালো না, তোমরা কেউ ভালো না। তোমরা কিচ্ছূ বোঝ না, কিচ্ছ ুনা।
সেদিন রাতের বেলা অয়ন ঘুমিয়ে আছে। হঠাৎ সে স্বপ্নে দেখল যে শরীফ স্যার তার ঠিক পিছনে দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি পেছন থেকে অয়নের কাঁধে হাত রাখলেন। অয়ন সামনে তাকিয়ে দেখে সে সম্পূর্ণ নতুন একটা জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। যেখানে তার সামনে অবারিত মাঠ, মাথার উপর দিগন্ত বিসতৃত আকাশ, চারপাশে অজস্র গাছ। গাছে গাছে পাখিরা ডাকছে, মাঠে ছেলেরা খেলছে। বাদামওয়ালা ডাক ছাড়ছে এই বদেম নেবে, বদেম। অয়ন হাত বাড়িয়ে বাদাম নিতে চাইল। কিন্তু হঠাৎ ওর ঘুম ভেঙে গেল। অয়ন তাকিয়ে দেখল সকাল হয়ে গেছে। ঘরে এসে ঢুকেছে সকালের মিষ্টি রোদ। অয়নের মনটা অনেক ভাল হয়ে যায়।
আজ শুক্রবার। অয়নের মনের ভেতর অদ্ভুত এক ভালোলাগা খেলা করে। যদিও আজ ছুটির দিন। অয়ন আজ কোথাও বেড়াতে যেতে চায় নি কারণ তার মনের ভেতর অদ্ভূত এক অনুভূতি কাজ করছিল। তার মন বলছিল আজ কিছু ঘটবে। অয়ন কিছু একটার জন্য অপেক্ষা করে। সকাল গড়িয়ে দুপুর, দুপুর গড়িয়ে বিকাল হয়ে পড়ে। অয়নের মন খারাপ হতে থাকে। তার মনে হতে থাকে যে না আজ আর কিছু ঘটবে না। বিকেলে অয়ন রোজকার মতো রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে থাকে। তার মন ভেসে যায় দূর-দূরান্তে তার স্বপ্নের সেই জায়গায় সেই মাঠে। সে এতই অন্যমনস্ক থাকে যে সে খেয়াল করে না কখন তাঁর পিছনে একজন মানুষ নি:শব্দে এসে দাঁড়িয়েছে। মানুষটি অয়নের কাঁধে হাত রাখে। অয়ন চমকে ফিরে তাকায়। শরীফ স্যার! খুশীতে তার চোখমুখ ঝলসে ওঠে। স্যারের হাতে একটা গাছের চারা। স্যার বললেন, অয়ন তোমার জন্য। অয়ন তাকিয়ে দেখে দরজায় আব্বু-আম্মু দুজনেই এসে দাঁড়িয়েছেন। তাদের মুখে স্মিত হাসি। অয়ন খুশীতে একহাতে স্যার কে জড়িয়ে ধরে। তার অন্যহাতে তখন একটা গাছের চারা, দু' চোখে সবুজ একটা পৃথিবীর স্বপ্ন।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
মোহাম্মদ ওয়াহিদ হুসাইন ......................চমতকার লাগল। মা-বাবারা তাহলে পুরো পাষন্ড নন। শুভেচ্ছা রইল।
রফিকুল ইসলাম সাগর চমত্কার লিখেছেন। ভালো থাকুন। লিখতে থাকুন........।
Shahitaz Aktar Nupur থাঙ্কস, সূর্য ভাই
সূর্য শরীফ সারের মতো মানুষ আজ অনেক বেশি প্রয়োজন। বুঝে না বুঝে আমরা শেষ করে দিচ্ছি আগামীর শৈশব, প্রকৃতির সবুজতা..... সুন্দর গল্প। অনেক ভাল লাগলো।
Shahitaz Aktar Nupur সোহানুর আপনার মন্তব্য আমার খুব ভালো লাগলো, থাঙ্কস
সিয়াম সোহানূর একটা পরিচ্ছন্ন গল্প । একরাশ সজীবতা। ভাল লাগলো ।
রুহুল আমীন রাজু নূপুরের গল্পের ঝংকার ভালো লেগেছে আমার ............সামনে আরো ভালো লেখা পড়ার আশায় রইলাম ........
আরিফ খান বেশ ভালো লাগলো।শুভ কামনা।
Shahitaz Aktar Nupur মুকুল ভাই, গল্পকবিতায় নিয়মিত হওয়ার চেষ্টা করছি
আহমাদ মুকুল সুন্দর গল্প। ম্যাসেজটি অন্তরে ধারণ করার মত। গল্পকবিতায় নিয়মিত হবেন বলে আশা করি।

১৮ জুলাই - ২০১১ গল্প/কবিতা: ৪ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "ছোটবেলা”
কবিতার বিষয় "ছোটবেলা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ ডিসেম্বর,২০২৪