ছোটবেলায় আমি ছিলাম খুবই হালকা পাতলা গড়নের যেন পাটকাঠির সেপাই।আমি এখনও ভেবে পাই না বিষণ্ণতা কি আমি মাতৃগর্ভ থেকে নিয়ে এসেছি নাকি পৃথিবীর আলো বাতাস আমার গায়ে পড়ায় আমি চির বিষণ্ণতায় ভুগছি।সে যাই হোক রোগাটে ছিলাম বলে পাড়ার ছেলে মেয়েরা আমাকে তাদের সাথে খেলায় নিত না আবার বিষণ্ণ ও ভাবুক টাইপ ছিলাম বলে আমাকে আড্ডায়ও কেউ ডাকত না। অবশ্য কখনও কখনও যদি তাদের খেলোয়াড়ের সংকট পড়ত তাহলে মুখ কালো করে কোনও পক্ষ আমাকে ডাকত আমিও তাদের সম্মান রক্ষার্থে ডাক না মেরে ৪-৫ রান করে মুখ লুকিয়ে চলে আসতাম। এসব এর ফলে আমি শৈশবে হয়ে পড়েছিলাম একাকী। একা ঘুরি, একা খেলি একাকী গান গাই।খুব যে সমস্যায় ছিলাম তাও না কারণ নির্জনতা আমার সবসময়ই প্রিয়।
এভাবে চলছিল দিনগুলো। তারপর একদিন, ততদিনে আমার শৈশব শেষ হয় হয় এমন সময়ে এসে হাজির আশিক।ওর বাবা চাকরি করত খুলনায়। বরখাস্ত হয়ে পড়লে চলে আসে গ্রামে। কিছুদিনের মধ্যে দেখা গেল সেও ভীষণ একাকী হয়ে পড়েছে। কেউ তাকে খেলায় নেয় না আড্ডায় ডাকে না। আমার মত বলে? মোটেও তা নয়। সে ছিল ভীষণ ডানপিটে খুব একগুঁয়ে। ছোটবেলা থেকেই পেশীবহুল শরীর ওর। সমস্যা হল ভীষণ দাঙ্গাবাজ আশিক। কারো সাথে ঝামেলা হলেই শুরু করত মারপিট। কোথা থেকে জানি সে একটা ফুট দুয়েক লম্বা রড নিয়ে এসেছিল। ঐ রড দিয়ে সে শুরু করত মারামারি। ভয়ে সব ছেলেমেয়ে এক হয়ে ওকে দুরে সরিয়ে রাখত। প্রথম ও রাগারাগি পরে কান্নাকাটি তারপর অনুনয় বিননোয় করলেও ওকে আর কেউ সাথে নিত না। কারণ কয়েকদিন ঠাণ্ডা থাকলেও আবার শুরু করত ঝামেলা। আমি তখন একলা একলা ঘুরি। হঠাৎ লক্ষ করলাম আশিক আমার পিছু নিয়েছে। আমি প্রথম বেশ ভয় পেয়ে গেলাম। বেটা কি আমায় মারবে টারবে নাকি? যে পালোয়ান! আস্তে আস্তে সে আমার সাথে মিশে গেল। কিছুদিনেই আমি বুঝে গেলাম ওর ভিতরটা একদম সহজ সরল। সেই শুরু। তারপর আমরা দুজন একসাথে খেলি,ঘুরি।
সবচেয়ে মজা হত আমাদের বর্ষায়। আমদের গ্রামটি ছিল একদম অজপাড়াগা। বর্ষায় চারদিকে পানিতে ভরে যেত। আমরা কাদা মাটিতে মাখামাখি করতাম সারাদিন। জাল নিয়ে পুকুরে বা বাড়ির পাশ দিয়ে বয়ে চলা ছোট খালে চলে যেতাম মাছ ধরার জন্য। চুরি করে নিয়ে আসতাম অন্যদের পাতা উনে থেকে মাছ। তারপর মাঝ দুপুরে কলাগাছ কেটে ভাসাতাম ভেলা। সন্ধ্যায় বৃষ্টি এলে আমরা টিনের চালে বৃষ্টি পড়ার শব্দ শুনতে শুনতে চিবতুম শিম বীচ। আমাদের একটি একচালা টিনের ঘর ছিল বাড়ির বাইরের দিকে। মেহমানদের থাকার জন্য এ ঘর বানানো হলেও মূলত ঘরে থাকত পাটকাঠি আর খড়। আমি আর আশিক মিলে পাটকাঠি দিয়ে এক অদ্ভুত খেলনা বানিয়েছিলাম। ওটাকে আমরা ডাকতাম টেলিফোন। যখন আকাশ জুড়ে মেঘ দেখা দিত তখন আমি আর সে মিলে এই যন্ত্রের কাছে দাড়িয়ে বৃষ্টিকে ডাকতাম নামার জন্য। কাকতালীয় ব্যাপার হল প্রায় দিনই এরফলে বৃষ্টি আসত।
দিনগুলো এভাবে চলতে লাগল বেশ। তারপর একদিন! কয়েকবছর পর আশিক চলে গেল দূরে বহুদূরে। পৃথিবীর পথে হাটার জন্য। আমি আবারো একলা হয়ে গেলাম। সে থাকে শহরে। ইট, পাথর, ইস্পাতের তৈরি আধুনিক জেলখানাতে। তার জেলখানায় যখন ইচ্ছা আলো আনা যায় যখন তখন বৃষ্টিতে ভিজা যায়। সেই আলো আসে ইলেকট্রিক লাইনে বৃষ্টি ঝড়ে তার বাথরুমের শাওয়ারে। আমি মাঝে মাঝে ফোন করি বলি, কিরে এই বৃষ্টি, আলো, বাতাস কেমন লাগে তোর? সহ্য হয়? সারাদিনের ক্লাস শেষে ক্লান্ত অবসন্ন আশিক বলে, তুই আর বড় হলি নারে পাগলা! সত্যিই আমি বড় হয় না।প্রকৃতি হয়ত আমাকে বড় করতে চায় তাই হয়ত এখন বর্ষায় আর আগের মত বৃষ্টি ঝড়ে না ডোবাগুলো আর ঐভাবে ভরে না। তবু আমি বৃষ্টিতে ভিজি। কলাগাছ কেটে চুপচাপ বসে থাকি। একজনকে খুঁজি পাগলের মত। কোথায় সে?
এক বর্ষায় আশিককে ফোন দেয় আমি বলি, চলে আয় বৃষ্টিতে ভিজার জন্য আবার মাছ মারার জন্য। কাদামাটি মাখানোর জন্য। সে বলে, দুর পাগল কিভাবে আসব? সামনের মাসেই পরীক্ষা। তারপরও দিনগুলো যায় আমার চলে। বর্ষায় ভেজামাটির ঘ্রাণ শুঁখে।
গত বর্ষায় বসে আছি বাড়ির বাইরের ঘরটায়। আকাশ কালো। বৃষ্টি হবে হবে ভাব। চোখ বুঝা আমার।হঠাৎ শুনতে পেলাম কেউ ডাকছে, মোহন! চমকে গেলাম, আশিক এর কণ্ঠ না! সে আসবে কিভাবে? গত পরশুও তো কথা হল। আসার তো কথা নয়! চোখ মেলছি না দেখে আবার ডাক দিল, এই বেটা দিনদুপুরে ঘুমাস নাকি? চোখ মেলে দেখি আশিক সামনে দাড়িয়ে। বলল, আয় বৃষ্টিতে ভিজি। কাদামাটিতে চল গড়াগড়ি খাই। বিস্মিত আমাকে টেনে নামাল সে। বলল, জেলখানা থেকে মুক্ত হয়ে এসেছি। আমি এখন তোর মত আবার প্রকৃতির সন্তান। কি চেঁচামেচি তার! আমাকে ঠেনে নিলো ডোবার কাছে। বলল, একদৌড়ে গিয়ে দা’টা নিয়ে আয়। কলাগাছ কাটতে হবে। আমার নিজের কানটাকে যেন বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। বললাম, কলাগাছ কাটবি? কাটব মানে? অবশ্যই কাটব! চল আজ ভেলা ভাসাই!
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
বিজ্ঞপ্তি
“ডিসেম্বর ২০২৪” সংখ্যার জন্য গল্প/কবিতা প্রদানের সময় শেষ। আপনাদের পাঠানো গল্প/কবিতা গুলো রিভিউ হচ্ছে। ১ ডিসেম্বর, ২০২৪ থেকে গল্প/কবিতা গুলো ভোটের জন্য উন্মুক্ত করা হবে এবং আগামি সংখ্যার বিষয় জানিয়ে দেয়া হবে।