আমানুল্লা এশা’র নামাজ পড়ার জন্য তৈরি হচ্ছিলেন, ঠিক তখনই বাইরের লোহার গেইটে মৃদু তিন টোকার শব্দ শোনা যায়। মুক্তিবাহিনীর কেউ তার কাছে এলে, এটাই ছিল সংকেত। আমানুল্লা ভেতরের দরজা খুলে দেন, উৎকণ্ঠা নিয়ে জিজ্ঞেস করেন, “কী খবর বল।“ তারপরই কি চিন্তা করে আবার বলেন, “তোমরা বস, আমি আগে রান্না করতে বলে আসি।”
একজন বলল, “স্যার, তার কোন দরকার নেই। আমরা…”
কিছু একটা বলতে গিয়ে তার কন্ঠ কেঁপে ওঠে! আমানুল্লা বিচলিত হয়ে পড়েন, তিনি ছেলেটির হাত ধরে বলেন, “কী হয়েছে বাবা, কোন খারাপ খবর?”
এবার দ্বিতীয়জন উত্তেজিত হয়ে বলে, “আমরা দেশ স্বাধীন করেছি, স্যার!”
আমানুল্লা অবাক চোখে তার দিকে ফিরে তাকান।
এবার তৃতীয় জন বলে, “ওরা দুই-তিনদিনের মাঝেই আত্মসমর্পণ করবে, স্যার।“
আমানুল্লার মুখে অবিশ্বাসের হাসি ফুটে ওঠে, আস্ফুটভাবে শুধু বলেন, “স্বাধীন বাংলাদেশ!”
চোখ মুছে প্রথমজন বলল, “স্যার, এই নয় মাস আপনি আমাদের যেভাবে সাহায্য করেছেন, সেই ঋণ কোনদিন শোধ হবার না। আমাদের পরিচিত যখনই কেউ ঢাকায় এসেছে, আমরা আপনার ঠিকানা দিতাম। যে কোন বিপদে আপনি হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন, চলার পথে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন। বুদ্ধি দিয়ে, সাহস দিয়ে, অর্থ দিয়ে, অভুক্তদের খাবার জোগান দিয়ে…”
আমানুল্লা হাত তুলে তাকে থামতে বলেন, তারপর বলেন, “অস্ত্র নিয়ে যুদ্ধ করার সৌভাগ্য সবার ভাগ্যে হয় না, তোমরাই দেশের সূর্যসন্তান। তোমাদের কাছে দেশ চির ঋণী। আমি যা করেছি তা তোমাদের কথা ভেবেই করেছি, স্বাধীনতার জন্য করেছি, আমার বাংলাদেশের জন্য করেছি। আর, আমি যে তোমাদের কিছুটা সহায়তা করতে পেরেছি, সেটাই আমার পরম ভাগ্য। ধরে নাও, এইটা আমার মুক্তিযুদ্ধ।“
তিনজনই সমস্বরে সম্মতি জানায়, “অবশ্যই স্যার।“
প্রথমজন আবারো বলল, “আপনাদের মত মানুষরা আমাদের সাহায্য না করলে আজকের এই বিজয় আমাদের জন্যও আরও কঠিন হয়ে যেত।“
আমানুল্লা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মৃত্তিকা বিজ্ঞানের প্রভাষক। তিনি তার ছাত্রদের সাথে খুব সহজেই মিশে যেতে পারেন। পাঠ্যপুস্তকের বাইরেও বিভিন্ন বিষয় নিয়ে ক্লাসের বাইরেও ছাত্ররা তাকে ঘিরে থাকতো। এমনকি তার ছাত্রদের বন্ধুরাও যে কোন সমস্যায় পড়লেই আমানুল্লা স্যারের কাছে পরামর্শের জন্য ছুটে আসতো। তার বাসভবনে ছাত্রদের আবাধ যাতায়াত ছিল। তিনি সবার পছন্দের শিক্ষক।
যুদ্ধের ঠিক আগে, আমানুল্লা ঔষধ তৈরির কারখানা করবেন সিদ্ধান্ত নেন। দেশে পর্যাপ্ত ওষুধ প্রস্তুতকারক তেমন একটা হয়ে ওঠেনি তখনও। তার জন্য আমানুল্লা নিজেকে তৈরি করতে ফার্মাসি বিষয় নিয়ে আবারো মাস্টার্স করেন। আমানুল্লার স্ত্রী লিলি নিজেও একজন ফার্মাসিস্ট, তারা দুজন মিলে সবে অফিস ঘরটা গোছাতে পেরেছিল। একতলা বাড়ীর সদরদরজার পর লাগোয়া বারান্দার ঘরটিকে অফিস ঘর বানানো হল। তাদের পরিকল্পনা ছিল, পুরো একতলায় জুড়ে হবে কারখানা, আর বাসা দোতলা করে তারা উঠে যাবে উপরে। ঠিক তখনই বাঁধে সর্বনাশা যুদ্ধ।
ছেলেগুলো বিদায় নিয়ে চলে গেল। আমানুল্লার খুব আনন্দ হচ্ছে, খবরটা রাস্তায় গিয়ে চেঁচিয়ে বলতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু তা কিছুতেই করা যাবে না, তাই তিনি উচ্চস্বরে তার স্ত্রীকেই ডাকতে লাগলেন, “লিলি কোথায় তুমি? লিলি জলদি শুনে যাও!“
লিলি ছেলেমেয়েদের ঘুম পাড়িয়ে, দ্বিতীয় দফায় রান্না করতে যাচ্ছিলেন। অফিস ঘরে কারা যেন এসেছে, এত রাতে সাধারণত শুধু মুক্তিযোদ্ধারাই উনার কাছে আসে। দিনরাত লুকিয়ে যুদ্ধ করে, কত কষ্ট করছে এই বাচ্চা ছেলেগুলো, আহারে কত দিন ভাল কিছু খায়নি কে জানে, এইসব চিন্তা করতে করতে রান্নাঘরের দিকে যাচ্ছিলেন… হঠাৎ ডাক শুনেই অফিস ঘরে ছুটে যান। আবার নতুন কোন বিপদ! এখন দিনের বেলাও কেউ চেঁচানোর সাহস করে না। লিলি পড়িমরি করে অফিস ঘরে আসেন, “কি হল?”
আমানুল্লা লিলিকে জড়িয়ে বললেন, “দেশ স্বাধীন হতে চলছে, লিলি!”
অবিশ্বাসী চোখে লিলি বলেন, “স্বাধীন বাংলাদেশ?”
“হ্যাঁ গো, যে কোন দিন পাক বাহিনী আত্মসমর্পণ করবে।“
লিলি খুশি হয়ে বলে উঠেন, “আহা আমার সোনার বাংলা… আচ্ছা, তুমি আজ ওদেরকে রাতে না খেয়ে যেতে দিলে কেন? না জানি কোথা থেকে কষ্ট করে এসেছিল ছেলেগুলি…”
“জানো, ওরা চলে যাওয়ার সময় আমি তাদেরকে কত করে বললাম খেয়ে যেতে। কিছুতেই রাজি হল না। একটা ছেলে মুচকি হেসে বলে, ‘আজ আর অভুক্ত হয়ে আসিনি স্যার। সেসব দিন যেন আর আমাদের সামনে দেখতে হয়, সেই দোয়াই করবেন।‘ এই বলে চলে গেল।“
আমানুল্লা এবার বলেন, “যাও তুমি শুয়ে পড়। আমি নামাজটা পড়ে আসছি।“
আমানুল্লা ঘরের আলো নিভিয়ে, জানালার পাশে জায়নামাজ বিছিয়ে নামাজের জন্য দাঁড়ান। ঠিক যখন সিজদায় যান, দরজায় কে যেন টোকা দেয়। এসময় কে এল? মুক্তিবাহিনীর কেউ হলে তো বাইরের লোহার গেইটে আগে শব্দ করার কথা। দরজার শব্দ বাড়তে লাগল। আমানুল্লার কেমন সন্দেহ হয়, তিনি সিজদাতেই পড়ে রইলেন! সিজদা থেকে উঠলেই জানালা দিয়ে বাইরে তার অবয়ব দেখা যাবে। এবার হাঁকডাক শোনা যাচ্ছে, “প্রফেসর সাহেব বাসায় আছেন?”
পাশ থেকে কে যেন উর্দুতে বলে, “ইয়ে তো অফিস লাগতা হে।“
অফিস কামরার দরজায় ‘অফিস রুম’ লেখা সাইনবোর্ডটা দেখে সে রাগান্বিত হয়ে আবার বলে উঠে, “কিউ হামারা টাইম ওয়েস্ট কররাহিও? চালো ইহাসে।”
এই বলে তারা চলে যায়। আমানুল্লা সিজদাতে থেকেই বুটের আওয়াজ দূরে চলে যাওয়ার শব্দ শুনতে পান। ডিসেম্বর মাসের ১৪ তারিখের শীতেও আমানুল্লা ঘামছেন। সারারাত আর ঘুমতে পারেননি, শুধু এপাশ অপাশ করে কাটালেন।
সকালে খবর পেলেন, পাকবাহিনী রাজাকারদের নিয়ে লিস্ট অনুযায়ী বুদ্ধিজীবীদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে তুলে নেয়, এবং তাদের বেশিরভাগকেই রায়বাজার এলাকায় নিয়ে গুলি করে হত্যা করে। এ যেন দেশকে মেধাশূন্য করার প্রচেস্টা। রাতের ঘটনা মনে করে আমানুল্লা শিউড়ে উঠেন! *
পরদিন দেশ স্বাধীন হল, হানাদার বাহিনী আত্মসমর্পণ করে। সব দুঃখ ভুলে সবাই নেমে আসে রাজপথে। চারিদিকে বিজয় মিছিল আর ‘জয়বাংলা’ জয়ধ্বনি!
আমানুল্লাও রাস্তায় নেমে আসেন, সে এখনও তন্দ্রাচ্ছন্ন, যেন কিছুই বিশ্বাস করতে পারছেন না, যেন কোন পরাবাস্তব জগতে চলে এসেছেন। এত আনন্দের মাঝেও কোথায় যেন এক বিষাদ কাজ করছে। আমানুল্লা নিজের অজান্তেই ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছেন রায়বাজার বধ্যভূমির দিকে…
______________
* যুদ্ধের নয় মাস সময়কালে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী স্থানীয় সহযোগীদের সহায়তায় নিয়মিতভাবে আনুমানিক ৯৯১ জন শিক্ষক, ১৩ জন সাংবাদিক, ৪৯ জন চিকিৎসক, ৪২ জন আইনজীবী এবং কমপক্ষে আরও ১৬ জন লেখক, শিল্পী ও প্রকৌশলীর মৃত্যুদন্ড কার্যকর করে। (উইকিপিডিয়া)