রাস্তায় নেমেই অপু বুঝতে পারে, টিপ টিপ বৃষ্টি হচ্ছে। হাত ঘড়িতে রাত ১১টা ১৫। তাই হয়ত রাস্তাটা এত নিস্তব্ধ। বুকের মধ্যে আবার সেই পুরনো কষ্ট। মনের অতল গভীরে কিছুটা বিস্মৃত হয়ে যাওয়া মুখ আবার সামনে। সেই চোখ; সেই হাসি। তার ছোট জগতের মাঝে আরো এক জগত। তার মনের মধ্যে আরো একটি মন। যে মনের সাথে আজও সে সারাদিন কথা বলে।
ক্লাসে লাইব্রেরীতে একসাথে চলতে চলতে কখন যে দুটি প্রাণ, দুটি সত্তা এক সাথে মিশে গিয়েছিল মনে করতে পারে না অপু, শুধু মনে পড়ে হৃদয় ভাঙার কষ্ট। অনেক ভাইবোনের মধ্যে সবার বড় শীলা, এরপর ও বাবর অসুখ। তাই পরীক্ষা শেষ হবার সাথে সাথেই হোস্টেল ছেড়ে মফস্বল শহরের বাড়ীতে ফিরে যেতে হয় শীলাকে। মেস ছেড়ে অপুও উঠে টিলেকোঠার এই ঘরটিতে। টিউশনির টাকায় চলে। অপুর সাথে সাথে শীলাও চাকরীর চেষ্টা করছিল, কিন্তু বাবার অসুখটা ধরা পরার পরই, এন.জি.ও'র বড় এক কর্মকর্তার সাথে ওর বিয়ে ঠিক করে সবাই। তখনই শীলা একদিন এসেছিল অপুর কাছে। এই ঘরে বসে মেয়েটা অপুর হাত ধরে হু হু করে পাগলের মত কেঁদেছিল সেদিন। কিছুদিন বাদেই বিয়ে হয়ে যায় শীলার। এর পরের দিনগুলো কি ভাবেই না কেটেছে।
জগন্নাথ কলেজের চত্বর, বারান্দা, সিঁড়ি, ক্যান্টিন সেখানে শীলার সাথে একদিন সে ভালবাসার দিন কাটিয়েছে, সেখানে ঘণ্টার পর ঘণ্টা একাই সময় কাটায়। রাতে ছাত্র পড়িয়ে ঘরে ফিরে ঘর অন্ধকার করে বসে থাকে। হৃদয় ভাঙার এক তীব্র কষ্ট কুড়ে কুড়ে খায় তাকে। পাশের বাড়ী থেকে একটা গান প্রায়ই ভেসে আসে। শীলার প্রিয় রবীন্দ্র সঙ্গীত। অপু জানালার গ্রিলে মুখ গুজে একভাবে গানটা শোনে
"আজি বিজন ঘরে নিশীথ রাতে
আসবে যদি শূন্য হাতে
আমি তাইতে কি ভয় মানি!
জানি, জানি বন্ধু জানি-
তোমার আছে দুহাত খানি"
জানালার পাশ দিয়ে উঠে গিয়েছে মাধবী লতার গাছ। বাতাসে ফুলের মিষ্টি গন্ধ ভাসে। সাদা, গোলাপি, লাল কত রং এর ফুল। সে ফুল দিয়ে অপু কত ভাবেই না সাজায় তার ভালবাসার ঘরকে। ছাই-পাশ কত কি-ই না ভাবে। নিস্তব্ধ রাত্রির কালো অন্ধকার বাইরে। জানালা দিয়ে দেখা এক টুকরো আকাশের মাঝে তারা গুনতে থাকে অপু। নিদ্রা হীন রাত কাটে; সকাল হয়। কোথাও গিয়ে চাকরীর ইন্টার্ভিউ দেয়, আবার কোথাও বায়োডাটা পাঠায়। সময়ের সাথে সাথে সব কিছু সয়ে যায়। চাকরী হয় ব্যাঙ্কে প্রতিবারই ফোন করলে একই উত্তর পায়-এই মুহূর্তে মোবাইল সংযোগ দেওয়া সম্ভব নয়" তবুও সেই পুরানো নম্বরে প্রতি চেয়েছিল, শীলার সাথে যোগাযোগ রাখতে, কিন্তু শীলা রাখেনি চিরদিনের জন্যই চলে যাচ্ছে তবে কেন এই বন্ধনে জড়িয়ে থাকা? কেন পিছনে ফিরে ডাকবে অপুকে? কোন অধিকারে?
হাঁটতে হাঁটতে কখন যে পার্কের পাশের এই ফুটপাতে তীব্র আলোর ঝলকানি আর, এর পর শব্দ। একটা বড় গাছের নীচে এসে দাঁড়ায় অপু- আর দৃশ্যটা তখনই তার চোখে পড়ে। একটু দূরে পলিথিনে ঘেরা খুপরি ঘর থেকে একটি পুরুষের ছায়া মূর্তি বেড়িয়ে আসে, তারই সাথে একটি নারীর ছায়াও আসে। মেয়েটি, পুরুষের পা জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলে, স্যার আমার বাচ্চার অসুখ স্যার, ক্ষুধায় কাঁদতাছে স্যার বাচ্চাটা, অনেক কষ্ট স্যার। আমার টাকাটা দিয়া যান স্যার পুরুষ লোকটি পা ছাড়িয়ে হন হন করে হেঁটে চলে যায়। শরীরের মধ্যে দিয়ে যেন একটা শীতর স্রোত নেমে যায়। এসব অনেক, কাগজে পড়েছে, কিন্তু আজ নিজ চোখে দেখল। অপু জানে, তার শার্টের পকেটে ১০০ টাকা আছে একবার মনে হয় টাকাটা সে মেয়েটাকে দিয়ে যাবে। কিন্তু খুপরি ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে মেয়েটাকে ডাকতে পারে না। জ্বরে আক্রান্ত, ক্ষুধার্ত শিশুটির কান্না, তার মায়ের কান্নার সাথে মিশে আরো জোড়ালো হয় ঠিকই, কিন্তু সে কান্না অপু ছাড়া আর কারো কানে পোঁছে না, পলিথিনে ঘেরা ছোট খুপরির মধ্যেই ঘুরপাক খেতে থাকে।
বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে আবার হাঁটতে শুরু করে অপু, একটি একটি দিন গিয়ে দু বছরের বেশী হয়ে গিয়েছে, শীলার বিয়ে হয়েছে, তবুও শীলাকে যেন সে আজও খুঁজে পায় তার অস্তিত্বের মাঝে, হৃদয়ের গভীরে। এই ঘরে শীলার স্পর্শ আছে, তাই ত সে এই বাসা ছেড়ে যেতে পারে না। যে বিছানার চাদরে শীলা বসেছিল, পুরনো হয়ে যাবে বলে,- সেই চাদরটাও ব্যবহার করে না। অনেক রাতে বসেছিল, এক টুকরো জ্যোৎস্নার আলো এসে পড়ে বিছানায়। সে এক ভাবে তাকিয়ে থাকে চাঁদের দিকে। এরপর, এক সময় শীলার ঐ মায়াভরা মুখটা তার দুহাতের মধ্যে নিয়ে জিজ্ঞাসা করে-
"তুমি কেমন আছ শীলা?"
গভীর রাতে কৃষ্ণপক্ষের আধা খাওয়া চাঁদের আলো-আঁধারের মাঝে শীলার কাছ থেকে কোন উত্তর না পেলেও আজ সকালে অপ্রত্যাশিত ভাবে শীলার ফোন পায় অপু। নিজেকে কিছুতেই বিশ্বাস করাতে পারে না! একি সত্যি শীলার কণ্ঠস্বর তবে সেই কণ্ঠস্বর অনেক বেশী ভারী, অনেক বেশী সাবধানী। আগামী পরশু, ভার্সিটিতে- ওর ভাই শাওনের ভর্তি পরীক্ষা। দুদিনের জন্য তাই শাওন এসে থাকবে অপুর কাছে।
অপুর সারাদিনের প্রতীক্ষা আর গভীর উৎকণ্ঠার শেষে হয় এক সময়। শাওন আসে রাত ১০টায়। ব্যাকুল হয়ে শাওনের মাঝে শীলাকে খুঁজে পেতে চায় অপু। কেমন আছে শীলা? ওকি আগের চেয়েও সুন্দর হয়েছে? ওকি মা হয়েছে? তার কথা কিছু বলে না শীলা? কিন্তু এসবের কোন উত্তরই পায় অপু। সে শুধু জানত, শীলা কণ্ঠর হার উঁচু হয়ে উঠেছে। চোখের নীচে কালি পড়ছে। সারা শরীরে অত্যাচারের চিহ্ন। বাবার কাছে টাকা না আনতে পারলেই শীলার গায়ে হাত তোলে ওর স্বামী। মুহূর্তের মধ্যে বিবর্ণ হয়ে যায় সব কিছু। নিঃশ্বাস নিতে ঘর ছেড়ে বাইরে বেড়িয়ে আসে। নিজেকে বড় অসহায় মনে হয়। জীবন যেন এক অন্ধকারাচ্ছন্ন পাতকুয়া। একই বৃত্তে বারবার পথ চলা। মুক্তির কোন পথ নেই। একদিন চাকরী ছিল না, কিন্তু শীলা ছিল, আর আজ- চাকুরী আছে ,শীলা নেই- আছে অবিবাহিত বড় বোন। টাকা জমিয়ে তাকে বিয়ে দেওয়ার স্বপ্ন দেখে অপু। কিন্তু, বেতনের দশ-পনের হাজার টাকায় বেঁচে থকাটাই সেখানে দুঃসাধ্য- সেখানে, স্বপ্ন দেখতে যেন অন্যায়। তার মত শত-শত অপু ঘুরে বেড়াচ্ছে পথে পথে তাদের খবর কেউ রাখে না। মাঝে-মাঝে ইচ্ছা হয়, সব কিছু ছেড়ে কোথাও চলে যেতে। কিন্তু- যত বারই সে হারিয়ে যেতে চেয়েছে, ততবারই তার বিধবা মা আর বোন যেন জড়িয়ে ধরে তাকে পিছন থেকে ডেকে বলে-ফিরে আয়, ফিরে আয়।–
এই ২ নারীর সাথে আরো এক নারী তাকে অবলম্বন করে বেঁচে থাকতে চেয়েছিল, কিন্তু অপু তাকে গ্রহণ করেত পারেনি। সে শুধু চেয়েছিলও, শীলা সুখে থাক। এর বেশী কিছু নয়। বৃষ্টির জলে সম্পুর্ণ ভিজে উঠে অপু। তবুও ঘরে ফেরে না। রাস্তার দুপাশে বৃষ্টির জল জমতে শুরু করে। সারি সারি স্ট্রিট ল্যাম্পের হলুদ আলোর ছায়া ভাসতে থাকে সে জলে। চোখ ফেটে জল আসে অপুর। চোখের জলে আরো ঝাপসা হয়ে আসে চারিদিক। রাত বাড়তে থাকে। আইরো জোরে বৃষ্টি নামে। আকাশ ভাঙা বৃষ্টি।