চোখ মেলে নূরজাহান বেগম কিছুক্ষণ নিঃশ্বাস বন্ধ করে রইলেন । দরদর করে ঘামছেন । কোথায় আছেন বুঝতে তার একটু সময় লাগলো । মাসখানেক ধরে প্রতি রাতে দেখা পুরোনো স্বপ্নটা আজ আবার দেখলেন . . . অনেক উঁচু একটা পাহাড় থেকে তিনি পড়ে যাচ্ছেন । পড়ছেন তো পড়ছেনই । কিন্তু মাটি ছুঁতে পারছেননা । তিনি যতো নামছেন মাটি ততোই দূরে সরে যাচ্ছে . . .
রাতে সম্ভবত তুমুল ঝড়-বৃষ্টি হয়েছে । ভ্যাপসা গরম পড়ছে । হয়তো নিম্নচাপের প্রভাব । কারেন্ট নাই । ট্রান্সফরমার কি আবার নষ্ট হয়ে গেলো ? কিন্তু IPS এর কি হলো ? ফ্যান তো ঘুরছে না । নূরজাহান বেগম বালিশে ঘুমান না । বালিশে শুলে তার ঘুম হয় না । কিন্তু কোল বালিশ তার চাই-ই চাই । পাশ ফিরে কোল বালিশ জড়িয়ে আবার ঘুমানোর প্রস্তুতি নিতে না নিতেই শোনেন ফজরের আজান হচ্ছে । নতুন মুয়াজ্জিনটা অনেক সুন্দর করে আজান দেয় । আগেরটা এত সুন্দর করে দিতে পারতো না । ‘ঘুম হইতে নামাজ উত্তম ‘ শুনে তিনিও বিছানায় উঠে বসলেন । প্রচন্ড মশা এখানে । তাই মশারি টাঙ্গাতে হয়েছে । ঢাকার বাসায় অবশ্য মশারি লাগতো না । বিছানা থেকে নামতে নামতে বুঝতে পারলেন আসমা নিঃশব্দে ঘরে ঢুকছে । আবার একটা দিনের শুরু হল . . .
আসমার পেছন পেছন বাঘাও এলো । নূরজাহান বেগমের আদরের কুকুর । বাঘা এসে তার পা চেটে দিলো । তিনিও আলতো করে বাঘার গলায় আদর করে দিলেন । আসমা জায়নামাজ , তসবি আর নামাজ পড়ার বড় ওড়না নিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো । দু’জনের বয়সই কাছাকাছি । দীর্ঘ ৩০ বছর ধরে একসাথে আছেন । কথা বলে মনের ভাব প্রকাশের দিন তারা অনেক আগেই পার করে এসেছেন ।
আসমা হল নূরজাহানদের বাড়ির অসংখ্য আশ্রিতদের একজন , যার বাবা মায়ের পরিচয় কেউ জানে না এবং সে কেন বা কিভাবে এই বাড়িতে এলো তার খবর কেউ রাখেনা । নূরজাহানের আম্মু আসমাকে বিয়ে দিয়েছিলেন এক মুদি দোকানদারের সাথে কিন্তু সপ্তাহ না ঘুরতেই সাদা শাড়ি পরে সে ফেরত এলো । মাত্র তিন দিনের জ্বরে ওর স্বামী মারা গিয়েছিলো ।
সুপ্রতিমের মৃত্যুর পর যখন রাতের পর রাত ভয়ে নূরজাহান ঘুমাতে পারতেননা তখন আসমা এসে তার ঘরে ঘুমাতো । সেই থেকে শুরু । তখন দু’জনের বয়সই ছিলো বিশের কোঠায় আর আজ তা পঞ্চাশের ঘরে ।
নামাজ শেষ করে তিনি বারান্দায় এসে দাঁড়ালেন । বৃষ্টিভেজা মাটির সোঁদা গন্ধ আর শিউলী ফুলের মনকাড়া সুবাস মিলেমিশে এক নতুন ঘ্রানের সৃষ্টি হয়েছে। শিউলী ফুল । সুপ্রতিমের প্রিয় শিউলী ফুল। শরৎকালে প্রতিদিন ভোরে তিনি শিউলী ফুল কুড়িয়ে নিয়ে চলে যেতেন সাগরপারে । ফুলগুলো হাতে পেয়ে ও মিষ্টি করে হাসতো । প্রতিদিন সেই হাসি দেখে তার দিন শুরু হতো । নূরজাহান অনর্গল কথা বলে যেতেন আর মুগ্ধ হয়ে তা শুনতেন সুপ্রতিম । পাশাপাশি বাড়িতে থাকতেন । সুপ্রতিম বছরখানেকের বড় হলেও শৈশব আর কৈশোরের দুরন্ত দিনগুলো কেটেছে একইসাথে ।
আনুষ্ঠানিকভাবে ভালবাসা প্রকাশের প্রয়োজন হয়নি কখনোই কারন অনুভবের স্তরটা ছিলো অনেক গভীরে । একটু বড় হতেই শুরু হলো বিধি নিষেধ । একটু একটু করে কমতে থাকলো একসাথে থাকার সময়গুলো কিন্তু জ্যামিতিকহারে বাড়তে থাকলো কাছে পাবার আকুলতা ।
দিনের বেলা খুব একটা দেখা হতো না । গ্রামে তা সম্ভব ও ছিলো না । তাই খুব ভোরে দু’জনে চলে যেতেন সাগরপারে । ঝিনুক কুড়াতেন দু’জন মিলে। হয়তোবা মুক্তার আশায় । যদিও পাননি কখনোই। আকাশের কোণে কোণে যখন সাদা মেঘগুলো আলস্য ভেঙ্গে লাল সূর্যকে একটুখানি উঁকি দেয়ার সুযোগ দিতো ততোক্ষনে দু’জনে বাড়ির পথে পা বাড়াতেন ।
আবার দেখা হতো মাঝরাতে । পূর্ণিমা রাতে তারা নৌকা নিয়ে সমুদ্রে ঘুরে বেড়াতেন । আকাশ ভরা জ্বলজ্বলে তারা আর সমুদ্রে মাছ ধরার ট্রলারগুলোতে হারিকেনের লালচে হলুদ আলো, দু’য়ে মিলে এক স্বপ্নীল পরিবেশ তৈরি হতো । কখনোবা তাদের দেখা যেতো ঘোর অমাবশ্যায় ক্ষেতের আইলে বসে গল্প করছে আর সামনে ক্ষেতজুড়ে জোনাকিরা যেন মিছিলে যাবার আগে প্রস্তুতি সভায় ব্যস্ত । সে এক অদ্ভুত আলো আঁধারের খেলা । এমনই এক অমাবশ্যায় যখন জোনাকিরা তাদের সভায় ব্যস্ত ,তখন নূরজাহান ও সুপ্রতিম তাদের মনের ভালবাসার রঙকে শরীরে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন । নিবিড় সেইক্ষণে হঠাৎ নূরজাহান জানতে চেয়েছিলেন “ দিনের বেলা জোনাকিরা কোথায় থাকে ?”
সুপ্রতিম এ প্রশ্নের কোন জবাব দিতে পারেননি । যেমন তিনি নূরজাহানকে কোন জবাব দিতে পারেননি যখন তিনি এসে জানালেন, “আব্বু আমার বিয়ে ঠিক করেছেন এখন আমি কি করবো ?” তার উত্তরের প্রতীক্ষায় থেকে ক্লান্ত হয়ে নূরজাহান বাড়ি ফিরে আসে আর বিভ্রান্ত সুপ্রতিম এগিয়ে যায় সমুদ্রের অতল গভীরে । ছোটবেলা থেকে সমুদ্রের সাথে সখ্যতা হলেও সাঁতার জানতোনা সে । লক্ষীপূজার দিন বাড়ির সবাই যখন ব্যস্ত ঘরে লক্ষীর আগমণ নিয়ে ঠিক তখনই ঘোষ বাড়ির ছোট ছেলে চলে গেল তাদের ছেড়ে । আর নূরজাহান তখন আকাশ দেখছিলো । প্রবারণা পূর্ণিমাতে রং বেরং এর ফানুস উড়ছিলো আকাশে আর এক
অদ্ভুত মায়ার জগৎ তৈরি হয়েছিলো । বোকা মেয়েটা হঠাৎ বুঝতে পেরেছিলো সে ভুল মানুষকে নিয়ে এক ভুলে ভরা স্বপ্নের গোলকধাঁধায় আটকে গেছে । তবুও ও আশায় বুক বেঁধেছিল । কিন্তু পরদিন সকালে মুঠোভর্তি শিউলী ফুল নিয়ে সাগরপারে গিয়ে তিনি থমকে গিয়েছিলেন, জোয়ারের পানির সাথে ভেসে আসা সুপ্রতিমের মৃতদেহ দেখে ।
প্রথম কিছুদিন তার ভয় লাগতো । রাতে ঘুম হতোনা । দিন রাত লাইট জ্বালিয়ে রাখতেন । দরজা বন্ধ করে ঘরে বসে থাকতেন । কিন্তু তিনি কাঁদতেন না । চোখটা যেন মরুভূমি হয়ে গিয়েছিলো । বাড়ির সবাই চিন্তায় অস্থির । মার আদেশে আসমা রাতে ওনার ঘরে ঘুমাতো । সুপ্রতিমের মৃত্যুর পর আর কোন দিন তিনি সাগরে যাননি । শিউলী ফুল দেখলেই মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন।
বর্ষার এক বিকেলে জানালার পাশে বসে তোলপাড় করা বৃষ্টির গান আর মেঘের গুরুগম্ভির ডাক শুনছিলেন নুরজাহান বেগম । হঠাৎ প্রচন্ড কোলাহল । কালো , উদোম গায়ের কিছু বাচ্চা ছেলে মাঠে ফুটবল খেলা শুরু করলো । সবাই কাঁদায় মাখামাখি হয়ে একাকার । কিন্তু কারো কোন ভ্রুক্ষেপ নাই । বলে লাথি মারতে গিয়ে পা পিছলে পড়ে যাচ্ছে বারবার । বল খেলার চাইতে লাথা-লাথিটাই বেশি হচ্ছে । ঐ নোংরা কাঁদা পানি তাদের খেলা উপভোগের ক্ষেত্রে কোন বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি । তিনি বুঝতে পারলেন জীবনে পুরোপুরি আঁধার বা পুরোপুরি আলোক বলে কিছু নাই বরং অনেকটা অংশ জুড়েই ধূসরতা । এই ধূসরতা কে বর্ণিল করার আপ্রাণ চেষ্টা করাই হল জীবন ।
নূরজাহানের আব্বুর ব্যবসার তখন রমরমা অবস্থা । গ্রামে এসে পরিবারকে সময় দিতে পারছেননা বলে সবাইকে শহরে নিয়ে এলেন । তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলেন । যান্ত্রিক জীবনে অভ্যস্থ হয়ে গেলেন কিছুদিনের মধ্যেই । সুপ্রতিম ও একটু একটু করে হারিয়ে গেল স্মৃতির অতলে। গ্রাম তাকে আর টানছিলো না । মাঝে মাঝে ভাবতেন ঐ থমকে থাকা গ্রামে তিনি কি করে এতোদিন ছিলেন ? এরমধ্যে রাজনীতি তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছিলো । শুরু হল নতুন জীবনের । বিশ্ববিদ্যালয়ে তার যথেষ্ট প্রতিপত্তি ছিলো । ক্রমেই পরিনত হলেন মহীরুহে । গত তিন বার তিনি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন তার এলাকা থেকে । কিছুদিন আগেও তিনি ছিলেন মৎস্য ও প্রানীসম্পদ মন্ত্রনালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী ।
মাস খানেক আগে একটি জনসভায় ভাষ্ণ দেয়ার সময় কে বা কারা গ্রেনেড হামলা চালায় । শরীরে ১৬৩ টা স্প্রিংটার লাগলেও তিনি বেঁচে আছেন । ডাক্তাররা ৫২ টা বের করতে পেরেছে বাকি গুলো শরীরে নিয়ে তিনি এখনও ঘুরে বেড়াচ্ছেন । শুধু হারিয়েছেন তার মন্ত্রীত্ব কারন ২ টা স্প্রিংটার তার চোখ নষ্ট করে দিয়েছে। আজ তাই তিনি অন্ধকারের বাসিন্দা।
স্বামী গত হয়েছেন ৭ বছর হলো । ছেলে মেয়েরা দেশের বাইরে । যতোদিন ক্ষমতা ছিলো আশপাশে অনেকেই ছিলো । এখন শুধু বাঘা আর আসমা । নিঃস্ব হয়ে আবার মাটির কাছে ফিরে এসেছেন । এখন তার সময় কাটে রাতভর দুঃস্বপ্ন দেখে আর দিনভর স্মৃতি রোমন্থন করে ।
প্রতিদিন সকালে তিনি হাঁটতে বের হন। আজ ও বারান্দা থেকে নামলেন । কিছুক্ষ্ণ থমকে দাঁড়ালেন । তারপর হাতড়ে হাতড়ে কিছু শিউলী ফুল কুড়ালেন । বাঘা দৌড়ে এলো । পেছনে আসমার পদশব্দ পেলেন । তিনি হেঁটে চলেছেন সমুদ্রের দিকে . . . তিন দশক পর . . . এক মুঠো শিউলী ফুল নিয়ে . . .
দূর নিলীমায় তখন রাতের ধূসরতা ছাপিয়ে আবছা লালচে আভা দেখা যাচ্ছিলো . . .
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
দিলরুবা মিলি
ম্যারিনা নাসরিন সীমা@তৌহিদ উল্লাহ শাকিল@সূর্য @বিষণ্ণ সুমন @সৌরভ শুভ (কৌশিক )@ফাতেমা প্রমি @প্রজাপতি মন @আবু ওয়াফা মোঃ মুফতি@ যারা কষ্ট করে পড়েছেন, কারো ভালো লেগেছে, কারো বা লাগেনি কিন্তু কমেন্ট করেছেন, সবাই কে ধন্যবাদ ও শুভেচ্ছা। ইচ্ছে ছিলো সবাই কে আলাদা ভাবে উত্তর দেয়ার কিন্তু সময়ের অভাবে পারলাম না। দুঃখিত। ভালো থাকবেন। শুভকামনা।
সূর্য
সাংসদ, মন্ত্রী এদের জীবন যাপন নিয়ে গল্পে আমরা অভ্যস্ত নই। তারচে' তাদের দেবতার আসনে দেখতেই বেশি স্বচ্ছন্দ আমরা। ***সাংসদ, মন্ত্রী, গ্রেনেড হামলা এ টুকু বাদ দিলে অনেক সুন্দর কাব্যিক একটা গল্প অনায়াসেই বলতে পারি।
আর হ্যা কিছু বাক্য সৃজন সবার নজর কাড়বে নিশ্চয়ই, যেমন [তিনি বুঝতে পারলেন জীবনে পুরোপুরি আঁধার বা পুরোপুরি আলোক বলে কিছু নাই বরং অনেকটা অংশ জুড়েই ধূসরতা । এই ধূসরতা কে বর্ণিল করার আপ্রাণ চেষ্টা করাই হল জীবন।]
গল্প অনেক ভাল হয়েছে....
বিষণ্ন সুমন
এক বৃদ্ধা মায়ের শেষ বয়সের একাকিত্বের করুন চিত্র তুলে ধরলে তোমার গল্পে। বড় বাস্তব ধর্মী কাহিনী, যেন গ্রাম বাংলার প্রতি ঘরেই এমন নুরজাহানরা বেছে আছেন মনে বড় কষ্ট নিয়ে । অসাধারণ লিখেছ ।
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।