সবুজাভ হলুদ সরষে ক্ষেতের মাঝে অনেকগুলো রঙ্গিন প্রজাপতি উড়ছে আর তাদের পিছু পিছু ছুটছে লাল রং এর একটা ছোট্ট প্রজাপতি । হঠাৎ ছোট্ট প্রজাপতিটা পড়ে গেলো । ইফতেখার সাহেবের বুকটা কেঁপে উঠলো । কিন্তু না, প্রজাপতিটা উঠে , ধুলো ঝেড়ে আবার পিছু নিল রঙ্গিন প্রজাপতিগুলোর । তিনি হাঁপ ছেড়ে বাঁচলেন । কিছুক্ষন পর তিনি অনুভব করলেন , কিছু একটা তার পা বেয়ে উঠছে । তাকিয়ে দেখেন , আস্ত একটা জোঁক ! রক্ত খেয়ে ফুলে আছে । তিনি জোরে পা ঝাড়লেন । জোঁকটা পড়ে গেল । এমন সময় তার কানে এল ,
‘ বাবাই ! বাবাই ! ’
ইফতেখার সাহেব সামনে তাকালেন। পুরো সরষে ক্ষেত ফাঁকা , আগাছায় পূর্ণ । ঝকঝকে নীল আকাশ হঠাৎ মেঘে ঢেকে গেলো । একটাও প্রজাপতি নেই । তার ছোট্ট প্রজাপতিও হারিয়ে গেছে।
‘ বাবাই ! বাবাই ! ’
বুকের ভেতরটা ছটফট করছে। তার একমাত্র অবলম্বন , ছোট্ট প্রজাপতি , তার মেয়ে , তিত্লী , তাকে ডাকছে । তিনি দিগ্বিদিক ছুটছেন । পিপাসায় কাতর । ঝড় শুরু হয়ে গেছে । কিন্তু তিত্লী কই ? তার ছোট্ট তিত্লী . . .
‘ বাবাই ! বাবাই ! ’
কাঁধে হাতের স্পর্শে তিনি চোখ মেললেন । পূর্বা ডাকছে।
‘ বাবাই , ডাক্তার এসেছেন । ওঠো । ‘
চোখ মেলে ইফতেখার সাহেব প্রথমে বুঝতে পারলেন না কোথায় আছেন । ধীরে ধীরে সব মনে পড়লো । পূর্বা , তিত্লীর বান্ধবী । আশপাশে আরও আছে শফিক , ছোটন , মিনা , সামির , নাদিয়া , মুন্না । সবাই তিত্লীর বন্ধু । ওরা আছে একজন প্রখ্যাত ডাক্তারের চেম্বারে ।
ইফতেখার সাহেবের নিজের বলে কেউ নেই । বড় হয়েছেন এতিমখানায় । একা ও নিঃসঙ্গ । যেসব মানুষ নিজে নিজে বেড়ে উঠে , তারা খুব অহংকারী হয় । কারন অন্যের সাহায্য ছাড়াই তারা বেড়ে উঠতে পারে । এক ধরনের গর্ব তাদের বিভোর করে রাখে । ইফতেখার সাহেবের ক্ষেত্রে তা অনেক বেশি ছিল । জীবনে কখনও কারো কাছে সাহায্যের জন্য হাত পাত্তে হয়নি তাকে । অসম্ভব শক্ত মনের মানুষ । শুধু যখন মেডিকেলে পড়তেন , তখন একবার সব কিছু ওলট - পালট করে দিয়েছিল রোল ৩৩ । কিভাবে যেনো দু’জনের প্রেম হয়ে গেল !
চন্দ্রা , ধনী বাবার একমাত্র সন্তান । অথচ ভীষণ কোমল ও অদ্ভুত সুন্দর । ওর চোখের দিকে একবার তাকালে তিনি সারাদিন সেই চোখের মায়ায় বুদ হয়ে থাকতেন । কিন্তু চিরায়ত ভাবে যা হয় , চন্দ্রার বাবা তাদের সম্পর্ক মেনে নিলেন না । একদিন ইফতেখার সাহেবকে ডেকে কথা বললেন । তাদের মধ্যে কি আলোচনা হয়েছে তা কেউ জানে না । কিন্তু পরদিন থেকে ইফতেখার সাহেবকে আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যায়নি । তিনি মেডিকেলের পড়া ছেড়ে দিলেন , হোষ্টেল ছেড়ে দিলেন , এমন কি ঐ শহরেও তাকে আর দেখা গেলো না । চন্দ্রা তাকে অনেক খুঁজলো , কোথাও পেলো না । সবার ধারনা চন্দ্রার বাবা তাকে এমন কিছু বলেছেন যা তার পক্ষে মেনে নেয়া সম্ভব ছিল না । তাই কারো কাছে মাথা নত না করে তিনি চলে গেছেন , তার একমাত্র সম্বল আত্মসম্মানবোধকে সঙ্গী করে ।
আমরা অবশ্য ইফতেখার সাহেবকে খুঁজে পেয়েছি । মফস্বলের একটি বেসরকারি কলেজে শিক্ষকতা করছেন । মেয়ে তিত্লীকে নিয়ে তার সংসার । ২৬ বছর আগে এক দিন তার পুরোনো এতিমখানায় বেড়াতে গিয়ে দেখেন , ছোট্টো একটা ফুটফুটে মেয়ে। হামাগুড়ি দিয়ে এদিক ওদিক ছুটছে ।
ইফতেখারঃ ” আরে এতো প্রজাপতির মতো ছুটছে । ”
বাচ্চাটা কি বুঝলো কে জানে ! ছুটে এলো উনার কাছে এবং দু’হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল ,
“ বাবাই । “
ইফতেখার সাহেব বাচ্চাটাকে বুকে তুলে নিলেন । আজও তিত্লী তার বুকের ধন ।
“ বাবাই ! ”
চমকে ফিরে তাকালেন তিনি !
“ ও তুই ! ” নাদিয়া ডাকছে। তিত্লীর ‘বাবাই’ এখন তিত্লীর সব বন্ধুদের ‘বাবাই’।
“বাবাই ! বাবাই ! চলো , আমাদের সিরিয়াল এসেছে । ”, শফিক বলল।
ইফতেখারঃ ‘না, আমি একাই যাবো, তোরা আপেক্ষা কর ।‘
ডাক্তার তখনও অন্য রোগীর সাথে কথা বলছিলো । ডাক্তারের সহকারি তার কাছ থেকে ফাইল নিয়ে ডাক্তারের সামনে দিল। তিনি অধীর আগ্রহে ডাক্তারের দিকে তাকিয়ে ছিলেন । ফাইল থেকে চোখ তুলতেই . . .
আপনারা ঠিকই ধরেছেন । ৩২ বছর পর আবার সেই চোখ । দু’জনেই নিরব । চন্দ্রাই প্রথম কথা বললো ,
” তুমি কোথায় হারিয়ে গিয়েছিলে ? ”
এরপর যা হয় , আমরা দেখছি চন্দ্রা আই. সি. ইউ. তে ; তিত্লীর পাসে দাঁড়িয়ে আছে । পুরো হাসপাতাল এখন তিত্লীর সেবায় নিয়োজিত । অথচ গতকালও যখন তিত্লী কেবিনে ছিল , স্যালাইনে রক্ত উঠে গেলেও একজন নার্স পাওয়া যাচ্ছিলো না ।
চন্দ্রাকে আই. সি. ইউ. থেকে বের হতে দেখে তিত্লীর বন্ধুরা দৌড়ে এলো । কি বলবে চন্দ্রা ! শুধু বললো,
” তোমরা চিন্তা করো না। সব ঠিক হয়ে যাবে । “
কেউ তার চোখের ভাষা পড়তে না পারলেও , ৩২ বছর পরেও ইফতেখার সাহেব বুঝতে পারলেন , কোনো আশা নেই । তিনি চন্দ্রার সাথে ডক্টর’স রুমে ঢুকলেন । চন্দ্রা অস্বস্থি বোধ করছিলেন। ইফতেখার সাহেব চন্দ্রাকে তিত্লীর গল্প বলা শুরু করলেন । কত্ত কথা ! বললেন , মেয়েও বাবার মত হয়েছে। বি. সি. এস. এ চাকরির জন্য ও পোস্টিং এর জন্য ঘুষ লাগবে শুনে আর ভাইবা ই দিলো না । এখন বাবা মেয়ে একই কলেজে শিক্ষকতা করছে । কারো কাছে মাথা নত করতে রাজি নয় । অথচ আজ দুয়ারে আঁধারের ছায়া । গত ২ বছর ধরে জ্বর , সর্দি লেগেই ছিল । চুল পরে যাচ্ছিলো , মুখে ঘা হতো মাঝে মাঝে , রুচি কমে গেল , সূর্যের আলোতে গেলে এলার্জি হতো , শরীরের প্রতি জয়েন্টে ব্যথা করতো । ডাক্তার পেইন কিলার দিল । তারপর থেকেই শরীরে পানি এলো । এরপর আর হাঁটতে পারছিলো না । হাত পা নাড়তে পারছিলো না । চোখে ও ঝাপসা দেখা শুরু করলো । প্রচন্ড কষ্ট পাচ্ছিলো । অনেক ডাক্টার দেখানো হল । ভারত নেয়ার জন্য ভিসা ,পাস পোর্ট ও করা হল । কিন্তু একদিন রাতে হঠাৎ স্ট্রোক করলো ।
“ রোগটার নাম SLE (Systemic Lupus Erythematosus) । আমাদের শরীরের কিছু বন্ধু টিস্যু আছে । এদের কাজ হল কোন রোগ আমাদের শরীরে আঘাত করতে চাইলে , এরা তাদের পাল্টা আঘাত করে এবং আমাদের রক্ষা করে । কিন্তু কোন এক আজ্ঞাত কারনে এই বন্ধুরা চন্দ্রাহত হয়ে যায় । তখন এরা ক্ষতিকর টিস্যু আর উপকারি টিস্যুর প্রভেদ বুঝতে পারে না । এদের প্রথম আঘাতটা আসে চামড়ার উপর , তারপর একে একে কিডনী , ব্রেইন , হার্ট সব অকেজো করে দেয় । তাদের এই অস্বাভাবিক আচরণের কারণ বিজ্ঞানীরা এখনো বের করতে পারেনি । এর লক্ষণ বুঝতে এতো সময় চলে যায় যে চিকিৎসা করার আর সময় থাকে না । Butterfly Rash হলো এক মাত্র লক্ষণ যা থেকে নিশ্চিত হওয়া যায় যে এটা SLE .” চন্দ্রা বলে যায়,” জানি তোমার নিজের উপর নিয়ন্ত্রন অনেক বেশি এবং তুমি ছাড়া যেহেতু তিত্লীর আর কেউ নেই , তাই আমাকে বলতেই হচ্ছে . . . আমাদের হাতে সময় নেই বললেই চলে।“
“ হো হো হো ” ইফতেখার সাহেব হেসে উঠলেন। তারপর বললেন,
”আবার ও প্রজাপতি।“
তিত্লীর সমাবর্তনের দিনের কথা মনে পড়ে গেল তার । এক গর্বিত বাবার গর্বিত সন্তান । সেদিন বাড়ি ফিরে তিনি খেয়াল করেন মেয়ের মুখে কিসের যেনো দাগ । ঝাপসা । কিছুদিন পর দেখেন নাক আর গাল জুড়ে একটা প্রজাপতির ছাপ । অনেক প্রসাধনী নিয়ে এলেন । কিন্তু দাগ আর যায় না । তিত্লী বলতো
” তিত্লীর মুখে তিত্লীর ছাপ ! বুঝলে বাবাই, ভাগ্যিস তুমি আমার নাম শাখামৃগ টাইপ কিছু রাখোনি । “ বাবা-মেয়েতে হাসির ধুম পরে যেত।
বাবাইয়ের হাসি শুনে তিত্লীর বন্ধুরা ছুটে এল । চন্দ্রা ঠায় বসে আছে। কিছুই করার নেই তার । লাইফ সাপোর্ট খুলে নিলেই তিত্লী নেই হয়ে যাবে । ঐ একবার গগণ বিদারী হাসি ছাড়া কেউ ইফতেখার সাহেবকে কাঁদতে দেখেনি । উনি চন্দ্রাকে বললেন,
“আমার তিত্লী কষ্ট পাচ্ছে । ওর লাইফ সাপোর্ট খুলে দাও । ওকে উড়তে দাও । ও স্বর্গের বাগানে উড়ে বেড়াক । “
তারপর তিনি আই. সি. ইউ. তে ঢুকে মেয়েকে আদর করলেন । কি বললেন বা আদৌ কিছু বললেন কিনা আমারা জানি না । কিন্তু তাকে কেউ কাঁদতে দেখেনি । আই. সি. ইউ. থেকে বের হয়ে মৃত্যু পরবর্তী যাবতীয় নিয়মকানুন যথাযথভাবে পালন করলেন । বাড়ির পাশেই তিত্লীকে কবর দিলেন । কবরের চারপাশ অসংখ্য হলুদ গাঁধা লাগালেন । ফুলে ফুলে কবরটা ছেয়ে গেছে। নানান রঙ এর প্রজাপতিরা সারাদিন হুটোপুটি খায় । আর আমরা ইফতেখার সাহেবকে দেখতে পাই , পূর্ণিমা রাতে চন্দ্রাহত হয়ে কবরের পাশে বসে গল্প করছে । সারাদিন কি হল সব মেয়েকে জানাচ্ছেন ঠিক আগের মতোই । এক সময় ওখানেই ঘুমিয়ে পড়েন । মাঝ রাতে তার ঘুম ভেঙ্গে যায় , মনে হয় তিত্লী ডাকছে . . .
” বাবাই !”