ছোটগল্প

ঘৃণা (সেপ্টেম্বর ২০১৬)

শিকদার নূরুল মোমেন
  • 0
  • ৪৪

দিমা বেশ কিছুক্ষণ আগে খালার রুমে এসেছে, কিন্তু জেসমিন ভাগ্নীর উপস্থিতি খেয়াল করেনি। সে এই মুহূর্তে ফোনে কথা বলাবলিতে ভীষণভাবে মগ্ন। উচ্ছ্বাস আর বাধ ভাঙা আনন্দ মানুষটিকে দখল করে আছে। পিঠে-পিঠি বোন ইয়াসমিনের সঙ্গে টেলিআলাপের সময় তার অবস্থা এমনই হয়। এরকম আনন্দপূর্ণ সময় উপভোগ করা দিমার কাছে নতুন নয়। ঢাকায় নিজেদের বাসাও বহুবার এমন দৃশ্যের চিত্রায়ণ দেখেছে। মায়ের মুখে দুবোনের গলায় গলায় ভাবের অনেক গল্প শুনেছে। একে-অপরের উপর সীমাহীন অধিকারের কথাও এই পরিবারের চেনা-জানা কারো অজানা নয়। অধিকারের জোরে ছোট বোন জেসমিন বড় বোনের কাছে দাবী তোলে, আমার তো মেয়ে নেই। তোমার বড় মেয়েকে আমার কাছে নিয়ে আসবো, তুমি ছোটজনকে নিয়ে থেকো। ইয়াসমিনও রাজী হয়, ঢাকায় থেকে ইন্টারমিডিয়েট পর্যন্ত কমপ্লিট করুক। তারপর তোর কাছে নিয়ে যাস্, তখন তো মেয়ে পুরোপুরি তোর হয়ে যাবে। তাদের ওই মৌখিক চুক্তি মোতাবেক, দুবছর আগে ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা দিয়ে কানাডার অটোয়ায় ছোট খালার কাছে চলে এসেছে দিমা।

ইয়াসমিন ও জেসমিনের মুখের গল্প শুনে আর খাতির দেখে সবাই অবাক হয়। পুরো জীবনে তাদের মধ্যে একবারও ঝগড়া হয়নি! ইয়াসমিন বড় বলে সবসময় ছোট বোনকে ছাড় দিয়েছে, অন্যদিকে জেসমিনও বড় বোনকে সর্বদা সম্মান দিয়ে এগিয়ে রাখতে চাইতো। নিজেদের দুবোনের কথাও ভাবে দিমা। তিন বছরের ছোট তিমার সঙ্গে তারও সম্পর্ক ভীষণ আন্তরিক। প্রবাসী জীবনে তাকে সবসময় মিস করে, সারথীর কথাও খুব মনে পড়ে। দেশের নামকরা এক স্কুলে তারা পড়াশোনা করেছে। ওই স্কুলের কলেজ শাখা থেকে দিমা ইন্টারমিডিয়েট পাস করেছে, তিমা বর্তমানে ইন্টারমিডিয়েটে পড়ছে। দেশে থাকাকালীন সময়ে ক্লাসের গল্প, বান্ধবীদের গল্প ভাগাভাগি না করলে তাদের দিন পার হতে চাইতো না। গত দুবছরে তিমা-সারথীকে মিস না করে একটি দিনও কাটাতে পারেনি। দিমার ভেতরে শূন্যতা জড়ো হয়। সেই তিমা, সারথী আজ কত দূরে? মা-বাবাকে কতদিন ধরে দেখি না! সবার সঙ্গে কথা বলতে খুব ইচ্ছে করে। খালাকে এই ইচ্ছের কথা শুনালে মুর্হূতের মধ্যে তার মুড বদলে যাবে। কান থেকে ফোন সরিয়ে কড়া গলায় শুনাবে, তোমাকে কথা বলতে দিয়ে সারাবেলা তোমার কান্নাকাটি আর গোমড়া মুখ দেখি? অবশ্য খালার অভিযোগ মিথ্যে নয়।

ফোনে ইয়াসমিনের কন্ঠ কানে আসতে দিমার চোখ দুটো জলে ভরে যায়। প্রবাস জীবন ছেড়েছুড়ে মায়ের বুকে ছুটে যেতে ইচ্ছে করে। বুকের ভেতরের খা খা তীব্র থেকে তীব্রতর হয়। মনের মধ্যে পুষে রাখা অভিমান ভুলে যেতে চায়, ফেরারী জীবন অসহ্য লাগে। বাবার সঙ্গে কখনোই দুই-একটির বেশি কথা বলতে পারে না। সালাম দেওয়ার পর জিজ্ঞেস করে, বাবা কেমন আছো? ফোনের অন্য পাশের কন্ঠে অস্পষ্টতা, ভালো, মা তুমি? তারপর দুপাশই বাকশূন্য-। এই নজরুল ইসলাম অফিস থেকে বাসায় ফিরে মেয়েদের দেখতে না পেলে অস্থির হয়ে যেতো। মেয়েরাও বাবাকে ছেড়ে কোথাও রাত্রি কাটাতে পারেনি। বড় মেয়ে দিমা কথা ফোটার পর থেকে যখন-তখন মায়ের কাছে জানতে চাইতো, বাবা কখন আসবে? এখনো কেন আসছে না? মার কোনো উত্তরই তাকে শান্ত করতে পারেনি। সন্ধ্যার পর কলিং বেল বাজলে দিমা গুটি গুটি পায়ে দরজার দিকে দৌঁড়ে যায়। বাবাকে পেয়ে মেয়ের কন্ঠে বাধ ভাঙা উচ্ছ্বাস, বাবা এসেছে, বাবা এসেছে। কখনো দিমা ছাড়া অন্য কেউ দরজা খুললে বাসায় বিপত্তি ঘটে যেতো। নজরুলকে ফের নিচে নেমে আবার কলিং বেল চেপে বাসায় ঢুকতে হয়েছে। মেয়ের আচরণে বাবা কখনো বিরক্ত হয়নি, উল্টো মেয়ের আনন্দরাশিকে জীবনের বড় প্রাপ্তি ভেবেছে। এতোকিছু ভাবাভাবি ছেড়ে দিমা সাহসী হয়ে ওঠে। সফলতা বা ব্যর্থতা যাই হোক, খালাকে প্রস্তাব করে দেখি তো-।

খালামণি, ও খালামণি-, আহ্লাদযোগে খালাকে ডাকে দিমা। জেসমিন ভাগ্নীর দিকে কঠিন চোখে তাকায়। ইশারায় জানতে চায়, কি হয়েছে? সে থতমত খাওয়া গলায় বলে, কথা দিচ্ছি আজ আম্মুর সঙ্গে কথা বলে একদম কাঁদবো না, মনও ভার করবো না। খালার কঠিনের অভিনয় ভেস্তে যায়, ঠিক তো? দিমা খুশি মনে হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ে। জেসমিনের চোখে জল চলে আসে, আপা নাও, আমার মেয়ের সঙ্গে কথা বলো। ফোনে মা-মেয়ের ঢাকা-অটোয়ার খবরাদির আদান-প্রদান চলে। মা-মেয়ের জমে ওঠা আলাপে বাধা হয়ে দাঁড়ায় তিমার চড়া গলা, তুই কি শুধু আম্মুর সঙ্গেই কথা বলবি? দিমাও সঙ্গে সঙ্গে মাকে বলে, আম্মু পাগলীটাকে দাও তো। ফোনে তিমার কন্ঠ শুনে দিমা প্রশ্ন করে, আমি কখনো দুষ্টু বোনের সঙ্গে কথা না বলে ফোন ছেড়েছি? ফোনের দুপ্রান্ত একসঙ্গে হা হা শব্দে হেসে ওঠে। তুই কেমন আছিস? সারথী কেমন আছে? কোনো উত্তর দেয় না তিমা। মা ছোট মেয়েকে তাগাদা দেন, দে মেয়েটার কাছ থেকে বিদায় নিই। তারপর তোর যতো ইচ্ছে কথা বলিস। টেলিফোনের রিসিভার হাতে নিয়ে ইয়াসমিন দ্রুত কথা শেষ করে, মা খাওয়া-দাওয়া ঠিকমতো করো। কোনো অসুবিধা হলে সঙ্গে সঙ্গে খালামণিকে জানিয়ো। এই বিদায় পর্বে ‘তুমি’ সম্বোধন শুনতে ভালো লাগে না দিমার। ‘তুই’ ছাড়া কি মা-মেয়ের কথা জমে? চোখের কোণে জমা অশ্রু সর্তকতার সঙ্গে আড়াল করে, তাহলে তো খালামণির কাছে ফোন চেয়ে পাওয়া যাবে না।

ইয়াসমিন রান্না ঘরে চলে যাওয়ার পর তিমা লম্বা দম ফেলে, যাক এখন একটু মন খোলে কথা বলা যাবে। দিমার প্রত্যুত্তর, ঠিকই বলেছিস। খালামণিও মাত্র ওঠে গেলো।
আপু তোর সঙ্গে একটা বিশেষ আলাপ আছে-।
তা অবশ্য বুঝতে পারছি, কিরে প্রেমে-ট্রেমে পড়েছিস নাকি?
ওসব কিছু না। আপু মনটা খুব খারাপ-
আগ্রহ নিয়ে দিমা জানতে চায়, কি হয়েছে? কথা না পেচিঁয়ে সোজাসুজি বল তো।
তুমি জাহাঙ্গীর স্যারকে-, বাক্যটি সম্পূর্ণ করতে দেয় না দিমা। সে নিজ কন্ঠে তুলে নেয়, আমাদের কলেজ শাখায় বাংলা পড়ায় যে...?
ঠিক চিনেছো, জানো ওই অমানুষটা কি করেছে? কথাটি শুনে দিমার ভেতরে ধক করে ওঠে। স্কুল-কলেজ জীবনের নানা স্মৃতি তার চোখের সামনে ভেসে বেড়াতে শুরু করে। কত হৈ-চৈ, কত গল্প। এসএসসিতে এ প্লাস, এইচএসসিতেও এ প্লাস; দুবারই গোল্ডেন। এতো এতো প্রাপ্তির মাঝেও-। বোনের উত্তেজিত কন্ঠে ফেরে দিমা, ওই জানোয়ার সারথীকে...। তিমা পুরোটা বলতে পারে না, কান্নায় তার গলা চেপে আসে।

তিমা কান্না জড়ানো কন্ঠে বলে, ওই পশুটা তার কোচিংয়ের আটকে এ রকম আচরণ আরো অনেক মেয়ের সঙ্গে করেছে। সারথী কাউকে কিছু জানায়নি। গত একমাস ধরে সারাক্ষণ মনমরা হয়ে থাকে। চঞ্চল সারথীর মধ্যে চঞ্চলতা পুরোপুরি অনুপস্থিত, একদম নিস্তব্ধ হয়ে গেছে। অনেক জিজ্ঞাসার পরও সে মুখ খোলেনি। তবে কয়েকদিন আগে আসল ঘটনা বেরিয়ে আসতে থাকে। সিরাজুল আংকেল বাবুল আংকেলকে নিয়ে প্রিন্সিপাল স্যারের সঙ্গে দেখা করে, স্যারকে সবকিছু জানায়। প্রিন্সিপাল স্যার ঘটনাটি শুনেও কোনো এ্যাকশনে যায়নি, উল্টো সব চেপে যেতে বলে। ঘটনাটি আর চাপা থাকে না, এক কান থেকে অন্য কান হতে হতে পুরো কলেজে ছড়িয়ে যায়। অভিভাবক মহল, ছাত্রীদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। দিমার চোখের সামনে মিষ্টি চেহারার সারথীর মুখখানি ভেসে ওঠে। দুকপোলে টোল পড়ে, গজ দাঁতের মোহনীয় হাসি যে কারো নজর সহজে কেড়ে নেয়। বাবা সিরাজুল ইসলাম বড় পদে চাকরি করে, ঢাকায় বাড়ি-গাড়ি সবই আছে কিন্তু মেয়েটির চাল চলনে কোনো অহংকার নেই। সর্বদা শালীন পোষাক-পরিচ্ছদে থাকে, পড়াশোনায়ও ভালো-। তিমার ধরা কন্ঠ, আপু এমন হলে আমরা কোথায় যাবো? আমাদের নিরাপদ স্থান কোথায়? যেই শিক্ষকদের মা-বাবার মতো শ্রদ্ধা করি তারা কিভাবে এমন কাজ করতে পারে? প্রশ্নগুলোর কোনো উত্তর দিতে পারে না দিমা, তার দুচোখ দিয়ে নীরবে অশ্রু গড়িয়ে পড়ে।

মা ও ছোটবোনের সঙ্গে আলাপের পর দিমা কাঁদেনি, তবে চেহারা থেকে উৎকণ্ঠার ছাপ শত চেষ্টা করেও সরাতে পারছে না। দুচোখে শুধু সারথীর কোমল মুখখানি ভাসছে। সারথীকে ঘিরে স্মৃতিগুলো এক এক করে মনে পরছে। দিমা ক্লাস সিক্সে পড়ে তখন তিমাও ওই নামকরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে থ্রিতে ভর্তি হয়। তিমা নতুন স্কুলে আসা-যাওয়ার তৃতীয় দিনে বাসায় সারথীর কথা বলে, জানো জানো মেয়েটি না খুব ভালো। ওর সাথে আমার বন্ধুত্ব হয়ে গেছে। ও-ই আমার বেস্ট ফ্রেন্ড। মায়ের নির্দেশে সারথীর সম্পর্কে খোঁজখবর নিতে থাকে দিমা। মা নাসরিন সারথীকে স্কুলে নিয়ে আসা-যাওয়ার কাজটি করে। ওর মা খুব মিশুক টাইপের, বাবাকেও বেশ ভালো লাগে দিমার। কয়েকদিনের মধ্যে তিমা ও সারথীর বন্ধুত্বের বিষয়টি দুপরিবারের স্বীকৃতি পেয়ে যায়। কোনো উৎসব, এমনকি ছোটখাটো অনুষ্ঠানও এক পরিবার অন্য পরিবারটি ছাড়া ভাবতে পারে না। দিনে দিনে দিমার সঙ্গে সারথীর সম্পর্কটা বেশি প্রগাঢ় হয়ে ওঠে। সে যেকোনো ব্যাপার নিজের মাকে বলার আগে দিমার সঙ্গে শেয়ার করে। স্কুলের কোনো অনুষ্ঠানে যাওয়ার আগে সারথী বায়না ধরে, আমাকে তিমার মতো সাজিয়ে দাও। নাচ, গান ও কবিতা আবৃত্তিতে অসাধারণ মেয়েটিকে সাজানোর পর মুগ্ধতায় দিমার দুচোখ জুড়িয়ে যেতো, আমার বোনকে পরীর মতো অপ্সরী লাগছে। পরীও তোর রূপ দেখলে হিংসে করবে। প্রত্যুত্তর করতে ভুলেনি সারথী, আমার বড়বোনও কি কম সুন্দরী? দেখতে হবে না আমি কার বোন, কে আমাকে সাজিয়ে দিয়েছে?

সারথী সবার কাছে গল্প করে, আমরা তিন বোন এক ভাই। ব্যাখ্যা দিতে যেয়ে বলে, বড় আপুর নাম দিমা, পড়ে ক্লাস সেভেনে। আমরা দুজন জমজ তিমা ও সারথী, পড়ি ফোরে। আমাদের একমাত্র ছোট ভাই, ওর নাম শুভ। ও আমাদের চেয়ে দুই ক্লাস নিচে পড়ে, মানে টু-তে। ফাইভের প্রথম পার্বিকের শেষ পরীক্ষা দিয়ে সারথী মা-বাবার কাছে প্রস্তাব তোলে, আজ আমি আর শুভ তিমাদের বাসায় যেয়ে রাত থাকবো। তার যুক্তি, রাতে তো আমরা পড়তে বসবো না, আজ আমাদের ছুটি। তাছাড়া এভাবে না জানিয়ে গেলে ওরাও চমকে যাবে। সারারাত সবাই মিলে একসঙ্গে মজা করবো। মেয়ের প্রস্তাবে বাধা দেয় না নাসরিন। সন্ধেবেলায় সিরাজুল ছেলে-মেয়ে নিয়ে ছোটে দিমাদের বাসার দিকে। ওখানে পৌঁছে তারা ঠক খায়। কতক্ষণ আগে তিমা-দিমাও তাদের বাবাকে নিয়ে সারথীদের বাসার উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছে। সিরাজুল ফোন করে স্ত্রীর কাছে জানতে চায়, দিমারা কি পৌঁছেছে? নাসরিন তো দুপক্ষের টান দেখে বিস্মিত হয়, নাহ্ ওরা তো এখনো আসেনি। ওদেরকে বসিয়ে রেখো, আমরা দ্রুত বাসায় চলে আসছি। আর শোন আমরা ভাবীকেও সঙ্গে নিয়ে আসছি, একদমে কথাগুলো বলে সে ফোন ছাড়ে। পরবর্তীতে ওই রাতেই সিদ্ধান্ত হয়, কোন পরীক্ষা শেষে কারা-কাদের বাসায় বেড়াতে যাবে। ওইসব উৎসবমুখর দিনগুলোর কথা ভাবতেই দিমার দুচোখ অশ্রুতে পূর্ণ হয়ে ওঠে।

কম্পিউটার গেমস্রে প্রতি দিমা মাত্রাতিরিক্ত ভাবে আসক্ত। খালাতো ভাইয়েরা যখন তার সঙ্গে যোগ দেয়, তখন তো তারা গেমস্ েমত্ত হয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা সময় কাটিয়ে দেয়। গেমস্রে প্রতি আপুর নেশার তীব্রতা ক্ষুদে দুজন বুঝে গেছে। তারাও রোজ রাতে স্টাডি শেষ করে আপুর রুমে চলে আসে। দিমা প্রতিদিন তাদের নতুন নতুন গেমস্ উপহার দেয়, তখন দুই ভাই তো খুশিতে আটখানা হয়। সেই নেশাগ্রস্থ মেয়েটির আজ গেমস্রে প্রতি বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই। কোলে ল্যাপটপ রেখে রকিং চেয়ারে মৃদু দুলছে দিমা। ওই খবরটির বর্তমান পরিস্থিতি জানতে উদগ্রীব হয়ে আছে। কোলের ল্যাপটপে ওয়েবসাইট ‘এনওয়াইবাংলা’য় যেয়ে বাংলাদেশ থেকে প্রকাশিত শীর্ষস্থানীয় দৈনিক পত্রিকাগুলোর হেডলাইনসমূহে চোখ বোলায়। আজকের আপডেট এখনো আসেনি, কিছুক্ষণের জন্য ল্যাপটপের স্ক্রীন থেকে চোখ সরায়। অর্ণব-আবীর পুরো এক সপ্তাহের গেমস্ খেলার খরা কাটাতে রুমে আসে। দুচোখ বন্ধ করে রকিং চেয়ারে হেলান দিয়ে আছে দিমা। বড়জনের উচ্ছ্বাসিত কণ্ঠ, আপু আমরা কি এখন গেমস্ নিয়ে বসবো? দিমার চিন্তায় ছেদ ঘটে, তবে ওই গ-ি ভাঙতে সময় লাগে না। বিষণœ মনে বলে, নারে ভাইয়া, আজ গেমস্ নিয়ে চিন্তা করার মুড নেই। আপুর মনের অবস্থা বুঝতে পেরে দুজনে সমস্বরে বলে, সরি আপু। দুজনের দিকে তাকিয়ে সে মিষ্টি করে হাসার চেষ্টা করে, অলরাইট ভাইয়ারা। আবীর অনুরোধের কন্ঠে বলে, আজ রাতে তোমার সঙ্গে শোব। দিমা সম্মতি দেয়, তোমরা শুয়ে পরো। আমি সময় মতো চলে আসবো।

অর্ণব-আবীর বেডে চলে যাওয়ার পর দিমা ল্যাপটপের স্ক্রীনে চোখ রাখে। তিমার বর্ণনানুযায়ী সে আন্দাজ করে, খবরটি অবশ্যই দেশের জাতীয় দৈনিক পত্রিকাসমূহে নিউজ হবে। বাংলাদেশ থেকে প্রকাশিত পত্রিকাগুলোর অনলাইন সংস্করণের নিউজ আপডেটে চোখ রাখে। অতীতের সব দুঃসহ স্মৃতি থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করে। মনিটরে মিনিমাইজ করে রাখা পত্রিকাগুলো একের পর এক বের করে ওই ঘটনা সম্পর্কিত নিউজ তন্ন তন্ন করে খুঁজতে থাকে। এই ঘটনা নিয়ে দেশে এখন কি ঘটছে, তা জানার কৌতুহল তার পরবাসী মনকে উতলা করে তুলেছে। অবশেষে ইন্টারনেটের পত্রিকার আপডেটের মাধ্যমে বিস্তারিত অবগত হতে পারে। সবকটি পত্রিকায় ভিন্ন ভিন্ন শিরোনামে নানা খবর প্রকাশ করেছে, শিক্ষকের যৌন নিপীড়নের প্রতিবাদে কলেজ ক্যাম্পাস উত্তপ্ত। অভিভাবকসহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্রীমহলের তীব্র আন্দোলনের ডাক। কলেজ কর্তৃপক্ষ ব্যাপারটি ধামাচাপা দিতে ব্যর্থ। কলেজ বন্ধ ঘোষণা। ক্যাম্পাসে অভিভাবক ও ছাত্রীদের কাউকে ঢুকতে দেয়া হচ্ছে না।

দৈনিক পত্রিকার অনলাইন সংস্করণ থেকে চোখ তুলে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে দিমা। চারিদিকে এতো এতো নারী আন্দোলন, কতো কর্মসূচী, এতো সমঅধিকারের জন্য লড়াই চলছে। তারপরও মেয়েরা এই সমাজে কতটুকু নিরাপদ? মেয়ে হয়ে জন্মানোই যেন ভীষণ অপরাধ। তাসলিমা নাসরীনের ‘নির্বাচিত কলাম’-এর উৎসর্গ বাণীটি কানে বাজতে থাকে, তবে কি এই-ই সত্য যে নারীর না মরে মুক্তি নেই? গত দুই-তিন দিন ধরে পত্রিকায় নতুন কোনো খবর পাচ্ছে না, ছাত্রী-অভিভাবকসহ সুধীসমাজের আন্দোলনের খবর রোজ রোজ ছাপা হচ্ছে। বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আন্দোলনের সচিত্র সংবাদ দেখে তার মনের জ্বালা দমে না। চারদিন পর পত্রিকা পড়ে দিমা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। প্রত্যেকটি পত্রিকা গুরুত্ব সহকারে নিউজ প্রকাশ করেছে, ডিবি পুলিশের হাতে অভিযুক্ত শিক্ষক জাহাঙ্গীর আলম গ্রেপ্তার। পরক্ষণে নিজেকে বোকা ভাবে, এতে স্বস্তির কি হলো? ওই শিক্ষকের ফাঁসি হলেও কি হারানো সম্ভ্রম মেয়েরা ফিরে পাবে? নিজেই ফের যুক্তি দেখায়, আর কোনো মেয়েকে তো ওই পশুটা নির্যাতন করতে পারবে না। দিমার মনের ভেতরে অনেক কথার এলোমেলো চালাচলি চলে, তাতে কোনো কূল-কিনারা পায় না।

মনের ভেতরের এতো প্রতিকূলতার মাঝে দিমা কিছু অনুকূলতা খুঁজে বেড়ায়। ওই নরপশুকে কয়েক দফায় রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে। সবাই এই জঘন্য অপরাধের কঠিন সাজা প্রত্যাশা করছে। পুরো জাতি আশা করে, সারা দেশে ছড়িয়ে থাকা এরকম হাজারো শিক্ষকের অপকর্ম বন্ধ হবে। তারা এমন অপরাধে নিজেকে জড়াতে আর সাহস দেখাবে না, নিজেদের লালসাকে নিয়ন্ত্রণে রাখবে। গত কয়েকদিনের মনের গোমট ভাব অশ্রুতে রূপ নেয়। ঝুম বৃষ্টির মতো কেঁদে পুরানো স্মৃতি ভুলতে চেষ্টা করে। সারথীর সঙ্গে কথা বলতে খুব ইচ্ছে করে। দিমা বুক সেলফ থেকে তার ডায়েরিটা বের করে আনে। ইন্টারমিডিয়েট সেকেন্ড ইয়ারের দিনগুলোর কথা মনে পড়ে। ওই দুর্বিষহ দিনগুলোর পর থেকে ডায়েরি লেখা ছেড়ে দিয়েছে, কেননা ডায়েরিতে সবসময় সত্য লিখতে হয়। পরবর্তী সময়ে কয়েক দফায় ডায়েরিটা হাতে নিলেও তাতে এক কলম লিখতে পারেনি। অনেক দিন পর আজ ডায়েরিতে লিখতে খুব ইচ্ছে করছে। শত-সহস্র অগোছালো ভাবনা থেকে দিমা বের হয়ে আসে। দিমা সারথীকে কিছু লিখতে চায়, মেয়েটির কাছে ক্ষমা চাইতে হবে। অত-শত ভাবনা ছেড়ে সে ডায়েরির পাতায় লিখতে শুরু করে।

সারথী,
জানি তোর এই কান্না¯œাত সময়ে আমার চিঠিটি তোকে আরো কাঁদাবে। তবুও তোর এই বোনটি তোকে না লিখে পারছে না। তোকে ভীষণ দেখতে ইচ্ছে করছে। দেখতে ইচ্ছে হচ্ছে অবশ্য অনেকগুলো কারণে; তোর জন্য অনেক মেয়ে লাঞ্ছনার হাত থেকে রেহাই পেয়েছে। কজন তোর মতো এতো সাহসী হতে পারে! স্যালুট তোকে। তুই নিজের মান-সম্মানের দিকে না তাকিয়ে প্রতিবাদ করেছিস্, তুই তো অসাধারণ একজন মেয়ে। আমাকে ক্ষমা করিস্ সারথী, তোর জীবনে এমন ঘটনার জন্য আমি নিজেও অনেকাংশে দায়ী। সেদিন আমার লাঞ্ছনার সময়ে যদি আমি তোর মতো এম্নি সাহসী হতে পারতাম, তাহলে হয়তো তোর জীবনে এই কলংকের দাগ লাগতো না। আমি লোক লজ্জার ভয়ে সাহসী হতে পারিনি। হবোই বা কিভাবে? তোর নিশ্চয় মনে আছে, গত কয়েক বছর আগে মিরপুরের চিড়িয়াখানা রোডস্থ এক কলেজে কয়েকজন ছাত্রী এমন অভিযোগ তুলেছিলো। তখন ক্ষমতাধর শিক্ষকেরাসহ সমাজের প্রতাপশালীদের তোপে তাদের অভিযোগ টেকেনি, উল্টো ছাত্রীদের নানাভাবে অপমান-অপদস্ত হতে হয়েছিলো। সে সময় ব্যর্থ হয়েছি বলেই তোকে এতোটা সাহসী ভাবতে পারছি, অহংকার করছি তোকে নিয়ে...। সতীত্ব হারিয়ে শুধু নিভৃতে কেঁদেছি, হেরেছি সামাজের ঠুনকো মর্যাদায় কাছে। নরপশুর শরীরের নিচে দুর্বল চিত্তের শরীরটি পেতে দিয়ে মুক্তি খুঁজেছি। অবশেষে ফেরারী জীবন বেছে নিতে হয়েছে। এই ফেরারী জীবন বেছে নেওয়ার কারণটা অবশ্য সবার অজানা। নরপশু জাহাঙ্গীর আমার-তোর মতো অনেক কোমলমতী মেয়ের সর্বনাশ করেছে। নানা কারণে আমরা নির্যাতিতরা মুখ বুঝে সব সহ্য করেছি। কেবল তুই-ই ব্যতিক্রম, তুই এই জঘন্য অপকর্ম বন্ধে সাহসী হয়েছিস্। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের মতো অনেকে নির্যাতনের শিকার হয়েছে, হচ্ছে-। আজ স্বপ্ন দেখতে ভালো লাগছে, জাতির কপালে এঁটে থাকা কালিমা হয়তো ঘুচবে। এই ঘটনার কঠিন ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা হলে শিক্ষক কর্তৃক ছাত্রী নিপীড়ন বন্ধ হবে। কেউ আর এমন অপকর্ম করার সাহস পাবে না। তখন আমাদের মতো আর কেউ লাঞ্ছিত হবে না..., ধর্ষিত হবে না...। দুঃসহ স্মৃতি নিয়ে কাউকে কাঁদতে হবে না নীরবে-নিভৃতে...

আর লিখতে পারে না দিমা। অশ্রুতে ভরাট দুচোখ থেকে ফোঁটায় ফোঁটায় অশ্রুর পতন শুরু হয়। ওই অশ্রু ফোঁটাগুলো একের পর এক ডায়েরির মেলে রাখা পাতার ওপর পরতে থাকে। জেল কালিতে লেখা জীবনের নির্যাতিত সময়ের স্বীকারোক্তি চোখের সামনে লেপ্টে যেতে থাকে। এই মুহূর্তে দুনিয়ার সাজানো-গোছানো সব এলোমেলো করে ফেলতে ইচ্ছে করে। দিমা ডায়েরির পাতাগুলো টেনেটুনে ছিঁড়ে ফেলে। সে নিজের ওপর আর নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারে না। হাউ মাউ শব্দে চিৎকার করে কেঁদে ওঠে। জেসমিন ভাগ্নীর রুমে দৌঁড়ে ছুটে আসে। সে কিছু বুঝতে পারছে না। তবে এইটুকু বুঝতে পারে, কোনো চাপা কষ্ট থেকে মেয়েটি এম্নিভাবে কাঁদছে। মুখে কিছু না বলে জেসমিন ভাগ্নীকে বুকে জড়িয়ে নিতে এগিয়ে যায়। দিমা ডায়েরির পাতাগুলো কুটি কুটি ছিঁড়ে খালার বুকে নিজেকে সঁপে দেয়।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
মিলন বনিক মাহী ভাইয়ের সাথে সহমত পোষণ করছি...ভালো একটা পজিটিভ কনসেপ্টে গল্পটা ভালোই এগিয়েছে..েএকটু যত্ন নিলে পাঠক ভালো কিছু পাবে...ধন্র হবে...শুভকামনা...
ভালো লাগেনি ২২ সেপ্টেম্বর, ২০১৬
আহা রুবন গল্পের কাহিনী তেমন দানা বেঁধে ওঠেনি। বর্ণনা-মূলক গল্পে পাঠকের মনোযোগ ধরে রাখা সংলাপধর্মী গল্পের চেয়ে কঠিন। শুরুটা সহজ দিয়ে করা ভাল। আর অনেক নতুন লেখককে লক্ষ করি এরা অন্যের গল্পে কোনও মন্তব্য করে না। তবে হাত পাকবে কীভাবে?
ভালো লাগেনি ৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৬
শিকদার নূরুল মোমেন গল্পের শিরোনাম ‘ফেরারি স্বীকারোক্তি’, গল্প-কবিতা কর্তৃপক্ষ কেন শিরোনামটি প্রকাশ করেনি, তার কোনো ব্যাখ্যা আমার জানা নেই...
ভালো লাগেনি ৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৬
পন্ডিত মাহী কনস্পেট ভালো। তবে পাঠকের মনযোগ কাড়তে বুনন আরো শক্ত হতে হবে। গল্পের নাম প্রয়োজন।
ভালো লাগেনি ২ সেপ্টেম্বর, ২০১৬

০৭ জুন - ২০১১ গল্প/কবিতা: ২ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "স্থিতিশীলতা”
কবিতার বিষয় "স্থিতিশীলতা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪