চোখে কিছু পড়ল নাকি! নালি পড়ে এ বুড়ো বয়েসে আইসে এমন কইরে জল ঝড়বে ক্যান!
মনে পইড়ে যাতিছে কত বছর নরম প্যাকে নাইমে হাড়ভাঙ্গা খাটুনি দিয়ে জমিতে হাল দিছি। দুপাশে দড়ি ধইরে সারি কইরে আলি পুতেছি। লিক লিক কইরে যখন সেগুলো বড় হয়, মনের ভিতরে খুশির ঝিলিক মারিছে। কত স্বপ্ন বুইনেছি.... এইবার এখখানা ট্রানজিস্টার কেনাই লাগবে। হয়নি, সেবার হয়নি, তার পরের বারও হয়নি। ধানের থোর ধরিছে, আকাশ জুইরে কোন বাদলার দেখা নাই। নদী-নালা শুকুয়ে ফেটে গেছে। পোয়াতি বউয়ের মত আমার সোনার ধান, চিটা হইয়ে গিয়েছে। শুকুয়ে ফাইটে যাওয়া মাটির মত আমার চোখ জোড়াও শুকুয়ে ছিল, কান্না ঝড়েনি। সেই দিন না কবেই পেড়ুয়ে এলাম!
তালি পড়ে এই আমার কী হল! আজ চোখ ভইরে বর্ষা ঠেকাবে কে? আমারই যদি এমন হাল হয়, আমার জন্ম কালা-বোবা বউটারে বোঝাবে সাধ্যি কার। দিনে দিনে ম্যালা যুদ্ধ করিছে। যখন বিল শুকায়ে চৌচির হয়েছে, আমার এই বউটা জায় নামাজে বইসে হাত দুটো তুইলে ধরে কী কান্দন ই না কান্দিছে। খোদা তার ভাষা বুইঝতে পারিছে কী না আমি বইলতে পারব না। তিনি তারে তো আর ভাষা দিয়ে দুইননায় পাঠান নাই, আমিও কতটা বুইঝতে পারি তারে?
আমার ফর্সা মনাটা যেদিন দুইননায় এল সেইদিন থেকেই তারে অনেক সুখি মনে হতি থাকল। আদর যত্নের কোন কমতি নাই। মা কতা কতি না পাল্লেও ছাওয়াল আমার ঠিকই মায়ের সুখ-দুঃখ বুইঝতে শিখল। মেট্রিক পাশ কইরল এই সেদিনের কতা। কোথায় ছাওয়াল আমার আর দশজনের মতো ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার হতি চাইবে তা না। ওরে ধরিছে খেলার নেশায়। সত্যি কতিছি প্রথম প্রথম আমার ভাল লাগত না তার এই খেলার জেদ।
মনা আমার ঠিকই নিজেরে উপরে উঠায়ে নিল। এক এক কইরে খেলায় সে সবার মন জয় কইরে নিতে লাগল। ছোট্ট একখান দেহ ছাওয়ালের, তার খেলা দেখলি পড়ে সবাই কত প্রশংসা কত্তি থাকে। কেউ যখন কয় মুশফিকুর রহিম খুব ভাল খেলে, তালি পড়ে আমারও বুকটা ফুইলে ওঠে। ওর খেলার ধরনে আর মানে নির্বাচকরা সন্তুষ্ট হইয়ে ওরে যুব দলের ক্যাপ্টেন বানায়ে দিল।
উনিশ বছরের তাগড়া জোয়ান গুলা যখন মাঠে খেইলতে শুরু করে তখন আর কষ্ট থাকত না। আমার এখনও মনে পইড়ে যায়, এইতো কয়টা বছর আগে ষোল বছরের আমার মনার নেতৃত্বে ওরা যখন যুব বিশ্বকাপে খেলতি গেল। একটা একটা কইরে খেলায় জিতে তর তর কইরে সেমিফাইনালে উইঠে গেল। সেদিন আমার ফর্সা মনাটা অনেক রান কইরে ফেলল। তার বন্ধুরা সব দাড়ায়ে যখন সম্মান জানাল, চোখের কোন দুটো সেদিনও ভিজেছিল। তবে তাতে কষ্ট ছিল না। কিন্তু ছাওয়াল আমার যখন ফোনে কতা কতি গিয়ে কাইন্দে ফেলল, মনে হতি লাগল কি যেন আমি বুইঝতে পারিনি। এত রান করিছে তারপরেও কান্দার কি আছে!
সে যখন আমারে বুঝায়ে কইল তার এত রান করার পরেও দল হাইরে গিয়েছে ইংরেজদের কাছে তখন বুইঝেছি, কষ্ট আর আনন্দ তার একার নাই, এইটা তখন দেশের হইয়ে গিয়েছে। তার আগে জিম্বাবুইয়ের সাথে যখন সে একশ কইরেও দল হাইরে গেল, ছাওয়াল আমার সেদিনও কান্দিছে। আরো কান্দিছে সাকিব, তামিমরাও।
ওর মা ও এখন খেলাটা কিছুটা বুইঝতে পারে। আগেতো সে খালি বুইঝত আরো জোরে মারলে ছক্কা হয়। আমার খুব হাসি আইসত তখন। বেটি! ছক্কা ছাড়া কি আর কিছু নাই এই খেলায়? আজ ফাইনালে ওর মা ও তো আমার পাশে বইসে খেলা দেখিছে। তার কানে যে কোন আওয়াজ যায়না তা আমি ভাল কইরে জানি। কিন্তু সে তো তার মা, ছেলের মুখের দিকে তাকালি পরে কি আর তারে বুঝায়ে দেয়া লাগবে যে তার ছাওয়াল কানতিছে? আমি খোদার দুয়ারে দোয়া কইরে যাই, আমার মনাডারে আর তার দলের যারা কানতিছে তাদের যেন বড় টেলিভিশনটায় আর না দেখায়। মাঠে অত দূরের ছাওয়ালগুলার মুখ দেখা যায় না। তাতে হয়ত তার মা বুইঝতে পারবেনানে ওরা কানতিছে।
এই এশিয়া কাপ শুরু হওয়ার আগে দেশের কেউ কি ভাবিছে বাংলাদেশ এত ভাল খেইলবে? আইজ যখন আমাগের ছাওয়ালগুলা নিজেদের যোগ্যতায় ফাইনাল খেলতিছে- সারা দেশের মানুষের মত আমারও আশা ওরা জিতে যাবে। শেষ বলে যখন চাইর রান দরকার তখনও ভাবিছি হইয়ে যাবে। আমার মনে হয়নি সেই যৌবনে ধান ক্ষেতে আশাভঙ্গের কান্না আবার আমার কানতি হবে।
আমার দোয়া কবুল হয়নি। পাশের চেয়ারে বইসে যে ভদ্রলোক খেলা দেখতিছে তার হাতে একখান ক্যামেরা। দূরের জিনিসও বড় কইরে দেখা যায়। মনার মা তাতেই দেখিছে খেলা শেষে মনা আমার সাকিবরে জড়ায়ে ধইরে হু হু কইরে কানতিছে। আরো কানতিছে নাসির, মাশরাফি বইসে আছে সীমানা দড়ির কাছে। সবগুলা ছাওয়াল যেন জীবন্ত ভুত হইয়ে গিয়েছে। মনে মনে বলি খেলাটা না বুঝলেই ভাল ছিল।
রাইতে যখন ছাওয়ালের উত্তরার বাসায় তার সাথে দেখা হলো, মায়েরে জড়ারে ধইরে তার সে কি কান্না, “ওমা আমরা পারিনিগো মা”। ওর মায়ের চোখের কোন দিয়েও পানি ঝরতিছে। তবুও সে ছাওয়ালের মাতায় হাত বুলায়ে যাচ্ছে। আমি যেন পষ্ট শুনতি পালাম বোবামুখেও সে বলতিছে, “ওরে মনা এতো তোদের নতুন দিনের শুরু কেবল, কানলি পরে কিছু হবে নানে, তোর বাপও যদি ফাইটে চৌচির হওয়া মাঠ দেইখে কানতি বসত তালি কিরম হতো? সে তো আবার চেষ্টা করিছে, আবার করিছে। তার সাথে তো কেউ ছিল না। তোগের সাথে দেখ পুরো দেশ আছে, তোদের জয়ে তারা হাসে, নাচে গায়। আবার তোগের হারে সবাই মিলে কান্দে। এই মানুষগুলাই তোগের স্বপ্নের বাগানে পানি দিবে, বাঁচায়ে রাখবে তোদের স্বপ্ন। আজ হয়নি, একদিন হবেই। আজ হতি শুরু হল তোগের নতুন যাত্রা। এত ভালবাসা কারা কবে পাইছেরে পাগলারা। একদিন তোরা সকলে মিলে আমার আঁচল ভরায়ে দিবি সেই আশায় আমি বেইচে থাকপ বাবা। আমি জানি তোরা পারবি”
((পুনশ্চঃ বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের অধিনায়ক মুশফিকুর রহিমকে উৎসর্গ করে এ গল্পটি লেখা হয়েছে, তার বাবা মাহাবুব হামিদ, এবং তার কথা বলতে না পারা মাসহ পরিবারের সবাই একসাথে বসে খেলাটি দেখেছেন, কিছু সত্য আর কিছু কল্পনা জুড়ে দিলাম, ভুল ভাবনা অথবা অন্য যে কোন তথ্য বিভ্রাট থাকলে আগে থেকেই মা চেয়ে রাখছি।))
০৭ জুন - ২০১১
গল্প/কবিতা:
১৩ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪