বন্যার পানিতে চারদিক ভেসে গেছে। গা বাঁচিয়ে চলবার কোন পথই আর অবশিষ্ট নেই। ঘরের ভেতরটা দরজায় ইট গেথে কোন মতে রক্ষা করা গেছে বটে তাতে বিরক্তির মাত্রা কোনভাবেই কমেনি। ঈদেরও মাত্র ক'টা দিন বাকি। নিকিতা অপেক্ষায় আছে, ওকে নিয়ে শপিংয়ে যেতে হবে। নাহ্ আর পারা গেল না। সৃষ্টিকর্তা তার সৃষ্টিকে এমনতর বিপদে ফেলে যে কি সুখ পান!
জুতো জোড়া বগলদাবা করে গেটের ভিতরে বেধে রাখা সদ্য কেনা কোষা নৌকাটায় উঠলাম। এও এক ঝক্কির ব্যাপার, আমি শুকনো জায়গায় পৌছাবার পরে এই কোষাটা কে বাড়ি নিয়ে আসবে? তবুও কোষাটায় চড়ে রওনা দিলাম, যদি বাড়ীর পাশের কাউকে পাওয়া যায়! তারও উপকার হবে আর কোষাটাও বাড়িতে চলে যাবে। পাকা রাস্তায় পৌছাতেই রমজান মিয়াকে দেখে বিলুপ্ত প্রায় ভাবনাটা আবার উঠে এল। মা বলেছিলেন, "রমজান বন্যার কারনে রিঙ্া চালাতে পারছেন না। সংসার বলতে সে নিজে আর মা মরা একমাত্র মেয়ে। কোষাটাতো সারাদিন বাড়িতেই থাকে, এটা যদি ওকে দিস্ তাহলে সে কিছু টাকা আয় করতে পারে"। ডেকে নিয়ে কোষাটা তাকে বুঝিয়ে দিলাম। সারাদিন সে এটাতে মানুষ পারাপার করবে টাকার বিনিময়ে, আর সময় মতো আমাদের পারাপার করবে। এতে তার ছোট্ট মেয়েটাকে নিয়ে বেশ চলে যাবে।
নিকিতাকে নিয়ে শপিংয়ে যাব, পুলকিত মনে বেশ চাঞ্চল্য ফিরে এলো। বাসটা যাত্রাবাড়ীতে কখন চলে এলো বুঝতেই পারিনি। নেমে এলাম বাস থেকে। একটু হেটে বিকল্প পরিবহনের ১৪নম্বর বাসের জন্য লাইনে দাড়িয়ে গেলাম। মিনিট বিশেক পর বাস এলে ইডেন কলেজের উদ্দেশ্যে তাতে চড়ে বসলাম। অতি বৃষ্টিতে ঢাকার রাস্তাঘাট গাড়ি চালানোর অনুপযুক্ত হয়ে গেছে বেশ আগেই। মানুষগুলোও ভাবলেশহীন, শত ঝাকুনী আর ঘন ঘন ব্রেক চাপায়ও কোন ভাবান্তর নেই। অসুবিধা আমার মত খন্ডকালীণ যাত্রীর। একটা বমি বমি ভাব চলে আসে।
কোন মতে পলাশী পর্যন্ত এলে বাস আর এগুচ্ছিলনা। হেলপার ও অন্যান্য যাত্রীদের আলাপে জানা গেল- সামনে এঙ্েিডন্ট হয়েছে, গাড়ী ঘুরে যাবে। নেমে এলাম বাস থেকে। বাকি পথটুকু হেঁটেই যেতে হবে। বাঙ্গালী নাকি খুবই কৌতুহলী, আমিও এই উক্তির প্রতি যথাযথ সম্মান দেখিয়ে কি ধরনের এঙ্েিডন্ট তা দেখার জন্য পা বাড়াই।
পলাশী থেকে আজিমপুর যাওয়ার রাস্তায় ফুটপাত দখল করে বেশ কিছু পলিথিনে ঘেরা ঝুপড়ি মতন আছে, চোখেও পড়ত। কখনো আগ্রহ জন্মেনি এখানে কি আছে, কে আছে, জানার। অনেক লোকের জটলা ঠেলে কাছে গিয়ে দেখলাম মধ্যবয়সী এক মহিলা রাস্তায় চিৎ হয়ে পড়ে আছে। ছেড়া একটা সুতি কাপড় জড়ানো গায়। ব্লাউজের বোতামগুলো খোলা অথবা বোতাম ছিলই না। রক্তমাখা একটা স্তন সেই খোলা ব্লাউজের বাইরে বেরিয়ে আছে। তাকে দেখে মনে হলো ভুল করে রাস্তায় ঘুমিয়ে আছে। এত মানুষ দাড়িয়ে তবু যেন একটা নিরবতা চারদিকে। লোকজনের ফিসফিসানি থেকে জানা গেল ফুটপাতে পলিথিনের ঝুপড়ি ঘরেই থাকতেন। দুটো বাসের আগে যাবার প্রতিযোগীতায় একটা বাস সেই ঝুপড়িতে উঠে যায়, আর তাতেই ভিতরে থাকা মহিলা সিটকে এসে পড়েন রাস্তায়। এঙ্েিডন্টের সময় বা আগে আশে পাশের কেউ তার কোন আওয়াজ শুনতে পায়নি। একেবারে যন্ত্রনাহীন মৃত্যু।
যখন ফিরে আসছিলাম ঠিক সেই মূহুর্তের একটি দৃশ্য আমাকে নিশ্চল বৃক্ষ বানিয়ে দিলো। একটা ১০ থেকে ১২মাস বয়সী শিশু ছেড়া কাপড় আর ব্লাউজের ফাক গলে বেরিয়ে থাকা মৃত মহিলাটার স্তনের বোটায় মুখ লাগিয়ে চুক্ চুক্ করে আওয়াজ করছিল। ক্ষুদার্ত পেটের অনিবার্য তাগিদে খাদ্য আহরণের নিষ্ফল চেষ্টা, আমার শরীরে একটা শিহরণ ছুয়ে যায়। মা মরে গেলেও তার সন্তানটি কোন এক দৈব কারনে বেঁচে গিয়েছিল। এঙ্েিডন্ট হয়েছে প্রায় ঘন্টা তিনেক হবে। হায়রে অবুঝ শিশু, সেকি জানে, তার মৃত মা আর কোন দিনই তাকে আদরে বুকে জড়িয়ে নিজ দেহ নিঃসৃত দুধ খাওয়াতে পারবেনা?
তবুও সৃষ্টির অমোঘ নিয়মে সে বুঝতে পারে, বেঁচে থাকতে হলে তার খাদ্য চাই।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
খন্দকার নাহিদ হোসেন
কি কঠিন জীবন আর কি নিরাসক্ত ভাবেই না বললেন। বড় ভালো লাগলো। আমি এভাবে হয়তো কখনোই লিখতে পারবো না কারণ ভাবতে গেলেই কি কষ্ট হয়! বড় করুণ গল্প।
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।