খুব ধীরে ধীরে একটা শব্দ কানে আসতে লাগলো. খুব চেষ্টা করেও চোখটা খুলতে পারছে না সময়. পিঠে এবং দু পায়ের গিরায় ভিশন ব্যথা টের পেতেই নড়াচড়া বন্ধ করে দিল সময়. উপুড় হয়ে পড়ে থেকে একটা একটা করে মনে পড়তে লাগলো সব কিছু. "বেছে আছি তাহলে" - একটা দীর্ঘশ্বাস খেলা করতে লাগলো ওর ভিতরে.
"চেয়ার ম্যান সাব, হালার মনে হয় জ্ঞান ফিরসে, দিমু নি আরকয়টা জুইত মত?" - সবুর এর গলাটা কানে ভেসে আসে সময় এর. " না, কিছু কউনের কাম নাই, চুপ মাইরা থাক, সার এ আইআ পড়ব এহন এ." - চেয়ার ম্যান এর ধমক খেয়ে চুপ করে যায় সবুর.
ভাবতে ভাবতে খুব অদ্ভূত লাগে সময়ের. এভাবে ধরা পড়ে যাবে, ভাবতেই পারেনি. চার মাস মা কে দেখেনা, অনেক বলে কয়ে অনুমতি পেয়েছিল সুজিত ভাইয়ের কাছ থেকে. খুব ডেনজারাস জায়গা বলে ফায়েজ কে সাথে দিয়ে দিয়েছিলেন তিনি. বিপদ ছিল জানত সময়, কিন্তু এভাবে আসবে তা ভাবেনি.
ফায়েজ এর কথা মনে পড়তেই, ওর মুখটা ভেসে ওঠে চোখের সামনে. সেই ছোট্টবেলায়, কতই বা বয়স হবে তখন, সাত কি আট, সেই সময় থেকে আজ অবধি, মনে পড়েনা, কোনো একটা আনন্দময় মুহূর্ত দুজন আলাদা ছিল. কলেজ এর শেষ দিন, ক্লাস শেষে হঠাত বলে বসেছিল, "আচ্ছা এবার কি তুই আলাদা হয়ে যাবি?" বলা মাত্রই চাটি খেয়েছিল সময়ের হাতে, "গাধা, এই বন্ধু তুই আমার? এখনই ভাগতে চাইছিস? যা ভাগ."
সাথে সাথে জড়িয়ে ধরেছিল ফায়েজ, "আরে বাবা, ফান করছিলাম. চল চা খাই, স্যার আসার আগে আবার প্রিপারাশন নিতে হবে."
চিন্তার সুতোটা কেটে যায় হঠাত একটা লাঠি খেয়ে, "লেট হিজ সেন্স কাম ব্যাক ফুল্লি, দেন ইনফর্ম মি, ওকে?" কাকে যেন নির্দেশ দিয়ে ভারী কন্ঠটা সরে যায় ধীরে ধীরে. মনেমনে হাসে সময়, কি অদ্ভূত লোকগুলো.
ভার্সিটি শুরু করা হয় নি, তার আগেই ক্যাম্প এ সময়, কাউকে না বলে, চারিদিকে শুধু হাহাকার, মানুষ মরছে, সাজন্পুরের মানুষ খুব ভয়ে শুধু পালিয়ে বেড়াচ্ছে. পুরুষদের তখন মাথা এবং রক্ত দুটি গরম. অর্ধেক ছেলে পালিয়ে গেছে কাউকে কিছু না বলে. যারা রয়েছে, তারা কি করবে ভেবে পাচ্ছেনা, আর কিছু শুধু জীবন বাচাতে ব্যস্ত.
সেই চরম সময়ে নিজের বইতে পড়া একটা লাইন বার বার মনে পড়ত সময়ের, "দেশপ্রেম ঈমানের অঙ্গ", বিড়বিড় করতে করতেই সুজিত ভাইয়ের মুখ মুখী, "কিরে কি ভাবছিস শুধু? কিছু করতে হবে না?" - প্রথম প্রশ্ন ছিল তার, সব মনে পড়ছে সময়ের. রাত তখন অনেক, কত তা মনে নেই, শুধু মনে আছে, ঘুমন্ত মা কে সালাম করেছিল দূর থেকে. অথচ ফায়েজ কে কাটাতে পারেনি, বাড়ির চৌহদ্দি থেকে বের হতেই এক হাতে জড়িয়ে ধরে কেউ,"আমাকে ফেলে যাবি,এভাবে? আমাকে নিবি না?" - চিরকালের প্রিয় কন্ঠটা ওকে শেষ নারা দিয়েছিল, আর দিধা করেনি সে, এক হাতে ফায়েজকে টেনে বের হয়ে এসেছিল.
তারপ ছয় মাস কেটে গেছে. নিথর সঙ্গী শুধু স্টেনগান আর ম্যাগাজিনগুলো, আর জীবনের আঠা - ফায়েজ. মনে আছে, আড়িয়ালখা নদীর অপারেশন এর সময়, কম সাতার জানে বলে ফায়েজকে যেতে দেন নি সুজিত ভাই, আর তাই পুরো দায়িত্ব ছেড়ে দিয়েছিল সময়. অনেক কথা কাটা কাটির পর সুজিত ভাই রাজি হয়েছিলেন, কিন্তু বিশাল রিস্ক মাথায় নিয়েছিল সময়. হাস্শ্যকর হলেও সেই অপারেশন একটা বেলুন এর জন্য বেছে গিয়েছিল সবাই, যেটা ফায়েজ এর লুঙ্গির ভেতর ছিল.
মা কে দেখতে এসে একদিন থাকার কথা ছিল, মায়ের কান্না সেটাকে আরো একদিন বাড়িয়ে দিয়েছিল. আর তাই, অনেক বলে কযে ফায়েজকে ফেরত পাঠিয়েছিল, অন্তত সুজিত ভাইকে কিছু খবর যেন পৌছাতে পারে. জীবনে প্রথমবারের মত, খুব বিপদের সময়, আলাদা হয়েছিল দুজন. এখন ভাবছে আর দেখা হবে কিনা কে জানে. এতক্ষণে খবর পেয়ে যাওয়ার কথা যে সময় ধরা পড়ে গেছে.
মা কে খাইয়ে মাত্র বাইরে এসে একটা সিগারেট ধরিয়েছে সময়, হঠাত সবুর এর গলা শোনা গেল,"সময় না, কখন আইছ ভাই?". ছোটবেলা থেকে খেয়ে পড়ে মানুষ হয়েছে সবুর এই বাড়িতেই, সময় ভাবত, মায়ের পড়ে ফায়েজ আর সবুর ই মনে হয় ওকে দেখে রাখে. সবুর এর চোখের দিকে তাকাতে একটা অদ্ভূত অসস্তি টের পায় সময়, সবুর এর চোখ যেন অন্য কথা বলছে. ভাবতে ভাবতেই ওর চোখে হঠাত একটা জোরালো আলো এসে পড়ে, চারটে জোরালো হাতের স্পর্শ পায় সময়, ঘাড়ের কাছে, হঠাত একটা আঘাতের পর,আর কিছু মনে পড়ে না.
এখানে এনে জ্ঞান ফিরিয়ে এনে অনেক চেষ্টা করা হয়েছে ওর দলের খোজ জানার জন্য. পা দুটো মনে হয় ভালো হবে না আর কোনদিন, যতটা ব্যথা করছে তাতে এছাড়া আর কিছু মনে পড়ছে না. রাগ এ পাগল হয়ে গেল হঠাত, একবার, শুধু একবার যদি ছাড়া পাই, ধ্বংস করে দেব সব কটাকে, শুধু সবুর কে জিগ্গেস করব, এই তোর প্রতিদান?
এখানে আসার পর সুর্যের আলো দেখেনি সময়. কয় দিন পার হয়েছে তাও বলতে পারবে না. আন্দাজে মনে হয়, অন্তত দুই দিন তো অবশ্শই, বেশিও হতে পারে. প্রচন্ড আঘাত ছাড়া আর খেতে পায় নি কিছুই, মেজর খুব দয়ালু, এক জগ পানি রেখে গেছে দরজার পাশে, যেখানে পৌছানোর শক্তি কোনদিন হবে না বোধহয়. ক্লান্তিতে আবার মনে হয় একটু ঘুম আসে, ভাবে সময়, মা কে কি করেছে ওরা? মা বেচে আছে তো? চোখের কিনারা দিয়ে নেমে আসে দুফোটা জল. কঠিন হওয়া খুব কঠিন.
আচমকা প্রচন্ড আওয়াজে ঘুম ভাঙ্গে,কিসের আওয়াজ? মনে হচ্ছে বৃষ্টির মত গোলা গুলি হচ্ছে আশে পাশে. হঠাত একটা আশার কথা মনে পড়ে যায়, তাহলে কি, তাহলে কি, ফায়েজ?
চরম ব্যথা উপেক্ষা করে হামাগুড়ি দিতে চেষ্টা করে সময়. উত্তেজনায় ব্যথা মনে মনে হয় একটু কম লাগে. দরজার কাছে আসতেই হঠাত দরজা ফুটো করে একটা গুলি ভেতরে ঢুকে আশে, মাথা নিচু করে শুয়ে পড়ে সময়.
দরজার নিচের দিকে একটা ফাক, সময় দেখতে পায়, জায়গা পরিবর্তন করে একের পর এক গুলি করে যাচ্ছে চার জন সৈন্য আর মেজর. নিজের মনে হেসে ওঠে সময়, তদের সময় শেষ. বুঝতে পারে, ওর উপস্থিতির কারণে গ্রেনেড মারতে পারছেনা বাইরে থেকে.
আচমকা উত্তেজিত হয়ে পড়ে সময়, কিছু কি করা উচিত নয়, আমার কি একটুও শক্তি নেই? অসহায় এর মত কেদে ওঠে সময়, হাত পা কোনটাই ভালো করে চালাতে পারবে না এসিস্ট্যান্ট কমান্ডার সময়, হায়রে বিধি.
উপুর হয়ে শুয়ে দেখতে পায় দু জন সৈন্য পড়ে গেছে, হঠাত সাদা কাপড় নাড়ায় মেজর. হাস্শ্যকর লাগে সময়ের কাছে, এরা এতই সাহসী যে সাদা কাপড় নাড়াতে চায় জীবন বাচাতে. সাদা কাপড় দেখেও গুলি থামে না, আরো একজন সৈন্য পড়ে যায়, এবার অস্ত্র ফেলে দেয় বাকিরা, বাইরে থেকে গুলি থামে, একটু এগিয়ে আসতেই দূর থেকে সুজিত ভাই কে দেখতে পায়, আস্তে আস্তে দলের তের জনকে দেখতে পায়, কিন্তু একজন কম কেন? সময় কে নিয়ে মোট পনের জন. ভালো করে দেখে সময়, বুকটা ধক করে ওঠে, ফায়েজ কোথায়, ফায়েজকে দেখতে পাচ্ছে না কেন? অস্থির হয়ে ওঠে সময়, কিছুই ভালো লাগে না, ফায়েজ কোথায় গেল তাহলে,ফায়েজ কি আসেনি?
নড়াচড়া বুঝে ওর অবস্থানের দিকে এগিয়ে আশে সুজিত, দরজা ধাক্কা দিয়েই বোবা হয়ে যায়, কি করেছে মেরে! মানুষ এত নির্দয় হয়? বসে মাথায় হাত দিতেই ফিরে তাকায় সময়, সুজিত কে দেখেই আরো অস্থির হয়ে ওঠে, "ফায়েজ কই সুজিত ভাই, আমার ফায়েজ কই?"
উত্তর না দিয়ে উঠে দাড়ায় সুজিত, প্রাণ সহ আরো দুজন কে ডেকে আনে. ধীরে ধীরে ওকে তুলে বাইরে নিয়ে আশে. "কেউ বলছে না কেন, ফায়েজ কোথায়?" - আশাহত চিত্কার করে ওঠে সময়. ওর মাথায় হাত বুলিয়ে ডুকরে ওঠে সুজিত,"শান্ত হ ভাই, শান্ত হ". ওর মুখের দিকে তাকিয়ে অসহায় হয়ে যায় সময়, শক্ত হতে চায়, পারে না."সত্যি করে বল সুজিত ভাই,ফায়েজ কোথায়?"
চোখের ইশারায় ডেকে আনে তাদের আবার, সুজিত এর ইশারায় সময় কে তুলে নেয় যোদ্ধারা আবার, চেয়ার ম্যান এর লাশটা দেখতে পায় সময়, তার গলায় শক্ত হয়ে বসে থাকা হাত.
হাতটা চিনতে কষ্ট হয় না ওর, চির চেনা হাত, এই হাত কতবার ওর মাথায় বুলিয়েছে, কতবার গাছ থেকে আম পেড়ে দিয়েছে, কতবার জড়িয়ে ধরেছে বুকে, আরো আরো কত স্মৃতি.
শরীরটা দেখতে পায়, গুলিতে ঝাঝরা বুক, এই বুক ওকে কত শান্তি দিয়েছে গহীন জঙ্গলে জ্জরের ঘোরে, কতবার শত্রুর গুলির আগে এগিয়ে এসেছে, আরো আরো কত কত স্মৃতি.
চোখ ঝাপসা হয়ে আসে লহমায়, কন্ঠ চিরে বের হয়ে আসে পৃথিবী চূর্ণ করে দেওয়া বুক ফাটা চিত্কার....!!!!