জীবনের গল্প বা নতুন জীবন!

বর্ষা (আগষ্ট ২০১১)

প্রজাপতি মন
  • ৫৯
  • 0
  • ৪৩
আজ বাইরে সারাদিন ধরে অবিরাম বৃষ্টি পরছে। যেন এ বৃষ্টি ফুরাবার নয়, বাইরে ঝড় উঠেছে কিন্তু মাধবীর অন্তরেও আজ দারুণ ঝড় বইছে শুধু পার্থক্যটা এই, বাইরের ঝড় সবাই দেখছে; কিন্তু মাধবীর অন্তরের ঝড় কেউই দেখছেনা। দেখছেনা কি গভীর বেদনায় দুবে গেছে মাধবীর মন। আজ দুপুরের ডাকে সে রুদ্র এর ১টি চিঠি পেয়েছে। রুদ্রকে মাধবী ভালোবাসে। সে কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার জন্য আমেরিকা গিয়েছে, সেখান থেকে সে প্রতিমাসেই মাধবীকে একটা করে চিঠি দেয়, প্রতিটি চিঠিতেই থাকে তার ভালোবাসার কথা। মাধবীকে দেখতে চাওয়ার আকুলতা। মাধবী সারামাস রুদ্রের চিঠির জন্য ব্যাকুল হয়ে থাকে। কখন চিঠি আসবে, কখন সে তার প্রিয় মানুষের হাতের স্পর্শমাখা চিঠি পাবে! যেদিন মাধবী রুদ্রের চিঠি পায় সেদিন সেই চিঠিটাই যেন তার কাছে জপমালা হয়ে দাঁড়ায়। সারাক্ষণ সেই চিঠির প্রতিটি কথায় বুঁদ হয়ে থাকে। কিন্তু আজ ছ’মাস হলো সে রুদ্রের কাছ থেকে কোন চিঠিই পায়না। তাই পিয়ন এসে যখন চিঠিটা মাধবীর হাতে দিল, তখন তার খুশী আর ধরেনা। কিন্তু চিঠি খুলেই সে অবাক বিস্ময়ে লক্ষ্য করলো চিঠির সাথে রুদ্র একটি ছবি পাঠিয়েছে; স্যুট-ব্যুট পরা রুদ্র আর তার পাশে হাস্যজ্জ্বল সাদা গাউন পরা তরুণী। ছবি দেখে কারও বুঝতে বাকি থাকার কথা না, রুদ্র একজন আমেরিকান তরুণীকে বিয়ে করেছে। ছবিটি একপাশে সরিয়ে রেখে সে এবার চিঠিটা পড়তে শুরু করলো।

প্রিয় মাধবীলতা,

ভালোবাসা নিও। কেমন আছো তুমি? আমি এই ক’মাস ভীষণ ব্যস্ত ছিলাম তাই তোমার কোন খোঁজ-খবর রাখতে পারিনি, সেজন্য আমাকে ক্ষমা করো। আজ তোমার কাছে নিজেকে ভীষণ অপরাধী লাগছে। মনে হচ্ছে, আমি তোমার ভালবাসার সাথে প্রতারণা করেছি, কিন্তু বিশ্বাস করো এছাড়া আমার আর কোন উপায় ছিলনা। তুমি জানলে ভীষণ কষ্ট পাবে, তবুও তোমাকে এই নিষ্ঠুর সত্যটা জানতেই হবে। আমি এখন বিবাহিত। আমেরিকার সিটিজেন হতে হলে এখানে বিয়ে করা ছাড়া আমার অন্য উপায় ছিলনা।অনেক ভেবে দেখলাম, দেশে গিয়ে আর মন টিকবে না। তাই চাচা-চাচীর পরিচিত এক আমেরিকান সিটিজেন তরুণীকে বিয়ে করে ফেললাম। এতে আমার ক্যারিয়ারের উন্নতি হবে। তুমি তো সবসময়ই বলতে, আগে ক্যারিয়ার গড়ো তারপর অন্য সব কিছু, আজ আমি তোমার সেই কথাটাই রাখার চেষ্টা করেছি মাত্র। আমরা গত ২৫শে জানুয়ারি শুক্রবার বিয়ে করেছি। আমার স্ত্রীর নাম ডায়না রোজারিও, তবে ধর্মান্তরিত হওয়ার পর তার নাম রাখা হয়েছে ডায়না জামান। ডায়নার বয়স ১৯। সে খুব চমৎকার একটি মেয়ে।
সে আমাকে খুব ভালোবাসে। আমি তাকে তোমার সমস্ত কথা বলেছি, কিন্তু সে তা হাসিমুখেই মেনে নিয়েছে। কিন্তু সে বলেছে, সহজে আমাকে দেশে আসতে দিবেনা। তার অনুরোধেই আমাদের যুগল ছবি পাঠালাম। আর তোমার আমার সম্পর্কের কথা চিরতরে ভুলে যেও। ভুলে যেও রুদ্র নামের কোন একজন মানুষ তোমার জীবনে এসেছিল। পারো তো আমায় ক্ষমা করো। আমি নতুন ঠিকানায় চলে যাচ্ছি, তাই পুরনো ঠিকানায় আর চিঠি পাঠিওনা। হয়তো তোমার কাছে লেখা এটাই আমার শেষ চিঠি। দোয়া করি সুখী হও। মনের মত জীবনসঙ্গী খুঁজে পাও। ভালো থেকো এই কামনায় এখানেই শেষ করছি।

ইতি
তোমার
অভাগা রুদ্র


চিঠিটা পড়ে মাধবী প্রথমে বাকরুদ্ধ হয়ে গেল। সে বিশ্বাস করতে পারছিলনা যে তার রুদ্র
বিবাহিত। যখন বুঝতে পারলো তখন তার বুকটা নিঃসীম শূন্যতায় হাহাকার করে উঠলো। বুকের ভেতরটায় কষ্টগুলো উথালপাতাল করতে লাগলো। মাধবীর মনে হলো এবার বুঝি বুকটা ভেঙ্গেই যাবে। সে ওঃ মাগো! বলে একটা চিৎকার দিয়েই মাটিতে লুটিয়ে পড়লো। সে চিৎকার দেয়ার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ছুটে এলো তার ছোত বোন মাধুরী। বাসায় এ মুহূর্তে কেউ না থাকায় সে বুঝতে পারছিল না কি করবে। সে একটি জগে করে পানি এনে তা থেকে একটু একটু করে পানি নিয়ে মাধবীর চোখে-মুখে ছিটাতে লাগলো। মিনিট দশেক পরে মাধবীর জ্ঞান ফিরে এলো, সে চোখ মেলেই দেখতে পেল মাধুরীর চোখে জল এবং মুখে চিন্তার ছাপ স্পষ্ট। সে, মুহূর্তেই নিজেকে সামলে নিলো, বলল __ কিরে কাঁদছিস কেন?

মাধুরী ফুঁপড়ে কেঁদে বলল __ তুমি এমন করে জ্ঞান হারালে কেন আপা? তোমার যদি কিছু হয়ে যেত?

___ ধুর পাগলী আমার আবার কি হবে? কিচ্ছু হয়নি। মাথাটা হঠাৎ ঘুরে উঠল। তুই এসব নিয়ে ভাবিস না। সব ঠিক হয়ে যাবে। বাবাকে আবার বলে দিস্ না যেন।

__ আপা তুমি একটা ভাল ডাক্তার দেখাও। হঠাৎ মাথা ঘুরে পড়ে অজ্ঞান হয়ে যাওয়া ভাল লক্ষণ নয়।

মাধবী বোনের কথা শুনে হেসে দিল। বলল __ হয়েছে তোমাকে আর পাকামো করতে হবেনা, যাও নিজের ঘরে গিয়ে পড়াশোনা করোগে। আমাকে নিয়ে আর ভাবতে হবে না।

__তোমাকে নিয়ে না ভাবলে আর কাকে নিয়ে ভাববো আপা, তুমিই তো আমার সব।
মাধবী একথা শুনে বোনকে পরম মমতায় বুকে জড়িয়ে ধরলো।


এরপর মাধুরী তার ঘরে পড়তে চলে গেল, সামনে তার সম্মান ১ম বর্ষের বার্ষিক পরীক্ষা, হাতে একদম সময় নেই। যাবার সময় বলে গেল শরীর খারাপ লাগলে তাকে যেন ডাক দেয়।
মাধুরী চলে যাওয়ার পর মাধবী দক্ষিণের জানালার নিচে এসে দাঁড়ালো, দেখলো বাইরে প্রচন্ড ঝড় উঠেছে। সেই সাথে পাল্লা দিয়ে তার মনেও ঝড় উঠেছে কিন্তু বাইরে সেই ঝড়ের সামান্যতম বহিঃপ্রকাশ ঘটল না। সে ঠায় দাঁড়িয়ে রইল! এদিক দিয়ে কত সময় গড়িয়ে গেল সে টেরই পেলনা।


মাধবী ও মাধুরী দুই বোন। তাদের মা দীর্ঘদিন রোগে ভুগে তারা যখন খুব ছোট তখন মারা গেলেন। মারা যাওয়ার আগে দু’বোনকে ডেকে পাশে বসিয়ে বললেন, মারে তোদের দু’জনকে রেখে গেলাম, একজন আরেকজনকে দেখে রাখিস। তোদের বাবার খেয়াল রাখিস। আমি হয়তো আর বাঁচবোনা, তোরা কেউ কখনও কারো মনে কষ্ট দিসনা। আর তাদের বাবাকে ডেকে বললেন, শোনো তোমার ভরসায় মেয়ে দু’টোকে রেখে যাচ্ছি, দেখো ওরা যাতে কোনদিন কোনরকম কষ্ট না পায়, তুমি তাদের আমাদের দু’জনের স্নেহ ভালোবাসা দিবে। কখনো যেন তারা তাদের মায়ের অভাব অনুভব না করে। তুমি চাইলে ওদের জন্য নতুন মা নিয়ে আসতে পারো, কিন্তু দেখো ওরা যেন তাদের নতুন মায়ের কাছে আদর-যত্ন পায়। কোনরকম কষ্ট পেলে আমার আত্মা শান্তি পাবেনা, বলেই তিনি কেঁদে দিলেন। তারপর সেদিনই রাতে তার প্রচণ্ড শ্বাসকষ্ট দেখা দিল এবং ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই তিনি ইহলোকের মায়া ত্যাগ করে পরপারে চলে গেলেন। সেই থেকে তাদের বাবা, মা এবং বাবার উভয় ভূমিকাই পালন করে যাচ্ছেন। মেয়েদেরকে তিনি প্রচণ্ড ভালোবাসেন, তাই তিনি আর দ্বিতীয় বিয়ের কথা চিন্তাই করেননি। তবে মাধুরীর দেখাশোনার সব ভার তিনি বড়মেয়ের হাতে তুলে দিয়েছেন। তিনি ব্যবসায়ী মানুষ, তাই যতটুকু খেয়াল তাদের রাখার দরকার তিনি ততটুকু খেয়াল রাখতে পারেন না। তাই মাধবীদের মা মারা যাওয়ার তিনমাস পর তিনি তার দূর সম্পর্কের এক বিধবা খালাকে তাদের বাসায় নিয়ে আসেন তাদের দু’বোনকে দেখাশোনা করার জন্য। সেই থেকে দুইবোন সেই দাদীর কাছেই থাকে। আর তাদের বাবাও নিশ্চিন্তে ব্যবসার কাজে মনোযোগ দিতে পেরেছেন।

ক’দিন পরেই মাধবীর মাস্টার্স পরীক্ষা শুরু হবে, কিন্তু তার দাদী তার বাবাকে মাধবীর বিয়ে ঠিক করার জন্য অস্থির করে তুলছেন। মাধবী অনেক কষ্ট করে তাদের বোঝাল যে, আগে পরীক্ষাটা শেষ হোক, পরে এসব নিয়ে ভাবা যাবে। সময় দ্রুত গড়িয়ে যায়। দেখতে দেখতে মাধবীর পরীক্ষাও শেষ হয়ে গেল। এবার বাবাও তার জন্য যোগ্য পাত্র খোঁজার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়লেন।
হাতে অবশ্য অনেক পাত্রই আছে, কিন্তু তিনি মেয়ের মত ছাড়া কাউকেই কথা দিতে নারাজ। তাই তিনি মাধবীকে একদিন তাঁর ঘরে ডেকে পাঠালেন।

মাধবী বাবার ঘরে আসামাত্রই তিনি বলে উঠলেন, __ আয় মা বস। পরীক্ষা তো শেষ হলো, এখন কিছু চিন্তা-ভাবনা করছিস?
__ কি বিষয়ে বাবা?
__ এইতো তোর বিয়ে-শাদীর ব্যাপারে আর কি?
__ বাবা আমি ঠিক করেছি, এখন থেকে চাকরী করব, বিয়ে-টিয়ে ওসব আমার দ্বারা হবে না।
__ কেন?
__ বাবা আমি বিয়ে করবোনা বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছি, এ নিয়ে আমাকে আর জোর করোনা প্লিজ।
__ কিন্তু কেন মা? তুই বিয়ে না করলে সমাজ কি বলবে? তাছাড়া তোর একটা ছোট বোন আছে তার কথাও তো তোকে ভাবতে হবে মা।
__ বাবা তুমি ভালো কোন পাত্র পেলে মাধুরীকে বিয়ে দিয়ে দাও। আর সমাজের কথা বলছ? সমাজ তো আমরাই তৈরি করি তাইনা বাবা? আমার জীবন আমি কিভাবে কাটাবো এটাও সমাজের কাছ থেকে জেনে নিতে হবে? বাবা আমি যদি বিয়ের পর অসুখী হই, যদি আমার স্বামী আমাকে অথবা আমি আমার স্বামীকে ডিভোর্স দেই, এটাকি তোমার সমাজ সহজভাবে মেনে নিবে? নিবেনা। আমি আমার জীবনের সাথে কাউকে জড়িয়ে তার জীবনটা নষ্ট করতে চাইনা বাবা। তাছাড়া ছেলেদের প্রতি আমার বিশ্বাস নষ্ট হয়ে গেছে বাবা। মন থেকে আমি আর কাউকেই মেনে নিতে পারবোনা, আমাকে ক্ষমা করো বাবা।
__ এসব তুই কি বলছিস মা! আমাকে সব কথা খুলে বল।

মাধবী অনেকক্ষণ চুপ করে রইল। এরপর সে ধীরে ধীরে তার বাবাকে সব কথা খুলে বলল, বাবাও খুব কষ্ট পেলেন মেয়ের কথা শুনে। তবু তিনি মেয়েকে বিভিন্ন যুক্তি দিয়ে বুঝাতে চাইলেন,
বিয়েতে রাজী হওয়ার জন্য। কিন্তু মাধবীর একই উত্তর “না”। অবশেষে বাবা হাল ছেড়ে দিলেন, তিনি ঠিক করলেন যত তাড়াতাড়ি হোক ছোট মেয়ের বিয়ে দিয়ে দেবেন, নয়তো দেখা যাবে ছোট মেয়েও বড় মেয়ের পথ অনুসরণ করেছে, দুশ্চিন্তায় তার কপালে ভাঁজ পড়লো।

এদিকে মাধবীর কথা দাদীর মারফত মাধুরীর কানে পৌঁছে গেল। সেও বিয়েতে বেঁকে বসলো। মাধুরী দাদীকে জানিয়ে দিলো আপু বিয়ে না করলে সেও বিয়ে করবেনা। দু’বোন একসাথেই জীবন কাটিয়ে দিবে। একথা শুনে দাদী হাউমাউ করে কান্না জুড়ে দিল, আর বিলাপ করে বলতে লাগলেন, এই জীবনে তার আর নাতজামাই দেখা হলোনা। তিনি মাধবীর উপর খুবই অসন্তুষ্ট হলেন। প্রায়ই তিনি মাধবীর সাথে দুর্ব্যবহার করতে লাগলেন। কথার খোঁচায় বিপর্যস্ত করে তুলতে লাগলেন তিনি মাধবীর জীবন। এসব দেখে মাধুরী দাদীর উপর ক্ষিপ্ত হয়ে প্রতিবাদ করল, কিন্তু দাদী নাছোড়বান্দা, তিনি বলতে লাগলেন, মাধবী বিয়ে করতে না চাইলে না করুক কিন্তু সাথে সাথে মাধুরীর জীবনটাকে কেন নষ্ট করছে? তিনি বললেন, মাধুরী বিয়ে না করলে তিনি সারাজীবন এভাবেই খুঁচিয়ে যাবেন মাধবীকে। এতে কাজ হলো, মাধুরী দাদীর উপর রাগ করে বিয়েতে সম্মতি দিল। দুইমাসের মধ্যে মাধুরীর বিয়ে হয়ে গেল।

মাধবী বর্তমানে একটা সরকারী ব্যাংকে চাকরি করছে। সে তার জীবনধারাকে একটু একটু করে বদলে ফেলছে। সে নিজেকে বিভিন্ন সামাজিক কর্মকান্ডে নিয়োজিত করলো। চাকরী আর বিভিন্ন সামাজিক কর্মকান্ড করতে করতে কেটে গেল দু’টি বছর। এরমধ্যে তার বাবার একটা ম্যাসিভ হার্ট এ্যাটাক করেছে। তিনি তার সম্পত্তির একটা বড় অংশ মাধবীর নামে উইল করে দিয়েছেন আর বাকীটা ছোট মেয়ে মাধুরীর নামে উইল করে দিয়েছেন। তাদের দাদী মাধবীর কাছেই থাকবেন। মাধুরীর অবস্থাপন্ন ঘরে বিয়ে হয়েছে। তার স্বামী ইঞ্জিনিয়ার। সম্পত্তির এমন অসম বন্টন সে মেনে নিতে পারেনি, কিন্তু মাধুরী তা হাসি-মুখে মেনে নেওয়ায় সে এ নিয়ে আর কোন মন্তব্য করলোনা।

আজ শ্রাবণ মাসের ২২ তারিখ। এই দিনটা মাধবী সারাদিন রবীন্দ্রসঙ্গীত শোনে। কিন্তু আজ এর ব্যতিক্রম ঘটল। আজ খুব সকালে মাধবী অফিস যাওয়ার জন্য তৈরী হচ্ছিলো, এমন সময় খুব নিকটে একটি বাচ্চার কান্না শুনতে পেল। সে প্রথম দিকে তেমন কিছু মনে করলোনা, আপনমনে নিজের কাজগুলো করতে লাগলো, কিন্তু হঠাৎ খেয়াল করলো, বাচ্চাটার কান্না কিছুতেই থামছেনা। সে এবার দরজা খুলে বাইরে এলো, অবাক হয়ে লক্ষ্য করলো তার দরজা থেকে মাত্র কয়েক হাত দূরে একটি ফুলের মত নিষ্পাপ শিশু ক্রমাগত কেঁদেই চলেছে। সে এক দৌড়ে বাচ্চাটিকে কোলে তুলে নিয়ে আদর করতে লাগলো এবং আশে-পাশে তার মাকে খুঁজতে লাগলো। কিন্তু তার চোখ বারবার কাউকে দেখতে ব্যর্থ হলো, কোথাও কাউকে দেখতে পেলোনা । অবশেষে কি আর করা বাচ্চাটিকে ঘরে নিয়ে এলো। দাদীতো বাচ্চাটিকে দেখেই চেঁচিয়ে উঠলেন, কি রে কার বাচ্চা নিয়ে এলি?
মাধবী দাদীকে সব খুলে বললো; কিন্তু দাদী এতে মোটেও খুশী হলেন না। বললেন, যেখানে ঐ আপদটাকে পেয়েছিস সেখানেই ওটাকে রেখে আয়। কে জানে ওটার জন্মের ঠিক আছে কিনা?

মাধবী প্রায় চেঁচিয়ে উঠলো __ দাদী! আর কক্ষনও তুমি এমন বাজে কথা মুখেও আনবেনা। এখন থেকে ও আমার এখানেই থাকবে। তোমার যদি ওর দেখাশোনা করতে কষ্ট হয় তবে আমি ওর জন্য একজন আয়া রেখে দেব। ওকে নিয়ে তোমাকে আর ভাবতে হবেনা।
দাদী একথা শুনে কেঁদেকেটে একেবারে অস্থির হয়ে পড়লেন। তিনি বলতে লাগলেন, __ পোড়া কপাল আমার! যার জন্য করি চুরি সেই বলে চোর। তোদের মা মারা যাওয়ার পর এই বুকে আগলে রেখে তোদের মানুষ করেছি, আর আজ কিনা তুই ঐ পথের থেকে কুড়িয়ে আনা শিশুর জন্য আমায় এমন কথা শোনালি। এর চেয়ে যে আমার মরণও ভালো ছিল। বলেই তিনি ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলেন।

মাধবী বুঝতে পারলো এভাবে দাদীর মনে তার কষ্ট দেয়া ঠিক হয়নি। মাধবী এবার দাদীর সামনে এসে পা জড়িয়ে ধরে বলল __ আমায় ক্ষমা করো দাদী, কি বলতে কি বলে ফেলে তোমার মনে কষ্ট দিয়ে ফেলেছি। কিন্তু এই বাচ্চাটিকে তুমি আর পথের উপর রেখে আসতে বলোনা। সে যার সন্তানই হোক সেতো একটা নিষ্পাপ মানবশিশু; রাস্তায় ফেলে দিয়ে তাকে আমি মরতে দিতে পারিনা। নাইবা থাকলো তার পরিচয় আজ থেকে তার পরিচয় সে মানুষ। তারপরও যদি কেউ কথা তুলে বলো সে আমার সন্তান। ওকে আমি কিছুতেই আর ফেলতে পারবোনা। তবে হ্যাঁ কেউ যদি কখনো খুঁজতে আসে তবে সে যেন আমার সাথে দেখা করে। এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে উঠে দাঁড়ালো সে। দাদী একথা শুনে বাকশুন্য হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো।
এমন সময় মাধবীর বাবা তার সামনে এসে দাঁড়ালেন। তার চোখ দুটি মেয়ের প্রতি ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে উঠলো। তিনি দু’হাত বাড়িয়ে মেয়ে এবং সদ্য কুড়িয়ে পাওয়া নাতনীকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। মাধবী তার বাবাকে শিশুটির কথা বলতে চাইছিল কিন্তু হাত দিয়ে ইশারায় তাকে থামিয়ে দিলেন এবং জানালেন যে, তিনি সব শুনেছেন। মাধবী এবার নিশ্চিন্ত হলো। সে বাবা এবং দাদীর কাছে বাচ্চাটিকে বুঝিয়ে দিয়ে অফিসে রওনা হলো।

অফিসে পৌঁছাতে তার প্রায় দু’ঘণ্টা দেরী হয়ে গেল। অফিসে ঢুকেই শুনতে পেল ম্যানেজার তাকে এরই মধ্যে তিন বার খোঁজ করেছেন। তাই বাধ্য হয়েই তাকে ম্যানেজারের রুমে যেতে হলো। ম্যানেজার তাকে সময়ের মূল্য সম্পর্কে অনেক বড় লেকচার দিলেন। উনার কথা শেষ হওয়া মাত্রই মাধবী এবার নিজের কথা শোনাবার সু্যোগ পেল। আজকের সকালের ঘটনাটা শোনালো। ম্যানেজার স্যার তার কথা শুনে মুগ্ধ হয়ে গেলেন। তিনি বললেন, আজ থেকে তাহলে আপনি নতুন মা হলেন, অফিসের সবাইকে মিষ্টি খাওয়ান আর মেয়ের নাম ঘোষণা করুন। মাধবী এই কথায় ভীষণ লজ্জা পেল। নিজেকে এখন কেন জানি সত্যি সত্যি মা মা লাগছে। সে অফিসের কাজে আজ বেশি মন দিতে পারলো না। ফুলের মত শিশুর মুখ তার চোখে ভেসে বেড়াচ্ছে। তাকে নিয়ে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনাও তার মনে মাঝে মাঝে উঁকি দিয়ে যাচ্ছে। আবার হঠাৎ হঠাৎ তার এই আশংকাও মনে জাগছে। বাসায় গেলে দেখতে পাব তো! ওকে যদি ওর বাবা-মা এসে নিয়ে যায়। ভাবতে ভাবতে তার চোখে জল এসে যায়। অফিসের সহকর্মীরা তার এই আনমনা ভাব দেখে আড়ালে-আবডালে হাসা-হাসি করছে।

অফিস ছুটি হওয়ার পর সে সোজা নিউমার্কেট চলে গেল তার বন্ধু ও সহকর্মী রাজার সাথে।
সেখানে গিয়ে নতুন বাবুদের জন্য যা যা লাগে তার সবকিছুই কেনাকাটা করলো। তার চোখে-মুখে এখন তৃপ্তির ছায়া পড়েছে। মাধবীর মুখ দেখে এখন পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ মনে হচ্ছে। রাজা অবাক হয়ে মাধবীর দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। বহুদিন ধরে সে মাধবীর এমন মুখ দেখেনা, ভার্সিটিতে পড়ার সময় সে মাধবীকে মনে মনে ভালবাসত কিন্তু রুদ্রর সঙ্গে মাধবীর সম্পর্কের কথা জেনে সে আর মুখ ফুটে তাকে কিছুই বলেনি। নিজের ভালবাসাকে নিজের মনেই কবর দিয়েছে। তারপর বহুদিন কেটে গেছে তারা একই সাথে ভার্সিটি থেকে পাশ করে বেরিয়েছে, চাকরী করছে। কিন্তু মাধবীর উচ্ছ্বলতা যেন দিন দিন একটু একটু করে হারিয়ে গেছে। অনেক চেষ্টা করেও সে জানতে পারেনি তার সমস্যাটা কি? এদিকে রুদ্র সেই যে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার জন্য আমেরিকায় গেল, আজ পর্যন্ত তার কোন খবর পর্যন্ত সে জানতে পারলনা কেমন আছে? কোথায় আছে? মাধবীকে রুদ্রের কথা জিজ্ঞেস করলে নানান ছুঁতায় সে এই প্রসঙ্গ এড়িয়ে যায়।
তাই সে আর এসব কথা জিজ্ঞেস করা ছেড়ে দিয়েছে।

মাধবী অনেকক্ষণ ধরে কেনাকাটা করে প্রায় হাঁপিয়ে গেছে। তাই সে খাবার জন্য রাজাকে একটা ফাস্টফুড শপে টেনে নিয়ে গেল। মাধবী খাবার অর্ডার দিয়ে রাজাকে কিছু বলতে যাবে এমন সময় খেয়াল করলো রাজা একদৃষ্টে তার দিকে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে। মাধবী তার চোখের ভাষা বুঝতে পেরে চট করে চোখ ফিরিয়ে নিল। রাজাও হঠাৎ করে সম্বিৎ ফিরে পেল। এরপর তারা খেয়ে-দেয়ে বাসার দিকে রওনা হলো। মাধবীকে পৌঁছে দিয়ে রাজা চলে গেল।

এদিকে বাসায় ফিরতে ফিরতে রাত ৯টা বেজে গেছে। বাবা আর দাদী চিন্তিত মুখে বাচ্চা কোলে নিয়ে বসে আছেন। সে দেখলো বাচ্চাটা দাদীর কোলে নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে। সে তার গালে আলতো করে আদর দিয়ে স্নান করতে চলে গেল। তারপর সে সারারাত শিশুটির পরিচর্যা করলো, রাতে ফিরেই মাধুরীকে বাচ্চাটার খবর দিল। সেও খুশী হলো খবরটা শুনে, যাক আপার একাকীত্ব তাহলে কিছুটা হলেও ঘুচবে।
দিনসাতেক পরেও যখন কেউ বাচ্চাটার খোঁজ করতে এলোনা তখন মাধবী একটা আকীকার ব্যবস্থা করলো। তাদের সব আত্নীয়-স্বজন, পাড়া-পড়শীকে ডেকে আকীকার দাওয়াত দেওয়া হলো। সবাই মাধবীর কান্ডকারখানায় হাসতে লাগলো। ঘনিষ্ট আত্নীয়-স্বজনরা খুবই বিরক্ত হলো, তারা কুমারী মেয়ের এসব কান্ডকারখানা ভালো চোখে দেখলোনা। কিন্তু তবু সবাই নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে এলেন। তারা মাধবীর বাবা আফজালুর রহমানকে আবারও মেয়ের বিয়ের ব্যাপারে ভাবতে বললেন। তিনি আবারও মেয়ের মতের কথা ব্যক্ত করলেন। এদিকে দেখতে দেখতে আকীকার সব আনুষ্ঠানিকতা শেষ হয়ে গেল। মাধবী তার মেয়ের নাম রাখলো “পুষ্পিতা রহমান”। মাধুরীতো কোল থেকে নামাতেই চায়না। সত্যিই যেন ফুলপরী একটা। দেখলেই মায়া লাগে, আদর করতে ইচ্ছে হয়। সবাই পুষ্পিতাকে দেখার আগে তার নামে বিষোদগার করেছে, কিন্তু যেই একবার তাকে দেখেছে সেই আর তাকে আদর না করে থাকতে পারেনি, তারা আর দ্বিতীয়বার মাধবীর বিয়ের কথা উচ্চারণ করলোনা। সবাই ভাবলো, মেয়েটা যদি এতে খুশী হয়, তাহলে তাকে অযথা কষ্ট দিয়ে লাভ নেই। থাকুক সে পুষ্পিতাকে নিয়ে।
সারাদিন চাকরী করে এসে বাকী সময়টা মাধবীর এখন পুষ্পিতাকে নিয়েই কাটে। পুষ্পিতাকে দেখলেই তার সমস্ত কষ্ট ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে যায়। এভাবে দেখতে দেখতে একটা বছর কেটে গেল। এদিকে রাজার মা রাজার জন্য বউ খুঁজে বেড়াচ্ছেন। রাজা এবার সমস্ত দ্বিধা-সংকোচ ঝেড়ে ফেলে মাধবীর সামনে এসে দাঁড়ালো। প্রথমেই সে রুদ্রের কথা জানতে চাইলো কিন্তু আজও মাধবী তার উত্তর এড়িয়ে গেছে। তখন উপায়ন্তর না দেখে সে সরাসরি মাধবীকে তার মনের কথা জানালো এবং এও জানালো সে তাকে বিয়ে করতে চায়।
মাধবী বলল __ এ হয়না রাজা!
__ কেন হয়না?
__ কারণ আমি একজনকে ভালোবাসতাম, কিন্তু প্রতিদানে কি পেলাম? শুধুই যন্ত্রণা আর অপমান।
__ আমি তোমার সমস্ত অপমান মুছে দেব, প্লিজ আমায় গ্রহণ করো।
__ রাজা প্লিজ অমন করোনা, আমি তোমাকে শুধুই বন্ধু হিসেবে দেখি। অন্য কিছু নয়। মানুষের মন একটাই থাকে আর তা কেবল একজনকেই দেয়া যায়। আর তা আমি রুদ্রকে দিয়ে ফেলেছি। যদিও সেটা অপাত্রে দান করা হয়ে গেছে। যে মন দিয়ে ফেলেছি তা কি আর ফিরিয়ে আনা যাবে?
__ তুমি আমাকে বিশ্বাস করোনা ?
__ করি, আমি তোমাকে খুব বিশ্বাস করি আর বিশ্বাস করি বলেই তো তোমার পাশে আছি বন্ধু। কিন্তু তুমি আমাকে ভুল বুঝোনা। আমি তোমাকে সবসময় আমার পাশে চাই বন্ধু হিসাবে; স্বামী কিংবা প্রেমিক হিসেবে নয়।
__ কিন্তু তুমি কি সারাজীবন এভাবেই একা থাকবে? জীবন চলার পথে কাউকেই তোমার প্রয়োজন নেই?
__ জীবন চলার পথে অবশ্যই আমার একজন বন্ধু চাই, যে আমার সব সুখ-দুঃখের অংশীদার হবে। আমার সব চাওয়া-পাওয়া বুঝবে। বিয়েই কি একজন মানুষের জীবনের সবকিছু? আমি যদি তোমাকে বিয়ে না করি তাহলে কি আমাদের বন্ধুত্ব শেষ হয়ে যাবে? আবার কি আমরা স্বাভাবিক হতে পারবোনা?
__ কিন্তু তোমার মেয়ে পুষ্পিতার ভবিষ্যৎ কি ভেবে দেখেছ?
__ হ্যাঁ, সে আমার পরিচয়েই বড় হবে। আমি তাকে মানুষের মত মানুষ করে গড়ে তুলবো।
__ কিন্তু তুমি ওর পিতৃ-পরিচয় কি দেবে?
__ প্লিজ রাজা, ও যে আমার মেয়ে নয় একথা তুমি আমাকে আর বার বার মনে করিয়ে দিওনা। ওই আমার ভবিষ্যৎ আর আমি তার। কখনও যদি বড় হয়ে সে নিজের পরিচয় জানতে চায় তাহলে তাকে আমি কিছুই লুকাবোনা। তখন সে যদি আমায় ত্যাগ করে তবে সেটাই আমার ভাগ্য বলে মেনে নেবো। শুধু শুধু আমার অধিকার কারও উপর চাপাতে যাবোনা, কেননা আমার বোধহয় কারও উপর সত্যিকার অধিকার নেই। তোমায় বিয়ে না করার অপরাধে যদি তুমি আমায় বন্ধুত্বের অধিকার থেকে বঞ্চিত করো আমি অবাক হবোনা। সেটাকেও আমি নিয়তি বলেই মেনে নেব।
__ তোমাকে আমার বিয়ের প্রস্তাব দেওয়াটাই ভুল হয়ে গেছে। ঠিক আছে আর কখনও তোমাকে বিয়ের কথা বলব না। আর মাকেও জানিয়ে দেব আমি বিয়ে করবোনা।
__ কেন?
__ সেটা আমার ব্যাপার।
__ কিন্তু আমার জন্য তুমি এমন সিদ্ধান্ত নিতে পারোনা।
__ তোমার জন্য নয়। তোমার কথাই তোমাকে ফিরিয়ে দিচ্ছি। মানুষের মন তো একটাই থাকে আর তা একজনের জন্যই, আমি তো সেটা কবেই তোমাকে দিয়ে দিয়েছি, কিন্তু তুমি সেটা আজও বুঝলেনা। আমি এখন এই অবহেলিত মন নিয়ে কার কাছে যাব বলতো। কে আমাকে আমার সুখ-শান্তি ফিরিয়ে দেবে?
__ প্লিজ রাজা এসব বলে আমার মনটাকে আর দুর্বল করে দিওনা। আমি যে সারাজীবন একা থাকার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি। আমার সামনে এখন শুধুই পুষ্পিতা। বাবা আর পুষ্পিতাকে ছেড়ে আমি আর কোথাও যেতে পারবোনা।
__ তুমি সিদ্ধান্তটা বদলানোর জন্য কিছু সময় নাও। দেখো, আমি তোমাকে নিরাশ করবোনা। পুষ্পিতাকে আমাদের নিজের মেয়ে বলেই মেনে নেব। তুমি আর একটু ভাবো।
এটুকু বলে রাজা আর একমুহূর্ত দাঁড়ালো না, সোজা হাঁটা ধরল। তার হৃদয়ে এখন ভাঙ্গা-চোরার খেলা চলছে। তার ভবিষ্যৎ নিয়ে সে বেশীদূর ভাবতে পারছেনা। তার কেবলই চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে আসছে। আর অদূরে হতভম্বের মত মাধবী দাঁড়িয়ে রইল। বহুক্ষণ তার কোন বাহ্যজ্ঞান ছিল না। যখন সম্বিৎ ফিরল, তখন দেখল একটা গাছের নিচে সে একা দাঁড়িয়ে আছে। সন্ধ্যাও প্রায় ঘনিয়ে এলো। সে ধীরে ধীরে বাসার পথে রওনা দিল। রাজার প্রতিটি কথা তার কানে বাজছে।
বাসায় ফিরে কলিংবেল টিপতেই দাদী দরজা খুলে দিলেন। আর পুষ্পিতা দাদীর কোল থেকে ঝাপ দিয়ে মা মা বলে মাধবীর কোলে গিয়ে পড়লো। মাধবী তাকে কোলে নিয়ে অনেকক্ষণ আদর করলো এরপর তারা মা-মেয়ে মিলে অনেকক্ষণ ধরে খেলাধূলা করল। মাধবী জোর করে পুষ্পিতাকে রাতের খাবার খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিল। রাতে সবাই ঘুমিয়ে গেলে সে একটু ভাবনার অবকাশ পেল। সে অনেকক্ষণ ধরে রাজার কথাগুলো নিয়ে ভাবতে লাগলো। রাজা যে কবে থেকে তাকে ভালোবাসতে শুরু করেছে সে তা টেরই পায়নি। কিন্তু যখন বুঝতে পারলো তখন অনেকটা সময় চলে গেছে। তার বিয়ে করা না করার সাথে আজ রাজার জীবনও জড়িয়ে গেছে। এদিকে পুষ্পিতাকে একান্ত নিজের করে পাওয়ার জন্যও ভবিষ্যতে তার একটা পিতৃ-পরিচয় দরকার, নয়তো স্কুল-কলেজে পদে পদে তাকে হেয় হতে হবে। সে ঠিক করল রাজার কথাই মেনে নিবে। এবার হয়তো জীবনটাকে নিয়ে আবার নতুন করে ভাবতে হবে। সিদ্ধান্ত নিলো রাজাকেই সে বিয়ে করবে।
পরদিন অফিসে এসে দেখে রাজা আসেনি, মোবাইলে ফোনও অফ করা। তখন মাধবীর মনে খুব কষ্ট হতে লাগলো, তার গতকালের ঘটনার জন্য নিজেকে বার বার অপরাধী মনে হতে লাগলো। মনে হলো সে রাজার সত্যিকার ভালবাসাকে পায়ে দলে মাড়িয়ে এসেছে। একটা ভুল ভালবাসা তার জীবনটাকে এলোমেলো করে দিয়েছে। সে আর নতুন করে ভুল করতে চায়না। তাই সে খুব সুন্দর করে স্যরি লিখে ম্যাসেজ পাঠালো। এবার সে অফিসের কাজে মন দিল। রাজা বিকাল ৪টায় মোবাইল অন করার সাথে সাথে মাধবীর ম্যাসেজ পেল। ম্যাসেজটা পেয়ে তার মন খুশীতে নেচে উঠল। সে অফিস ছুটির সময় বাইরে দাঁড়িয়ে রইল। মাধবী বাইরে বেড়িয়ে আসা মাত্রই রাজা তার মুখোমুখি হলো। রাজাকে দেখে মাধবীতো হতবাক! আজ অফিসে এলোনা কেন জানতে চাইলো। জবাবে রাজা অভিমানী কন্ঠে বলল যে, সে যদি ম্যাসেজটা না দিত তাহলে সে চাকরীটাই ছেড়ে দিত। তারপর সে হাসিমুখে তার সিদ্ধান্তটা কি জানতে চাইলো। মাধবী লাজুক মুখে তার সম্মতি জানিয়ে দিল এবং শর্ত দিল পুষ্পিতাকে নিজের মেয়ে বলে স্বীকার করে নিতে হবে।
মাধবীদের পরিবারে এখন খুশী উপচে পড়ছে। এতদিন পর মাধবী বিয়েতে মত দিয়েছে, এতে সবচেয়ে খুশী হয়েছেন তার বাবা। মাধুরীও কম খুশি নয় সে স্বামী-সন্তানসহ বাবার বাড়ীতে ১৫ দিনের জন্য চলে এসেছে, বোনের বিয়ের সব দায়িত্ব তার। দাদীর মুখেও এতদিনে হাসি ফুটেছে। কিন্তু মাধবীর বাবার এত আনন্দের মধ্যেও একটা কষ্ট বুকে চেপে বসেছে, আর তা হলো একে তো মাধবী তার সবচেয়ে প্রিয় সন্তান তার উপর পুষ্পিতা এতদিন ধরে হাসি আর খেলায় সারা বাড়ি ভরে তুলেছিল। বাড়িটা তার বহুদিন পর স্বর্গ হয়ে উঠেছিল, কিন্তু এখন মাধবীর সাথে সাথে পুষ্পিতাও তাকে ছেড়ে যাবে, এই ভেবে মনটা তার বিষাদের কালো মেঘে ছেয়ে গেছে।
সামনের সপ্তাহে মাধবীর বিয়ের দিন ধার্য্য করা হয়েছে। রাজার মা যেদিন তাকে আংটি পরাতে এলেন, সেদিনই তিনি মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন তাকে দেখে কি নিষ্পাপ চেহারা। তিনি পারলে ঐদিনেই তাকে পুত্রবঁধু করে নিতে চাইছিলেন কিন্তু মাধবীর বাবা বিভিন্ন আনুষ্ঠানিকতার কথা বলে তাকে নিবৃত্ত করেন। বিয়ের সব কেনাকাটা মাধুরী নিজে করলো এবং দেখতে দেখতে সেই শুভদিন এসে গেল। রাজা আর মাধবী সুখের সংসার পাতলো।
মাধবীর বিয়ের দেখতে দেখতে ৫ বছর কেটে গেল। পুষ্পিতার বয়স এখন ছয় বছর। সে দ্বিতীয় শ্রেণীতে পড়ে। মাধবীর ইতিমধ্যে ঘর আলো করে ১টি ছেলে হয়েছে। ছেলের বয়স তিন বছর। তার এখন ছেলে-মেয়ে নিয়ে সুখের সংসার। তবে তার বাবা দু’বছর আগে হার্ট-এ্যাটাকে মারা গেছে। দাদীও সমস্ত বন্ধন ছিন্ন করে দেশের বাড়িতে চলে গেছেন। তিনি মাঝে মাঝে এসে পালাক্রমে দুই নাতনীর বাসায় এসে থেকে যান। দুই নাতনীর সুখ দেখেই তিনি শান্তি পান। মাধবীর বাবার বাড়িতে এখন ভাড়াটিয়ারা থাকে। বাড়ি ভাড়ার সমস্ত টাকা মাধবী দাদীর নামে বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়। একদিন দুপুরবেলা ঐ বাড়িতে একজন ভদ্রলোক এসে হাজির হলেন। তিনি বাড়ির কলিংবেল চাপতেই ভেতর থেকে বেড়িয়ে এলো অপরিচিত মুখ। তিনি জানতে চাইলেন __ কাকে চাই?
ভদ্রলোক অপরিচিত মুখ দেখে খানিকটা ঘাবড়ে গেলেন। তারপর ধীরে ধীরে তার মুখে কথা যোগালো। তিনি মাধবীর নাম বললেন। অপরিচিত লোকটি জানালো তিনি এই বাড়ির ভাড়াটিয়া। বাড়ির মালিক থাকেন ইস্কাটন। তার ঠিকানা ফোন করে জেনে নিতে হবে। তিনি একটি ফোন নম্বর এগিয়ে দিলেন। ভদ্রলোক ফোন নম্বর নিয়ে হোটলে চলে এলেন বেলা তখন প্রায় দুপুর তিনটা বাজে। মাধবী সবেমাত্র দু’বাচ্চাকে ঘুম পাড়িয়ে নিজে শুতে যাবে এমন সময় ফোন বেজে উঠল। মুখভরা বিরক্তি নিয়ে সে টেলিফোনের সামনে এসে দাঁড়ালো। রিসিভার উঠিয়ে হ্যালো বলতেই __অপরপ্রান্তের গলা শুনতে পেয়ে তার গা কেঁপে উঠল। মনে হলো খুব পরিচিত কন্ঠস্বর। যেন কতদিনের চেনা। তবু অপর প্রান্তের লোকটির পরিচয় নিশ্চিত হওয়ার জন্য জানতে চাইলো __ কে বলছেন প্লিজ?
__ আমাকে চিনতে পারছোনা?
মাধবী এবার পুরোপুরি নিশ্চিত হলো সে কে। তবু মিথ্যে করে বলল __ না।
তখন অপর প্রান্ত থেকে একটি দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে এল। তারপর আগুন্তক নিজের পরিচয় দিল।
__ হ্যালো মাধবী, আমি রুদ্র।
__ রুদ্র! এতদিন পর আমার নাম্বার পেলেন কোথায়?
__ আপনি করে বলছ কেন মাধবী? ফোন নাম্বার পাওয়া কোন ব্যাপার? তোমার ভাড়াটিয়াদের কাছ থেকে নিয়েছি। কেমন আছো মাধবী?
__ খুব ভালো আছি, সুখে আছি। আপনি কেমন আছেন মিঃ রুদ্র?
__ ভালো নেই মাধবী, আমি ভালো নেই।
হাঃ হাঃ করে হেসে উঠল মাধবী। বলল, ঠাট্টা করছেন, আপনার স্বপ্নের রাজ্যের রাজকন্যা নিয়ে বাস করেও আপনি বলছেন ভালো নেই। ভালোই বলেছেন, তা দেশে ফিরলেন কবে?
__ মাধবী প্লিজ অমন করে হেসোনা। সত্যিই আমি ভাল নেই। আমার রাজকন্যা আমাকে ছেড়ে চলে গেছে অনেকদিন হয়, দু’দিন হলো দেশে ফিরেছি। তোমাদের খুব দেখতে ইচ্ছে করছে। আমি কি তোমাদের সাথে দেখা করতে পারি?
__ তোমাদের মানে? কাদের সাথে দেখা করতে চান?
__ তুমি আমাকে সেই কখন থেকে আপনি আপনি করে চলেছ কেন বলতো? এভাবে আপনি আপনি করে বললে নিজেকে ভীষণ পর পর মনে হয়।
__ আপনি আবার আপন ছিলেন কবে?
__ তুমি এত নিষ্ঠুর কেন মাধবী? বুঝেছি তুমি আজও আমার দেয়া দুঃখ ভুলতে পারোনি। আমি তো সেজন্য তোমাকে স্যরি বলেছি।
__ স্যরি! এই শব্দটা বললেই কি সব ভুল ঠিক হয়ে যায়, সব কিছু ক্ষমা করে দেয়া যায়? আপনি কি ভাবেন ইঞ্জিনিয়ার সাহেব, যখন যা ইচ্ছা হয় করবেন, এতে কারো জীবনে কি ঝড় বয়ে গেল না জীবন ঝরে গেল তাতে আপনাদের কিছুই যায় আসবেনা শুধু ইংরেজিতে একটা স্যরি উচ্চারণ করলেই সবকিছু মাফ হয়ে যাবে! সত্যিই এই ইংরেজরা খুব কার্যকরী একটা শব্দ আপনাদের জন্য বানিয়েছিলেন। নইলে আপনাদের যে কি হতো!! বিদ্রুপের সুরে বলে উঠল মাধবী। কি কথা বলছেন না যে?
__ কি বলব এরপরে আমার কি আর কিছু বলার আছে?
__ কিছুই বলার নেই, বেশ তবে বলুন ঐ তোমাদের মানে কাদের সাথে দেখা করতে চান?
এবার রুদ্রের ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি খেলে গেল, বলল __ তোমাদের মানে তোমার বাবা, বোন, দাদি, তুমি আর তোমার মেয়ে।
__ আমার মেয়ের খবরও আপনি পেয়ে গেছেন, ভালোই। বাবা দু’বছর হয় আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। মাধুরী এখন এলিফ্যান্ট রোডে তার হাজব্যান্ডের সাথে থাকে। দাদী দেশের বাড়িতে চলে গেছেন। আর আমি আমার হাজব্যান্ড আর দু’সন্তান নিয়ে ইস্কাটন থাকি।
__ তুমি বিয়ে করেছ?!
__ আপনি কি মনে করেছেন ইঞ্জিনিয়ার সাহেব, আপনার দেয়া দুঃসহ স্মৃতি হাতরিয়ে আমি একাই জীবন পার করে দেবো? আমার কখনো বিয়ে হবেনা? আমাকে কেউ ভালোবাসবেনা?
__ না আমি তা বলিনি, কিন্তু ......
__ কিন্তু কি ইঞ্জিনিয়ার সাহেব?
__ মাধবী প্লিজ বারবার আমাকে এভাবে খোঁচা দিওনা। আমি শুনেছিলাম যে তুমি আর বিয়ে করবেনা বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছো। সিদ্ধান্তটা বদলানোর কোন খবর আমি পাইনি।
__ সিদ্ধান্তটা নয়া বদলালেই মনে হয় আপনার জন্য ভালো হতো তাইনা?
__ ছিঃ এসব কি বলছ তুমি?
__ আমি বললেই ছিঃ তাইনা। আচ্ছা একটা প্রশ্ন করতে খুব ইচ্ছা করছে সত্যি করে জবাব দেবেন তো?
__ প্রশ্নটা করেই দেখোনা।
__ আপনার রাজকন্যা আপনাকে ছেড়ে চলে গেল কেন?
__ কারণ সে যে ওপাড়ের ডাক শুনতে পেয়েছিল। তাকে ধরে রাখার কোন সাধ্যই আমার ছিলনা। বলতে বলতে রুদ্রের গলা ধরে এল।
মাধবীর গলায় এবার উদ্বেগ ঝরে পড়ে। __ কি হয়েছিল তার?
__ ব্লাড ক্যান্সার। কখন যে ধীরে ধীরে তার শরীরে এই মরনব্যাধি বাসা বাঁধল আমি টেরই পাইনি। সবই হয়তোবা তোমার অভিশাপে হয়েছে। নইলে আমার সোনার সংসারে কেন এমন হবে?
__ মিথ্যে কথা। আমি কখনো কাউকে অভিশাপ দেইনি। নিজের দুঃখ, নিজের কষ্ট নিজের মাঝেই লুকিয়ে রেখেছি। সবসময়ই চেয়েছি তুমি সুখী হও। আজ কেন তবে এই নির্মম পরিহাস সইতে হবে?
__ সবই আমার নিয়তি, তুমি অভিশাপ না দিলে কি হবে, প্রকৃতি ঠিকই আমার উপর প্রতিশোধ নিয়েছে। তোমাকে একা ফেলে রেখে সুখের আশায় আমেরিকায় পাড়ি জমিয়েছিলাম। আর আজ তোমার ভরাট সংসার। আমি নিঃস্ব, অসহায়, একাকী।
__ তোমার কোন ছেলে-মেয়ে হয়নি?
__ হয়েছিল একটা মেয়ে।
__ হয়েছিল মানে? সে কোথায়? সে নেই?
__ আছে। সে যেখানেই থাকুক, আমি জানি সুখে আছে।
__ কেমন অদ্ভুত কথা বলছ তুমি! তোমার মেয়েকে তোমার কাছে এনে রাখো, দেখবে তোমার সব কষ্ট দূর হয়ে যাবে।
__ যার কাছে আমি আমার মেয়েকে রেখে এসেছি সে কি আমার মেয়েকে ফিরিয়ে দেবে?
__ কেন দেবেনা? অবশ্যই দিবে। তুমি মেয়ের বাবা না। তার উপর তোমার অধি
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
প্রজাপতি মন M. A Halim, কর্মব্যস্ততার কারণে এই সংখ্যায় লেখা দিতে পারলাম না, ইনশাল্লাহ আগামী সংখ্যায় পাবেন :)
ভালো লাগেনি ১১ সেপ্টেম্বর, ২০১১
M.A.HALIM বন্ধু প্রজাপতি মন, আপনি গল্প কবিতার একজন নিয়মিত লেখক, হঠাৎ করে এ সংখ্যায় বিরতি দিয়ে আমাদেরকে আপনার সুন্দর লেখনি হতে বঞ্চিত করলেন। যাক, আগামী সংখ্যার প্রত্যাশায় বুক বাঁধলাম।
ভালো লাগেনি ৮ সেপ্টেম্বর, ২০১১
প্রজাপতি মন মিজানুর রহমান রানা ভাই, আপনাকে অনেক ধন্যবাদ. আমার প্রিয় লেখকের প্রিয় হতে পেরে গর্ববোধ করছি ............. :)
মিজানুর রহমান রানা চমৎকার গল্প। লেখার স্টাইলটি আমার পছন্দ হলো। ধন্যবাদ জানাই আমার অন্যতম প্রিয় লেখক প্রজাপতি মনকে। প্রিয়তে নিলাম।
প্রজাপতি মন এক খেয়ালী কবি, আবারও ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা রইলো .
এক খেয়ালী কবি আবার ও ভোটে দিতে holo
প্রজাপতি মন শামীম আরা চৌধুরী, অনেক ধন্যবাদ আমার গল্পটি পড়ার জন্য|
শামীম আরা চৌধুরী বেশ নাটকীয়। ভাল লাগলো।
প্রজাপতি মন তৌহিদ উল্লাহ শাকিল ভাই, এই তো ফেলে দিলেন বিপদে। আমার নিজের নাম প্রকাশ করতে আমার একটুও ভালো লাগেনা। নিজেকে প্রকাশ করার চাইতে আড়াল করে রাখতেই আমার বেশী ভালো লাগে। একটু ঘরকুনো মানুষ কিনা। আমার নাম শ্রেয়া আহমেদ (নাহিন)। দয়া করে এই নামে ডাকবেন না। আমার প্রজাপতি মন হয়ে থাকতেই বেশী ভালো লাগে।

৩১ মে - ২০১১ গল্প/কবিতা: ৮ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "ছোটবেলা”
কবিতার বিষয় "ছোটবেলা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ ডিসেম্বর,২০২৪