একটু আগে ফজরের আজান দিয়েছে । রাতের অন্ধকারের বুক চিরে জন্ম নিয়েছে আরও একটি ঝলমলে নতুন সকাল । গত রাতও নিদ্রা দেবীর পরম স্নেহ আলিঙ্গনেও বন্ধ হয়নি স্নিগ্ধার চোখেঁর কপাট । যদিও এটা তার কাছে নতুন কিছু নয় । জন্মের পর থেকে যে ঘটনা তাকে তিলে তিলে সহনশীলতায় গর্বিত করেছে এবং মনটাকে উদার করেছে আকাশের বিশালতায় , তার ভাবনা তাকে মাথা উচু করে বাঁচতে শেখায় । দিন কেটে যায় শত ব্যাস্ততার মাঝে, তাই ভাবনাগুলো দূরে দাঁড়িয়ে নিঝুম রাতের অপেক্ষায় থাকে । কিন্তু মায়ের কান্না , উন্মাদনা , আর আহাজারি তাকে স্বস্তি দেয়না এক বিন্দু পরিমাণ ।স্নিগ্ধা জানে হৃদয় কতটা শুভ্র ফুলের মত বিকশিত হলে সে আদর্শবান হয় আর তাঁরই আয়না হয় স্বাভাবিক দীপ্তিময় ।সে নিজেই চলার পথে কাঁটা সরিয়ে নির্দ্বিধায় ফুল ফোঁটায় আপন মহিমায় ।
আফজাল সাহেব দক্ষিনাঞ্চলের একটি প্রভাবশালী রাজনৈতিক দলের সদস্য । যুদ্ধ শুরু হতেই তিনি বুঝে গেলেন নেতার আসল উদ্দ্যেশ্য । আফজাল সাহেবের অনেক বন্ধু মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিলেন কিন্তু তিনি ইচ্ছা থাকা স্বত্বেও যেতে পারলেন না । দল থেকে বের হতে চাইলেন কিন্তু বাঁধ সাধলেন প্রাণপ্রিয় বন্ধুরা । তাঁরা সবাই পরামর্শ দিলেন সে যুদ্ধে গেলে যেভাবে দেশকে শত্রুমুক্ত করতে পারবেন , তার চেয়ে এই রাজাকারের দলে থেকে খবরাখবর মুক্তিসেনাদের কাছে পৌছে দিয়ে শত্রুদের মোকাবেলা করতে বেশি সহযোগীতা করবেন । সেই সাথে গর্ভবতী স্ত্রীর পাশেও থাকতে পারবেন অনায়াসে । কথাটা একেবারে ফেলে দিতে পারলেন না আফজাল সাহেব । তবে বুঝে গেলেন শত্রুর গহ্বরে বাস করে শত্রুকে বধ করায় জীবনের ঝুঁকি কতটা, এ কাজ সহজসাধ্য নয় । যদিও দলের সাথে বেঈমানী করা হবে । তবে দলের চেয়ে মা বড়, দেশের মাটি বড় , বড় এদেশের আপনজন নীরহ মানুষ । তথাপি সাহসী তিনি সুচারু ভাবে অভিনয় করতে হলেন বদ্ধ পরিকর । নেতার আশেপাশে থেকে তার সব কথা শুনতে লাগলেন নানা উছিলায় । যেহেতু তিনি একজন সৎ , নিষ্ঠাবান ব্যাবসায়ী এবং বেশ টাকা পয়সার মালিক , তাই সমাদরটাও একটু অন্যরকম । নেতা বিশ্বাসও করেন অনেক । আফজাল সাহেব গোপনে সেনা বন্ধুদের খাবার এবং খবরাখবর পৌছে দিতে লাগলেন দিনের পরদিন । দিনে দিনে পরিস্থিতি অনেক গম্ভীর হয়ে উঠেছে । কেউ ভাবেনি এতটা দুরূহ হবে দেশকে শত্রুমুক্ত করতে । ভাবেনি একটা মুসলিম দেশের নেতা এবং তার অনুসারী সৈন্যরা এতটা ঘৃন্য মানসিকতায় পরিপূর্ণ অমানুষ হবেন । তাদের অমানবিক কার্যকলাপ যেন একজন জীবিত মানুষকেও মৃত করে দেয় বিবেকের তাড়নায় । আফজাল সাহেবের দুজন বন্ধু শহীদ হলেন যা তিনি সইতে পারলেন না । ভীতরে ভীতরে ঘৃনার পরিমান শতগুন বেড়ে গেল । কিন্তু দেশের ও বন্ধুদের স্বার্থেই কমিটির অফিসে আনন্দ উল্লাসে সামিল হলেন বুকে পাঁথর চাপা দিয়ে । একটু ভয়েও ছিলেন পাছে তার হৃদয়ের নীরব রক্ত ক্ষরনের তরঙ্গধ্বনী সবাই টের পেয়ে যায় ।
দলের অনেকেই মুখোশ পরে আশেপাশের বাড়ীতে হানা দিয়ে লুট করলেন এবং ঘর ছাড়া করতে মানুষকে বাধ্য করলেন নেতার দাপটে ।সবাই আফজাল সাহেবকে ভাগ দিতে চাইলেন কিন্তু তিনি বললেন -
- "না রে ভাই , আল্লাহ আমা্রে যা দিছে আমি তাতেই খুশি । বাড়তি কিছু চাইনে ।" সবার অগোচরে নিজেরই অজান্তে হাত মুষ্ঠিবদ্ধ হয়ে যায় আফজালের ।
কথাটা শুনে তালুকদার একটু নাখোশই হলেন । স্বভাব সুলভ ভাবেই কাঁটা জবাব দিলেন
-"কিছু চাতিছো না , নাকি অন্য কোন কতা আছে ? তুমারে তো তালি নজরে রাহা লাগবিনে । আবার ঐ হারামিগের সাথে যোগ দিছো নাকি তাই কও ?"কথাটা শুনে সবাই এক সঙ্গে হেসে ওঠে। আফজাল সাহেব তাদের কথা এড়িয়ে যেতে চাইলেন কিন্তু সমীচীন হবে না ভেবে বেশ নরম সুরেই ভদ্রভাবেই বললেন ।
-"তুমরা ভাল করেই জান , আমি বাজে কথা পছন্দ করিনা আর কইও না । খুশি হব আমারে মিথ্যে অপবাদ না দিলি । তুমরা কি কর না কর তা কলাম আমি জানি । "বিনয়ী , সদালাপী , স্বল্পভাষী আফজাল সাহেব মিথ্যে কথাগুলো সাহস করে বললেও গলাটা বুঝি নিজের অজান্তেই কেঁপে উঠেছিল । তবে সান্ত্বনা, তিনি যা করছেন দেশের মানুষের কথা ভেবেই করছেন ।
কয়েক দিনের মধ্যেই তালুকদার আর মইনুদ্দীন বেশ কয়েকটা বাড়ীর মালিক হয়ে গেলেন । নেতাও দখল করে নিলেন এলাকার সবচেয়ে বড় জমিদার বাড়ীটি । জমিদার নেই , নেই জমিদারের দর্পোদ্ধত স্বভাব । শুধু আছে ভোগবিলাসী উত্তরসুরী । তারা সবাই জান বাঁচাতে বেনাপোল দিয়ে ওপারে পাড়ি জমালেও বুড়ী ঠাকুর মা পারলেন না মাটির টান আর পতি দেবতার স্মৃতিস্তম্ভকে নিঃসঙ্গ করতে । আর তাই প্রতিদান দিলেন জীবন দিয়ে । কাক ডাকা ভোরে পূজার ঘরে তাকে পাওয়া গেল বুকের মাঝে একটা ছোট্ট ছিদ্র নিয়ে লাল বসনে । এ কাজ যে স্বয়ং নেতা করেছেন আফজাল সাহেবের তা বুঝতে কষ্ট হল না ।পাষন্ডদের হাত থেকে রেহায় পেল না এলাকার প্রতিবেশী নিরীহ মানুষগুলো। আর তাই তিনি এক নতুন খেলা শুরু করলেন । এলাকার সব হিন্দুদের রাতের আঁধারে নিজের বাসায় নিয়ে রাখলেন । স্ত্রীকে বললেন সবার জন্য বোরখা বানাতে । অনেককে বোরখা পরিয়ে পৌছে দিলেন তাদের কাঙ্ক্ষিত নিরাপদ স্থানে ।
যুদ্ধের দামামা চারিদিকে । এক ভয়াবহ পৈশাচিক খেলায় মেতে উঠেছে নরপশু বর্বরের দল । অত্যাচারের তাণ্ডবলীলায় ধৈর্য্যের বাঁধ ভেঙ্গে ঝাপিয়ে পড়ে শত্রুদের উপর কিশোর-যুবা,বৃদ্ধের দল । কিছু দিনের মধ্যেই মুক্তিসেনাদের জয়গান চারিদিকে আলো ছড়ালো অপ্রত্যাশিতভাবে । এদিকে নেতাজি ঢাকায় গেছেন জরুরী তলবে । তাকে বেশ চিন্তিত এবং ভীত মনে হল । তিনি আফজাল সাহেবের কার্যকলাপ কিছুটা আচঁ করতে পারলেও বিশ্বাস করতে পারলেন না । হয়ত তাই আফজাল সাহেবকে এখনও পর্যন্ত কিছুই বলেননি । বেশ তাড়াহুড়া করেই ঢাকায় গেলেন কাউকে কিছু না বলে । তিনি যে আফজাল সাহেবের প্রতি কিছুটা সন্দেহ পোষণ করেছেন তার বহিঃপ্রকাশ ঘটালেন অফিসের দায়িত্ব তালুকদারকে দিয়ে । ব্যাপারটা আফজালের জন্য অপমানকর । তিনি ব্যাক্তিগত কাজের দোহায় এবং অসুস্থ স্ত্রীর পাশে থাকার অজুহাতে কমিটি অফিসে আসা কিছুটা কমিয়ে দিলেন । তালুকদার তাকে অপমান করতে এবং নেতাগিরি ফলাতে হাতের নাগালে খুঁজতে লাগলেন । আর তাই দেখা হতেই বিদ্রুপ মাখা সুরে বলে
-"এই তুই অফিসি আসিস নে কেনো"? বেশ ঝাঁঝালো ভাবেই জিজ্ঞাসা করে কিন্তু আফজাল নিরুত্তর থাকে ভাবখানা সে শোনেনি ।
-"বস আসুক ঢাকাত্তে তারপর দেকপানি তর পাখনা কিরাম করে ভাঙ্গতি হয় । এই হাতে তরে গুলি কইরে যদি না মারিছি হারামি, বেঈমান ।" রাগে আর দুঃখে থরথর করে কাঁপতে থাকে তালুকদার । আফজাল সাহেব মনে মনে হাসে খুশিও হয় অনেক । আপনমনে বলে -"শালা বস আসার আগেই দেশ স্বাধীন হয়ে যাবে তখন তর কি হবে তাই চিন্তা কর " । আফজাল সাহেব বুঝতে পারলেন তার দলের অনেকেই বুঝে গেছেন যে তিনি মুক্তিসেনাদের হয়ে কাজ করছেন । তড়িতবেগে সিদ্ধান্ত নিলেন । সবাইকে শহর থেকে যেতে হবে নিরাপদ স্থানে । ভাইদেরকে খবর দিলেন এবং তারা আসতেই বাড়ীর সবাইকে রাতেই পাঠিয়ে দিলেন নৌকাযোগে গ্রামে । স্ত্রী কোনভাবেই যেতে চাইলেন না প্রিয়তম স্বামীকে ছেড়ে । কিন্তু একসময় হার মানলেন স্বামীর জেদের কাছে । আফজাল সাহেব নিজেও বাড়ীতে থাকা নিরাপদ মনে করলেন না কিন্তু বাসা ছেড়ে গেলেই দখল হয়ে যাবে । গুদামের এক কর্মচারীকে বাসায় রেখে তিনি রাতের আধারে গাঁ ঢাকা দিলেন । এক মাস পরে গ্রাম থেকে খবর এসেছে খুব সুন্দর ফুটফুটে একটা মেয়ে হয়েছে আফজাল সাহেবের ।তিনি খবরটা শুনে খুশিতে কেঁদেই ফেললেন । স্বাধীন দেশে মেয়ের জন্ম এ এক অপার আনন্দানুভূতি ।
কিছুদিন পর দেশ স্বাধীন হয়েছে কিন্তু এখনও শহরে কেউ ফেরেনি । চারিদিকে রক্ত পচা গন্ধ । দুদিন আগে মইনুদ্দীনের বাড়ীতে চারটা মেয়েকে ধরে নিয়ে অমানসিক অত্যাচার করেছে এবং জীবন্ত মাটির নিচে পুতে রেখেছে তাঁদের । আফজাল সাহেব মেয়েদেরকে উদ্ধার করতে পারেনি কারন সে নিজেই তালুকদার আর মইনুদ্দীনের হাতে বন্দী হয়ে গেছে । কালীবাড়ী মোড়ে অবস্থিত আফজাল সাহেবের চাল,ডাল তেলের গুদাম ঘরে এবং বসত বাড়ীতে আগুন লাগিয়ে দিয়েছে তালুকদার আর মইনুদ্দীনের লোকেরা । দেশ স্বাধীন হওয়াতে যেন তাদের গায়ে আগুন ধরে গেছে । সেই আগুনের লেলিহান শিখায় জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দেবে এই ছোট্ট মফঃস্বল শহর । তারা ধরেই নিলেন এই স্বাধীনতার জন্য আফজাল সাহেব সবচেয়ে বেশি দায়ী । জীবনের শেষ শ্বাসটুকু অবশিষ্ট আছে । আফজাল অত্যাচারের সহ্য সীমানা অনেক আগেই পার করেছে । মনে মনে শুধু পরম করুণাময়ের কাছে প্রার্থনা করছে -"হে খোঁদা আমি আমার মায়ের সাথে বেঈমানী করিনি । তাঁর ইজ্জত বাঁচাতে আর আমার সন্তানের নিরাপদ স্বাধীন আশ্রয় দিতে যা করেছি তার জন্য আমি গর্বিত । আজ আমার জান গেলেও কোন দুঃখ নেই , নেই সামান্য অনুতাপ । শুধু কষ্ট আমি আমার প্রথম সন্তানের মুখ দেখে যেতে পারলাম না ।"
হঠাৎ গুলাগুলির শব্দ । এখন রাত না দিন ঠিক বুঝতে পারছে না কারন চোখ বাঁধা , সাথে হাত পাও বাঁধা । কে যেন হাতের বাঁধন খুলে দিচ্ছে । তারপর চোখ খুলতেই যেন হিমালয়ের দমকা হাওয়া এসে রাজ্যের অবিশ্বাস এনে দিল চোখে মুখে , সে যা দেখছে তা কি সত্যি ! আবেগটা ঝরে পড়ল নিমেষে । সামনে দাঁড়িয়ে প্রাণপ্রিয় বন্ধু নুরু । ঝাঁপটে ধরে বুকের মাঝে -"শালা কি ভাবিছিলি এত তাড়াতাড়ি চইলে যাবি? তাও ঐ কাফের , বেঈমানদের হাতে পইড়ে । আমি বাঁইচে থাকতে তোরে কিডা মারবে শুনি ?"দুই বন্ধু একসাথে হু হু করে কেঁদে দেয় ,অসীম আনন্দে নেচে ওঠে তাঁদের প্রাণ । সামনে তালুকদার আর মইনুদ্দীন দুজন মুক্তি সেনার বন্ধুকের সামনে হাত জোড় করে বসে আছে । মইনুদ্দীন তার পরিনাম বুঝতে পেরে লুঙ্গী ভিজিয়ে ফেলেছে ইতিমধ্যে । নুরু বন্দুক তুলে দিল আফজালের হাতে । কিন্তু যে বীর মানুষটা শত্রুদের মাঝে থেকে গোপনে তাদের পরিকল্পনা জেনে নিয়ে প্রতিটা অভিসন্ধি বাঞ্চাল করে দিয়েছে , সে এই ভারী ,শীতল যন্ত্রটা হাতে নিতে সাহস পেল না । আনমনে বলে উঠল -"নুরু আমার মেয়ে হয়েছে । তোর কাছে আমি তার একটা নাম চাই , এখুনি দেনা ভাই ।" যেন এই ক্ষনেরই অপেক্ষায় থেকেছে সে ।
- "আজ আমার মনের কোণে বয়ে যায় দখিনা বাতাস
হিল্লোলিত দোলা প্রতিটা রক্ত উপশিরায়
বিসর্জন দিয়েছি আপনজন, গর্বিত আত্মা-
দুঃখের সরোবরে সান্তনা পেয়েছি মায়ের স্নিগ্ধতা
শৃঙ্খল ভেঙ্গেছি স্বগৌরবে ;এনেছি সুরভিত স্বাধীনতা !
স্নিগ্ধা ! তোর মেয়ের নাম স্নিগ্ধা ! " খুশিতে আত্মহারা হয়ে যেন চিৎকার করে ওঠে নুরু ।"
-"ভাই একটা অনুরোধ রাখবি ?" বিনীতভাবে বলে আফজাল ।
-"তুই আজ যা চাবি তাই দেব ।" আনন্দে লাফাতে থাকে নুরু ।
-"ছেড়ে দে মইনুদ্দীন আর তালুকদার রে । দেশ তো স্বাধীন হয়েই গেছে । বাইরের শত্রুরা লেজ গুটিয়ে পালিয়েছে । এদের মেরুদন্ড তো ওরা ছিল । যেহেতু ওরা নেই সেহেতু এই রাজাকারের দল কি করবে বল ? আর কোন রক্ত দেখতি চাইনা মায়ের বুকে " কান্না ভরা চোখে সব অত্যাচার আর ঘৃনা ভুলে , বিজয় আর বেঁচে থাকার আনন্দে বয়ে যায় খুশীর স্রোতস্বিনী ।
-"আজ যদি এই হারামির দল সাহায্য না করত তাহলি দুই মাসের মধ্যি দেশ স্বাধীন হয়ে যাতো " বেশ জোরে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে তারপর বলে "তুইও ক্ষমা করে দিতি কলি বন্ধু ? নেতাজীও সাধারন ক্ষমা করেছেন এই কুত্তার বাচ্চাগের , যাহ যা ভাল বুঝিস তাই কর । তয় আমি কয়ে রাখলাম এই কালসাপ গুলো একদিন এই দেশটারে শেষ করে দেবে তখন হয়ত তুইও থাকবি না আর আমিও................." গলাটা ধরে আসে নুরুর । সাথে সাথে তালুকদার আর মইনুদ্দীন নুরুর পা ধরে আকুতি-মিনতি করতে থাকে ।পরিবার আর সন্তানদের দোহায় দিতে থাকে । নুরু পা ছাড়িয়ে নিয়ে বন্দুকের বাট দিয়ে সজোরে বাড়ি মারে তালুকদারের পায়ে । চিৎকার দিয়ে দুটো ব্লাঙ্ক ফায়ার করে রাগটাকে দমন করে । তারপর জোর করে আফজালের হাতে বন্ধুক ধরিয়ে দিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে যায় ।
সেদিন আফজাল সাহেব পারেনি তার শত্রু এই দুই রাজাকারকে মেরে ফেলতে । এ যে তার চরম ভুল ছিল তা বুঝতে পারল বছর না ঘুরতেই । প্রথমে কানাঘুষা তারপর সরাসরি । তাদের নিজেদের সব দোষ আফজাল সাহেবকে দেয় , বাড়ী লুট থেকে শুরু করে নারী নির্যাতন । মানুষ খুব সহজে তা বিশ্বাসও করল কারন মহল্লার অনেকেই তাকে কমিটি অফিসে দেখেছে । একদিন ক্ষমতাসীন দলের অফিসে নুরু একরকম জোর করেই নিয়ে যায় আফজালকে , রিলিফের কম্বল আনতে । কিন্তু সেখানে রীতিমত চলল বাকবিতন্ডা নুরুর সাথে । আফজালকে কম্বল দেয়া হবেনা সে রাজাকার দলের সদস্য । বহু কষ্টে নুরু বোঝাতে সক্ষম হল সে ঐ দলের কর্মী থাকলেও আদৌতে সে মুক্তিসেনাদের হয়ে কাজ করেছে । একটা কম্বল জুটল ঠিকই কিন্তু তা গায়ে দিয়ে ঘুমাবার সামান্যতম ইচ্ছে জাগল না আফজালের । বেশ কয়েকজন মুক্তি সেনার সাথে আফজালের ছবি আছে যা ক্যাম্পে তোলা হয়েছে যখন বস্তা ভরে খাদ্য ও খবর পৌছে দিতে স্বয়ং সে গিয়েছিল । সেদিনটি ছিল আফজালের দেয়া খবরের ভিত্তিতে মিলিটারিদের ক্যাম্প উড়িয়ে দেবার আনন্দোঘন প্রহর । আফজালকে একরকম জোর করেই সেনারা ঘিরে ধরে ছবিটি তুলেছিল । এই জ্বলন্ত প্রমান বুকে লাগিয়ে সে নিশ্চয় ঘুরে বেড়াবে না ।
মহল্লার ও শহরের কিছু মানুষ তাকে সমীহ ও সম্মান করে চললেও আফজাল নিজেকে গুটিয়ে নিলো সবারই অজান্তে । একদিন নুরুকে ডেকে বলে -"দোস্ত তোর পায়ে ধরি আমার একটা কথা রাখবি ?" মিনতি ঝরে পড়ে বলিষ্ঠ কন্ঠে । -"কি হইছে তোর ? তুই এমন করতেছিস কেন্? কিডা কি কইছে তোরে ? আমারে ক তার ভুড়ি ফাটাইয়ে দেব । ক কি হইছে তোর?" রাগে গজগজ করতে থাকে নুরু ।
-"আগে আমারে ছুইয়ে ক তুই কথাডা রাখবি ?"
-" রাখবনে তুই ক আগে । এই নে তোরে ছুয়ে কলাম ।"
-"তুই আর কোনদিন কাউরে কবি না যে , আমি মুক্তি সেনাগের হয়ে দেশের জন্যি কাজ করিছি ।আমারে যে যা কয় কোক তুই কাউরে কিছু কবিনা । আমি নাম কিনার জন্যি কিছু করিনিরে ভাই । "
নুরু একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে । তারপর অপরাধীর সুরে মাথা নীচু করে খুব ধীরে ধীরে বলে
- "আমারই ভুল , তখন তুই যুদ্ধে যাতি চালি আর আমি তোরে ঐ দলে থাইকে খবরাখবর দিতি কলাম । আমারে সম্মান দিতি যাইয়ে তুইও থাইকে গেলি । তখন কি আর বুঝিছিলাম এই দিন দেখতি হবে ?" একটু থেমে যেন কিছুটা বাতাস নেয় ফুসফুসের চাহিদা মেটাতে । তারপর আবার শুরু করে ঝাঝাল কন্ঠে - " আসল রাজাকাররা মাথা উচু করে , দেশের জন্যি যারা জীবন ঝুকি নিয়ে কাজ করিছে তাগের গীবত করে বেড়াচ্ছে, নিজেগের দোষ ঢাকা দিয়ে । সেইদিন যদি এট্টূ সাহস দেহায় কুত্তার বাচ্চাগের জন্যি দুইটে বুলেট খরচ করতি ,তালিফরে আর আড়ালে আমাগের কান্তি হত না । যা আমি কোনদিন কাউরে কিছু কব না ! তুই মরে গেলিও আমি কাউরে কিছু কব না ।" অভিমানে ঝড়ের বেগে বের হয়ে যায় সে । যেন অপরাধ বোধ থেকে পালিয়ে বাঁচল ।
আফজাল সাহেব জীবনের তাগিদে সংসার চালাতে নতুন করে শুরু করে স্ত্রীর গহনা বিক্রির টাকা দিয়ে একটা মুদি দোকান । পোড়া বাড়ীটাও কিছুটা বাসযোগ্য করে তোলেন । কিন্তু কিভাবে হাসতে হয় আর আনন্দ করতে হয় তা তিনি ভুলে গেলেন। এ যেন ইস্পাতে তৈরী একজন মানুষ । ওদিকে তালুকদার একটা সুন্দর খেতাব পেয়ে যায় - "ল্যাংড়া তালুকদার ।" যদিও তার পিছনে সবাই এই সুন্দর খেতাবে ডাকে । আর মইনুদ্দীন সমাজে দুঃস্থ মানুষের সেবায় নিজেকে ব্যাস্ত রাখার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে । ওরা দুজনেই ফুলেফেপে ঢোল হয়ে যায় ধনদৌলত আর আভিজাত্যে । আফজাল সাহেবের মুদি দোকানে দুদুবার কারা যেন হাত সাফাইয়ের কাজটি বেশ সুনিপুণ ভাবেই সম্পাদন করেছে । দিনে দিনে তাঁর মানসিক শক্তির জোরটুকু লোপ পেতে শুরু করে । আর এদিকে সুযোগ পেলেই সবার সামনেই ল্যাংড়া তালুকদার আর মইনুদ্দীন তাকে খোঁচা মারতে ছাড়েন না বরং আগের চেয়ে বেশি সাহসীকতা দেখায় । আফজাল সাহেব জানেন প্রতিবাদ করে কোন লাভ নেই । এরা খুব সুন্দর করে মিথ্যাকে সত্য করে দেখাতে পারে । মানসম্মানের সামান্যতম পরোয়া এরা করেনা । এদের শিকড় অনেক মজবুত , যদিও এদের উৎসটা কোথায় বুঝতে পারেন না সে । তবে ভুলটা যে তারই ছিল । সেদিন যদি সাহস করে বন্দুকটা হাতে নিয়ে দুইটা গুলি............চোখ ঝাপ্সা হয়ে আসে । মনে মনে সিদ্ধান্ত নেন এই শহর ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যাবেন । কিন্তু এযে এক ধরনের পরাজয় স্বীকার । অন্যায় না করেও দোষী সাব্যাস্থ হওয়া , অন্যায়কে প্রশ্রয় দেওয়া । বিবেকের তাড়নায় থেকে যান শহরেই ।
সময় বয়ে চলে মাঝিহীন পালতোলা নৌকার মত । স্নিগ্ধা বড় হয় কলেজে পড়ে । একদিন সে সব সত্য জানতে পারে । সে নিজেও জানে কেন গর্বে তার বুকটা ভরে যায় । কারন সে জানে দেশ স্বাধীন করতে যদি কেউ মুক্তি সেনাদের সামান্যতম সাহায্য করেও থাকে, তাহলেও সে এই স্বাধীনতার আনন্দের অংশীদার । কিন্তু এই শিক্ষিত সভ্য সমাজের সবাইতো তা ভাবে না । আফজাল সাহেব স্নিগ্ধাকে বিয়ে দিয়ে দায়মুক্ত হতে চাইলেন । তার ধারনা সে আর এই নীরব আনন্দোহীন জীবন বেশিদিন বইতে পারবেন না । দ্বিধাগ্রস্ত আফজাল সাহেব । তিন তিনটা ভাল বিয়ে ভেঙ্গে গেল অলৌকিক কারনে । স্নিগ্ধা মোটেও ভেঙ্গে পড়েনি কিন্তু আফজাল সাহেব ভেঙ্গে পড়লেন । যে মানুষটা কোনদিন কারও কাছে হার মানেননি । মিথ্যার কাছে নিজেকে সমর্পণ করেননি সেই কিনা আত্মসমর্পণ করলেন মৃত্যুর কোলে তাও এত সহজে তারুন্য থাকতেই । হৃদয়টা অপমান আর মিথ্যে অপবাদের বোঝা বইতে পারল না তাই , যন্ত্রটার ক্রিয়া বন্ধ হয়ে গেল চীরতরে। মৃত আফজালকে হাস্পাতাল থেকে আনতে কেউ এগিয়ে আসেনি । এসেছিল ফেরেস্তার বেশে দূত হয়ে সেই প্রাণপ্রিয় নুরু । একটা ট্রাকে করে লাশটা বাড়ীর উঠানে রেখেই উধাও হয়ে গিয়েছিল । তিন ঘন্টা পরে এসে আবার কবরে শুইয়ে দিয়েছিল পরম স্নেহে ।
মাকে নিয়ে স্নিগ্ধা থাকে দারিদ্রের আতিশয্যে । একটা কিন্ডারগার্ডেন স্কুলে সামান্য বেতনে মাষ্টারি করে । প্রতি রাতে মা , বাবার কথা মনে করে হু হু করে কাঁদে । কখনও বা চিৎকার করে প্রলাপ বকে , কখনও বা কি এক অভিমানে নিজের গায়েই আগুন ধরাতে চায়। ডাক্তার দেখানোর টাকা নেই তবে , কেউ কেউ পাবনায় পাঠাবার পরামর্শ দিচ্ছে । যারা অতি নিকটের এবং শুভাকাঙ্ক্ষী বলে নিজেদের দাবী করেন তারাই । কিন্তু স্নিগ্ধা মাকে কোথাও যেতে দেবে না । বাবা তাকে তাঁর আদর্শ দিয়েছে , শিখিয়েছে ন্যায় নীতি ও স্বার্থহীন ভালবাসতে , সেই আলোতেই বুকের মাঝে লুকিয়ে রাখবে প্রণপ্রিয় গর্ভধারিণী মাকে । বাবাকে নিয়ে তাঁর যে অহমিকা তা এই পৃথিবীর সব কিছুর কাছে তুচ্ছ । এ অহঙ্কার একান্তই তার । মা কি সন্তানকে ছেড়ে থাকতে পারে? স্নিগ্ধা তার মায়ের মা হয়ে ঠিক সন্তানের মত বুকে আগলে রেখে বাকী জীবনটা কাটিয়ে দেবে । নাইবা আসুক জীবনে - দুঃখ ফালি করে এক চিলতে সুখ !!
২৭ মে - ২০১১
গল্প/কবিতা:
১২০ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ ডিসেম্বর,২০২৪