শ্রাবনের এক বর্ষাস্নাত দুপুর । তখন বেলা দ্বিপ্রহর । বাবার সাথে ফিরছি বড় বোনের বাসা থেকে । বাসের ভীতর বেশ একটা বিব্রতকর অবস্থায়
পড়লাম । যে সব বাংলা সিনেমার গান বাজঁছে এবং সেই সাথে বেসুরে গলা মিলিয়ে হেল্পার আর কন্ডাক্টর গান গাওয়ার যে বৃথা চেষ্টা করছে, তা দেখে নিজেকে নিজের মাঝেই লুকিয়ে নেবার জায়গা খুজেঁ ফিরছি । সাথে বাবা থাকায় গান গুলো শুনে ভীষন লজ্জা বোধ করছি কিন্তু করার কিছুই নেই । বাসের সবাই যে ঐ কন্ডাক্টর বা হেল্পারের মত মজা পাচ্ছে তা মনে হল
না । কয়েকজনকে গান বন্ধ করতে বলতে শুনলাম কিন্তু সে কথা কারো কানে পৌছাল বলে মনে হল না । যাত্রীরা আবার বেশি কিছু বলে না । কারন সবার ইউনিয়ন থাকলেও এই আমজনতার কোন ইউনিয়ন নেই , শেষে দেখা যাবে এই গান বন্ধ করতে বলার ইস্যু নিয়ে যেসব অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার জন্ম হবে তাতে জনগনের ভোগান্তি বরং বেড়েই যাবে। তার চেয়ে চুপ করে থাকাই ভাল।
সারাটা দিন এত বর্ষা হয়েছে যে , রাস্তায় পানিতে ভরে গেছে । বাস থেকে নেমে রিক্সা পেতে অনেক কষ্ট হয়েছে , যদিও ভাড়া তিনগুন বেশি দিতে হবে । সারা রাস্তায় বাবা কথা বললেন না আর তাই কিছুটা ভয়ে কিছু জিজ্ঞাসাও করলাম না । বাবা এমনিতেই অনেক গম্ভীর স্বভাবের মানুষ । তার মনের ভাব বোঝা খুবই দুঃসাধ্য । মা বলেন “আমি ৪০ বছরে তোর বাবাকে বুঝলাম না আর ১৬ বছরে তুই কি বুঝবি ?” ভাবলাম বাবার গম্ভীরতার হেতু হয়তবা এই অঝর বৃষ্টি বা আমাকে বুবুর বাসা থেকে আনতে যাওয়া হবে হয়ত। আমি কৌতুহল বশতঃ বারবার বাবার মুখ দেখে মন পড়ার ব্যর্থ চেষ্টা করে যাচ্ছি । মনে মনে ভাবছি- বুবুকি বাবাকে সব বলে দিয়েছে ? রুম থেকে সবাইকে বের করে দিয়ে , বাবা আর বুবু এক সাথে অনেকক্ষন আলোচনা করেছে । বাবা কি অমত করেছে ? নাকি মত দিয়েছে ? আচ্ছা বুবুর বাসায় আমি বেড়াতে এসেছি এখানেও যদি কেউ পছন্দ করে, তাহলে আমার কি দোষ ?
বুবুর পাশের বাসার দিপুর আম্মু । বুবুর জানের বান্ধবী । আমি জীবনে দেখিনি অচেনা অজানা একজন মানুষের সাথে মানুষের এতটা ভাব বা খাতির থাকতে পারে । বুবু আর বিনু (দীপুর মা ), দুজনের আহ্লাদী খাতির দেখে গা আমার জ্বলে গেছে । দুজনে পাশাপাশি ফ্লাটে থাকে । ভাবখানা যেন আপন মায়ের পেটের বোন , তার চেয়েও বেশি । কতদিন পরে বুবুর সাথে দেখা , অথচ আমার সাথে যতক্ষন কথা বলেছে তার চেয়ে বেশি বলেছে বিনুর সাথে । একজন চা বানালে আরেক জনের জন্য নিয়ে এসে হাজির
-“এই শোন , তুমি কিন্তু আমাকে রেখে আবার দুপুরের খাবার খেয়ে নিও না সই ” আমি সিওর তিন দিনে আমার পিত্তি জ্বালা করে কালো কয়লা হয়ে গেছে । সহ্য না করতে পেরে বলেই ফেললাম
- “আচ্ছা বুবু , এই মহিলা দিনে রাতে একশতবার কেন আসে তোর
বাসায় ? তোর তো প্রাইভেসি বলে কিছু নেই রে ।” বুবু আমার হেসে গদগদ
-“আরে কি যে বলিস না ! তুই আছিস বলে তো এখন একটু কম আসে ।”
- “সর্বনাশ ! তারমানে আরও বেশি আসে নাকি ?” হিহি করে হাসে বুবু । ভাবি এইটা কেমন করে আমার বুবু হয় ? বুবুকি পাল্টে গেল নাকি ?
-“শোন্ তোরা সবাই দূরে থাকিস । আমার বিপদ আপদে তাৎক্ষনিকভাবে যত রকম সাহায্য সহযোগিতা সব বিনু করে ।” বুবু সমস্ত শরীর কাঁপিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ।তারপর আবার বলে-
-“ যদি আমার কিছু হয় , তোদের খবর দিলে , তোরা আসতে আসতে তো আমি মরেই যাব । আর ওর সাথে সখ্যতা আছে বলেই না তোদের সবাইকে ভুলে থাকতে পারি ।”
আচ্ছা দাঁড়াও মাকে গিয়ে বলেনি । এই জন্য মাসের পরে মাস , না কোন চিঠি, না কোন ফোন । বিড়বিড় করে কথাগুলো বলে দাঁত কিড়মিড় করতে থাকি । আপুর সাথে কথা শেষ না হতেই দীপু এসে হাজির ।
-“খালামনি কি করছ?”
-“এইত সোঁনা তোমার জন্য পিঠা বানাচ্ছি ।”
মাগো বুবু কি মিথ্যুক ! একটু আগে বলল আমার জন্য বানাচ্ছে আর এখন ! আমি এই পিঠা কিছুতেই খাব না ।সমস্ত রাগ গিয়ে পড়ল বিচ্ছুটার উপর। তারপরও দীপুর সাথে দুদিনেই আমার বেশ খাতির হয়ে গেল ।
-“দীপু তুমি অনেক মজা কর তাইনা এখানে ?”
-“হ্যাঁ ! পিকনিক করি , খেলা করি”। এক লাফে আমার বেডে উঠে বসে ।খুশিতে লাফাতে লাফাতে বলে
-“ জানো আমি অনেক ভাল দৌড়াতে পারি ।”
-“আচ্ছা তাহলে তো তুমি দৌড়বিদ তাই না ?”
-“হ্যাঁ কিন্তু আমি দৌড়ে নামি না।”
-“কেন কেন ?” বেশ অবাক হলাম আমি
-“কারন আমি ফাষ্টেই ফাষ্ট আউট হয়ে যাই যে ।”
হাসিটা আমি অনেক কষ্টে থামালাম ।এই জন্য বাচ্চাদের আমি অনেক বেশি ভালবাসি ওরা কত সহজে সত্যি কথাটা অকপটে বলে ফেলে । সবাইকেই খুব সহজেই আপন করে নিতে পারে , যা আমরা বড়রা পারিনা ।
আমি যে বিনু আপুকে অপছন্দ করি তা হয়ত সে একটু হলেও বুঝতে পেরেছে । কেন জানি মনে হয় আপুটা আমার আর বুবুর মাঝে এসে আমার ভালবাসায় ভাগ বসিয়েছে। আর তাই আপুটার সাথে আমি অনেক কম কথা বলি । মাঝে মাঝে কোন কোন কথার উত্তর দেই না ভাব করি যেন কিছুই শুনিনি । কিন্তু সে আমাকে অবাক করে দিয়ে তার প্রবাসি ভায়ের জন্য বুবুর কাছে আমার বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে ফেলল । আর বুবুও যেন হাতে চাঁদ পাবার মত একেবারে সাঁতচল্লিশ পাঁটি দাঁত বের করে গলে গলে পড়ল । কিন্তু আমিতো এখন বিয়ে করব না । মরে গেলেও না । মাথা নষ্ট হয়ে গেল আর মাকে ফোন দিয়ে বললাম
–“-মা আমার এখানে ভাল লাগছে না, আমাকে নিয়ে যাও।”
ইস্ বাবা নিশ্চয় বুবুর কথায় রাজি হয়েছে বা আমাকে নিতে আসতে চায়নি মা জোর করে পাঠিয়েছে । অনেক অস্থির লাগছে । বাবার দিকে আবার তাকালাম সেই গম্ভীর , শান্ত মুখোভাব ।
বেশ কিছুক্ষন পরে বাবা কথা বলে উঠলেন
-“আপনার অনেক কষ্ট হচ্ছে রিক্সা চালাতে । ভাঙ্গা রাস্তা তার উপর আবার পানি”।
-“আমাগের অভ্যেস আছে ভাই সাহেব । গরিবের আবার কষ্ট !”নির্লিপ্ত ভাবে বলে রিক্সা চালক
ম্যানহোলের ঢাকনা তুলে নিয়ে বিক্রি করে বখাটে ছেলেগুলো , নেশা করার জন্য । রাস্তা প্রতিবছর দেখি ঠিক করে কিন্তু দশদিনও যায়না আবার ভাংতে শুরু করে । প্রতিটা বাসার চাইতে রাস্তা উঁচু হয়ে গেছে ।যাদের একতলা তাঁদের ভোগান্তি অনেক বেশি কারন রাস্তায় পানি জমে যাবার আগেই তাদের বাসা ডুবে যায় ।রিক্সা খাঁদে বা ম্যানহোলে পড়ে উল্টে যাবার ভয়ে বাবা একটু থেমে আবার বলেন-
-“আপনি ধীরে ধীরেই চালান । আমার কোন তাড়া নেই ভাই ।” রিক্সা চালক বেশ জোঁরে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন । আমার মনে হল আমার ভীতরটা সেই শব্দে খানিকটা কেঁপে উঠেছিল । বাবা আবার জিজ্ঞাসা করেন-
-“আপনার যদি বেশি কষ্ট হয় তাহলে আমি নেমে হেঁটে যাই ।”
-“না ভাই । শরিলে এহনও জোঁর আছে । খারাপ লাগতিছে আমার ছোট ছেলেডা হাস্পাতালে । আমার ঘর পানিতে ডুইবে গেছে । হাস্পাতালের বারান্দার নীচে ফেলাই রাখিছে বাচ্চাডারে আমার। গরীবের জানের , কোন দাম নাই এই দুনিয়ায় !”কথাটা বলে হু হু করে কেঁদে দেয় সে।
এবার আমার মনে পড়ে কেন বাবা আজ এতটা চুপচাপ গম্ভীর। ইস্ ! কি করে আমি আজকের এই দিনটা ভুলে গেলাম ? সব ঐ দীপুর আম্মুর জন্য । যেদিন থেকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছে , সেদিন থেকে জানিনা কেন এক ধরনের ভীতি কাজ করছে । মনে হচ্ছে সত্যি যদি বিয়ে দিয়ে দেয় তাহলে কি হবে ? এই দুশ্চিন্তায় আজকের এই দিনটাও ভুলে গেছি । যা এই প্রথম ঘটল আমার জীবনে ।
এমনই এক শ্রাবনও ধারায় বাবা তাঁর প্রিয় বোনটাকে নিজের হাতে চীর নিদ্রায় শুইয়ে দিয়েছে আজ থেকে প্রায় ছয় বছর আগে । আমার এক মাত্র ফুফু । আমাকে ফুফু অনেক বেশি আদর করতেন । ভালবেসে শশী বলে ডাকঁতেন । তিনি খুব ভাল মনের একজন মানুষ ছিলেন ।
ফুফুর বয়স যখন সাঁত বছর তখন দাদু মারা যান । বাসার সবাই শোকাহত । অন্যদের খবর নেয়া তো দূরে থাক , নিজেদের কে কোথায় কি খাচ্ছে, কিভাবে আছে সেই খবরটুকুও নেবার মত মন মানসীকতা কারও ছিল না । আর সেখানে ফুফু ভাড়াটিয়ার ঘরে বাজার হয়নি দেখে জামার কোচরে করে চাল ,তরকারি লুকিয়ে নিয়ে তাদেরকে দিয়ে আসছে । আমার মা দেখেন সারা বারান্দা আর মাটিতে তরকারি আর চাল । মা অনুসরণ করে গিয়ে দেখে ফুফু ভাড়াটিয়া মহিলাকে বলছে –
-“আপনার যদি আর কিছু লাগে আমারে বলবেন আমি এনে দেব, তবু না খেয়ে থাকবেন না ।”
মা শত কষ্টের মাঝেও ফুফুর এই উদারতায় অভিভূত হয়েছিলেন । ফুফুকে বকা না দিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরে আরও বেশি উম্মাদ হয়ে গিয়েছিলেন প্রিয় বাবাকে হারানোর শোঁকে ।
আমার সব সময় মনে হত মা আমাদের ভাইবোনের সবার চেয়ে ফুফুকে যেন একটু বেশিই ভালবাসেন , আদর করেন । প্রতিটা ঈদে দেখতাম আগে ফুফুর জামা কেনা হত, তারপর আমাদের । এই নিয়ে ফুফুও মাঝে মাঝে মাকে বলত-
“-এইটা কি হল ? আমিতো এখন বড় হইছি আগে ওগের কিনে দেও তারপর টাকা থাকলি আমারে দিও । ”
মা আদর করে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলতেনকে
-আরে বুদ্ধু ! তুইতো কয়দিন পরে বরের ঘরে চলে যাবি , তখন তুই দিবি তোর ভাইজিগের । এখন আমি তোরে খুশি করি , আমি মরে গেলি আমার ছেলে মেয়ে তো তুইই দেখবি , না ?” কথাটা শুনে ফুফু ঠোঁট উল্টিয়ে মৃদ্যু অভিমানে চোঁখ ছলছল করে । তাই দেখে মা হেসে দেয় আর বলে-
-“আরে আমিতো মরবই একদিন । তুই কি আমার মৃত্যুকে আটঁকাতে পারবি ?” আদর করে দেয় মা । ঠিক যেন ঐরষজাত সন্তানকে বুকে জড়িয়ে ধরেছে ।
ফুফু সব সময় বলতেন- “হে আল্লাহ আমি যেন শীতের সময় বা শুকনার সময় মরতে পারি । তাহলে আমার কবরে পানি উঠবে না”। ফুফু পানিকে ভীষন ভয় পেতেন । পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে সব সময় এই দোয়াটাই করতেন । ফুফুকে ভালবাসে না এমন মানুষ আমাদের মহল্লায় কাউকেই পাওয়া যাবে না । তিনি সবার সুখে দুঃখে সব সময় পাশে থেকেছেন । বাবা ফুফুকে ছেড়ে থাকতে পারবেন না বলে নিজের পছন্দে মহল্লারই এক ছেলের সাথে তাঁকে বিয়ে দিয়েছেন । ফুফুর ছোট ছোট দুটো বাচ্চা ।২য় বাচ্চা হবার পর থেকে ফুফু বেশ অসুস্থ হয়ে পড়েন । ডাক্তার বলেন ফুফু হিমোগ্লোবিনের সমস্যায় ভুগছেন । কিন্তু ফুফু যতই আয়রন খান বা আয়রন জাতীয় খাবার খাননা কেন , তিনি দিন দিন মোটা হতে থাকেন । এক সময় দেখা যায় তার শরীরে পানি জমেছে । মাথা ঝিম ঝিম করে,শরীরে বল পান না । দিন দিন শারীরিক দুর্বলতা বেড়েই চলেছে । চোঁখেও ঝাপ্সা দেখতে শুরু করেছেন । ঠিক সেই সময়ে কিছু মেয়েলী সমস্যাও ধরা পড়ে । যার ফলশ্রুতিতে ছোট্ট একটা অপারেশন করার প্রয়োজন দেখা দেয় । ডাক্তার বলেন ফুফুকে রক্ত দিতে হবে । এই মফঃস্বলের চিকিৎসায় বাবা বা ফুফা আস্থা রাখতে পারলেন না । আর তাই ফুফুকে নিয়ে যাওয়া হল ব্যয়বহুল ও বিশ্বস্থতার শহর ঢাকায় । রাখা হল একটি স্বনামধন্য সরকারী হাস্পাতালে । তখন ক্লিনিকের কোন অস্তিত্ব ছিল না । এখানকার ডাক্তারও একই কথা বলেন, রক্ত দিতে হবে , রক্তের গ্রুপ ও পজেটিভ । বর্তমানে তাদের কাছে এই রক্ত নেই । বাবাকে এবং ফুফাকে আশ্বাস দেয়া হল কালকের ভীতর রক্তের ব্যবস্থা তারা যেভাবেই হোক করবেন ।
ফুফু যখন ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছিলেন তখন মহল্লার সব বাসা থেকে সবাইকে বলে বিদায় নিলেন ।ঠিক যেমন করে মানুষ স্বদেশ ছেড়ে যাবার বেলায় সবার সাথে দেখা করে পরামর্শ আদান প্রদান করেন ঠিক তেমন করেই তিনি সবাইকে কাঁদিয়ে বিদায় নিলেন ।কিন্তু নিজে কাঁদলেন না কারো সামনেই । সবাইকে বেশ সুন্দর করে বললেন “আমি যখন ফিরে আসব , বড় একটা ফুলের মালা নিয়ে সবাই রাস্তার মোড়ে দাড়াই থাকবা । আমি সাত দিনের মধ্যে ফিরে আসব সবাই রেডী থাকবা ! ” সবাই বেশ খুশি মনেই বিদায় দিলেন ফুফুকে ।
আমাদের উঠানে ফুফুর লাগান বেলি আর গন্ধরাজ ফুলে ফুলে ভরে গেছে । চারিদিকে মৌ মৌ সুবাসে বাতাস মুহু মুহু ছন্দে সুখের পরশ দিয়ে যায় । ফুফু নিজের হাতেই চার বছর হয়েছে একটা কদম গাছের চারা লাগিয়েছে , ঠিক গেইটের পাশে । এতদিন একটাও ফুল ধরেনি কিন্তু ফুফু যেদিন ঢাকায় যাবে সেদিন সকালেই একটা ফুল ফুটেঁছে । তাই দেখে ফুফুর আনন্দ ছোট্ট বাচ্চার উচ্ছলতায় ঝরে পড়ে । মাকে দিয়ে গেলেন গুরু দায়িত্ব । যেন তিনি ফিরে এসে সব ফুল ঠিক মত পান । কেউ যেন গাছে হাত না দেয় ।মাও কথা দিলেন যেভাবেই হোক কেউ যাতে তার ফুল ছিড়ে না নেয় তা তিনি দেখবেন । মার গলা ধরে খুব খুশি হয়েছিল ফুফ কথাটা শুনে ।
হাস্পাতালের বেডে শুয়ে ফুফু শুধু ছটফট করছে। বাবাকে ডেকে বলেন-
-“ভাইজান , রক্ত কেন দেয়া লাগবে? আমি বেশি করে কচুঁ শাঁক , লাল শাঁক,কলিজা এগুলো খাবানে, আমারে বাড়িতে নিয়ে চলেন ।” বাবা হেসে বলেছিলেন
-“তুই একটু শান্ত হ , ছেলেমানুষি কেন করিস ? দুই বাচ্চার মা হয়েছিস এখনও বাচ্চাদের মত কেন করিস !” কথাটা শুনে ফুফু নাকি অনেক হেসেছিল । বাবাকে বলেছিল
-“"ভাইজান শিমুল আর তমালরে অনেক দেখতি ইচ্ছে হচ্ছে” । " কথাটা বলেই কেঁদে ফেলে বাচ্চাদের কথা মনে করে । বাচ্চাদের আমার মায়ের কাছে রেখে গেছে কারন , কে দেখবে ওখানে ? বাবা মাথায় হাত বুলিয়ে সান্ত্বনার বাণী খুঁজে কিন্তু মায়ের এই আব্দারের কাছে সব ভাষা যে শব্দহীন ।
যথারীতি পরের দিন ফুফুকে রক্ত দিতে আসে ডাক্তার , কিন্তু ফুফুর বায়না আগে সে তার সন্তানদের সাথে কথা বলবে । ফোন করে কথা বলতেই বাচ্চারা মায়ের কন্ঠ শুনে কেঁদে ফেলে । একটা ৩ বছর আর একটা ৪ বছরের ছেলে ।
-“ ও বাবা , মামুনি কালকেই আসবে দেখে নিও । কান্দে না বাবা , মামীর কথা শুনবা । ঠিকমত নাওয়া- খাওয়া …...”" কথা শেষ করতে পারে না লাইন কেটে যায় । ফুফু হেঁটে গিয়ে আবার বেডে শুয়ে পড়ে । নার্সকে বলে
-“সিস্টার তাড়াতাড়ি রক্ত দেন । ফোঁটা বেশি করে দেন যেন তাড়াতাড়ি রক্ত দেয়া হয় , আমি বাড়ী যাব । আমার বাচ্চারা আমার জন্য কানতেছে । ” কথা শুনে নার্স মুচকি হাসে । কিন্তু চরম মুহূর্তে রক্ত দিতে অপরাগতা প্রকাশ করে ফুফু আর তাই ডাক্তারও চলে আসেন । তিনি বুঝিয়ে রক্ত দেয়া শুরু করেন । কিন্তু একি ! ফুফুর সারা শরীর এত চুলকাচ্ছে কেন ? মুখে গোঁটা গোঁটা উঠে গেল রক্ত দেবার দুই মিনিটের মধ্যে ।
-“ও ভাইজান ! আমার ক্যামন জানি লাগতিছে , আমার শিমুল তমালরে কি আমি আর দেখতি পাব না ? ” বাবা আর ফুফা চিৎকার দিয়ে ডাক্তারকে ডাকলেন কিন্তু ততক্ষনে সব শেষ । ফুফু চলে গেছে অনেক দূরে কিন্তু সে তাকিয়ে আছে আকাশের দিকে । বাবা আমার প্রায় পাগলের মত হয়ে গেলেন । ডাক্তার শুধু বললেন “আমরা দুঃখিত !” আর কিছুই বললেন না । বাবা বা ফুফার কোন হিতাহিত জ্ঞান তখন ছিল না শুধু শুনেছিলেন যে রক্ত ফুফুকে দেয়া হয়েছে সেই রক্তের তারিখ এক্সপায়ার বা বাতিল হয়ে গেছে বহু আগেই ।
ওদিকে মা ফুফুর বাচ্চাদেরকে নিয়ে সারাটা রাত অস্থিরতায় কাটাঁলেন । দুজনের কেউ ঘুমায় না, খায় না । ভোরের আলো ফুটতেই মা দেখেন ফুফুর বেলি আর গন্ধরাজ ফুলগুলো সব ঝরে গেছে । কদম ফুলটা নুয়ে পড়েছে ডালসহ । প্রচন্ড গরম এই শ্রাবনেও একফোঁটা বৃষ্টি নেই । কিন্তু আজ অনেক মেঘ করেছে । যদিও এমনটা প্রতিদিনই হয় । মেঘ গর্জন করে কিন্তু বৃষ্টির লেশমাত্র দেখা নেই । বাবা মাকে ফোন করে বলেছিলেন তাঁরা আজই আসছে । আর কিছুই বলেনি ।
রাতেই ফুফুকে নিয়ে রওনা দেয় নিজেদের শহরের উদ্দেশ্যে । সকাল দশঁটায় এসে পৌছায় । বাবা বলে লাশের বহর নাকি সহজে সামনে এগুতে চায় না , তাই অনেকটা বিলম্বে আসে শহরে । মহল্লার সবাই দলে দলে দাঁড়িয়ে থাকে তাদের চক্ষের মনিকে চার দিন পরে দেখবে বলে । কিন্তু
একি ! ট্রাক কেন ঢুকছে গলির ভীতর ? সবাই ট্রাকের পিছনে দাঁড়িয়ে থাকে কৌতুহলি দৃষ্টি নিয়ে । যখনই ফুফুকে ট্রাক থেকে নামানো হয় তখন আকাঁশ ভেঙ্গে ঝর ঝর ঝর্ণায় বর্ষা শুরু হয় । সেই সাথে শুরু হয় সবার আহাজারি আর হাহাকার । কেউ মেনে নিতে রাজি না , তাঁদের প্রিয় মানুষটা এমন করে সবার চোঁখে বৃষ্টি ঝরাতে পারে । এমন করে ফাঁকি দিয়ে চলে যেতে পারে । বাবা নিজের কাঁধে করে প্রানপ্রিয় বোনকে নিয়ে গেলেন গোরস্থানে । বাসায় এসে কেঁদে কেঁদে বললেন –
-“ পাগলিটা সব সময় চাইত আল্লাহ যেন বর্ষার দিনে না নেন ওকে , কিন্তু এই হাতে , এক হাঁটু পানির ভীতরে শুইয়ে দিয়ে আসলাম ! ”
ফুফু মাত্র পঁচিশটা বর্ষার আলিঙ্গনে প্রিয় কদম ফুলের সুবাসে নিজেকে সাজাতে পেরেছিল । তারপর অকাঁলে ঝরে গেল । যার কিনা ভাবী মারা যাবার পরে ভাইজীদের দেখাশুনা করার কথা , মানুষ করার কথা । কিন্তু বিধির লেখা ঠিক ছিল তার উল্টো । ফুফুর অবুঝ নিষ্পাপ শিশুদেরকে নিয়ে বিপাকে পড়ে গেলেন মা । কি বলবেন এই শিশুদেরকে ? তাদের মায়ের মৃত্যু কেমন করে হয়েছিল ? কার ভুলে হয়েছিল ? এই মৃত্যুর দায়ভার কে নেবে ? এতগুলো অজানা প্রশ্ন নিয়ে বেড়ে উঠবে মাতৃহীন এই শিশুরা ।
রিক্সাটা একটা হোঁচট খেতেই দেখি বৃষ্টির পানি আর চোঁখের পানিতে আমার জামা কাপড় ভারী হয়ে গেছে । বাবা বললেন
-“কি হয়েছে ব্যাথা পেয়েছেন ? ”
-“না ভাই রাস্তা ভাঙ্গা , একটুর জন্য রিক্সা উল্টে যায়নি ।”
বাবা রিক্সা থেকে নেমে রিক্সাওলাকে পাঁচশত টাকা দিলেন । আর বললেন
-“আপনার ছেলের জন্য । আমার সামর্থ্য থাকলে আরও একটু বেশি দিতাম কিন্তু আমার সে সামর্থ্য নেই ।” রিক্সাওয়ালা খুশিতে কেঁদে ফেললেন । হাত তুলে দোয়া করলেন ।
বাসায় ঢুকে দেখি দুজন হুজুর কোরান তেলাওয়াত করছেন । আজ আমাদের বাসায় মিলাদ হবে । ফুফুর আজ চলে যাবার দিন ছিল । কদম গাছটা ফুলে ফুলে ভরে গেছে । কিছু পাখিও বাসা বেধেঁছে । বৃষ্টির দিনে এটাই তাদের আশ্রয়স্থল আর পরম সুখের সংসার । অন্তহীন কষ্টরা নীরবে কেঁদে যায় , অনাহুত বর্ষায় , প্রিয় কদম ফুলের অনাকাঙ্ক্ষিত ঝরে যাওয়ায় ।