নীল আকাশের সীমানা

কষ্ট (জুন ২০২০)

সেলিনা ইসলাম
  • ৪১
বাবা আমার ভীষণ ভয় করছে।
-না রে মা ভয়ের কিছু নেই।
-বাবা আমি বাঁচবো তো?
-কী যে বলিস মা। এই করোনা ভাইরাস আমার মাকে কিছুই করতে পারবে না।
-বাবা কত মানুষ মারা যাচ্ছে।
-মাগো অনেক মানুষ বেঁচে ও তো যাচ্ছে। ভয় পেও না সোনা। আমি আছি তো তোমার সাথে,কিছু হবে না।

আমার বাবা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন। সামনে বসা পুলিশটা মাস্ক পরা। আমাদেরকেও দুইটা মাস্ক দিয়েছে। আমাদের কথা শুনছে। গত কয়েকদিন ধরে আমার প্রচণ্ড হাঁচি হচ্ছে। আমার একটা দোষ পরীক্ষার সময় অসুস্থ্য হওয়া। অথচ এখন কোন পড়াশুনারও চাপ নেই। সারাবিশ্ব করোনা ভাইরাসের সাথে যুদ্ধ করছে। আমাদের বাসায় সবাই আতঙ্কে একেবারে বেলুনের মত চুপসে আছে। আমাদের বাড়িয়ালা ভাড়াটিয়াদের বাড়িতে বাড়িতে যেয়ে দেখছে কেউ অসুস্থ্য হল কিনা। আমার হাঁচি কাশি দেখে সে-ই ৯৯৯ এ ফোন দিয়েছে। মা আমাকে লুকিয়েই রেখেছিল। কিন্তু আমিই বুঝতে পারিনি মহিলা "যাই যাই" বলেও গেঁটের সামনে যেয়েও আবার ফিরে আসবে। বেশ বড় একটা হাঁচি দিতেই মহিলার সেকি কাণ্ড!

-ওরে আল্লাহ রে জুলিরে দেহি করোনাই ধরছে! মাইয়া কার লগে কী করছে?

উনার কথা শুনে মা ভীষণ বিরক্ত হলেন। রেগে বললেন

-আরে এসব আপনি কী বলেন?
-এই করোনা বিদেশ থাইকা আইছে! কোন বিদেশী পুলার লগে ইটিসপিটিস করছে! আমার বাড়ী খালি করেন। আজগোই...!

ঠিক সেই মুহূর্তে আব্বা বাসায় এলেন। আমার আব্বা এনায়েত মওলা। একটা সিরামিকের ফ্যাক্টরির সিকিউরিটি গার্ড। রাতে ডিউটি করে। আমার বাবার ফ্যাক্টরি বন্ধ। যে বেতন পায় তা দিয়ে কোন রকম সংসার চলে। কিন্তু বেশ কিছুদিন লকডাউনের কারণে ঘরে একফোঁটা খাবার নেই। তিন সপ্তাহ ধরে সবাই ঘর বন্দী। তাহলে করোনা কীভাবে আসবে? আজ প্রথম আব্বা বের হয়েছে যদি কোন সাহায্য পায় সেই আশায়। ঘর ভাড়ার জন্য প্রতিদিন বাড়িওয়ালি এসে তাগাদা দেয়। এই তো কয়েকদিন আগে এসে শুরু করলো হম্বিতম্বি! তার সোজা কথা-"হয় ঘর ভাড়া দাও নাইলে ঘর খালি কর!"

-কিন্তু এর ভীতরে কোথায় যাব আমরা?

মায়ের এই কথায় মহিলা তেলে বেগুনে জ্বলে উঠে। বলে-

-তার আমি কী জানি। আমি কী আশ্রম খুইলা বইছি?

আমার বাবা ঘরের ভীতরে চুপ করে বসে থাকেন। কিছুই বলে না। কী করবেন ভেবে পায় না। কিন্তু আজ! আজ বাবা চুপ থাকলেন না। বেশ রেগে বললেন-

-আপনার ঘরে ওতো মেয়ে আছে চাচি। আপনি কীভাবে আমার বাচ্চা মেয়েকে নিয়ে এভাবে বলেন?

এবার তিনি কিছুই বললেন না। চলে গেলেন। আমার ভীষণ হাঁচি হল। মনে হচ্ছে কেউ ঘরের ভীতরে এমন কিছু রেখেছে তার জন্য আমার এলার্জি বেড়েছে। ধূলা,পলিন,পাউডার এসবে আমার এলার্জি। আমার নিঃশ্বাস নিতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। মা বাবা আমাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে উঠলেন। আমার কোন জ্বর বা সর্দি নেই। বাবা গ্যাস্টিকের রুগী। প্রায় তাঁর পেটে ব্যথা করে। আমার আরও দুটো ছোট ভাইবোন আছে। আমরা গরিব হতে পারি কিন্তু কাউকে অসম্মান করে সেখানে থাকা বা কারো কাছে সাহায্য চেয়ে খাওয়া আমাদের পক্ষে অসম্ভব।

বিল্ডিঙের সব ভাড়াটিয়ারা আমাদের বাসার সামনে এসে দরজা ভাংচুর করতে লাগলেন। আমাকে বাইরে বের করে দিতে বললেন। আমরা ভীষণ ভয় পেলাম। ভয়ে আমার হাত পা কাঁপতে লাগল। দরজার ওপাশে প্রচণ্ড চিৎকার চেঁচামেচি। কেউ কেউ জানালা দিয়ে ইট পাঁথর মারছে। জানালার গ্লাস ভেঙ্গে ফেলেছে! আমরা সবাই টেবিলের নীচে জড়াজড়ি করে মাটিতে বসে আছি। প্রায় ঘণ্টা খানেক তাণ্ডব চলার পর সবাই চলে গেলো। রাতটা ভয়ে ভয়ে মুড়ি আর পানি খেয়ে কাটালাম। কী করব আমরা কিছুই বুঝতে পারলাম না। দুদিন আমরা কেউ আর ঘরের বাইরে এলাম না। বাড়িওয়ালীরও কোন সাড়াশব্দ নাই। দুদিন পর আজ সকালে দরোজায় ধামাধাম কে যেন বাড়ী মারছে। প্রথমে দরজা খুলতে চাইল না বাবা। পরে খুলে দিলো। দেখে পুলিশ। বাবাকে বললেন-

-আমাদের সাথে আপনার মেয়েকে পাঠিয়ে দিন।

আমরা ভয়ে পেলাম। বাবা বললেন

-কেনো? আমার মেয়ে একা কেন যাবে?
-আপনার মেয়ের করোনা পজেটিভ কিনা তার পরীক্ষা করাতে হবে।

আমি কেঁদে বাবাকে জড়িয়ে ধরলাম। বাবা বললেন

-ভয় নেই মা।

পুলিশের সাথে তর্ক করলেন না। বাবা অনুরোধ করলেন-

-স্যার আমি মেয়ের বাবা। প্লিজ আমি মেয়ের সাথে যাই।
-কিন্তু আপনি তো অসুস্থ্য না। তা ছাড়া ওর কাছ থেকে আপনার হতে পারে।
-হয় হোক স্যার। মেয়েকে একা ছাড়বো না।
-আপনার বয়স বেশি শারীরিক কোন সমস্যা আছে?
-হ্যাঁ স্যার গ্যাসটিকের সমস্যা আছে।
-তাহলে তো আপনাকে নিয়ে ভয়। আপনি বরং বাসায় থাকেন।
-না স্যার আমি মেয়ের সাথে যাবো।

তাকিয়ে দেখি বিল্ডিঙের সবাই উঁকিঝুঁকি মারছে। সবাই বেশ মজা পাচ্ছে। আমি আর বাবা পুলিশ ভ্যানে করে গেলাম হাসপাতালে। সেখানে আমার নাকের ভীতর থেকে গলার ভীতর থেকে লালা নেয়া হল। বলল তিনদিন পরে রিপোর্ট দেবে। এই দিনদিন বাসায় যেয়ে থাকতে হবে। ঘরের বাইরে বের হওয়া যাবে না। যেহেতু আমার কোন শ্বাস কষ্ট নেই তাই হাসপাতালে রাখল না। বাসায় ফিরলাম সন্ধ্যার দিকে। আশ্চর্য আমাদেরকে বিল্ডিঙের ভীতরে ঢুকতে দিলো না। দেখি গেইটের কাছে মা ছোট ভাইবোনদের নিয়ে বসে আছে। আমাদের বাসার ভীতর ঢুকে সমস্ত জিনিষ ভাংচুর করেছে। বাবা আমাদেরকে নিয়ে একটা বাসার বারান্দায় থাকলেন। সেই বাসার বাড়িয়ালাই আমাদেরকে থাকতে দিলেন। খেতে দিলেন। তিনদিন পর বাবা হাসপাতালে গেলেন আমার রিপোর্ট আনতে। রিপোর্ট নেগেটিভ আসলো। সেই কাগজ নিয়ে বাবা থানায় গেলেন। এবং বাড়িওয়ালি বাসায় ঢুকতে দিচ্ছেন না তাও বললেন। সব শুনে থানা থেকে পুলিশ এলেন। আমাদেরকে বাড়িওয়ালীর কাছে রিপোর্টসহ নিয়ে গেলেন। তারপর আমাদেরকে ঢুকতে দিলেন। আমাদের বাসার সবকিছু ভেঙ্গে চুরে চুরমার করে দিয়েছে! আমাদের কত কষ্টে করা খাট আলমারি টেবিল সব এখন জ্বালানি হিসাবে ব্যবহার করা ছাড়া কোন উপায় নেই! পুলিশ তাদের ত্রাণ তহবিল থেকে আমাদের জন্য চাল ডাল দিয়ে গেলেন।

আমরা সবাই যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। বাড়িওয়ালী আমাদের দরজার পাঁশ দিয়ে হেঁটে যায় কিন্তু ভাড়া চাইবার সাহস করেন না। পুলিশের অফিসার বলেছেন তিনি আমাদের ভাড়া যথা সময়ে দিয়ে যাবেন। এই দুর্যোগের সময়ে সহযোগিতা করার অনুরোধ করেছেন।

বেশ কয়েকদিন ধরে পুরো বিল্ডিং শান্ত। আমাদের বিল্ডিঙ্গের কোন ফ্ল্যাটে যেন করোনা ভাইরাস রুগী পাওয়া গেছে। আমাদেরকে ঘর থেকে বের হতে একেবারেই নিষেধ করেছেন। মাকে দেখলাম ডাল চাল খেচুড়ি আর ডিম ভাঁজি বাটিতে করে সাজিয়ে বাবাকে দিয়ে বলছেন-

-যান না একটু দিয়ে আসেন। দরজা খুললেই দরজার সামনে রাখবেন। উনারা নিজেরাই নিয়া নিবেন।
-আরে তুমি যেয়ে দিয়া আসো।
-যান খাবারের কষ্টে আছে।

বাবা আমার দিকে তাকিয়ে বললেন-
-মা বাটিগুলা নিয়া আমার সাথে আসো। নাইলে এই প্যান প্যানানি বন্ধ হবে না!

আমি খাবারগুলো ব্যাগে ভরে নিলাম। দুজনেই মাস্ক পরে বের হলাম। দ্বিতীয় তলার ফ্ল্যাটের দরজার সামনে খাবারের ব্যাগটা রেখে কলিং বেল বাজালেন বাবা। তারপর একেবারে সিঁড়ির কাছে দাঁড়ালাম। "খক খক" করে কাশি দিতে দিতে দরজাটা খুলে গেলো। হাঁপানি রুগীর মত "হাঁসফাঁস" করে নিঃশ্বাস নিতে নিতে বয়স্ক বাড়িওয়ালী বললেন-

-"আর কইও না! পোলা মাইয়া সব একা রাইখা ভাগছে! বেঈমানের বাচ্চা বেঈমান! কাফেরের জাত! মায়রেও দয়া করে নায়...!" কথা শেষ করে "খকখক খটাস...!" করে কাশি দিলেন। উনার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে! আব্বা বললেন-
-চাচি যদি আর কোন কিছু লাগে ফোন করে জানাবেন।

উনি আমাদের দিকে সরাসরি তাকাতেও পারলেন না! মেঘের আড়ালে থাকা সূর্যের মত উঁকি দিলেন ঘোমটার আড়াল থেকে! বাবার শেষ কথাটায় যেন মন বিষাদের সমুদ্র ঢেউ উনার দুচোখে! "দড়াম" শব্দে দরজাটা দিয়ে দিলেন। আমার হয়ত রাগে টমেটোর মত লাল হওয়া উচিৎ ছিল! কিন্তু কেন যেন সেই মুহূর্তে রাগের পরিবর্তে আমার মন খারাপ হল! বললাম-

-"বাবা উনি কী মারা যাবেন?"
-আল্লাহ মাফ করুন মা। চলো নামাজ পড়ে তোমার দাদির জন্য দোয়া করি!
-না বাবা উনি আমাদের দাদি না! আমাকে কী সব...

বাবা আমার কথা শেষ হতে দিলেন না। বললেন-

-থাক মা ওসব মনে করে মুরুব্বী মানুষের আর লজ্জা বাড়াইও না! একটা কথা সারা জীবন মনে রাইখো মা-"কাছের মানুষের কাছ থেকে আঘাত,দুঃখ পাওয়া মানুষটারে পৃথিবীর আর কোন কিছুই ব্যথা দিতে পারে না! দুঃখ কষ্ট সহ্য করার জন্য তার মন অনেক কঠিন হয়ে যায়! তবে লজ্জিত হয় তারা! আর তার জন্য কারো কাছ থেকে ক্ষমা পাওয়াই সবচেয়ে বড় লজ্জা!" কথাটা বলে বাবা বেশ জোরে নিঃশ্বাস ফেললেন। আর একটু হলে মাস্কটাই উড়ে যেত।কেন জানি না আমার কান্না পেলো! 'আমার বাবা এতো ভালো কেন? সব বাবা বুঝি এমনই হয়!?' কেন যেন বুকের ভেতরে খুব যন্ত্রণা হচ্ছে...।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
ফয়জুল মহী শ্রুতিমধুর লেখা।
Omor Faruk গল্পটি মনে দুই পর্বের . তবে বেশ সুন্দর হয়েছে

২৭ মে - ২০১১ গল্প/কবিতা: ১২০ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "ছোটবেলা”
কবিতার বিষয় "ছোটবেলা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ ডিসেম্বর,২০২৪