আমাদের গল্পগুলো বেঘোরে ঘুমায়

মা (মে ২০১৯)

সেলিনা ইসলাম
  • ৫০
'মা তোমাকে নিয়ে একটা জায়গায় বেড়াতে যেতে চাই। তুমি যাবে আমার সাথে?' আমার কথা শুনে মা দেখি একহাত দিয়ে আরেক হাত কচলে কাঁচুমাচু করছে! তারমানে হচ্ছে মা লজ্জা পাচ্ছে আমার কথা শুনে। কিছুক্ষণ পর অস্বস্তির সুরে বললেন-

- "ইয়ে মানে...বলছিলাম কি,সংসারের সব কাজ করে সময় কই!"

-'মা আর কত খাটবে? সেই ছোট বেলা থেকেই তো দেখে আসছি-কী ঝড় বৃষ্টি,কী ঠাটা পড়া গভীর রাত! অথবা আগুন ঝরা কড়া রোদ। সবকিছুকে উপেক্ষা করে শুধু আমরা সবাই শান্তিতে আছি কিনা,এইটাই দেখে গেছ! নিজেকে নিয়ে তো কোনদিন ভাবোনি!'

-"আরে মেয়ে এই জন্যই তো আমি মা।"

-'এখন আমার পালা...এখন থেকে সব কাজ আমিই করব। আর তুমি ঘুরে বেড়াবে,আরাম করবে!'মা হেসে দেয়।

-"কী যে বলিস না! এই বয়সে ঘুরাঘুরি করলে মানুষইবা কী বলবে!"মাকে আর কিছুই বললাম না। সারা জীবন দেখে এসেছি মাকে সবার জন্য ভাবতে! নিজের পাহাড় সমান কষ্টকে ঝরনা করে বয়ে দিয়েছে,অন্যের খুশি বিকাশে! নিজে ভালো না থাকলেও,ঘরের সবার ভালো থাকার সুযোগ করে দিয়েছে!


মনে পড়ে তখন কলেজে পড়ি! একদিন ফেসবুকে দেখি "মাদার ডে"তে এক একজনে তাদের মাকে নিয়ে নানান রকম পরিকল্পনা করে ভালোবাসা জানাচ্ছে। কেন জানিনা আমারও ইচ্ছে জাগল মায়ের জন্য কিছু করি! সকালে ঘুম থেকে উঠে মায়ের রুমে তাঁর জন্য চা আর টোষ্ট নিয়ে গিয়েছিলাম। সেসব দেখে মা মৃদ্যু ধমক দিলেন-

-"আরে আরে! একী করেছিস পাগলি! আমার জন্য কেন আবার কষ্ট করতে গেলি?"

-'মা তুমি সবার জন্য কষ্ট কর। আর আমি তোমার জন্য সামান্য কষ্ট করতে পারব না? আজকে তুমি কিচ্ছু করবে না। এই নাও,খাও।' আমি নিজেই চায়ে টোষ্ট ডুবিয়ে মায়ের মুখে তুলে খাওয়ালাম। রঙিন প্রজাপতির উড়াউড়ি অনেক দেখেছি। আমি এবার মায়ের মুখের হাসিতে সেই প্রজাপতির উড়াউড়ি দেখলাম। শান্ত পানিতে রোদের ঝিকিমিকি দেখেছি। সেদিন আমি মায়ের চোখের খুশির জলে,সেই ঝিকিমিকির ঝিলিক দেখলাম। মা যখন আমাকেও একটু টোষ্ট মুখে তুলে দিল? কেন যেন ভীষণ কান্না পেলো। এই মা সারা জীবন সন্তানের জন্য কত কিছু করে এসেছে। তবুও আমরা সন্তানরা খুশি হতে পারিনি। ভাইটা শহরে লেখাপড়া শেষ করে চাকরী নিয়ে শহরেই থেকে গেছে। মেয়ে বলে মা আমাকে শহরে যেতে দিলেন না। থাকা,লেখাপড়ার খরচ এসব ঝক্কি-ঝামেলা মা আমাকে করতে দিলেন না। আসলে মা ভয় পেতেন! যদি ছেলের মত মেয়েকেও হারিয়ে ফেলেন! আমরা তো মায়ের কথা কেউ ভাবি না...! মায়ের জন্য কিছুই রাখি না! অথচ আমাদের শুধু চাই,আরও চাই...।



ভাই রাত করে ঘরে ফেরে। মা না খেয়ে জেগে জেগে ঝিমাতে থাকে। ভাই রাগ দেখিয়ে বলে-"জেগে কেন থাকো! আমার জন্য আর জাগবে না!" মা ছেলের জন্য জেগে থেকে যেন মহা ভুল করেছেন! আর আমি? দুপুরে খেয়ে দেয়ে একটা লম্বা ঘুম দিয়ে উঠি। দেখি মা তখনও নাওয়া খাওয়া বাদ দিয়ে উঠানে ঝাড়ু দেয়! অথচ আমি চাইলেও মা আমাকে এসব করতে দেয় না! বলে-"না রে মা তোর কষ্ট হবে!" কখনো কখনো মায়ের হাতে ধোয়া,আয়রন করা শার্ট গায়ে দিয়েও ভাই চিৎকার করে বলে উঠে-'ধ্যেত জামার দাগটা কেন উঠেনি? মা আমার দামি শার্টটাই নষ্ট করে দিয়েছ!' ফুটপাত থেকে কেনা জামাটাও তখন,অনেক দামি বলতেও ভাই কার্পণ্য করে না। মা যেন খুব বড় ধরনের কোন অন্যায় করে ফেলেছে। আস্তে করে বলে-"সরি বাবা আমারই ভুল হয়ে গেছে!" অথচ ওই শার্ট পরেই ভাই আবার বের হয়ে যায়।


মায়ের কাছে আমাদের চাওয়ার শেষ নেই! পাওয়ারও কোন কমতি নেই। অথচ সেই মাকে নিয়ে কোনদিন আমরা ভাবিনি! মা হাজার করলেও কেন যেন আমাদের খুশি করতে পারত না। মাঝে মাঝে আমিও রাগ ঝাড়তাম-'কেন তুমি রাত জেগে থাকো? কেন না খেয়ে তোমাকে বসে থাকতে হবে? কেন কেন কেন?' মা শুধু একটাই উত্তর দিতেন-"যেদিন তোদের সন্তান হবে! সেদিন আমার কষ্ট তোরা বুঝবি! আর এই সব কেন'র জবাবও পাবি!"


এখন বুঝি সেদিন সামান্য চায়ের মাঝে টোষ্ট ভিজিয়ে মায়ের মুখে তুলে দিয়েছি বলে,মা কেন খুশি হয়েছিল! অথচ এই ছোট্ট ছোট্ট খুশিগুলোও সন্তান হয়ে মাকে দিতে পারিনি। "এই গাঁ-ও গ্রামে থেকে আর যাই হোক-ছেলে মেয়ে মানুষ হবে না!" এই অজুহাতে বউ বাচ্চা নিয়ে ভাই আর কোনদিনও গ্রামে ফিরল না। আমার মা শুধু অস্ফুটে বলেছিল-"হ্যাঁ রে বাবা তোদের তো মানুষ করতে পারি নি তাই না?''মায়ের দীর্ঘশ্বাসের ঝড় হাওয়া বহুবছর পর আজও আমি অনুভব করতে পারি।



দিন দিন আমার মেয়েটা যত বড় হতে লাগল! আমি কেমন যেন একটা ঘোরের মাঝে থাকতে লাগলাম। সবাই দেখি নিজের সন্তানকে নিয়ে সাফারি পার্কে যায়। আজ আমিও এলাম। মা আমার সাথেই যেন আছে! আমার হাতটা বেশ শক্ত করে ধরে বলল-

-"মিষ্টি এইটা তো বাচ্চাদের পার্ক। আমাকে কেন আবার টেনে আনলি!"

-'মা কে বলেছে এখানে শুধু বাচ্চারা আসবে?' মা আমার কথার জবাব দিলেন না। পশুপাখির মূর্তিগুলো দেখে মা হেসে কুটিকুটি! হাত দিয়ে ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখছেন।

-"জানিস,ছোট বেলায় ভীষণ ইচ্ছে হত চিড়িয়াখানা যাই। কিন্তু আমার বাবা এত কড়াকড়িতে রাখতেন যে,চিড়িয়াখানা দেখা তো দূরে থাক। বাড়ির পাশের সার্কিট হাউজে সার্কাস দেখালেও যেতে দিত না। জানিস,সেই সময় স্বপ্ন দেখতাম বিয়ের পরে স্বামীর সাথে চিড়িয়াখানায় যাব। পুঁড়া ভুট্টো খাবো। মোগলাই,ফালুদা খাব। সার্কাস দেখব। থাক বাবাকে শুধু শুধু না জ্বালাই...।" গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলে মা থেমে গেলেন।

-'মা সেই সময়েই তুমি স্বামীকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতে?' মজা করে হেসে কথাটা বলতেই,মা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঠিকই উত্তর দিলেন-"হ্যাঁ রে মিষ্টি,বাসায় তো সারাক্ষণ বিয়ে দেবার কথাই হত!"

-'মানে...! তোমার বয়স কত ছিল তখন?' মা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে-

-"কত আর হবে? তের কী চৌদ্দ বছর! ক্লাস সিক্সে যখন পড়ি বাবা তো আর স্কুলেই যেতে দিলেন না!"

আমি যেন আকাশ থেকে পড়লাম! অবাক হয়ে বললাম-

-'মা এটা তো নানাভাই ঠিক করেনি!' মা মৃদ্যু হেসে বললেন-

-"তখন বাবা মা,মেয়ে একটু বড় হলেই তার বিয়ে দেয়া নিয়ে ভাবতে ভাবতে ঘুম হারাম করে ফেলত! মেয়ে বিয়ে দিয়ে তবেই তাঁরা নিশ্চিন্ত হতেন। লেখাপড়া নেই। হাতের কাজ,ঘর গৃহস্থলির কাজ শেখা। আর ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা। স্বাভাবিকভাবে মনে মনে হবু বরকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন দেখতাম। অদেখা সব চাওয়া পাওয়া সেই বরের কাছ থেকে পাব আশা করে সুখ পেতাম!"

-'তারপর আব্বা তোমাকে নিয়ে অনেক ঘুরেছে? সব শখ পূরণ করেছে?' মা একটু ভাবলেন তারপর দীর্ঘশ্বাস চেপে রেখে বললেন-"আর শখ! বিয়ের পরে সংসার নিয়ে,সবার প্রতি দায়িত্ব পালনে কীভাবে যে সময় যেত,টেরই পেতাম না! সারাদিনে স্বামীর সাথে তাঁর প্রয়োজন ছাড়া কথাও হত না! রাতের বেলা সব কাজ শেষ করে একখিলি সুগন্ধি পান খেতাম স্বামীর সাথে। এতেই দুনিয়ার সুখ এসে মনে ধরা দিত!" মা এইটুকুতেই সুখী হয়ে যেত! অবাক হয়ে মায়ের দিকে তাকিয়ে দেখতাম! এ পর্যন্ত কথা বলে মা চুপ করে যেত। কোথায় যেন হারিয়ে যেতেন। হয়ত মনের সুপ্ত ইচ্ছেগুলোকে জাগানোর চেষ্টা করছেন! অতীতের ভাবনার অতলে যেন আমি ডুবেই গেছি!


একটু পরেই আবার আমি মায়ের ছুটাছুটি দেখছি। ঝিরঝির পাতার শব্দে মনে কাঁপন তুলে যাচ্ছে। আজ এই পার্কে এসে মা আমার,একেবারে ছোট্ট শিশু হয়ে গেছে। আমি মায়ের চঞ্চলতা উপভোগ করছি। ঠিক যেমন মায়েরা তাঁদের সন্তানের উড়ে চলা উপভোগ করে মনের তৃষ্ণা মেটায়। মনের তৃপ্তি মেটায়। আজ তেমনি করে আমি আমার বহুদিনের পিপাসা মেটাচ্ছি। সেই ছোট বেলায় কোন একদিন মা গল্পে গল্পে বলেছিল-"মিষ্টি আমার না আমার মায়ের হাত ধরে খুব ঘুরতে ইচ্ছে হত। মনে হত বাবা আমাকে বের হতে না দিলেও,মা ঠিকই গোপনে আমাকে নিয়ে সুন্দর সুন্দর জায়গায় ঘুরে বেড়াবে। বোরখা পরে মা আর আমি দুজনে রেস্টুরেন্টে খেতে যাব! দু'জনে প্রচণ্ড গরমে গলে যাওয়া আইসক্রিম চেটেপুটে খাব! কিন্তু আমার মা চাইলেও কোনদিন আমার হাত ধরে ঘুরতে পারত না। বাবাকে ভীষণ ভয় পেত। মেয়েরা মেয়েরা বাইরে যাবে! সে সময়ে ভাবাই যেত না! তারপর তো একদিন হার্ট এটাক করে বহুদিন মা প্যারালাইজড হয়ে বিছান নিছিল !" এইটুকু বলে মা থেমে গেছেন! সেই ছোট্ট আমি সেদিন মায়ের চোখের পানি মুছে দিয়েছিলাম! মনে মনে আরও একটা কাজ করেছিলাম-প্রতিজ্ঞা...। বড় হয়ে আমি চাকরী করব! যেদিন চাকরীর প্রথম বেতন পাবো,মায়ের হাত ধরে অনেক ঘুরব! 'উফঃ' আজ মায়ের বলা সেইসব কথাগুলো ভেবে চারদিক ঘোলা,কুয়াশার মত লাগছে!


তাকিতে দেখি ছুটাছুটি করে মা কিছুটা ক্লান্ত হয়ে গেছে। তাঁর হাত ধরে নিয়ে একটা জায়গায় বসলাম। আইসক্রিম এনে মায়ের সামনে ধরলাম। সে দেখি এদিক ওদিক তাকিয়ে লজ্জা পেলো! ফিসফিস করে বলল-

-"আরে পাগলি আইসক্রিম খাওনের বয়স আছে নাকি!"

-'মা ধর প্লিজ...। আইসক্রিম গলে যাবে কিন্তু।'

মা আইসক্রিম হাতে নিলেন। তারপর আমার দিকে গভীর দৃষ্টি মেলে বলে উঠলেন-

-"হ্যাঁরে মিষ্টি,প্রথম বেতন পাইছোস বুঝি?" ঝরঝর করে কয়েক ফোঁটা পানি আমার জামাতে পড়লো। আমি মায়ের কাঁধে হাতটা রেখে বললাম- 'হ্যাঁ মা...! তোমাকে চমকে দেব বলে আগে বলিনি।'

-"আমি যে সত্যিই চমকে গেছি মা। যে শখগুলো এতটা বছর মনের মাঝেই দাফন দিয়া রাখছিলাম। আজ থাইকা

আমার মিষ্টি সোনা তার মায়ের সেই ছোট্ট বেলার শখগুলো পূরণ করতাছে! এর চেয়ে বড় চমক একজন মায়ের জন্য কী হইতে পারে মা! শিক্ষা দীক্ষা মানবিকতায় একজন যোগ্যতা সম্পন্ন মেয়ে হয়ে,আমাকে তুই একজন গর্বিত মা হবার যোগ্য করেছিস সোনা। যা অনেক মা অনেক সন্তানের জন্য অনেককিছু করেও হইতে পারে না। আজকাল তো সব ছেলে মেয়েরা মাকে আশ্রমে রাইখা বাঁইচা যায়! আর তুই কিনা আমাকে নিয়ে ঘুইরা ঘুইরা বেড়াস? আমাকে দেইখা সব মায়েরা হিংসা করব। সন্তান হইয়া তুই মাকে জিতাইয়া দিছোস মা।"


মা খিলখিল করে হেসে যাচ্ছে। আর আমি মায়ের জন্য কিছু করতে পারার স্বর্গীয় আনন্দে ভেসে বেড়াচ্ছি। মাকে ওষুধ কিনে নিজে হাতে খাইয়ে দিচ্ছি!

'মা তোমার কী চাই? একবার বল সব তোমার সামনে এনে হাজির করব!'মা হাসে!

"পাগল মেয়ে আমার। আমার অনেক আছে! আর এত দামি দামি বিদেশি ওষুধগুলা কেন কিনছিস? শুধু শুধু টাকা নষ্ট!"

-''না মা টাকা কেন নষ্ট হবে? দেশের ওষুধগুলো তো ভ্যাজাল মেশানো! তোমার কিছু যদি হয়ে যায়,আমি নিজেকে কোনদিনও ক্ষমা করতে পারব না!'

-"পাগলি মেয়ে-এই বোঝা নিয়া ঘুইরা বেড়াস...না? আমার কোন অভিযোগ নাই মা। তোর মত মেয়ে গর্ভে ধইরা আমি গর্বিত হইছি! তোর কোন দোষ নাই রে সোনা!"

-'তুমি মা এভাবেই তো বলবা। কিন্তু আমি যে নিজেরে ক্ষমা করতে পারি না। আর...!'এমন সময় বাতাসে ভেসে আসে খুব চেনা ফুলের ঘ্রাণ।

"মা...মাআআআআআ সন্ধ্যা হয়ে গেছে। বাসায় যাব!" ঘ্রাণটা যেন এক নিমিষেই হারিয়ে গেলো। আমার পাঁচ বছরের মেয়েটা এত জোরে হাতটা ধরে ধাক্কা দিল! চোখের মাঝে হাজারো জোনাক জ্বলে আবার দপ করে নিভে গেলো। যেন গভীর ঘুম ভেঙ্গে জেগে উঠলাম। একেবারে ঘেমে নেয়ে উঠেছি!

-'হ্যাঁ মা বাসায় যাব!'বুকের ভীতরে চাপচাপ ব্যথা অনুভব করলাম-'মাগো তুমি বেঁচে থাকতে আমাকে বিয়ে দিতে একটা পাত্র পাওনি! টাকার অভাবে আমি পড়াশুনাটাও শেষ করতে পারিনি! পারিনি শত চেষ্টায়ও একটা চাকরী করতে। হয়ত সময়ে চাকরীটা পেলে তোমার মনের মাঝে চাপা থাকা স্বপ্নগুলোকে একটুখানি নাড়িয়ে দিতে পারতাম। হয়ত তোমার সাথে কিছু জীবন্ত মুহূর্ত থেকে যেত আজীবন।' আজ যখন আমার স্বামী সংসার সন্তান সবকিছুই আছে? তখন তুমি নেই মা! আর তাই শুধু তোমাকেই মনে পড়ে। মনে পড়ে তোমার মুখের প্রতিটা অভিব্যক্তি। তোমার বলা সব কথা আমি পালন করে যাচ্ছি! দিনে দিনে তো লোহাতেও মরিচা ধরে যায়। অথচ দিনের পর দিন চলে গেছে মায়ের কিছু স্মৃতি এখনও সজীব! মায়ের বলা প্রতিটা কথা এখনও কানে বাজে!


আমার ভাইটা সংসার নিয়ে এতোটাই ব্যস্ত থাকে যে,কোনদিন একবারের জন্য খোঁজ করেনি! সে খোঁজ করলে হয়ত আজও মা আমাদের সাথেই থাকত! আমার মা বহুদিন অসুখে ভুগেছে! অথচ আমার কাছে টাকা নেই,আমি দুশ্চিন্তা করব ভেবে আমাকে জানায়নি! একমাত্র মা-ই বুঝি এভাবে নিজের কষ্টকে হজম করে ঠোঁটে হাসি রাখতে পারে? মা যখন মৃত্যু শয্যায় ছিলেন। আমাকে কাছে ডাকলেন। বহু কষ্টে বললেন-"ও মিষ্টি ইলিশ মাছের ঘ্রাণ আসতাছে কেন? আমি দম নিতে পারতাছি না! জানালা বন্ধ কইরা দে।" অথচ কোথাও কোন মাছের গন্ধ নেই! আমার কেন যেন মনে হয়েছে মা আসলে ইলিশ মাছ খেতে চেয়েছে। কিন্তু মুখ ফুটে বলছে না। আমি অভাগি সন্তান আঁটশ বা হাজার টাকায় একটা মাছ কিনে আমার আত্মত্যাগী মাকে খাওয়াতে পারিনি! অথচ এখন? এখন আমার ফ্রিজে সব ধরণের মাছে ঠাসা। আমি আমার শাশুড়িকে মায়ের মত যত্ন করি। মাও নাকি আমার দাদিকে অনেক যত্ন করতেন। সেসব গল্প মা-ই আমার সাথে করেছে। আমি আজও ইলিশ মাছ খেতে পারি না। কিন্তু মেয়েকে কাঁটা বেছে বেছে নিজে হাতে খাইয়ে দেই। মনে মনে ভেবে নেই মাকে খাওয়াচ্ছি।


আমার প্রতি মায়ের কোনদিন কোন অভিযোগ ছিল না সত্য। কিন্তু মা মরে যাবার আগে যা করে গেছেন সে কষ্ট আমি কোথায় রাখি? বাবার রেখে যাওয়া যৎসামান্য ভিটেটুকু আমার নামে দিয়ে গেছেন। যা আমি তাঁর মৃত্যুর পরে জেনেছি! আর এই সম্পত্তির জন্য গ্রামের একটা শিক্ষিত ছেলের সাথে মামারা আমাকে বিয়ে দিতে পেরেছেন! অথচ আমার ভাই এই জমি বিক্রি করে শহরে ফ্লাট কিনবে বলে মায়ের সাথে কত ঝগড়া করেছে। মা ভাইকে সম্পত্তি দেয়নি! মায়ের এই সিদ্ধান্তে ভাই সব সম্পর্ক ছিন্ন করেছে। চাচারা এই সম্পত্তি হাতিয়ে নেবার চেষ্টা করেও মায়ের জন্য নিতে পারেনি! এখন বুঝি মা কেন প্রায়ই বলতেন-"সন্তানের জন্য কিছু করতে গেলে-আল্লাহ ছাড়া মাকে হারিয়ে দেবার ক্ষমতা কী কারো আছে?"এই সম্পত্তির জন্যই আমার বিয়ে হয়েছে। যে সম্পত্তি মা ভাইকে বিক্রি করতে দেয়নি। আমার স্বামী সেই সম্পত্তি বিক্রি করে ব্যবসা করে। স্বামী সন্তান অর্থ যেটুকু আছে তাতে আমি সুখী হলেও,শান্তি পাই না কোথাও।


প্রতিটা ক্ষণ আমি মাকে ভাবি। কয়টা টাকার জন্য মায়ের সাথে ভাইয়ের জঘন্য দুর্ব্যবহারের কথা ভাবি! আমার মা একবারও আমাকে বুঝতে দেয়নি-সে নিজের চিকিৎসা না করে-আমার বিয়ের টাকা জোগাড়ে ব্যস্ত! একমাত্র মা-ই বুঝি সন্তানের জন্য এতবড় একটা দৃষ্টান্ত রেখে যেতে পারে! কিন্তু মা বুঝেনি আমি সারা জীবন বিয়ে না করেও,তাঁকে সাথে নিয়ে থাকলে আমি আরও বেশি শান্তিতে থাকতাম! এইসব যখন ভাবি- আমি নিজেকে ক্ষমা করতে পারি না। কেন মেয়ে হয়ে জন্ম নিলাম? কেন একটা ছেলেকে মা কষ্ট করে লেখাপড়া শেখানোর পরও,চাকরী পেয়ে সে মা বোন সব ভুলে যায়? কেন একটা মেয়ের গায়ের রং দেখে,আর্থিক অবস্থা দেখে কোন ছেলে বিয়ে করতে চায় না?


মাঝে মাঝে মনে হয় স্বামী সংসার সবকিছু ছেড়ে ছুড়ে একদিকে চলে যাই। কিন্তু পারি না। পারি না মেয়েটার কথা ভেবে। মেয়েটা যে সারাক্ষণ "মা মা" করে আমাকে অস্থির করে নেয়! ওর "মা ডাক আমাকে বাঁচতে শেখায়। ওর "মা" হতে পেরে আমি নিজেকে ধন্য মনে করি। মনে হয় যে অপরাধ বয়ে চলেছি তার কিছুটা হলেও প্রায়শ্চিত্ত হবে,যদি মেয়েটাকে লেখাপড়া শিখিয়ে স্বনির্ভর করতে পারি!


আমি চাই না আমার মেয়েটা আমার মত বা আমার মায়ের মত দুঃখের বোঝা নিয়ে বেড়ে উঠুক। আর তাই দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানোর মত করে-মায়ের সব স্বপ্নগুলো,মেয়েকে নিয়ে পূরণ করি! এতে কিছুটা আনন্দ খুঁজে যাই। মায়ের সাথে আমার দেখা হয়,কথাও হয়! কিন্তু স্বপ্ন ভেঙে গেলে সব আনন্দ কর্পূরের মত হাওয়ায় মিলিয়ে যায়।

আসলে সময়ে কোনকিছুই হয় না বলে কত স্বপ্ন অঙ্কুরেই ঝরে যায়! আয়ু থাকতেও সবচেয়ে প্রিয়জন বিনা চিকিৎসায়,ওষুধের অভাবে আকাশের তারা হয়ে যায়!"কথাটা ভেবে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আকাশের দিকে তাকালাম। দেখি সন্ধ্যা তারাটা মিটিমিটি জ্বলছে। যেন চোখ পিটপিট করে হাসছে।

-'মা এখনো চোখে চোখে রেখেছ আমাকে!'

-"হ্যাঁ রে মা-কোন মা-ই সন্তান কষ্টে থাকলে নিশ্চিন্তে শেষ ঘুমটাও দিতে পারে না!"

কথাগুলো মনে করে আমি অঝরে কেঁদে গেলাম! "আমি যে মা...!" তাই কষ্ট গিলে খাওয়া শিখে গেছি! মেয়েকে কিছুই বুঝতে না দিয়ে দীর্ঘশ্বাসটা গিলে ফেললাম! পাথর চাপা হৃদয়ের ভারে মাথা নত হয়ে আসে! মেয়ের হাত ধরে মা মেয়ে ধীরে ধীরে ঘরে ফিরি...।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
মোঃ নুরেআলম সিদ্দিকী একটি চমৎকার গল্প। পড়তে বড্ড দেরি করে ফেলছি। চাইছি একটু বিস্তারিত বলে বড় করে কমেন্ট করবো , কিন্তু সময় পাই না! শুভ কামনা আপু।।
মোঃ মোখলেছুর রহমান আজ তিনটি গল্প শেষ করার ইচ্ছে আছে,আপনাদের গল্পে শুভ কামনা জানান ছাড়া বলার তো তেমন কিছু থাকেনা।
রণতূর্য ২ কোন মা-ই সন্তান কষ্টে থাকলে নিশ্চিন্তে শেষ ঘুমটাও দিতে পারে না! চিরন্তন সত্য কথা।মা-মেয়ের ভালোবাসার কোন তুলনা হয় না।শুভকামনা ও ভোট রইল।আমার কবিতায় আমন্ত্রণ রইল।আপনার সুচিন্তিত মতামত প্রত্যাশি।
অনেক অনেক ধন্যবাদ শুভকামনা সতত।
মুহম্মদ মাসুদ কষ্টের গল্প, বেশ ভালো লাগলো। আমার পাতায় আমন্ত্রণ রইলো।
অনেকঅনেকধন্যবাদ। শুভকামনা নিরন্তর।

লেখার সাথে বিষয়ের সামঞ্জস্যতা ব্যাখ্যায় লেখকের বক্তব্য

একজন মা সন্তানের ভবিষ্যৎ দেখতে পারেন বিধায়,সন্তানের জন্য কঠিন সিদ্ধান্তে জয়ী হতে পারেন। যা আর কেউ পারে না। আবার একজন মেয়ে যেন মায়ের কষ্ট,ত্যাগ,তিতিক্ষা,সব অনুভূতিগুলো নিজে বড় হতে হতে অনুভব করতে পারে। মেয়েটা মা হলেই যেন মাকে সবচেয়ে বেশিই অনুধাবন করে। দূরে-বহুদূরে থেকেও মায়ের সাথে সন্তানের মনঃসংযোগ যেন বিধাতার প্রদত্ত এক পরম উপহার। যে সন্তান সেই সংযোগ রাখতে পারে সে পরম ভাগ্যবান। একজন মা মেয়েকে নিজের কাজ দিয়ে অভিজ্ঞতা দিয়ে,শিক্ষা দিলে কোন আশ্রমেরও প্রয়োজন হবে না। মায়ের দেয়া শিক্ষাই বড় শিক্ষা। মায়ের জন্য কিছু করতে না পারার অপরাধ বোধ মেয়েটাকে কুড়ে কুড়ে খায়! মাকে নিয়ে ভাবতে ভাবতে,মেয়েটা ওদের মা মেয়ের স্বপ্নকে ঘুমন্ত রেখে-ধীরে ধীরে মায়ের দেখা স্বপ্নের মাঝে বাস করা শুরু করে। অবচেতন মনে মায়ের দেখা স্বপ্নগুলোকে মেয়ের মাধ্যমে জীবন্ত করে তোলে। এই নিয়েই "আমাদের গল্পগুলো বেঘোরে ঘুমায়" গল্প লেখার চেষ্টা করেছি। আশাকরি সবার ভালো লাগবে।

২৭ মে - ২০১১ গল্প/কবিতা: ১২০ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

বিজ্ঞপ্তি

“এপ্রিল ২০২৪” সংখ্যার জন্য গল্প/কবিতা প্রদানের সময় শেষ। আপনাদের পাঠানো গল্প/কবিতা গুলো রিভিউ হচ্ছে। ১ এপ্রিল, ২০২৪ থেকে গল্প/কবিতা গুলো ভোটের জন্য উন্মুক্ত করা হবে এবং আগামি সংখ্যার বিষয় জানিয়ে দেয়া হবে।

প্রতিযোগিতার নিয়মাবলী