প্রায় একঘণ্টা ধরে বাসের জন্য দাঁড়িয়ে আছি। ভ্যাপসা গরম আর মানুষের ভিড়ে দম বন্ধ হবার মত অবস্থা। সেই সাথে মাঝে মাঝেই বাতাসে ভেসে আসছে ধুলো।পকেট থেকে রুমালটা বের করে মুখের ঘাম মুছে নিলাম। ধরেই নিয়েছিলাম আজকের ইন্টার্ভিউতেও কোন ভালো খবর আসবে না। আশা করা, স্বপ্ন দেখা এসব বাদ দিয়েছি তিন বছর আগেই। তবুও নিজেকে ব্যস্ত রাখতে হোক বা চেষ্টা করছি এই সান্ত্বনা পেতেই হোক-ছুটে যাই এক অফিস থেকে আরেক অফিসে। চাকরিটা খুব দরকার হলেও পাচ্ছি না কোনভাবেই। বাবা মারা গেছেন। অসুস্থ মায়ের ওষুধের ডিব্বাটা প্রায়ই খালি থাকে। পান খাবার অভ্যাসটাও মনে হয় ছেড়ে দিয়েছেন। মায়ের লাল টুকটুকে ঠোঁট দুটো এখন কেমন ফ্যাঁকাসে লাগে! বুক কাঁপিয়ে দীর্ঘশ্বাসটা বেরিয়ে আসে।
বাসটা এসে সামনে দাঁড়াতেই মানুষের ঠেলাঠেলি শুরু হয়ে গেছে। বহু কষ্টে বাসে উঠলাম। কোন সীট খালি ছিল না। মানুষে একেবারে ঠাসা! কোন রকম ফাইলটা একহাতে বুকের সাথে চেপে ধরে,আরেক হাতে বাসের একটা সিট ধরে দাঁড়িয়ে আছি। কিছুদূর যাবার পরেই একটা মেয়ের চিৎকার ভেসে এলো-
-আআআআহঃ...! এই আপনি এইটা কী করলেন? তাকিয়ে দেখি অনেক মানুষের মাঝে একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
-কী করেছি? একটা মধ্যবয়সী লোক কথাটা বলে উঠলো। মেয়েটা বোরখায় মুখটা ঢেকে রাখা। শুধু চোখ দুটো দেখা যাচ্ছে। চোখ দেখে বুঝে নেয়া যায় সে অনেক ব্যথা পেয়েছে। আবারও মেয়েটা বলে উঠলো
-আপনি জানেন না আপনি কী করেছেন? অসভ্য ছোট লোক কোথাকার।
এবার রাগে মেয়েটার চোখে যেন আগুন জ্বলছে। পুরো বাসের মানুষের চোখ মেয়েটার দিকে। লোকটা সেই একই স্বরে বলে উঠে- আরে আপনি বলবেন তো আমি কী করেছি? ফাজলামো পাইছেন তাই না...? ভদ্র মানুষ পেয়ে যা খুশি তাই বলে যাবেন!
-আপনি আমার গায়ে হাত দেননি? নির্দ্বিধায় মেয়েটা বলে উঠে...। মেয়েটার কথা শুনে কেউ কেউ "হা" হয়ে যায়। কেউ কেউ মুখে বিরক্তি প্রকাশ করে। এবার এগিয়ে আসে বাসের হেল্পার ছেলেটি। সে এসে মেয়েটাকে উদ্দেশ্য করে বলে-
-আপা থাক বাদ দেন।
-কেন? বাদ দেব কেন? মেয়েটা একই সুরে বলে যায়।
- না...! আগে বলেন আমি আপনার গায়ে কোথায় হাত দিছি? ঐ লোকটা এবার বেশ জোরেই মেয়েটাকে উদ্দেশ্য করে বলে। কেন জানি না আমার রাগ হয়। দুই তিন ফুট দূরে দাঁড়িয়ে দেখছি। মেয়েটা এবার চোখ ঘুরিয়ে বাসের সবার দিকে তাকায়। কেমন যেন একটা অসহায় ভাব ফুটে উঠেছে মেয়েটার চোখে। হেল্পার ছেলেটা বলল-
-আপা আপনি মেয়ে মানুষ,একটু চুপ করে থাকেন। লোক জানাজানি হলে আপনিই লজ্জা পাবেন। আপানরই ক্ষতি হবে।
বুঝতে পারলাম বাসের বেশির ভাগ মানুষই হেল্পারের কথায় একমত। যে লোকটা এই ঘটনা ঘটিয়েছে সে দেখি মিটিমিটি হাসছে! হেল্পার ছেলেটা বাসের গায়ে ধাম ধাম শব্দ করে চিৎকার করে বলে-
-এই বাস থামবে,বাস থামবে। এই ভাই আপনি বাস থেকে নামেন!
একটা অভদ্র ইতর টাইপের লোক একটা মেয়েকে এভাবে হয়রানি করে কী সুন্দর সাঁজা পেল...! বাস থেকে তাকে নামিয়ে দেয়া কোন সাঁজা হল? অন্য বাসে গিয়ে এই লোক আরও কোন মেয়েকে উত্যক্ত করবে! কোন অবুঝ বোকা মেয়ে হয়ত ওর খপ্পরে পড়ে নিজের সবকিছু খুয়াবে!
মনে হল ঘণ্টা দুয়েক আগের চাকরির ইন্টার্ভিউ-এর কথা। কোন চাকুরী টাকুরি দেবে না। অথচ মানুষকে ইন্টার্ভিউতে ডেকে নেবে লোক দেখানো আনুষ্ঠানিকতা করতে। ক্ষমতার জোর আছে যার হয়ত তেমন কাউকে আগেই নেয়া হয়ে গেছে! তবুও কিছু মানুষকে চাকরির নাম করে "পানি পুরিতে কতটুকু পানি থাকে?" "আচ্ছা বলুন তো হিন্দি ছবি বাজরাঙ্গি ভাইজান ছবিতে সালমান খান ছোট মেয়েটাকে কাঁধে করে কেন নেয়? মেয়েটা তো নিজেই হেঁটে যেতে পারত তাই না?" এসব কৌতুক প্রশ্ন শুনে অস্বস্তি লাগে,রাগ হয়। এরা বাঙালি,এরাই দেশের উন্নতির আসনে বসে আছে! এসব ভাবনা ভেবে ঘৃণা লাগে! ওরা অবশ্য আমাদেরকে নাজেহাল করে আনন্দ পায়! প্রতিবাদ করে না কেউ। তাই সমস্যার সমাধানও পায় না কেউ। চলতি পথে বাস থেকে শুরু করে বিভিন্ন অফিস আদালত;সব জায়গায় মানসিক,শারীরিক নির্যাতন! কিছু মানুষের অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে সবাই মজা লুটে নেয়। না...এভাবে চলতে দেয়া যায় না। জানি না লোকটার হাসিতে কেন আমার মনে আগুণ জ্বলে উঠলো! আমার যে কী হল? এতক্ষণ ইন্টার্ভিউ দেবার সময়ের অপ্রীতিকর বিষয়টি ধৈর্য ধরে মনে পুষে রেখেছিলাম।ভীতরে ভীতরে আমি ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেছি! কিন্তু এবার তা যেন বাসের এই ঘটনায় তীব্র জ্বলন্ত আগুন হয়ে বের হলো। বলে উঠলাম-
-এই বাস থামবে না। এই ব্যাটা মেয়ে মানুষ নির্যাতিত হবে আর বলতে পারবে না কেন?
হেল্পারের দিকে তাকিয়ে আমি প্রশ্নটা করলাম। সেও বেশ উঁচু গলায় মেয়েটাকে দেখিয়ে বলল-
-ক্ষতিটা তো উনারই হবে...।
-তোকে কী উনার ক্ষতির দায় ভার নিতে বলেছে উনি? আমিও মেয়েটাকে দেখিয়ে বললাম। হেল্পার এবার কাঁচুমাচু করা শুরু করলো। আমি এবার ঐ লোকটাকে ধরলাম
-এই ব্যাটা মেয়ে মানুষ দেখলে তাদেরকে বিরক্ত করতে ইচ্ছে হয় না? কথাটা বলেই লোকটার কাঁচা পাকা দাঁড়িতে ঢাকা মুখে ঠাস করে একটা চড় মেরে বসলাম। লোকটা অপ্রস্তুত হয়ে গেলো। তখন আমার চোখে লোকটার মিটিমিটি হাসিটা ভাসছে! লোকটার শার্টের কলার ধরে বেশ কয়েকটা ঝাঁকি দিলাম! বাসের সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। মেয়েটাকে বললাম-
-আপনি মারেন...। মেয়েটা যেন এই সুযোগের অপেক্ষা করছিল। ঠাস ঠাস শব্দে লোকটাকে বেশ কতগুলো চড় দিলেন। পাশের সীটের ছেলেটা পুলিশকে ফোন দিয়েছে। সামনে বাস থেমে দাঁড়িয়ে রইল। "মাফ করে দেন।এমন আর কোন দিন হবে না। আমার ভুল হয়ে গেছে!" হাতজোড় করে কথাগুলো বলতে বলতে লোকটা বের হবার পথ খুঁজতে লাগল। কিন্তু বেশ কয়েকজন তাকে চড় মেরে,মনে চেপে থাকা রাগ প্রকাশ করলো। সবার ভাব দেখে মনে হল-তারা সবাই-ই যেন একজন কেউ সাহস দেখিয়ে এগিয়ে এলেই ঝাঁপিয়ে পড়বে-এই ক্ষণেরই অপেক্ষায় ছিল! একজন একটা কার্ড আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল-"ভাই এখানে আমার নাম্বার আছে। আপনার মত সাহসী লোক দরকার। প্লিজ সময় করে একটা ফোন দিবেন!" আরেকজন এসে করমর্দন করে বলে-"ভাই আপনার মত সাহসীরা পাশে থাকলে সব অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে,মানুষের অভাব হবে না!" সবাই আমাকে সাবাসি দিচ্ছে! যা আমাকে লজ্জায় ফেলে দিয়েছে। পুলিশ আসতেই দোষী লোকটাকে তাদের কাছে দেয়া হল। একজন নারী সার্জেন্ট মেয়েটার সাথে কথা বলে সবকিছু লিখে নিলেন।
আমি বাস থেকে নেমে হাঁটতে লাগলাম। আজ কয়েকমাস ধরে হেঁটে হেঁটে পায়ের নিচে চামড়া ছিলে গেছে। দুই বছর আগের কেনা স্যান্ডেলটার তলাও যেন ব্যথায় কাতরাচ্ছে! কত জায়গায় যে তালি পড়েছে সে হিসেব রাখিনি। ইদানীং হিসেব নিকেশ করতেও ইচ্ছে হয় না। মনে পড়ে ছোটবেলার কথা-স্কুল শিক্ষক বাবার বেতনে সংসারের হাল চালাতে মায়ের ভীষণ কষ্ট হত। এক একটা পয়সাও তিনি আমাকে নিয়ে হিসেব করতেন! তবু বাবা কষ্ট পাবে বলে মা মুখে কিছু বলতেন না। তিনি নিজে প্রায়ই না খেয়ে থাকতেন। দেখতাম আঁচলে বারবার চোখ মুছে নিতেন। কত রাত দেখেছি চাল পানি খেয়ে শুয়ে পড়েছেন। দশ বছরের এই আমি মায়ের কষ্টটা ভীষণভাবে অনুভব করতাম। মনে হয়েছিল মায়ের সব কষ্ট দূর করে দেই,প্রয়োজনে যুদ্ধ করব। কিন্তু এই অভাবের জন্য কে দায়ী? কার সাথে যুদ্ধ করে মায়ের মুখে হাসি ফুটাবো? মা প্রায়ই বলতেন- "বাবা মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল পাকিস্তান সরকারের অত্যাচার থেকে বাঁচার জন্য। আর আমাদের মত মানুষ কষ্টযুদ্ধ থেকে বাঁচতে চাইলে অনেক লেখাপড়া করতে হবে!" আমি সত্যিই অনেক লেখাপড়া করব এটা মনে গেঁথেই পড়াশুনা করেছি। কষ্টের সাথে যুদ্ধ করতে হবে। অভাব থেকে মুক্তি পেতে হবে।এসব নানা রকম ভাবনা আমাকে সেই ছোটবেলাতেই কুড়েকুড়ে খেত।
মনে পড়ে একদিন ক্লাসে "স্বাধীনতা দিবস" নিয়ে রচনা লিখতে দিয়েছে। কিন্তু বিষয়টি নিয়ে তেমন কিছু জানি না। তাই মাকে প্রশ্ন করলাম "আচ্ছা মা ২৬শে মার্চ স্বাধীনতা দিবস কেন?" সব কষ্ট লুকিয়ে রেখে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মা বলেছিল-
-"পাকিস্তানি সরকার বুঝে গিয়েছিল বাঙালি জাতিকে দমানো যাবে না। তাই তারা গোপন ষড়যন্ত্র করে। ২৫শে মার্চের গভীর রাতে 'অপারেশন সার্চলাইট ' নাম দিয়ে পাকিস্তানি সৈন্যরা নিরহ বাঙালিদেরকে হত্যা করা আরম্ভ করে! ওদের উদ্দেশ্য ছিল সমস্ত বাঙালির মনে মরার ভয় ঢুকিয়ে দেয়া। তাদেরকে দুর্বল করে দেয়া। যেসব বাঙালিরা পাকিস্তান সৈন্য হয়ে চাকরি করতেছিল। তাদের অনেককেই অস্ত্র নিয়ে ওদেরকে মেরে ফেলে। ছাত্র ও শিক্ষিত ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার এডভোকেট সবাইকে মেরে ফেলে! সারাদেশে নির্বিচারে সাধারণ মানুষ হত্যা করে। মায়ের বুকে ছোট্ট শিশু দুধ খাচ্ছে তাঁদের লাশ। কেউ কেউ ঘরে বসে ভাত খাচ্ছে! পাকসেনার গুলি এসে ওদের বুকটা ঝাঁঝরা করে দেয়।এই হত্যাযজ্ঞ থেকে শিশু বৃদ্ধ,কেউ রক্ষা পায় নি। সেদিন ঢাকা শহর মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়। যে দিকে চোখ যায় শুধু রক্তাক্ত লাশ আর লাশ। ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর গণহত্যা শুরুর পর মধ্যরাতে অর্থাৎ ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। নিজের বাসভবনে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাতে গ্রেফতারের আগমুহূর্তে দেওয়া সেই ঘোষণায়-বঙ্গবন্ধু শত্রুসেনাদের বিতাড়িত করতে বলেন! নিজেদের শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে যার যা আছে তাই নিয়ে লড়াই করার জন্য তিনি দেশবাসীকে ঝাঁপিয়ে পড়ার নির্দেশ দেন। দেশকে স্বাধীন করতে হবে। এই অত্যাচারী সরকারকে পূর্ব পাকিস্তান ছেড়ে যেতেই হবে। আর এটাই হবে লাল সবুজ পতাকায় ঘেরা আমাদের বাঙালির প্রাণের দেশ,বাংলাদেশ! ব্যস শুরু হয়ে গেলো যুদ্ধ!
সারা দেশ বিক্ষোভে ফুঁসে উঠে! দেশ আমাদের। দেশের মানুষ,মাটি, ফসল,শিক্ষা,শ্রম সব আমাদের। অথচ এই আমাদের জন্য কোন সুযোগ সুবিধা বা আমাদের নিজের মত করে কিছু করার ক্ষমতা নেই। সবকিছুই পাকিস্তান সরকার নির্ধারণ করে দেবে! এই অত্যাচার থেকে মুক্তি নিতে বাঙালিরা একযোগ হয়। তাঁদের সবার চাওয়া একটাই-''দেশকে পাকিস্তানি শত্রু থেকে মুক্ত করে বাংলার মানুষকে মুক্তি এনে দিতে হবে।'' আর এই বিশ্বাস নিয়েই দলে দলে বাঙালিরা রাস্তায় নেমে আসে। শুরু হয় নিরস্ত্র বাঙালির মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকার মুক্তিযুদ্ধ।"
মায়ের বলা কথাগুলো সেদিন খুব মনোযোগ দিয়ে শুনেছিলাম। "স্বাধীনতা দিবস" নিয়ে লিখে ক্লাসে প্রথম হয়েছিলাম। তারপর এক সময় বাবা মারা গেলে পুরো পরিবারের কষ্ট বেড়ে যায়। সেদিন মায়ের কষ্ট দূর করতে কাদের সাথে যুদ্ধ করব বুঝে পাইনি। ধীরে ধীরে বুঝে গেছি যুদ্ধ কাদের সাথে করতে হবে। যুদ্ধ করতে হবে নিজের সাথে,ভয়ের বিরুদ্ধে! স্বাধীন দেশের নাগরিক হয়েও সাহস হারিয়ে ফেলেছি! সাহস নেই অন্যায়ের প্রতিবাদ করার। সাহস নেই নিজের অধিকার বুঝে নেয়ার! "স্বাধীনতা দিবস" প্রতিবছর পালন করে শ্রদ্ধা জানাই বীর সৈনিকদের প্রতি। অথচ তাঁদের আত্মত্যাগের শিক্ষা নেই না! পুরো জাতি ভয়ে ভয়ে বেঁচে থাকি। মনে পাথর সমান বোঝা হয়ে আছে সবলের অত্যাচারে গুম,খুন,আর মৃত্যু ভয়! চলতি পথে বাঁধা! পানি পানে বাঁধা! খাবারে বাঁধা! এমন কী বিশুদ্ধ বাতাসে গভীর নিঃশ্বাস নিতেও বাঁধা! এত এত বাঁধার মাঝে আমাদের মুক্তি কোথায়? কোথায় সাধের স্বচ্ছন্দবোধ? সবকিছুতেই মৃত্যু আতঙ্ক। ভীরু মন নিয়ে দেহ টেনে চলছি। দায়িত্বে থাকা মানুষগুলো নৈতিকতার লেবাস পরে অনৈতিক কাজ করে যাচ্ছে! এই অন্যায় মেনে নিয়েই আমরা ধুঁকে ধুঁকে মরছি। এই বেঁচে থাকার নাম কীভাবে জীবন হয়?
আজ তিন বছর ধরে লেখাপড়া শেষ করেও একটা চাকরি পাচ্ছি না। পিয়ন থেকে শুরু করে অফিসার পদে আবেদন করছি। এই মুহূর্তে একটা চাকরি আমার চাই! এই দেশ স্বাধীন হয়েছে ঠিকই কিন্তু স্বাধীনতা কোথায়? এমন দেশ কি চেয়েছিল ত্রিশ লক্ষ শহিদ? তাঁদের কোরবানি এভাবে বৃথা যাবে? তাঁরা কী জানত একদিন এই দেশে আমার মত লেখাপড়া জানা মানুষ ভীরু কাপুরুষের মত সব অন্যায় মেনে নিয়ে চলবে? নাহঃ আর না। "স্বাধীনতা দিবস"-এর তাৎপর্য মেনে নিয়েই এবার শহিদের প্রতি সম্মান জানাবো! বাঁচলে অন্যায়ের প্রতিবাদ করেই বাঁচব। না হলে প্রতিবাদ করেই মরে মাটি হব।
রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে কথাগুলো ভাবছিলাম।আমার কেন যেন মনে হয় দেশের প্রতিটা মানুষ আমার মত করে কেবল ভাবে! 'উফঃ সবাই যেন আমার মত এমনটা ভেবে ভেবেই সবকিছু উদ্ধার করে দেবে!' আমার মনে হয় সবাই নিজের উপর নিজেই আখুটি করে যায়! কার্যত কিছুই করা হয় না। এসব ভাবতে ভাবতে হাঁটছি। এমন সময় ফোনটা বেজে উঠলো। ফোন কানে লাগিয়ে বললাম-
-হ্যালো কে বলছেন?
-জ্বী আপনি কী আজমল হোসেন?
-জ্বী কে বলছেন?
-আপনি আজ ইন্টার্ভিউ দিয়ে গেছেন আমাদের অফিসে।
-আচ্ছা...। তো ফোন দিয়েছেন কেন?
- এই পোষ্টের জন্য আপনি যোগ্য। আমরা চাইছি আপনি আমাদের অফিসে জয়েন করেন।
কথাটা শুনে আমার আনন্দে চিৎকার দিতে ইচ্ছে হল। মা ভাই বোন সবার হাসি মাখা মুখটা মুহূর্তেই চোখের সামনে ভেসে উঠলো! কিন্তু পরমুহুর্তেই সব খুশি কর্পূরের মত উড়ে গেলো...। ফোনের অপর প্রান্ত থেকে ভেসে এলো-
-কিন্তু আপনাকে পাঁচ লক্ষ টাকা ডিপোজিট হিসাবে দিতে হবে।
হঠাৎ আমার চোখের দৃশ্যপট পরিবর্তিত হল-আমি দেখতে পেলাম বাসের সেই লোকটার মত ফোনের অপর প্রান্তের লোকটা যেন মিটি মিটি হেঁসেই কথা বলছে! আমার চারদিকের মানুষগুলোও আমাকে দেখে অট্টহাসি হাসছে! নিজেকে জোকার মনে হচ্ছে! আমি এবার বেশ জোরে শব্দ করেই বলে উঠলাম-
-কীসের ডিপোজিট? আর বলছেন আমি এই পোষ্টের জন্য যোগ্য। তাহলে পাঁচ লক্ষ টাকা কেন লাগবে?
-আসলে আমাদের অফিসের এইটাই পলিসি...
-আরে ভাই সাহস থাকলে বলেন না যে ঘুষ খাওয়ার জন্য পাঁচ লক্ষ টাকা দিতে হবে। মিষ্টি খাবার জন্য পাঁচ সাত হাজার টাকা চান,ধারদেনা করে বা বিধবা মায়ের নাকফুল বিক্রি করে এনে দিতে পারব। পাঁচ লক্ষ টাকা থাকলে মাসিক দশ হাজার টাকা বেতনের চাকুরী কেন করব? ঐ টাকা দিয়ে গ্রামে গিয়ে পুকুর কেটে মাছের চাষ করব। সবজি বাগান করব। সেইসব বিক্রি করে বছরে এক লাখ টাকা কামাবো। ফাজলামো পাইছেন না?
-ভাই আমি আপনার উপকার করতে চাইলাম আর আপনি...
-রাখেন মিয়া আপানর উপকার...! আপনি তো আমার মত মধ্যবিত্ত পরিবারকে সাগর থেকে তুলে মহাসাগরে ফেলতে চাইছেন। এই আপনারাই ধারদেনা করে হলেও আমাকে পাঁচ লক্ষ টাকা দিতে বাধ্য করছেন। আবার এই ধারদেনা শোধ করতে আমাকেই আমার সুশিক্ষার বিরুদ্ধে গিয়ে ঘুষ খেতে বাধ্য করছেন। নিজেরা যেমন নিজেদের নৈতিকতা গিলে খেয়েছেন। তেমনি আমাকেও গিলে খাবার রাস্তা দেখিয়ে দিচ্ছেন। মিয়া আপনার উপকার আপনার কাছে রাখেন। ঘুষের টাকায় ছেলে মেয়েকে ফাঁস হওয়া প্রশ্ন কিনে শিক্ষা দেবেন;ফরমালিন যুক্ত খাদ্য খাওয়াবেন। মিয়া নিজের সন্তানেরই তো ভালো করতে পারেন না। আপনি আমার কী ভালো করবেন...? রাখেন আপনার "ম্যা ম্যা!" কথা শেষ করেই ফোনটা কেটে দিলাম।শেষে লোকটা বলার মত কথা খুঁজে পায়নি। কথার মত ধারালো অস্ত্র আর নেই! মানুষ চড় খেলে তার ব্যথা ভুলে যায়। কিন্তু কথা! কথা কানে বাজতেই থাকে। মোক্ষম সময়ে একবারের জন্য হলেও সেই কথাগুলো মানুষকে ভাবায়। এই লোকও ভাববে।
"মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি" ভুলেই গিয়েছিলাম এটা মার্চ মাস। পাশের কোন দোকানে বেজে চলেছে গানটা! একেবারে বুকের ভীতরে যেয়ে লাগল। কয়েকদিন পরেই "স্বাধীনতা দিবস"! ১৯৭১ সালে দীর্ঘ ৯ মাস মুক্তিযুদ্ধ করে একদিকে যেমন রচিত হয়েছে ইতিহাসের মহীয়ান অধ্যায় মুক্তিকামী বাংলার মানুষের বীরত্বগাথা;তেমনি আরেকদিকে জন্ম নিয়েছে হানাদার বাহিনীর নির্বিচার হত্যা,গণহত্যা,ধর্ষণ ও লুটতরাজের এক নজিরবিহীন কলঙ্কিত অধ্যায়! একাত্তরের ১৬-ই ডিসেম্বর ঢাকায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণের মাধ্যমে বাঙালির চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত হয়েছে। ৩০ লাখ মানুষের রক্ত আর দুই লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে বিশ্ব মানচিত্রে আমাদের গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ নামের স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্রের আত্মপ্রকাশ ঘটেছে। এসব কিছু আমরা ভুলে গেছি। ভুলে গেছি বলেই হয়ত আজ আটচল্লিশ বছরেও সত্যিকার স্বাধীনতার সুখাদর থেকে আমরা বঞ্চিত! আমরা আজও লাল সবুজ পতাকা তলে নিজেদের দেশের স্বার্থপরায়ণ কিছু মানুষের কারণে মাথা উঁচু করে রাখতে ব্যর্থ! এখন যে আর দেহটাকে বয়ে নিয়ে চলতে ইচ্ছে হয় না! দিনে দিনে হতাশা আত্মবিশ্বাসকে নিভিয়ে দিচ্ছে।দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে। এসব ভাবতে ভাবতে চোয়াল শক্ত হয়। ব্যস আর নয়...। আমি আমার অধিকার চাই!
"কারার ঐ লৌহকপাট,ভেঙ্গে ফেল, কর রে লোপাট..." গানটা কানে আসতেই নিজেরই অজান্তে আমার হাত মুষ্টিবদ্ধ হয়ে যায়! মনে হল জীবনে এই প্রথম অনেক প্রশান্তি পেলাম। মনে হল এই আমি নিজেকে এতদিন দাবিয়ে রেখেছিলাম নিজের ভীতরেই...! উফঃ এক নাগাড়ে এতোগুলো কথা বলে,এত কিছু ভেবে ভেবে আমি হাঁপিয়ে গেছি। অবাক হলাম ভেবে-'আজ আমার এতো সাহস কোথা থেকে এলো? আমি নিজে ওতো সব সময় গা বাঁচিয়ে চলেছি! আর চলেছি বলেই আজ চারদিকে শুধুই অন্যায় অনাচার দেখছি। প্রথমেই যদি আমাদের বাপ চাচারা এই অন্যায়কে বাঁধা দিত,তাহলে আজ এই দিন দেখতে হত না। 'যার যার পরিবার ভালো আছে।'-এই কথা ভেবেই সবাই শান্তি খুঁজে নিয়েছে। আর তরতর করে জোয়ারের মত ভাসিয়ে নিয়ে গেছে দুর্বলের প্রতি সবলের ক্ষমতার দাপটে অন্যায়ের স্রোত! অন্যায় সয়ে সবাই অন্যায়কে বাড়তে দিয়েছে। আজ যে ভয়াবহ অবস্থা হয়েছে তার জন্য দায়ী বাপ চাচাসহ এই আমরাই। দয়া মায়া,মমতা,ভালোবাসা,কোথাও নেই। নেই একটুও শান্তি...! মারামারি,খুন,ধর্ষণ,অন্যেরটা মেরে খাওয়া,খাবারে ভ্যাজাল-এসব এখন সবার সহ্য হয়ে যাচ্ছে! কেউ ভাবছে না আমাদের সন্তানের জন্য কী ভয়াবহ একটা অন্ধকারের পথ রেখে যাচ্ছি!'
কিন্তু এই মুহূর্তে আমার অনেক ভালো লাগছে। ভালো লাগছে ভেবে এই আমি সাহস দেখিয়ে অন্ততঃ দুটো অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে পেরেছি! যদি সবাই প্রতিদিন একটা অন্যায়ের প্রতিবাদ করত! তাহলে ধীরে ধীরে অন্যায় কমে যেত। 'যদি বাঁচতেই হয় অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেই বাঁচব। তবু অন্যায়কে মেনে নেব না!' কথাটা ভাবতেও আজ মনের মাঝে চেপে থাকা পাথরটা অনেকখানি হালকা মনে হচ্ছে। যে অন্ধকারে হাবুডুবু খেয়ে ডুবে যাচ্ছিলাম। আজ সেই অন্ধকারের জায়গাটা আলোকিত মনে হচ্ছে! মনে পড়ে একবার খাতায় নিজেই দুটো লাইন লিখেছিলাম-'গভীর অন্ধকারেও একবিন্দু আলো,জানিয়ে দেয় তাঁর অস্তিত্ব-অন্ধকারকে গিলে খেয়ে একদিন সেই আলো হয় পরিব্যাপ্ত...!' মেঘ দেখে কেউ করিস নে ভয়, আড়ালে তার সূর্য হাসে!" যথার্থ কথাটা মনে পড়ে গেলো। সূর্যের হাসি আনতেই হবে। আর তাঁর জন্য দরকার সাহস এবং সঙ্ঘবদ্ধ হয়ে কাজ করা। সবাইকেই অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে।
আগামীকাল আরও একটা ইন্টার্ভিউ আছে। খুব গোপনে মোবাইলটাতে সবকিছু রেকর্ড করতে হবে।ডান হাতদিয়ে বাম পাশের বুকপকেটে রাখা ভিজিটিং কার্ডটার অস্তিত্ব অনুভব করলাম। বীরত্ব দেখিয়ে অস্ত্রে সস্ত্রে সজ্জিত পাকিস্তানিদের সাথে যুদ্ধ করে জয়ী হতে পারলে; নিজের দেশের কিছু মানুষের অন্যায়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে কেন জয়ী হতে পারব না! যেভাবেই হোক জয়ী হয়ে"স্বাধীনতা দিবস"এর মান রক্ষা করব! বড় করে শ্বাস টেনে বেশ খানিকটা বাতাস বুকের ভীতরে ঢুকিয়ে নিলাম। মাথা উঁচু করে বাসার দিকে হাঁটতে লাগলাম...।
আজ “স্বাধীনতা দিবস"! সারা দেশের মানুষ শহিদ মিনারে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা ও শুভেচ্ছা জানাচ্ছে। দেশাত্মবোধক গানের সাথে সাথে ভেসে আসছে বঙ্গবন্ধুর ৭-ই মার্চের আগুন ঝরা ঐতিহাসিক ভাষণ। আহ্লাদ আর মুক্তির উত্সবে চাপা পড়ে গেছে এক অভাগি মায়ের আর্তচিৎকার! যার ছেলে জীবনে প্রথম প্রতিবাদ করেছিল কোন এক অফিস কর্মকর্তার বিবেককে জাগাতে! যে ভুলে গিয়েছিল এ দেশে বিষের দামের চেয়েও জীবনের দাম কম। বিষ খেয়ে হজম করতে পারলেও কিন্তু প্রতিবাদের ভাষা হজম করতে পারে না। মা তাঁর ছেলের খোঁজ পাচ্ছে না কয়েকদিন ধরে। ওদিকে বালির স্তূপের ভীতরে এক যুবকের লাশ পাওয়া গেছে। যার পায়ের স্যান্ডেলের তলায় বেশ কয়েকটি ফোঁকর। যা চিৎকার করে বলছে- 'এই যে খুব ভালো করে দেখে নাও সবাই-এইটাই আমাদের আগামী প্রজন্মের ভাগ্যের প্রতিচ্ছবি।'
লেখার সাথে বিষয়ের সামঞ্জস্যতা
ব্যাখ্যায় লেখকের বক্তব্য
৩০ লাখ মানুষের রক্ত আর দুই লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে বিশ্ব মানচিত্রে আমাদের গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ নামের স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্রের আত্মপ্রকাশ ঘটেছে। এসব কিছু আমরা ভুলে গেছি। ভুলে গেছি বলেই হয়ত আজ আটচল্লিশ বছরেও সত্যিকার স্বাধীনতার সুখাদর থেকে আমরা বঞ্চিত! আমরা আজও লাল সবুজ পতাকা তলে নিজেদের দেশের স্বার্থপরায়ণ কিছু মানুষের কারণে মাথা উঁচু করে রাখতে ব্যর্থ! এখন যে আর দেহটাকে বয়ে নিয়ে চলতে ইচ্ছে হয় না! দিনে দিনে হতাশা আত্মবিশ্বাসকে নিভিয়ে দিচ্ছে। পিঠ ঠেকিয়ে দিচ্ছে দেয়ালে! বাঁচার শেষ ইচ্ছেই যখন অধিকার আদায়ে মাথাটা উঁচু করা হয়! তখনই নেমে আসে অন্তিম মুক্তির দিন। মায়ের কান্না থামে না।
২৭ মে - ২০১১
গল্প/কবিতা:
১২০ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ ডিসেম্বর,২০২৪