অদৃশ্য অবান্তর

কি যেন একটা (জানুয়ারী ২০১৭)

সেলিনা ইসলাম
  • ১১
এক

সবুজ ঘাসের উপর চুপ করে বসে থাকতে রাশেদার বেশ ভালোই লাগছে। চারিদিক অন্ধকার করে আসছে। সূর্যটা ডুবে গেছে অথচ তার ঘরে ফিরতে মন চায়ছে না । খালের পারে বসে বসে হিসাব মেলাতে পারে না। এই খালকে ঘিরে মনে পড়ে হাজারো স্মৃতি। তখন জীবনটাই ছিল অন্যরকম। বাবা প্রতিদিন রাশেদাকে সাথে নিয়ে এসে এই খালের পারে বসে থাকত। বলত - "রাশু দেখেছিস মা,কী সুন্দর মিষ্টি বাতাস? গভীরভাবে নিঃশ্বাস নে মা। দেখবি মনটা একেবারে হাওয়াই মিঠার মত ফুরফুরা হয়ে যাবে!" সেই সময়ে সত্যি সত্যি বাবার কথা বিশ্বাস করে রাশু জোরে নিঃশ্বাস টেনে নিত। মনটা তখন ফুরফুরা হত কিনা সে বুঝে উঠতে পারেনি। তবুও সে কাজটা করে মজা পেত! কিন্তু আজ সে অনেক চেষ্টা করেও গভীরভাবে নিঃশ্বাস নিতে পারছে না। কেবল দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে বুকটাকে ভারী করে তুলছে! সে বুঝে উঠতে পারছে না তাঁর ভীতরে আসলে কী যেন একটা হচ্ছে! জীবনের হিশেব নিকেশ মেলাতে ভাবনার অতলে তলিয়ে যায় সে।

আজ বারবার নিজেকেই গালি দিতে ইচ্ছে হচ্ছে! জীবনে কী করে এতবড় ভুল হল!? কেন একবারও বুঝতে পারিনি আমার জীবনে যা কিছু ঘটছে তা আসলে কোন দুর্ঘটনা নয়! সবই পরিকল্পিতভাবে ঘটানো হচ্ছে। কথাগুলো মনে হতেই কোলের উপর টুপ টুপ করে ঝরে পড়ে ফোঁটা ফোঁটা পানি। আজ এই জীবনের জন্য নিজেকেই বারবার দায়ী মনে হয়। কত সুখের সংসার ছিল। অথচ সামান্য একটা কথা,আজ ভুলের কাঁটা হয়ে সবকিছু তছনছ করে দিয়েছে। এই ভুলের প্রায়শ্চিত্ত আমাকে আজীবন করে যেতে হবে।

মনে পড়ে স্বামী তোফায়েল মারা গেলে কীভাবে সে এক মেয়ে আর এক ছেলেকে মানুষ করেছে। পরমুহুর্তেই থমকে যায় "মানুষ...! সত্যিই কি ওদেরকে মানুষ করতে পেরেছে...? যদি ওরা মানুষ হবে তাহলে কেন আজ এইদিন দেখতে হচ্ছে?" চাপচাপ দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে আসে। একদিন নিজের চারিদিকে যেমন ছিল সুখের ছায়া? আজ সেখানে অশুভ বাতাস ঘিরে ধরেছে! জীবনে একটু সুখ আর সচ্ছলতা চাওয়াটাই আজ জীবনে ভয়াবহ কাল হয়ে গেছে। বারবার মনে হচ্ছে এই গ্রামই আমার জন্য ভালো ছিল! সে ভুল করেছে শহরের হাওয়ায় ছেলেমেয়েকে নিয়ে মানুষ করতে গিয়ে। এই গ্রাম এই খাল এই শনের ঘর এসবে সচ্ছলতা ছিল না ঠিকই! কিন্তু ছিল এক তৃপ্তিময় সুখ। আমি লোভ করেছি! আর সেই লোভের আগুনে আজ সব পুড়ে ছারখার হয়ে গেছে...! দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ধীরে ধীরে মনে পড়ে সব ঘটনা...

দুই

একদিন ছেলে ভিকি একটা মেয়েকে সাথে করে বাসায় আনে। উচ্ছ্বসিত হয়ে বলে-
-"মা তোমাকে বলেছিলাম না সেঁজুতির কথা? ঐ যে আমার বান্ধবী...যার বাবার অনেকগুলো গার্মেন্টস ব্যবসা আছে আর...।" রাশেদা ছেলেকে আর কিছুই বলার সুযোগ না দিয়ে সেঁজুতিকে বসতে বলে। মেয়েটার পা থেকে মাথা পর্যন্ত বেশ কয়েকবার দেখে নেয়। মনের ভীতরে কে যেন একটা ধড়াম ধড়াম হাতুড়ী পিটাচ্ছে। আর বলছে-"না রে রাশু এই মেয়ে তোর ছেলেকে সুখী করতে পারবে না! এই মেয়ে তোর ছেলের জন্য নয়।" একটা অস্বস্তি ওর সারা শরীরে কিলবিল করে ঘুরে এসে কপালে ঘাম ঝরাতে লাগলো। কিন্তু সেই সময়ে সে কিছুই বলল না। সেঁজুতি চলে গেলে যখন ভিকিকে রাশু বলল "মেয়েটার সাথে বেশি ঘনিষ্ট হইও না বাবা...!" ব্যস ভিকি একেবারে অগ্নিমূর্তি ধারণ করল। জীবনে এই প্রথম মাকে যা মুখে এলো তাই বলল-"মা আমি আগেও বলেছি তোমার পছন্দ করা মেয়ে আমি বিয়ে করব না। আবারও বলছি। আমি যদি বিয়ে করি সেঁজুতিকেই করব !" রাশেদাও কম যায় না। সেও আজ রেগে গিয়ে নিজের সিদ্ধান্ত জানায়-"ঐ মেয়ের বাবা একজন অসৎ মানুষ। সে গরীবের টাকা মেরে এত ধনী হয়েছে। আর এই মেয়ের পোশাক চালচলনও আমাদের পরিবারের মেয়েদের মত না। এই মেয়ে ঘরে আনলে ঘরের মেয়েই ওর মত হয়ে যাবে। বান্ধবী আছে ভালো কথা কিন্তু বিয়ে করলে আমি তোঁর সাথে থাকব না।" ভিকি মায়ের চোখে চোখ রেখে বলে
-"এই ঘরের মেয়ে কী হবে বা হবে না এই চিন্তা করে আমি আমার ভালবাসার বলিদান দিতে পারব না মা।"
-"আমি কী বলেছি বলিদান দিতে? বিধবা মা যে কিনা এত কষ্ট করে ছেলেকে বড় করেছে? তার ভালবাসার মূল্য ছেলের কাছে কিছুই না!"
-তুমি কী বলতে চায়ছো? আমার পিছনে যত অর্থ খরচ করেছ তা এখন সুদে আসলে তোমাকে দিয়ে দিতে হবে!?" ছেলের এমন কথার পরে আর কিছু বলতে পারল না রাশেদা। বুকে চাপচাপ ব্যথা করছে। মাথা ঘুরছে...! মনে হচ্ছে সে পড়ে যাবে। পাশে থাকা চেয়ারটাতে অনেক কষ্টে বসে পড়ে। ভিকি কী বুঝল মায়ের এই ব্যবহারে তা ঠিক বুঝা গেল না। ওকে ক্যামন যেন অস্থির লাগল। খুব আস্তে করে বলল- "ঠিক আছে তোমার যদি সেঁজুতিকে এতই অপছন্দ হয়? তাহলে আমি ওকে নিয়ে আলাদা থাকব!"

রাশেদা আর কিছুই বলতে পারেনি। এই ঘটনার তিনদিন পরে এক বিকেলে ভিকি সেঁজুতিকে এনে ঘরে তুলল। ভিকি সেঁজুতিকে বলল মাকে সালাম করতে। আর বলল-"সেঁজুতি আমাকে তোমার কিছুই দিতে হবে না। যদি পার আমার মায়ের মনটাকে জয় করে দেখাও!" সেদিনও রাশেদা কিছুই বলেনি। শক্ত পাঁথরের মত হয়ে গেছে ছেলের এই কাজ দেখে। সেঁজুতিকে আজ শাড়িতে একেবারেই অন্যরকম লাগছে! ছেলের কথা ভেবে সেদিন ছেলে বউকে সে মেনে নিয়েছিল। রাশেদার খুব ইচ্ছে ছিল আগে মেয়ে বিনুকে বিয়ে দেবে তারপর ঘরে ছেলে বউ আনবে। মেয়েটা আজকাল যেভাবে শহরে একা একা ঘুরে বেড়াচ্ছে? ভয় হয় আবার না কিছু ঘটে যায়। একদিন তো কলেজ থেকে ফিরে মাকে জড়িয়ে ধরে তার সেকি কাঁপন! রাশেদারও অজানা ভয়ে মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গিয়েছিল। বিনু বলে
-"মা একটা গুণ্ডা ছেলে মোটর বাইকে করে বেশ কিছুদিন ধরে আমাকে ফলো করছিল! আজ আমার পিছন পিছন
এসে বাড়ী চিনে গেছে!" রাশেদা কী করবে বুঝতে পারেনি। ওর শুধু মনের মাঝে একটা কথাই তোলপাড় করছিল"মেয়েটাকে আবার এসিড মেরে চেহারা নষ্ট করে দেবে নাতো!?" চারিদিকে খুন ধর্ষণ আর শ্লীলতা হানীর খবর। টিভির খবরে বা খবরের কাগজের পাতায় এই একটা খবর ইদানীং মেয়েদের বাবা মায়ের ঘুম হারাম করে দিয়েছে! মেয়েকে কোন রকম সান্ত্বনা দিয়ে সাহস দেয়। বলে- ও সব বখাটে ছেলে কিছুই করতে পারবে না। আজ ভিকি বাসায় এলে সবকিছু বলিস। ও নিশ্চয় বুঝে শুনে একটা ব্যবস্থা নেবে।

কিন্তু ঘটনার কথাটা আর ভিকির কান পর্যন্ত দেয়া হয়নি। কেন যেন মনে হয়েছিল হয়ত ওকে বললে বেশি ঝামেলা হবে। আজকালকার ছেলেদের বুদ্ধি শুদ্ধি কমে গেছে। তাদের আছে শুধু রাগ। দেখা গেল রেগেমেগে একটা অঘটন ঘটিয়ে ফেলেছে। আর তাই রাশেদা সিদ্ধান্ত নেয় মেয়েকে একটা ভালো ছেলে দেখে ভিকির আগেই বিয়ে দিয়ে দেবে। কিন্তু সব উল্টো হয়ে গেল।"ছেলেমেয়ে বড় হয়ে গেলে আসলে নিজের মন মত করে কিছুই করা হয় না!"

তিন

সেঁজুতি শাশুড়িকে খুব সেবা করতে লাগল। তাঁর হাত থেকে কাজ কেড়ে নিয়ে কাজ করে। পানি গরম করে বালতিতে ঢেলে দিয়ে বলবে- "মা গোসল করে নিন। খবরদার কাপড় কিন্তু আপনি ধুবেন না। ঐটা আমি ধুয়ে দেব। আপনার আবার কোমর ব্যথা করবে!" রাশেদা নিজেকে ধিক্কার দেয় সেদিনের সেই ঝগড়ার জন্য। ছেলেকে অভাবে না বললেও সে পারত। প্রথম একমাসেই সেঁজুতিকে মনের মত বউ মনে হল। মনে মনে সে ভাবে "যে জমানা পড়েছে হয়ত এর চেয়ে ভালো মেয়ে সে তার ছেলের জন্য খুঁজেও পেত না।" এবার সময় সুযোগ বুঝে একদিন রাশেদা ভিকিকে বিনুর জন্য ছেলে দেখার কথা বলে। কিন্তু ওর কথা শেষ না হতেই সেঁজুতি বিনুর জন্য ছেলে দেখার দায়িত্ব নিয়ে নেয়। আনন্দ নিয়েই বলে -"মা ননদ বলেন আর বোন,বিনু তো আমার আপনজন তাই না? ওর জন্য ছেলে আমি নিজেই দেখব। সত্যি বলতে খুব ভালো একটা ছেলেকে আমি জানি। যে বিনুকে অনেক সুখে রাখবে!" মা বা স্ত্রী কারো কথায় ভিকি কিছুই বলে না। রাশেদার কেন যেন মনে হয় ভিকির মন ভালো নেই। কিন্তু ছেলেকে জিজ্ঞাসা করবে? না সেঁজুতিকে? ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না।

ছেলেটা ইদানীং ওর সাখে খুব একটা কথা বলে না। কাছে গিয়ে বসলেও উঠে চলে যায়। মা হয়ে সে ছেলেকে আর আগের মত কাছে পাচ্ছে না! এটা ছেলে বউয়ের নজরে পড়ুক তা সে চায়ছে না। ছেলেকে সে ছোট বেলা থেকেই জানে। সামান্য মন খারাপ হলেও তার সব অভিমান মায়ের উপর। কিন্তু বোনের উপর তার কোন অভিমান নেই। সেই ছোট বেলা থেকেই দুই ভাইবোন বন্ধুর মত খাবার থেকে শুরু করে কথা পর্যন্ত শেয়ার করে আসছে। দুজনের পেটে এমন কোন কথা মনে হয় নেই,যা দুইজনের কেউ জানে না। রাশেদা জানে বিনু মাঝে মাঝে ভাইকে নিয়ে গর্ব করে। প্রায়ই বলে-"মা এই যে ভাই সেঁজুতিকে বিয়ে করেছে না? এই কথাটাও কিন্তু আমি জানতাম। হিহিহি
রাশেদা রাগ দেখায়- পাজি মেয়ে তুই জানিস তাহলে আমাকে কেন আগে বলিস নি?
-তোমাকে বললে কী হত শুনি? আমি তো তোমাকে চিনি। যতই মেয়ে অপছন্দ কর না কেন ভাইয়া বউ করলে তুমি একেবারে চুপ হয়ে যাবে হা হা হা।
-থাক থাক এখন আর হি হি হা হা করতে হবে না। ভাবির জ্বালা তো কখনো দেখনি! যখন দেখবে তখন বুঝবে কেন ভাইয়ের আগে তোমাকে বিয়ে দিতে চেয়েছিলাম!
-বঙ্গজননী তুমি টেনশন নিও না। ভাবি সেরকম কিছুই কোনদিন করতে পারবে না। সে যখন জানবে ননদীকে তার ভাই খুব ভালবাসে! তখন সেও আমচুর হয়ে ননদীকে ভালবেসে যাবে। আর কে বলেছে তোমাকে যে,আমি বিয়ে করে এই বাড়ী ছাড়ছি!?
রাশেদার চোখ জলে ভরে আসে। মনে মনে বলে"মা রে যত যাই হোক না কেন মেয়ে বড় হলে তাকে যে বাবার বাড়ী ছাড়তেই হয়! স্বামীর বাড়িই হয় তার নিজের বাড়ী!"দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে চুপ করে থাকে সে।

চার
একদিন বিনুকে নিয়ে সেঁজুতি বাইরে যায়। বিনুকে একটা ছেলের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়।
-বিনু এই হচ্ছে আবিদ। আমার খুব ভালো বন্ধু। তোমাকে সে খুব পছন্দ করে...!
বিনু ছেলেটার দিকে তাকাতেই ওর সমস্ত শরীর ঠাণ্ডা হয়ে আসে। মনে মনে চমকে যায়-"আরে এই তো সেই ছেলেটা যে ওকে প্রতিদিন মোটর বাইকে ফলো করে!"সেঁজুতি বিনুর থেকে দুই বছরের বড়। কিন্তু বিনুর সাথে এমনভাবে কথা বলে মনে হবে বিনু বড়। নাকি ভাষায় আহ্লাদে আহ্লাদে কথা বলে। বিনু আবিদকে দেখে কিছুই বললো না। ছেলেটাকে তার একটুও পছন্দ নয়। ব্যপারটা হয়ত সেঁজুতি বুঝতে পেরেছে। আর তাই বিনুকে একেবারে জড়িয়ে ধরে বলে"আচ্ছা বিনু তুমি কী চাওনা একটা সুন্দর সচ্ছল জীবন যাপন করতে?" অবাক হয়ে বিনু তাকায় সেঁজুতির দিকে! সেঁজুতি আবার বলে যায়- "তুমি কী জানো আবিদের বাবার কী পরিমাণ টাকা আছে? তোমার ধারণাও নেই আবিদের বাবার পাওয়ার সম্পর্কে!"
-"ভাবি তুমি আমার ভাবি,না আবিদের?" বিনু কথাটা বলতেই সেঁজুতি চমকে উঠে। বলে-"অফকোর্স হানি আমি তোমার ভাবি। এই জন্য তো তোমার ভালো চাই,তুমি সুখী হও..."
-"কে বলল আমি আবিদকে বিয়ে করলে সুখী হব! আমার এত পাওয়ার,অর্থ কিছু লাগবে না। প্লিজ তুমি আমাকে বাসায় নিয়ে চল। না হলে আমি একাই..."
-"এমন করছ কেন তুমি স্যুইট হার্ট?"আবিদ কথাগুলো কেমন জড়িয়ে জড়িয়ে বলে। "নিশ্চয় নেশা করেছে ছেলেটা" কথাটা মনে মনে বলে বিনু। ছেলেটা একেবারে বিনুর গায়ের সাথে ঘেঁষে এসে দাঁড়িয়েছে! কেমন একটা ভয় ওর শিরদাঁড়া বেয়ে নীচে নেমে যাচ্ছে।
-"শোন সেজু তোর ননদ আমার একহাতে দিবি আর একহাতে আমি তোকে দেব বিএমডাব্লুউ'র চাবি। যত তাড়াতাড়ি করবি তত তাড়াতাড়ি গাড়ি তোর!" কথাটা বলতে বলতে একেবারে বিনুর মুখের কাছে নিজের মুখ আনে আবিদ। ভু ভু করে ওর গরম নিঃশ্বাসের সাথে এলকোহলের গন্ধ এসে বিনুর নাকে লাগে। সে গন্ধে পেটের ভীতর মোচড় দিয়ে বমি আসে। বহু কষ্টে নিজেকে ধরে রাখে। বিনু আর কিছু না বলে হনহন করে হেঁটে আসে রাস্তায়।

ওদিকে আবিদের লোভনীয় প্রস্তাবে চকচক করে উঠে সেঁজুতির চোখ। সে আবিদকে কথা দেয় খুব শীঘ্রই বিনুকে তার হাতে তুলে দেবে। "আমি যা বলব তাই হবে আমার সংসারে!" কথাটা বলে আশ্বাস দেয়। আবিদ একটা টাকার বান্ডিল সেঁজুতিকে দিয়ে বলে- "শোন শালি,মাছরে খেলায়য়া ধরার মাঝে বেজায় আনন্দ আছে। তোর ননদরে নজরে নজরে রাখছি বছর হইয়া গেছে। ওরে আমার চাই। তোর এইসব বন্ধু বন্ধু খেলা খেলনে আমার মন গলবো না! বেশি তেরিবেরি করবি তোর ননদ রাইখা তোরে তুইলা নিয়া যামু,মাইন্ড ইট!" কথাটা বলেই মোটর বাইকে শাঁ করে বেরিয়ে যায়। সেঁজুতি এতক্ষণ যেন দম বন্ধ করে আবিদের সব কথা শুনছিল। সে চলে যেতেই ফুঁস করে নিঃশ্বাস নিয়ে বলে-"কী ভয়ঙ্কর জানোয়ার!" বলেই হাতের টাকায় চুমু খেয়ে ব্যাগে রাখে।

পাঁচ

আজ রান্না ঘরে রান্না করতে করতে রাশেদা নিজের সাথে অনেক কথা বিনিময় করে। সিদ্ধান্ত নেয় সেঁজুতিকেই জিজ্ঞাসা করবে-"ভিকির মন কেন খারাপ?" সে অপেক্ষা করে সেঁজুতি কখন রান্নাঘরে আসবে। একে একে রান্নাগুলো সব করে ফেলে। কিন্তু তবুও সেঁজুতির রান্না ঘরে দেখা নেই। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে ভিকি আসার সময় হয়ে গেছে। "নাহ আজ গোসলও করা হল না!" ঠিক তখনই কলিং বেলের শব্দ...! সেঁজুতি নিজের ঘর থেকে ছুটে বের হয়ে দরজা খুলে দেয়। ভিকিকে দেখেই কোমরে পেঁচানো শাড়ি খুলে কপালের ঘাম মুছে। সেঁজুতিকে উদ্দেশ্য করে ভিকি বলে-"এই গরমে রান্না ঘরে একটু কম গেলে হয় না? আইটেম কয়েকটা কম রান্না করলে না খেয়ে কেউ মরে যাব না!" সেঁজুতি স্বামীর কথা শুনে আদুরে গলায় বলে-" কী যে বল না স্যুইটহার্ট...মা চারপদের তরকারি ছাড়া ভাতই খায় না! এটা নাকি উনার ছোট বেলা থেকে অভ্যেস হয়ে গেছে!"ভিকি কিছু একটা বলতে গিয়েও থেমে যায়। এমনিতে অফিসের কাজে মন খারাপ। আর অযথা কথা বলতে ইচ্ছে হয় না।

রাশেদা ছেলের কণ্ঠ শুনে রান্না ঘর থেকে খাবারের বাটিগুলো ট্রেতে করে এনে টেবিলে রাখে। আর তা দেখে সেঁজুতি হাঁয় হাঁয় করতে করতে ছুটে যায় -"মা কতবার বলেছি আপনি এসব কিছুই করবেন না! নাহ আপনি কোন কথাই শুনতে চান না। দেন আমাকে দেন" ট্রেটা হাত থেকে এক রকম কেড়েই নিয়ে যায়। রাশেদা দেখে ভিকি মুখভার করে বসে আছে। "ছেলের অফিসে কী কিছু হল!" কথাটা মনে করে মনটা কিছুতেই ভালো লাগে না। "মা আপনি যান হাতমুখ ধুয়ে আসেন তারপর একসাথে খাই!" সেঁজুতির কথায় আঁতকে উঠে বলে রাশেদা-"আমি তো এখনও গোসল..."কথা শেষ হতে দেয় না। সেঁজুতি বলে-
- "কী যে করেন না মা? সেই কখন থেকে বলছি যান গোসল করে নেন!" রাশেদা ভেবে পায়না সেঁজুতি তাকে কখন গোসল করতে বলেছে!? টেবিলে সব কিছু দেয়া হয়েছে কিনা দেখে নেয়। তারপর রান্না ঘরে গিয়ে লেবু কেটে আনে। সেঁজুতি আবার ওর হাত থেকে লেবুর প্রিচটা কেড়ে নেয় - "কী যে ভুলো মন হয়েছে আমার! লেবু কেটে রেখে এসেছি অথচ টেবিলে দিতে ভুলে গেছি! যান মা বাথরুমে পানি রেখেছি গোসল করে আসেন!" রাশেদা আর কিছু না বলে বাথরুমে যেতে যেতে ভাবে-কী হচ্ছে এসব? সেঁজুতি আজ এমন করছে কেন? বাথরুমে গিয়ে দেখে বালতিতে কোন পানি নেই। এখন বাইরে থেকে বালতি ভরে পানি আনতে হবে। যে ঠান্ডা পড়েছে তাতে গরম পানিও মিলাতে হবে। কিন্তু ওর ইচ্ছে হচ্ছে না পানি বয়ে আনতে। অনেক কষ্টে ছোট এক বালতি পানি এনে মাথাটা ধুয়ে অজু করে কাপড় বদলে নেয়। খুলে রাখা কাপড় ধুতে গিয়ে কোমরে কটমট শব্দ করে পুরনো বাতের ব্যথা করে উঠে। কাপড় বালতিতে রেখেই বের হয়ে আসে। এসে দেখে টেবিলে সব এঁটো প্লেট আর জুঠা পড়ে আছে। দেখে সেঁজুতিও খেয়ে নিয়েছে। রাশেদা নামাজ পড়ে টেবিল পরিষ্কার করতে গিয়ে ভাবে? নাহ আগে খেয়ে নেই আজ কেন যেন খুদাও লেগেছে বেশ। সে যখন খেতে বসবে! দেখে ভিকি আবার বের হয়ে যাচ্ছে। ছেলেকে ডাক দেয় রাশেদা-
-ভিকি একটা কথা ছিল বাবা!
-যা বলার সেঁজুতিকে বল। আর বিনুর হাত খরচের টাকা এখন থেকে সেঁজুতির কাছ থেকে নিয়ে নিও।
-না মানে তোর সাথে একটু কথা ছিল…
-আমার এখন সময় নেই রাত্রে বল...।
ভিকি হনহন করে হেঁটে চলে যায়। সেঁজুতি মিটি মিটি হাসে। যা রাশেদা খেয়াল করে না। সে কেবল প্লেটে ভাত নিয়েছে শুনতে পায় সেঁজুতি বলছে-"মা এখনও আপনি ভাত খাচ্ছেন!?" কথাটা কেমন যেন লাগে রাশেদার কাছে। সে তো এই মাত্র বসেছে!? সেঁজুতি নরম সুরে বলে-"মা সরি আপনার ছেলে অনেক জোর করাতে আমি আজ আগে খেয়ে নিয়েছি। প্লিজ কিছু মনে করবেন না!" রাশেদা অনেক কষ্টে বলে- "না মা ঠিক আছে।"এমন সময় বিনু এসে টেবিলে বসে মায়ের সাথে খাওয়া শুরু করে। আর তা দেখে সেঁজুতি মনে মনে বলে-"আবার খেতে বসছে! এইটারে আগে শায়েস্তা করতে হবে তারপর বুড়িটারে!" কিন্তু মুখে কিছু না বলে শোবার ঘরে চলে যায়।

ছয়

বিনুকে সেঁজুতি যে আবিদের সাথে পরিচয় করে দিয়েছে? সেদিনের সেই ঘটনার কথা মাকে বলার সাহস বিনুর হয়নি। মায়ের ব্লাড প্রেসার অনেক হাই। এসব ঘটনা শুনে কী থেকে কী হয়ে যায় এই ভেবে সে ঘটনাটা এড়িয়ে গেছে। ভেবেছে সময় সুযোগ মত ভিকিকে সবকিছু খুলে বলবে! বিনু মাকে সঙ্গ দিতে খুব সামান্য একটু খায়। তারপর মাকে বলে "তুমি যাও মা একটু বিশ্রাম নেও। আমি সবকিছু ধুয়ে গুছিয়ে রাখব।" রাশেদা বিনুর কথামত তাই করে। এতক্ষণ ভালোই ছিল কিন্তু খাওয়ার পরে কেন যেন রাজ্যের ক্লান্তি আসে। ভীষণ দুর্বল লাগে। আজ বিছানা যেন ওকে হাতছানিতে কাছে ডাকছে। অথচ সে কোনদিন ভাতঘুম দিতে পারে না। আজ অনিচ্ছাকৃতভাবে বিছানায় গিয়ে শুতেই রাজ্যের ঘুম এসে ওকে ডুবিয়ে নেয় ঘুমের অতলে।

রাশেদা কতক্ষণ ঘুমিয়েছে জানেনা। ঘুম ভাঙে সেঁজুতি আর বিনুর তর্কের শব্দে।"নাহ বিনুটাও যা হয়েছে না! কেন বড় ভাবির সাথে ঝগড়া করতে যাস!?" কোমরের ব্যথায় কোমর টসটস করে উঠলো। অনেক কষ্টে খাট থেকে নেমে ডাইনিং রুমে আসে। দেখে টেবিলে দুনিয়ার প্লেট গ্লাস! এমন কি রাশেদা আর বিনু খাবার পরে যেভাবে রেখে সে বিশ্রাম নিতে গেছে? ঠিক সেভাবেই টেবিল পড়ে আছে! এমন কি চেয়ারগুলো পর্যন্ত ঠিক করে রাখেনি! ওর নিজের উপরই ভীষণ রাগ হয়। বিনু এভাবে ওকে বিশ্রামে পাঠিয়ে সব ফেলে রেখে কোন কাজ না করে ঠিক কাজ করেনি। সেঁজুতি রাগে থরথর করে কাঁপছে আর বলছে-"কেন কাজের লোক রাখতে হবে? কী এমন কাজ এই সংসারে? আর তোমার মা কাজ করলে বরং ভালো থাকে। না হলে তো বাতের ব্যথায় উঃ আঃ করতেই থাকে!" বিনু খেঁকিয়ে উঠে
- তুমি এই বাড়ীর বউ রান্না ঘর গোছানো এসব তোমার কাজ। আমার বা আমার মায়ের না বুঝেছ?
-হ্যাঁ আমার স্বামী খেঁটে খেঁটে টাকা রোজগার করবে আর তোমরা মা বেটি লাটসাহেবের মত খাবে আর ঘুমাবে। আবার আমাকেও চাকরানির মত খাটাবে তাই না!?
-এটা তোমার সংসার...। আর যাকে আমার স্বামী আমার স্বামী করছ সে আগে আমার মায়ের ছেলে,আমার ভাই...। তুমি লাটসাহেবের মত শুয়ে বসে...
-বিনু...! রাশেদা ঠাশ করে চড় বসিয়ে দেয় বিনুর গালে। কাঁদতে কাঁদতে বলে-"এই শিখিয়েছে তোর মা তোকে? বড়দের সাথে এভাবে তর্ক করা শিখিয়েছি আমি তোকে!"
-"এসব কী হচ্ছে শুনি!? এটা কী কোন ভদ্র লোকের বাড়ী!" পিছন থেকে ভিকি হুঙ্কার ছাড়ে। সাথে সাথে সেঁজুতি হুহু করে কান্না শুরু করে বলে-
-দেখছো তোমার মা বোন দুজনে মিলে আমাকে যা না তাই বলছে। আমি আর এই বাসায় থাকব না...। সারাদিন এত এত কাজ করি। আজ একটু ঘুমিয়েছি দেখ টেবিলের অবস্থা। এখন আমাকে বলছে এইসব পরিষ্কার করতে...!

রাশেদা ঘুরে দেখে ভিকি কখন যেন বাসায় এসেছে। শাড়ীর আঁচলে চোখ মুছে এগিয়ে যায় ডায়নিং টেবিলের দিকে। থালাবাটি গোছাতে থাকে। সেঁজুতি এগিয়ে এসে হাত থেকে কেঁড়ে নেয় সব। হাতের ছোঁয়া লেগে ঠ্যুং করে একটা গ্লাস মেঝেতে পড়ে ভেঙে যায়! রাশেদা যেইটাতেই হাত দেয় সেইটাই কেঁড়ে নিয়ে বলে- "থাক থাক ছেলেকে দেখে এখন কাজ দেখাতে হবে না। যখন ছেলে বাসায় থাকে না তখন তো কোন কাজেই পাইনা। এখন ছেলেকে দেখে...। দেখ দেখ তোমার বুড়োধাড়ি বোন আর বুড়ি মায়ের কাণ্ড! যেন ভাঁজা মাছ উল্টে খেতে জানে না।"
বিনু যেন আর সইতে পারেনা। মা যে গালটাতে মেরেছে সেই গালটা ঝাঁঝাঁ করে জ্বলে যাচ্ছে। তবু হাত দিয়ে একটু ছুঁতেও ইচ্ছে হচ্ছে না। চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে। কিন্তু সেঁজুতির কথায় সে আবার তর্ক করে বলে-
-"হ্যাঁ সত্যিই ভাঁজা মাছ উল্টে খেতে জানে না। আমি তো বুড়োধাড়ি আপনি কী!?"
-"দেখ তোমার সামনে তোমার বোন আমাকে...! তুমি আমাকে বুয়া করে এ বাসায় এনেছো না!? একটা বুয়াও রাখা যায় না তোমার মা বোনের জন্য। ওদের জ্বালায় কেউ এই বাসায় কাজ করতে চায় না। আমাকে দিয়ে কাজ করাতেই ওরা ষড়যন্ত্র করে বুয়া তাড়িয়ে দেয়। তুমিও আমাকে ভালবাস না..." কথাগুলো বলে হুহু করে কেঁদে যায় সেঁজুতি। যা দেখে বিনু ব্যাঙ্গ করে বলে"ইস কত্ত বড় অভিনেত্রী! তোমার তো হলিউডে যাওয়া উচিৎ। অনেক শাইন..."
"ঠাস" করে আবার চড়ের শব্দ। এবার বিনু হাত দিয়ে গালটাতে বুলিয়ে নেয়। আর আশ্চর্য হয়ে তাকিয়ে থাকে সামনে দাঁড়ানো ভাইয়ের দিকে! "ভাইয়া তুই আমাকে মারতে পারলি!?"থরথর করে কেঁপে যায় দু'ঠোঁট। মুখ থেকে কোন কথা বের হয় না। ভিকি মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে-"গ্রামে যাবার ব্যবস্থা কর। বিনুকে আর শহরে রাখার দরকার নেই...!" কথাটা বলেই শোবার ঘরে চলে যায়।

রাশেদার মাথা ঘুরছে। কানের ভীতরে ফরফর করে শব্দ হচ্ছে। মনে হচ্ছে কানে যেন কোন কথায় ঢুকছে না। মাথার কাপড়টা একটু টেনে নিয়ে চেয়ারগুলো টেবিলের ভীতরে ঢুকাতে থাকে। ছেলের সামনে কেন যেন ভীষণ লজ্জা লাগছে আজ। এই প্রথম মনে হচ্ছে সত্যিই সে ছেলের রোজগারে ভাগ বসাচ্ছে। তার যেন কোন অধিকার নেই এভাবে ছেলের সংসারে বোঝা হবার।

সাত

বিনু বড় অভিমান করে এক কাপড়ে বের হয়ে যায়। "সেই জন্মের পর থেকে যে ভাইয়ের সাথে হেসে খেলে বড় হয়েছে। যে ভাই যে কোন খাবার বা যেকোনো কিছু,নিজে এক হাতে নিজের ভাগটুকু রেখে আরেক হাতে বোনের ভাগটুকু যত্ন করে রেখেছে। সেই ভাই আজ সেই হাতে আদরের বোনটাকে চড় মেরেছে! যে ভাই বাবা মরে গেলে হাজারো দুঃখ কষ্ট নিজে সয়েছে। অথচ তার ছিটেফোঁটা বোনের মনে লাগতে দেয়নি! সেই ভাই আজ...! না আর এই ভাইয়ের সাথে সে থাকবে না।" কাউকে কিছু না বলেই বিনু এই বাড়ি ছেড়ে চলে যায়। মরে যাবে তবু এই বাড়িতে সে আর থাকবে না! সে হারিয়ে যাবে অনেক অনেক দূরে...। বিনু যখন বাসা থেকে বের হয়? সেঁজুতি মোবাইলে কাউকে একটা ম্যাসেজ পাঁঠায়।

বিনু বাসা থেকে বের হয়ে সোজা হাঁটতে থাকে। আজ আশেপাশে কোন দিকেই তার খেয়াল নেই। দুচোখে ঝরঝর করে বৃষ্টি ঝরে যাচ্ছে। সে ভাবতেই পারেনা বাবা মরে গেলে এমন একটা দিন তার জন্য অপেক্ষা করে থাকতে পারে! নানা কথা ভাবতে ভাবতে হেঁটে যায়। হঠাৎ একটা গাড়ী এসে ঠিক ওর সামনে থামে। আর একটু হলেই ও গাড়ীর নীচে পড়ত। গাড়ীর ড্রাইভার সীট থেকে একজন গলা বাড়িয়ে দিয়ে জিজ্ঞাসা করে-"ম্যাডাম শিবগলিটা কোন দিকে?" বিনুর বিরক্ত লাগে। ও কিছু না বলে আবার হাঁটতে থাকে। গাড়ীটা আবার ওর পথ রোধ করে একেবারে পাশে ঘেঁষে দাঁড়ায়। লোকটা আবার জিজ্ঞাসা করে-"ম্যাডাম শিবগলিটা কোন দিকে?" শাঁ শাঁ শব্দে গাড়ীর দরজা খুলে দুজন লোক বিনুকে দুদিক থেকে ধরে ঠেলে গাড়ীতে তোলে। চিৎকার দিতে যায় কিন্তু তার আগেই একটা কাপড় কেউ মুখে ধরে...। কিছুক্ষণ ধস্তাধস্তি হয়। তারপর বিনু আর চোখ মেলে রাখতে পারে না। ঝাপ্সা চোখে একটা চেনা মুখ দেখে! ঠিক ওর মুখের উপর এসে ওর ঠোঁট দুটো চেটে দেয়! এলকোহলের গন্ধটা অনেক চেনা লাগে ওর। ওর সমস্ত শরীরে কিলবিল করে হেঁটে যায় এক বিষাক্ত গিরগিটি। খুব চেষ্টা করে নির্বিঘ্নে চলায় বাঁধা দিতে। কিন্তু ও একটুও নড়ার শক্তি পায়না। সারা শরীর জুড়ে ব্যথা অনুভব করে। একরকম যুদ্ধ শুরু হয়েছে ওর সারা শরীর জুড়ে। টেলিভিশনে যুদ্ধের দৃশ্যগুলো মনে পড়ে...ড্রিম ড্রিম করে বোমা পড়ছে! হুড়মুড় করে দালানগুলো ভেঙে যাচ্ছে। চারিদিকে রক্তের স্রোত আর লাশ আর লাশ...! এই মাত্র বোমার আঘাত লেগেছে শরীরে! ব্যথায় ককিয়ে উঠে বিনু...। দম বন্ধ হয়ে আসে। "মা গো আমাকে বাঁচাও!" চিৎকার দিয়ে কথাটা বললেও একটুও শব্দ বের হয় না দু'ঠোঁটের ভাঁজ খুলে। এই যুদ্ধ চলে অনেকক্ষণ। সৈন্য পরিবর্তন হয়। যুদ্ধের কৌশল চলে একইভাবে...। এক সময় আর কিছুই বুঝতে পারে না। শুধু শরীরটা দুলে যায়।

রাশেদাকে রাতেই ট্রেনে তুলে দেয় ভিকি। মাকে বলে"পারলে ক্ষমা কর মা। অফিস সংসার দুই দিকের এত প্রেসার আমি নিতে পারছি না। আমি কথা দিচ্ছি এদিকটা একটু গুছিয়ে নিয়ে,তোমাকে খুব তাড়াতাড়ি আবার শহরে আনব!" রাশেদার মনের মাঝে হু হু করে ঝড় উঠে...। যে ঝড় সব কথা উড়িয়ে নিয়ে গেছে। মনে মনে বলে-" তুই সুখী হ বাবা। আমি আর কোনদিনই শহরে আসব না।" ট্রেন ছেড়ে দিতেই যেন কিছুটা ভালো লাগে রাশেদার। এতক্ষণ ছেলের চোখে চোখ রাখতে লজ্জা করছিল। ওর মুখের দিকে তাকাতে একটা সংকোচ বোধ হচ্ছিল। কিন্তু তারপরও খুব ইচ্ছে হচ্ছিল আদরের ছেলেকে একটু ছুঁয়ে দিতে। খুব করে ইচ্ছে হচ্ছিল বলতে-"বাবা নিজের দিকে খেয়াল দিস। রাত জেগে কাজ করে অসুস্থ হয়ে পড়িস না সোনা!" নাহ কিছুই বলতে পারেনি। সে কেঁদে কেঁদে বুকে জমা কষ্টটাকেও গলাতে পারেনি। জমাট বেঁধে কষ্টটা বুকে ব্যথা দিচ্ছে। "বিনু আমার কলিজাটা কোথায়!?" ট্রেনের জানালা দিয়ে দুচোখ খুঁজে বেড়ায়! ছেলেকে বিনুকে খুঁজে বের করার কথাটাও সে বলতে পারে না। আঁচলে মুখ ঢেকে শুধু কেঁদে যায়।

শেষ

এর কয়েকদিন পরেই ভিকি এবং সেঁজুতি নতুন গাড়ীতে করে গ্রামে আসে। দুদিন আগেই সেঁজুতির সাথে এই গাড়ী নিয়ে ভিকির ঝগড়া হয়ে গেছে। সেঁজুতি বলেছে এ গাড়ী ওর বাবা ওকে দিয়েছে। কিন্তু ভিকি ওর শ্বশুরের কাছ থেকে কৌশলে জেনে নিয়েছে যে,সে সেঁজুতিকে কোন গাড়ীই দেয়নি! সন্দেহ মনে দানা বাঁধলেও,সেঁজুতিকে সে কিছুই বলার সুযোগ পায়নি। কিছু বুঝতেও দেয়নি কারণ ওকে সেই মুহূর্তেই থানায় যেতে হয়েছিল।

ওদেরকে দেখে রাশেদা খুশি হয়ে যায়। ভাবে "নিশ্চয় ওরা ওদের ভুল বুঝতে পেরেছে! হাজার হোক ছেলে মেয়ে তো ওরা। ওরা যে ভুলটা বুঝে ওর কাছে এসেছে এটাই তো ওর পরম পাওয়া!" কিন্তু ট্রাক কেন বাড়ীর ভীতরে আসছে!? বিনু কোথায়? ভিকি বিনুকে মারুক বা যাই করুক সে যেভাবেই হোক আদরের বোনকে খুঁজে দুঃখ প্রকাশ করবে। বোনকে আদরে আদরে ভরিয়ে দেবে! এমন কতদিন করেছে দুজন। ভিকি "সরি সরি"বলতে বলতে কেঁদে কেঁদে কান ধরে উঠবসও করেছে। অথচ ও কিন্তু তেমন কিছুই করেনি। বিনু রাগ করে ওর সাথে কথা বলেনি আর এতেই ভিকির ভয়। না জানি বোনটাকে কী কষ্টটাই না দিয়ে ফেলেছে। ভিকি মাথা নিচু করে আছে কেন?! মায়ের সামনে আসছে না কেন!? রাশেদা ভিকির মাঝে কোন ভাবান্তর লক্ষ্য করছে না। মনে হচ্ছে ট্রেনে তুলে দিতে আসা ভিকির মাঝে আর এই ভিকির মাঝে কোন পার্থক্য নেই। সেদিনও এভাবেই ছিল।

ধীরে ধীরে ট্রাক থেকে একটা কফিন নামানো হয়। রাশেদার চোখের সামনে ভেসে উঠে ভিকির বাবাকেও এভাবেই এনেছিল! "অফিস থেকে মেসে ফেরার পথে একটা বাসের ধাক্কায় রিকসা উল্টে জায়গায়ই...!" আর ভাবতে পারে না। সেঁজুতি কাঁদতে কাঁদতে এসে ওকে জড়িয়ে ধরে বলে-"মা বিনু ব্রিজ থেকে নদীতে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেছে। পুলিশ ওর লাশ নদীতে পেয়ে আপনার ছেলেকে ফোন দিয়েছে। বিনুর সাথে থাকা ব্যাগে আপনার ছেলের ফোন নাম্বার..."রাশেদার কেন যেন সেঁজুতির স্পর্শ ভালো লাগছে না! মেয়েটার কথা শুনতে ভীষণ বিরক্ত লাগছে । অসহ্য লাগছে...।

এদিকে সেঁজুতির আজ ভীষণ কান্না পাচ্ছে...। ওর নিজেরই মনে হচ্ছে বিনুর মত করে মরে যেতে। নিজেকে আজ অনেক বড় অপরাধী লাগছে...। ও বুঝতে পারছে না কেন এতটা লোভ ওর মাঝে কাজ করেছে? ও নিজেও জানেনা কীসের জন্য এত বড় একটা অন্যায় সে করেছে। টাকা পয়সা,ধনদৌলত,আভিজাত্য সবই তো ওর বাবা ওকে দিয়েছে। তবু কেন এমনটা করল সে!? এবার সত্যি সত্যি সেঁজুতি হু হু করে কাঁদতে থাকে। ওর কান্না দেখে ভিকির মনে পড়ে সেদিন বিনুর বলা কথাগুলো"ইস কত্ত বড় অভিনেত্রী! তোমার তো হলিউডে যাওয়া উচিৎ। অনেক শাইন..."আজ ভিকির অনুভূতিও জেগে উঠে "সেঁজুতি সত্যিই অভিনয় করছে।" বিনুকে মনে করে ভিকির মনের মাঝে কী যেন একটা হয়ে যাচ্ছে! ভিকি ঠিক বুঝতে পারছে না। আকাশের দিকে তাকিয়ে"বিনুউউউ...তোর ভাইকে মাফ করে দিস বোন"কথাটা ভেবে ডুকরে কেঁদে উঠে।



আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
তানি হক Onek din pore prio apur akti golpo porlam... Kichu bolar bhasa nehi... :'( janina kobe amader moddhe monusotto jege uthbe.. Oshongkho dhonnobad janai apuke ai golootir jonno
মনোয়ার মোকাররম সামাজিক বাস্তবতার সুন্দর চিত্রায়ন ...শুভ কামনা
ভালো লাগেনি ২৯ জানুয়ারী, ২০১৭
অনেক অনেক ধন্যবাদ। শুভকামনা নিরন্তর।
ভালো লাগেনি ৩০ জানুয়ারী, ২০১৭
সেলিনা ইসলাম "সমাজে অনেক বিনু আছে, যারা বুকভরা দু:খ নিয়েই ওপারে পাড়ি জমিয়েছে। আবার এমন সংখ্যাও কম নেই, যারা বাবার বাড়িতে বিনু থাকলেও শ্বশুর বাড়িতে ঠিকই সেজুতি বনে যায়।" খুবই মূল্যবান কথা বলেছেন। অনেক ধন্যবাদ সময় দিয়ে গল্প পড়ে এত সুন্দর মূল্যবান মন্তব্য দেবার জন্য। শুভকামনা নিরন্তর।
ভালো লাগেনি ২৪ জানুয়ারী, ২০১৭
আশা সমাজে অনেক বিনু আছে, যারা বুকভরা দু:খ নিয়েই ওপারে পাড়ি জমিয়েছে। আবার এমন সংখ্যাও কম নেই, যারা বাবার বাড়িতে বিনু থাকলেও শ্বশুর বাড়িতে ঠিকই সেজুতি বনে যায়। তবে গল্পের শেষটায় এসে সেজুতির ভুল বুঝতে পারাটা ভালো কিছুই বটে। (আর গল্প-কবিতায় আমার প্রিয় লেখক-কবিদের মধ্যে সেলিনা আপু একজন, তাই আপনার গল্প পড়লে বাড়তি একটা আমেজ থাকেই, তাই আপুর জন্য শুভকামনা থাকল)।
ভালো লাগেনি ২৪ জানুয়ারী, ২০১৭
মামুন ম. আজিজ অনেক অনেকদিন পরে গল্পকবিতায় ঢুকে প্রথমেই তোমার গল্প পড়লাম . হিউম্যান সমাজের সেইসব ঘুনে ধরা বিষয়ের চিরায়ত প্রচারের একটি .... ভালো লিখেছেো..তবে আমি নতুন কিছূ খুঁজছিলাম। সেটা পেলাম না। ...
ভালো লাগেনি ২৩ জানুয়ারী, ২০১৭
ক্যামন আছো মামুন ভাই...? অনেকদিন পড় তোমাকে দেখলাম। গল্পকবিতা খুব মিস করে তোমাকে! ভালো লাগল অনেকদিন পড় গল্পে তোমাকে পেয়ে ভাইয়া। অনেক ধন্যবাদ শুভকামনা নিরন্তর।
ভালো লাগেনি ২৪ জানুয়ারী, ২০১৭
কবিতা দিছি একটা অাগামী সংখ্যায়, মন্তব্য ঘরেই দেখবেন মিস করার মত তেমন বেশি কেউ নাই
ভালো লাগেনি ২৬ জানুয়ারী, ২০১৭
Fahmida Bari Bipu আপা, আপনার লেখাটা পড়ে বূকটা ভারী হয়ে গেল। গল্পের কাহিনি বেশ লেগেছে। 'কী যেন একটা' অর্থটা ঠীক যেন ফুটে ওঠেনি এমনটা মনে হয়েছে। প্লট টা নিয়ে বড় কিছু লিখলে মনে হয় বেশি ফুটে উঠতো। অল্প পরিসরে বিশাল কাহিনি বর্ণণা মনে হচ্ছিলো।
ভালো লাগেনি ২২ জানুয়ারী, ২০১৭
প্রথমেই আন্তরিক ধন্যবাদ সময় দিয়ে গল্প পড়ার জন্য আপা। পুরো কাহিনী জুড়েই 'কী যেন একটা' বিষয়টি তুলে ধরেছি আপা। প্রতিটি চরিত্রই বুঝে উঠতে পারেনি তাদের সাথে যে ঘটনাগুলো ঘটেছে এবং কি কারণে ঘটনাগুলো ঘটিয়েছে। যখন বুঝতে পেরেছে ততক্ষণ অনেক কিছুই ঘটে গেছে। এমন কি সেঁজুতি যা করেছে তাও সে জানেনা ঠিক কি জন্য করেছে। আমার ব্যর্থতা আমি হয়ত 'কী যেন একটা' বিষয়টি ঠিক যেভাবে এনেছি গল্পে তা পাঠককে বুঝাতে পারিনি। ছোট গল্প এমনই আপা শেষ হইয়াও হইলো না শেষ! আর সে দিক থেকে ভাবলে হ্যাঁ এই গল্পটিকে বড় পরিসরে একটা উপন্যাসে রূপ দেয়া সম্ভব। অনেক ভালো থাকুন নিরন্তর শুভকামনা।
শামীম খান আগেই পড়েছিলাম । এখন শুধু মন্তব্য । সংসার জীবনের জটিল একটি বিষয় নিয়ে লেখনীর দারুন সঞ্চালনা , আগাগোড়া উপভোগ করছি । শুভকামনা আর আর ভোট রইল ।
ভালো লাগেনি ৭ জানুয়ারী, ২০১৭
শেষাবধী মন্তব্য পেয়ে খুবই অনুপ্রাণিত হলাম ভাই। আপনার লেখা কিন্তু খুব মিস করি। অনেকদিন লেখা পাচ্ছি না কিন্তু...! অনেক অনেক ধন্যবাদ সময় দিয়ে পড়ার জন্য ভাই। নিরন্তর শুভকামনা।
ভালো লাগেনি ৯ জানুয়ারী, ২০১৭
আহা রুবন ঘরে ঘরে আজ সেঁজুতিদের বসবাস। জানি না কী আনন্দ পায় এতে। দেখা যায় যাদের স্বামীর অনেক আছে এরাই যেন স্বামীর পরিবারকে হেনস্থা করে। হয়ত তাদের কাছে এটাই একটা খেলা! মনটা খারাপ হয়ে গেল। খুব ভাল লিখেছেন, মাঝে মাঝে মনে হয়েছে এটি গল্প নয়। অমুকের কাছে তো এমনটাই শুনেছিলাম সেটিই গল্পচ্ছলে শুনছি। শুভ কামনা রইল।
ভালো লাগেনি ৭ জানুয়ারী, ২০১৭
আপনার মূল্যবান মন্তব্যে অনুপ্রাণিত হলাম। আসলে আমাদের সমাজে অনেক মানসিকতার মানুষ আছে। ভালো মন্দ মিলেই আমাদের সমাজ চলছে সামনের দিকে। মানুষ শিক্ষিত হচ্ছে কিন্তু কার্যকলাপে তা প্রকাশ পাচ্ছে না। স্বার্থপরতার বাইরে যেন অনেকে কিছুই ভাবতে পারছে না। যদিও গল্পটি কল্পনায় লেখা তবে এমন ঘটনা আমাদের চারপাশে ঘটছে! সময় দিয়ে গল্প পড়ার জন্য আন্তরিক ধন্যবাদ। শুভকামনা নিরন্তর।
ভালো লাগেনি ৭ জানুয়ারী, ২০১৭
কাজী জাহাঙ্গীর চায়ছে/ভীতরে-শব্দগুলো বেশ ক’জায়গায় একই রকম দেখলাম আপা। আর "এই ঘরের মেয়ে কী হবে বা হবে না .../"আমি কী বলেছি বলিদান দিতে?/রাশেদা কী করবে বুঝতে পারেনি- বাক্য ‍গুলোতে ‘কী’ যথার্থ মনে হয়নি , আমার মন বলছে ‘কি’ হবে। আমার দোষ নেই আপা, আমারও অনেক ভুল হয় লিখতে গিয়ে, কিছুতেই খুজে পাই না, এই জ্বালায় বড় কষ্ট পাই। আপনার গল্পের কোন কৈফিয়ত নাই, পুরোটা অবশ করা গল্প, অনেক শুভকামনা, ভোট আর ভয়ে ভয়ে জানিয়ে গেলাম আমার পাতাায় আসার আমন্ত্রণ।
ভালো লাগেনি ৭ জানুয়ারী, ২০১৭
বড়ই জটিল বিষয়টি সামনে এনেছেন! অনেক অনেক ধন্যবাদ আগামীতে খেয়াল থাকবে। আর ভয় কেন ভাই? আমি তো আপনার লেখা অনেক সেরা লেখার মাঝেই মনে করি। অনেক ভালো লিখেন আপনি এবং আমি পড়ার চেষ্টা করি। অবশ্যই পড়ব। ভালো থাকুন শুভকামনা সতত।
ভালো লাগেনি ৭ জানুয়ারী, ২০১৭

২৭ মে - ২০১১ গল্প/কবিতা: ১২০ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "স্থিতিশীলতা”
কবিতার বিষয় "স্থিতিশীলতা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪