আমি যখন মায়ের বাসায় ছিলাম তখন আমার কিছু সন্তান ছিল। যারা বয়সে বুড়ি এবং যাদেরকে মানুষের কাছে হাত পেতে নিজেদের জীবন চালাতে হত। ওদের মাঝে একজন ছিল বেশি বয়স্ক এবং বেশি পুতুপুতু(খুঁতখুঁতে) টাইপ। সপ্তাহে সবাই একদিন আমাকে দেখতে আমার বাসায় আসত। কিন্তু ঐ পুতুপুতু বুড়ি প্রায় প্রতিদিন আসত। এই নিয়ে মা মাঝে মাঝে আমাকে বকা দিতেন। কারণ ঐ বুড়ি একেবারে আমাকে আদর করে দোয়া করত। আর বাসায় এসে আর যেতে চাইত না। এতে আমারও আর কোন কাজ করা হত না। একদিনের ঘটনা-
আমাদের বাসায় ছোটদের জন্য নিয়ম ছিল দুপুরে খাওয়ার পরে ভাতঘুম দিতে হবে। আর যদি ঘুমাতে না চাও তাহলে হোমওয়ার্ক বা হাতের লেখা প্র্যাকটিস করতে হবে। সাধারণত দেখা যেত লেখাপড়ার ভয়ে ভাই এবং আমি ঘুমাতে যেতাম বিছানায়। কিন্তু কারোর চোখে একবিন্দু ঘুম থাকত না। নিয়ম মাফিক আব্বা ঠিকই কপালে হাত রেখে বিছানায় শুয়ে আছেন। তিনি ঘুম না ঘুম নেই এই নিয়ে আমি,ভাই ভাগ্নি সবাই ফুসুর ফাসুর করতাম। মন পড়ে থাকত বাড়ীর পাশের মাঠে। না হয় ছাঁদে। মনে হত সবাই আমাকে ছাড়াই গোল্লাছুট, বুড়িচ্চু,দাঁড়িয়া বান্ধা খেলা শুরু করে দেয়নি তো? আবার মনে হত আকাশ জুড়ে নিশ্চয় রঙিন ঘুড়ির উড়াউড়ি হচ্ছে! সবাই মজা করছে আর আমরা ভরদুপুরে ঘুমানোর পাঁয়তারা করছি! এভাবেই আমরা চোখের ইশারায় সবাই সবার সাথে কথা বলে যাচ্ছি। এর ভীতর মা এসে আমার কানে কানে বললেন-"এই সময় দেখ পুতুপুতু বুড়ি আসছে। তোকে ডাকছে। শোন তোর কিন্তু কাল পরীক্ষা আর তোর আব্বা ঘুম থেকে যাবার আগে ওকে যেতে বলিস। তোর আব্বা যদি দেখে পড়াশুনা বাদ দিয়ে বুড়ির সাথে গল্প করছিস তাহলে কিন্তু বোকা দেবে!" আমি লাফ দিয়ে উঠে চলে এলাম বারান্দায়। বুড়ি আমাকে দেখে একেবারে ফোকলা হাসি হেঁসে দিলেন! নিচু স্বরে কিছুক্ষণ ওর সাথে গল্প করলাম! কারণ আব্বার যদি ঘুম ভেঙে যায় সেই ভয়ে। বুড়ির সাথে গল্পগুলো ছিল অনেক মজার। সারাদিন ভিক্ষা করতে করতে বুড়ির অভিজ্ঞতার ঝুলি ভরে থাকত। উনার গ্রামের কথাও শেয়ার করত। আমার সাথে সাথে মাকেও দেখতাম বসে বুড়ীর কথা শুনছে। আসলে মা আমাকে কখনো একা করতেন না। বুড়ি কত কত বাড়ী ঘুরে ভিক্ষে করত তা আমার জানা নেই কিন্তু প্রতিদিন দুপুরে সে যে কেবল আমাকে দেখতে আসত এটা আমার বিশ্বাস হত না। কেন যেন মনে হত উনি আসলে মায়ের রান্না করা খাবারের জন্যও আসত! সেদিন আব্বা ঘুম থেকে উঠে দেখে বুড়ি ভাত খাচ্ছে আর আমি পাশে বসে তাল পাখা দিয়ে বাতাস করছি। আমি আব্বাকে দেখে বাতাস করা ভুলে গেলাম। ভাবলাম আব্বা বুঝি এই বোকা দিলেন। কিন্তু আমাদের সবাইকে আশ্চর্য করে দিয়ে আব্বা কিছু না বলেই বের হয়ে গেলেন! সেদিন সন্ধ্যা হয়ে গেছে তবুও বুড়ি যাচ্ছে না।
আজ মনে হল বুড়ির সাহস বেড়ে গেছে। প্রতিদিন বলতাম-বুড়ি তুমি এখন যাও আব্বা এসে দেখলে বকা দেবে। সে তাই বিশ্বাস করেই চলে যেত। কিন্তু সেদিন সে রাতের খাবারও খেয়ে তারপর যাবে। আমার মা বললেন "তুমি ভাত নিয়ে যাও বাসায় যেয়ে খেও।"কিন্তু সে কিছুতেই যাবে না। বুড়ি বলে-"না বাসায় নিতি নিতি এক্কেরে জুড়োই(ঠাণ্ডা) যাবে নে! এর চেয়ে এহেনে বসে খাইয়ে যাই!" সেদিন মা বলেছিল "দেখেছিস বুড়ি কত চালাক!" আমি বলেছিলাম- না মা চালাক না। আমার মনে হয় ও একা থাকতে,খেতে ওর খারাপ লাগে। অথবা ওর ভয় লাগে। মা কিছুই বলেনি। সেদিন বেশ রাত করে আমাদের বাসা থেকে বুড়ি গিয়েছিল। সত্যি বলতে অন্যদের তুলনায় এই পুতুপুতু বুড়ির সাথেই আমার একটা টান অনুভূত হয়েছিল। আমি আমার স্কুলের টিফিনের টাকা, রিকসা ভাঁড়া বাঁচিয়ে উনাদেরকে দিয়ে দিতাম। যেদিন উনাদের আসার দিন থাকত আমি বনভাত(নিজে হাতে ছোট চুলায় রান্না করা) করতাম। আমার আব্বা এইদিন আমাকে বাজারে নিয়ে যেতেন। আমার হাতে থাকত একটা কাপড়ের ব্যাগ(যা আমি নিজেই বানিয়েছিলাম)। আমি যা যা চাইতাম আব্বা তাই তাই কিনে দিতেন।
এভাবে বেশ চলছিল। একদিন আব্বা মারা গেলেন। পুতুপুতু বুড়িটা ছাড়া অন্য বুড়িরা সবাই আসা কমিয়ে দিল। একদিন দেখা গেল কেবল শুধু এই পুতুপুতু বুড়িই কষ্ট করে হলেও আমাকে দেখে যেত। উনাকে যত বলতাম আমাদের বাসায় কোথাও থেকে যেতে,উনি থাকতে চাইতেন না। একদিন মা আমাকে ভীষণ করে বুঝাতে লাগলেন"তুমি এখন বড় হয়েছ। এ ভিক্ষুকদের সাথে যেভাবে সম্পর্ক করে ফেলেছ দেখা যাবে একদিন তোমার শ্বশুর বাড়িতে গিয়ে হাজির হয়েছে।"
যথারীতি একদিন আমি শ্বশুর বাড়ীতে গেলাম। পুতুপুতু বুড়ি প্রতিদিন মায়ের কাছে এসে আমার কথা জিজ্ঞাসা করে। মা বলে "সে ভালো আছে। তুমি দোয়া কর...!" বুড়ি ভীষণ অস্থির হয়ে একদিন মাকে প্রায় হাত পা ধরার মত অবস্থা। সে কান্না করতে লাগল আমাকে দেখার জন্য। মা কী করবে ভেবে পেলো না। কারণ বুড়ি একবার বাসা চিনে নিলে প্রতিদিন এসে আমার শ্বশুর বাড়িতে ঝামেলা করে যদি এই ভাবনা মাকে পেয়ে বসলো। মায়ের কাছে সবকিছু শুনে বুড়ির জন্য আমারও খারাপ লাগতে লাগল। একদিন দেখি আমার শ্বশুর বাড়ীতে কে যেন ভীষণ গেইট নাড়াচ্ছে। বের হয়ে দেখি পুতুপুতু বুড়ি! আমাকে দেখে কান্নায় ভেঙে পড়ল। সে বলে - "মা আমি তোমারে খুঁজতে খুঁজতে ঠিকই পাইয়া গেলাম!" সত্যি বলতে কি আমি কিছু ভয় পেলাম হাজার হোক শ্বশুর বাড়ী বলে কথা। আমার ননদ ঘর থেকে বের হয়ে বুড়িকে দেখল। আমি ভাবলাম না জানি কী বলে বসে। কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে আমার ননদ বুড়িকে ধরে সোফাতে বসতে দিল। বুড়ি মোটেই বসবে না...! সে নীচে বসবে। আমার ননদ প্লেটে করে ভাত এনে বুড়িকে খেতে দিল। এবার আমার আশ্চর্য হবার পালা! বুড়ি তার ব্যাগ থেকে একটা টাঙ্গাইলের সুতি শাড়ি বের করে আমার হাতে দিলেন... বললেন "মা এইটা তোমার বিয়ের উপহার!" আমি অপ্রস্তুত হয়ে গেলাম। বুড়িকে জোর করে সেই শাড়ি ফেরত দিলাম। বুড়ি তা ব্যাগে রেখে আমার গালে হাত রেখে দোয়া করলেন। আমি কিছু চাল আর নারিকেল(নিজেদের গাছের) দিলাম। বুড়ি সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেল। আমার মনের মাঝে জানিনা কেন তোলপাড় করছিল। আমার মন বলছিল এভাবে না ফেরালেও পারতাম! ঠিক মেইন গেইটের কাছে গিয়ে পিছন ফিরে আমাকে দেখল বুড়ি। ছেঁড়া শাড়ির আঁচলে চোখ মুছে নিতেই আমার ভীষণ কান্না পেলো। আমি ছুটে আমার রুমে গিয়ে ব্যাগ থেকে বেশ কিছু টাকা বের করে আমার ননদকে দিয়ে বললাম-" তুমি এই টাকা ঐ বুড়িকে দিয়ে শাড়ীটা নিয়ে আসো। বল ভাবি চেয়েছে!" আমার ননদ দৌড়ে বের হল। কিন্তু ঐ বুড়িকে কোথাও পেলো না!
বুড়ির জন্য আমার খুব খারাপ লাগতে লাগল। ওর সাথে গল্পে গল্পে জেনেছিলাম উনাকে নিয়ে আমার যে ধারণা ছিল তা সম্পূর্ণ সত্যি! একটা সময়ে ওর অবস্থা খুব ভালো ছিল। গ্রামের ভাষায় যাকে বলে গৃহস্থ্য বাড়ি। ছোট ছোট নাতি নাতনিদের পদচারনায় বাড়ী ছিল মুখরিত। কিন্তু ধীরে ধীরে একদিন সে একা হয়ে গেছে। নিয়তি তাকে সম্পূর্ণ নিঃস্ব করে দিয়ে গেছে। সবাই উনাকে ছেলে গেলেও স্বজনের মাঝে থাকার যে আনন্দ সেই আনন্দকে সে ছাড়তে পারেনি। তার জীবনে কী ঘটেছিল তা সে কোনদিন আমাকে না বললেও? সন্তান আর নাতিনাতনিদের কথায় তার যে মনের আগ্নেয়গিরির জলচ্ছাস তা তার চোখে বেয়ে নেমে যেতে আমি বহুবার দেখেছি।আজ কেন যেন মনে হল আমিও সেই তাদের দলে ভিড়ে গেছি। অভিমানী একজন বয়স্ক মানুষের সামান্য খুশিকে, আমি গলাটিপে হত্যা করেছি!
বুড়ি কোথায় থাকে আমি জানতাম। একটা বাড়ির সিঁড়ির নীচে সে থাকত। আর তাই পরেরদিনই ওর ওখানে চলে গেলাম। গিয়ে শুনলাম বুড়ি পনের বিশ দিন আগেই মারা গেছে! আমি অবাক হলাম... বললাম সে তো গতকালই আমার বাসায় গিয়েছিল! ওরা বলল-কী জানি আপনি কার কথা বলছেন। আমি উঁকি দিয়ে সিঁড়ির নীচে দেখি কালকে বুড়ির কাছে থাকা সেই ব্যাগ! ব্যাগ থেকে উঁকি দিচ্ছে সেই জরির পাড়ের শাড়িটা! ব্যাগের পাশেই নারিকেল। আমি বুঝতে পারলাম বুড়ি চালাকি করছে আমার সাথে। ভাবলাম যখন চলে যাব নিশ্চয় সে আড়াল থেকে বের হয়ে আসবে। কিন্তু না! এমন কিছুই হল না।
সেই থেকে বুড়িকে আর কোনদিন দেখিনি। খোঁজ নিয়ে জেনেছিলাম সে আর ওখানে নেই। সিঁড়ির নীচে কেঁউ আর থাকে না। বুঝলাম বুড়ি ভিক্ষুক হলে কী হবে তার আত্মসম্মান বোধটা অনেক চাঙা। যা হয়ত অনেক ধনী,শিক্ষিত মানুষেরও নেই। সেই থেকে আমার আমিও খানিকটা হয়ত বদলে নিয়েছি নিজেকে। সেদিন কেন বুড়ির দেয়া ভালবাসা আমি গ্রহণ করতে পারিনি! বা এক নিমিষেই সহজভাবে নিতে পারিনি তা হয়ত আমার অবচেতন মন সেদিন বুঝে উঠতে পারেনি। কিন্তু আজও ঘটনাটা মনে উঠলে আমি লজ্জিত হই। আমার সব ভালো দিকগুলোতে আমি দুর্বল হয়ে পড়ি। আমার ভালো থাকার উদ্দীপনারা আর আগের মত করে নিজেকে নির্ভেজাল দাবি করতে পারে না। আমি দিবানিশি শুধুই,আত্মদহনে জ্বলছি।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
কেতকী
আমার ছোটবেলায় আমাদের বাসায় আসতো এক ফোকলা বুড়ি। কেন জানিনা সেই বুড়ির জন্যে ভীষণ কান্না পাচ্ছে এখন। জানি সে বেঁচে নেই... সৃষ্টিকর্তা আমার দোয়া যেনো তার কাছে পৌঁছে দেয়। গল্পে ভোট রইল। আর অনেক শুভেচ্ছা।
আমরা মানুষকে ভালবাসি,দয়া করি,তাদেরকে সাহায্য করি! প্রতিদানে যখন সেইসব মানুষ ভালবাসা দিতে চায় তখন নিজেদের মনের কোণে আসল নকল কতখানি তা নিজেদের অজান্তেই বের হয়ে আসে! যা অনেক সময় আমরা নিজেরাও নিজেকে বুঝতে পারিনা! হয়ত বয়সের সাথে সাথে এক সময় অনুধাবন হয় এই আমি আসলে কোন আমি!? আমার আমিকে চেনা সত্যিই অনেক দুঃসাধ্য একটা ব্যাপার! অনেক ধন্যবাদ সময় দিয়ে পড়ার জন্য।
Fahmida Bari Bipu
খুব ভালো লিখেছেন আপা। আত্মসত্তাকে অন্যের মাধ্যমে তুলে নিয়ে আসা। নাড়া দিয়ে গেল যেন। কিছু জায়গায় সামান্য কিছু টাইপিং মিসটেক পেলাম। অশেষ শুভকামনা আপনার জন্য।
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।