অনাকাঙ্খিত দায়

প্রায়শ্চিত্ত (জুন ২০১৬)

সেলিনা ইসলাম
মোট ভোট ১২ প্রাপ্ত পয়েন্ট ৪.৪
  • ১৮
"শিশুকাল ছিল ভাল যৌবন কেন আসিল
বাগিচায় ফুল ফুটিল কোকিল কেন ডাকিল"
-"ওরে মুখপোড়া তোর গানের একী শ্রী রে! শহুরের ছাওয়ালরা কী এই গান গায়?" চমকে উঠে সেজান! সে কি করে দাদিকে বলবে কাল হাসান ভাই গানটা গেয়েছিল। আর তাই গানটা আজ মনে হতেই সে গুনগুন করছে। বুড়ী দাদী যে কখন পিছনে এসে দাড়িয়েছে,তা সে বুঝতেই পারেনি! দাদির কথায় সেজান লজ্জা পেয়ে যায়। মাথা নীচু করে পায়ের বুড়ো আঙ্গুল দিয়ে মাটি খুড়ে চলে সে। দাদি লাঠিতে ঠক ঠক আওয়াজ তুলে ওর একেবারে সামনে এসে দাঁড়ায়। হাত বাড়িয়ে ওর গোঁফ,দাঁড়ি সব হাতড়ে চলে। মুখ ভেঙচি দিয়ে বলে উঠে-"তোর তো দেহি এহনো মুচ উঠিনি..। আরে দেহি দেহি মুখ উঁচো কর। হায় আল্লাহ এ কী সর্বনাশ করিছিস"! আঁতকে উঠে দাদি! সেজানের বুঝতে অসুবিধা হলনা, এবার যে সারা বাড়ী মাথায় নিয়ে এই বুড়ী ধিতাং ধিতাং করে নেচে যাবে! এরপর কী হবে সেই কথা ভেবে ভীষণ অস্বস্তি লাগে। ওর মাথার ভীতর ভোঁ ভোঁ করে সারা বাড়ীটা নিয়ে ঘুরছে! "ইস! কী ধরাটাই না খেলাম রে আল্লাহ...!" এখন সবাই ভাতঘুমে। আর সেও এই সুযোগে বাবার সেভিং রেজারটা নিয়ে একটু পোচ দিয়েছে। ও কী ইচ্ছা করে দিয়েছে? দিতে বাধ্য হয়েছে। কাল রেশমা আপু বলেই বসল "সেজান তোকে না ছোট বেলাতেই অনেক সুন্দর লাগত। এই কিশোর বয়সটাতে কেমন যেন মেসি বিড়াল,মেসি বিড়াল লাগে?"
-"মেসি বিড়াল,মেসি বিড়াল লাগে মানে?" কথাটা জিজ্ঞাসা করতে ওর গলাটা কেঁপে উঠেছিল।
- "এই যে ভাসা ভাসা মোচ উঠতেছে তোর,এইটার জন্য! আর তোর চোখে মুখে মেয়েদের মত লজ্জা জড়িয়ে থাকে সব সময়! তাই তোকে মেসি বিড়াল,মেসি বিড়াল লাগে" কথাটা বলে দোলা আর সে দুজন হেসে গড়াগড়ি!

রেশমা আর সেজান চাচাতো ভাই বোন। রেশমা আপু সেজানের চেয়ে এক বছরের বড়। মনে হচ্ছে মেয়েটা বেশী পাকাঁ! বলবি তো বল দোলার সামনে? দোলা...,সেজান যেদিন প্রথম গ্রামে এসেছিল? সেইদিন ওকে দেখেই মনের ভীতর কেমন যেন ঘন্টা বেজেছিল। শরীরের মাঝে এক ধরণের শিহরন খেলে গিয়েছিল। কেন এমনটা লেগেছিল জানেনা সে। তবে সেই থেকে মেয়েটাকে দেখতে এবং ওর আশেপাশে থাকতে ওর ভীষন ভালো লাগে। ভালো লাগে ওর বেনী দুলিয়ে টোল খাওয়া গালে খিলখিল করে হাসিটা। "উফ.."কী অদ্ভুত ভালো লাগা খেলে যায় মনে। ওকে নিয়ে ভাবতে, স্বপ্ন দেখতে খুব বেশী রোমাঞ্চ অনুভব করে সে। মাঝে মাঝে মনে হয় দোলাকে নিয়ে সে হারিয়ে যাবে ঐ দূর আকাশে পরীদের দেশে। মেঘের চাদরের নীচে দুজনে হাত ধরে বসে বসে সারা পৃথিবী ঘুরে বেড়াবে। পিজা,চিকেন ফ্রাই,পটেটো চিপ্স,মজার মজার সব রকম খাবার খাবে। সুযোগ পেলে বলিউডটাও ঘুরে দেখে আসবে! ইস কত মজা হবে! দাদির চিৎকার শুনে কল্পনার তার ছিড়ে যায়। সে জানেনা কেন এই গানটাই গুনগুন করে তার গাইতে ইচ্ছে হল। দাদী এমনিতে অনেক কথাই জোরে বললেও কানে শোনে না। অথ্চ আজকে তার মৃদু স্বরে গাওয়া গান,ঠিকই তাঁর গানে গেছে!

-"আমি আগেই কইলাম এই ছাওয়ালরে আমার কাছে রাইখে যা। তোগের শহরে থাকতি শখ হইছে থাক। এহন দেহো ছাওয়াল এই বয়সে কী সব গান গায়! আর ঐ বান্দর এইডা কী করিছিস?" কথাটা বলে সেজানের গোঁফের জায়গায় একতা ঠোকনা দেয়! রাগে গজগজ করতে করতে আবার বলে-"দারা তোর বাপরে ডাইকে আনি। ও তোয়াজ...তোয়াজ, কনে গেলি? ও তোয়াজ...! এই দিনে দুকুরেও কী তোগের বউ কোলে নিয়ে ঘুমোন লাগে? ও তোয়াজ!" দাদীর এই ব্যবহারের জন্য মাঝে মাঝে বাবা ওদেরকে গ্রামে আনতে চায়না। একটু পান থেকে চুন খসলেই দাদি চিল্লাপাল্লা করে গ্রাম জড় করে। অবশ্য মা বলে সে নাকি আগে এমন ছিল না। দাদা মারা যাবার পরে যখন বড় হয়ে একে একে বাড়ীর ছেলেরা গ্রাম ছেড়ে শহরমুখি হতে লাগল? তখন তাঁর ব্যবহারও বদলে গেল। তাঁর ধারণা ছেলেরা কেউ তাঁকে ভালবাসে না। তাই সবাই তাঁকে একা করে বাপ দাদার ভিটে ছেড়ে চলে যাচ্ছে। শুধু থেকে গেছে বড় চাচা,রেশমা আপুর বাবা।

দাদির চিৎকার শুনে মা একরকম দৌড়ে এসে সেজানের সামনে দাঁড়ায়। ওর মন চায়ছিল ছুটে কোথাও পালায়...। কিন্তু তখনও সে মাথা নীচু করে পেয়ারা গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে আছে। অপেক্ষা করছি পরবর্তি ঘটনা দেখার জন্য। কিছুটা আতঙ্কেও আছে "যদি পাশের বাসার দোলা বা ওদের বাসার কেউ এই সময়ে এখানে এসে যায়!" মা ওর মুখের দিকে তাকিয়ে "হি হি হি" করে হেসে গড়াগরি যাচ্ছে। আর তাই দেখে দাদী গেলেন আরো ক্ষেপে।
-"কী লো বৌ!? মনে হচ্ছে ভানু মিয়ার যাত্রা দেখতিছো!?" মা সে কথার উত্তর না দিয়েই মুখে কাপড় চাপা দিয়ে হেসে যাচ্ছে। দাদী আবার হাঁক ছাড়লেন "তোয়াজ ও তোয়াজ...মলি কোহানে!" এবার বাবা চোখ ডলতে ডলতে বের হয়ে এলেন। হাই তুলতে তুলতে বললেন-
"আহা মা...কোথায় নীরব পরিবেশে একটু আরাম কইরে ঘুমোবো। তা না! তোয়াজ তোয়াজ কইরে গ্রাম মাথায় নিছো"
দাদি সেই একী টোনে বললেন-
-দেখ তোর ছাওয়ালের কান্ড...।
-কী করিছে ঐ বান্দর? কথাটা বলেই বাবা সেজানের মুখের দিকে তাকিয়ে "হো হো হো" করে হেসে যায়। এবার দাদী রাগে কাঁপতে থাকে। হাতের লাঠি বাতাসে ঘুরিয়ে বলে
-তোরা সব কয়ডা শহরে থাইকে থাইকে অমানুষ হইয়ে গেছিস! ছাওয়াল মানুষ করবি কী কইরে?
দাদির কথায় বাবা কান দিলেন না! তিনি হাসতে হাসতে সেজাকে বললেন-
-"তোরে দেখি একদম বাইলে মাছের মত লাগতিছে... হাঃ হাঃ হাঃ । আচ্ছা তোর গোঁফ কী অনেক বড় হৈচিলো নাকি ? হাঃ হাঃ হাঃ" সেজান কিছু না বলে শুধু এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখছে। দোলা যেন এসময় না আসে। বাবা এসে ছেলের মাথাটা বুকে টেনে নেয় "কী রে দাদীর চিৎকারে ভয় পেয়ে গেছিস?"
তা দেখে এবার দাদি বলে-
-হ্যাঁ ছাওয়ালরে কোলে নিয়ে আদর কর। আর শুনো কী গান গাচ্ছিল নবাবজাদা "শিশুকাল ছিল ভেলো যৌবুন কেনে আসিল"এই তোর ছাওয়ালরে দেহী বিয়ে দিতি হবে এহন!
"হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ" এক সাথে অনেকের অট্টহাসি শুনে পিছনে ফিরে সেজান। দেখে চাচা চাচী রেশমা আপু সবাই দাদীর কথা শুনে হাসছে। লজ্জায় সে মায়ের বুকে মুখ লুকিয়ে রাখে। আঁচলের ফোকর দিয়ে তাকায় রেশমা আপুর দিকে। দেখতে পায় একটা চমক খেলে গেছে তার চোখে! যা দেখে সে বুঝে যায় আপু বুঝে গেছে কেন সে গোঁফ কেটেছে।
-কিন্তু এহন যে তুই কিশোর থাকপি না নে। তোরে এহন যুবক যুবক লাগবেনে। দেখিস কেনে দুই তিন দিনের মধ্যি একেবারে মোটা ঘন গোঁফ গজাই যাবে নে।
বড় চাচার কথা শুনে কিছুটা ভয় ভর করে সেজানের মনে। সবাইকে ব্যাপারটা জানাতে পেরে দাদীর রাগ কিছুটা কমে গেছে! এবার ও ছাদে গিয়ে চুপ্চাপ বসে থাকে। কিছুই ভাল লাগছে না তার। সত্যি সত্যি যদি দুই তিনদিন পরে গোঁফটা বড় হয়ে যায়? তাহলে সে স্কুলে যাবে কী করে? সবাই তাকে নিয়ে হাসাহাসি করবে! এই কথাটা কেন মাথায় আগে আসেনি? নানা কথা ভাবতে ভাবতে ছাদের চিলেকোঠাতেই ঝিমুনি আসে। সময় কতটা বয়ে গেছে সে জানে না। কানে আসে ফিসফিস করে একজন মেয়ে আর একজন ছেলের কথা বলার আওয়াজ! কথা অনুসরণ করে একটু সামনে যেতেই সন্ধ্যার আবছা আলোয় সে যা দেখতে পায়? তা দেখার পর পা-টা যেন কে ছাঁদের সাথে সেঁটে রেখেছে। রেশমা আপু আর রাজু ভাইয়ার বন্ধু হাসান ভাই! ওরা দুজনে হাতে হাত রেখে কথা বলছে! রাজু ভাইয়া রেশমা আপুর বড় ভাই। সেজান অবাক হয় ক্লাস নাইনে পড়া মেয়ে এতো পেঁকে গেছে কি করে? তা আর বুঝতে বাকী থাকে না এইটে পড়া সেজানের! ওর মনে হোয় দাদী যদি জানতে পারে রেশমা আপু গ্রামে থেকেই এতো কিছু বোঝে? তাহলে নির্ঘাত ওর বাবা মাকে খুন করে ফেলবে।

ভয়ে সেজানের মুখ থেকে "রেশমা আপু" ডাকটা বের হয়ে যায়। কিন্তু সে নিজেই নিজের কন্ঠকে চিন্তে পারল না! ওরা দুজন ছিটকে দুদিকে চলে যায়। হাসান ভাই ভয় পেয়ে সাঁই সাঁই করে নেমে যায় নীচে। আর আপু এসে উল্টা ওকে বলতে শুরু করল- কিরে তুই কেন গোঁফ কেটেছিস? মনে করেছিস আমি জানি না। না? হুম...দোলা না..? দাঁড়া আমি কাল সব দোলাকে বলে দেব।
-না না আপু প্লিজ আজকের কোন কিছুই তুমি দোলাকে বলবা না। তাহলে আমি আর গ্রামে আসব না।
-ঠিক আছে তাইলে বল তুইও হাসান ভাইয়ের কথা কাউকেই বলবি না...প্রমিজ কর।
সেজান প্রমিজ করতে বাধ্য হয়। সে কাউকেই কিছু বলে না। কিন্তু সেদিন থেকে গ্রামে যতবার এসেছে রেশমা আপু আর হাসান ভাইয়ের পিয়ন হয়ে চিঠি আদান-প্রদান করেছে। তাতে করে রেশমা আপুও দোলার সাথে সেজানের ভাব করিয়ে দিয়েছে।

এরপর থেকে সেজান গ্রামে আসতে আগের থেকেও বেশি,অন্যরকম টান অনুভব করে। আর তাই প্রতিবারের মত এসএসসি পরীক্ষার ছুটিতেও মা বাবাকে নিয়ে গ্রামে চলে আসে। এরই মাঝে দোলার সাথে ভালবাসার সম্পর্কটা হয়ে যায়।এবারই ঘটে যায় একটা দুর্ঘটনা...। এদিন সেজান উঠোনের বড় পেয়ারা গাছ থেকে পড়ে যায়। দোলা রেশমা আপু সবাই নিষেধ করে সে যেন গাছে না উঠে। সে আসলে গাছে চড়তেও পারে না। কিন্তু দোলার সামনে একটু বিরত্ব না দেখালেই না। তাই সবার কথা অমান্য করেই গাছে চড়ে বসে। বেশীদূর উঠার আগেই পা পিছলে পড়ে যায় মাটিতে। পেয়ারা গাছের নীচে থাকা গেজুর গাছের কাঁটা ওর বাম চোখে ঢুকে যায়। সেদিন বিকালেই বাবা মা ওকে নিয়ে চলে আসে শহরে এবং ক্লিনিকে ভর্তি করে। কিন্তু এই সময়ের মাঝেই রক্ত ক্ষরণে বাম চোখটা অকেজো হয়ে যায়! সেজান ভাবে ছুটিতে কত মজা করতে তারা গেছে গ্রামে। কিন্তু করুণাময়ের ইচ্ছা কি কেউ জেনেছিল? হাসি আনন্দ সবই ছিল সেজানের জীবনে। ছিল প্রথম প্রেমের খানিকটা পরশ। যে পরশের হাতছানি পেতে মধ্য দুপুরের কড়া রোদের আলোতে ঘুড়ি নিয়ে ছুটে গেছে ছাদে! সন্ধ্যাবেলায় ঘন কুয়াশা ঢাকা ঢিমে আলোয় অপলক চেয়ে দেখেছে গ্রামময় উর্বশী রূপ। সকালের টুপটুপ শিশিরের ছন্দে যখন মিষ্টি আবেশে সুর তোলে পাখীদের গান? দোলা আর সে দুজনে মিলে তখন শিউলি কুড়ায়ে ঝাপি ভরেছে পরম আনন্দে। আনমনা হয়ে মাকে জিজ্ঞাসা করে
- মা আমি আর মনে হয় কোনদিন দুচোখ ভরে দেখতে পাব না...আর কোন আনন্দ উপভোগ করতে পারব না! তাই না মা?
বুকের ভেতর তোলপাড় করে উঠে ঝড়। ওর মা ছুটে যায় ডাক্তারের কাছে। ডাক্তার পরামর্শ দেয় এক সপ্তাহের মধ্যে যদি কর্নিয়া সংগ্রহ না করা যায়? তাহলে চোখটা খুব শীঘ্র তুলে ফেলতে হবে। না হলে এই চোখের কারণে ডান চোখটাও আলো হারাবে। ডাক্তারের কথা শুনে সেজানের মা পাগলের মত হয়ে যায়। যেভাবেই হোক আদরের সন্তানের দুচোখেই আলো চাই তাঁর। এই আধোঁ আলো অন্ধকারে সে তাঁর ছেলেকে রাখতে পারবে না। হঠাৎ আপন ভাবনায় মায়ের মন দুলে উঠে অসীম আনন্দে। বুকের ধন মায়ের হাসিমাখা মুখ,সুন্দর এই পৃথিবী চোখে দেখবে না...? মা বেঁচে থাকতে তা কি হয় কখনো?


তারপর কেটে যায় বছরের পর বছর...। কত শীত আসে আবার একাকী চলেও যায়। গ্রামের মেঠো পথ চেয়ে থাকে কারো অপেক্ষায়...। এদিকে জীবনের মানে খুঁজে পায় সেজান আর দোলা। দুজনে হাতে হাত রেখে পাড়ি দেয় এক অনাবিল সুখের জীবনে। যে জীবনে গ্রামে যাওয়া এখন সময় নষ্ট,ঝক্কির কাজ। সেজান দুচোখ ভরা আলো নিয়ে গড়ে তোলে স্বর্গ। সেই স্বর্গের বাগানে ফুল হয়ে আসে সন্তান দীপ। দাদীর চোখের মণি। দাদাকে সে চোখে দেখেনি। শুনেছে রোড এক্সিডেন্টে মারা গেছে।

ইদানীং সেজানের হয়েছে যত জ্বালা! বাবা মারা গেলে দাদু বাড়িতে পাওয়া সব সম্পত্তি বিক্রি করে এই ফ্লাটটা কিনেছে। কিন্তু সমস্যা হল মা। উনার একটা চোখ নেই। তার উপর আরেকটা চোখেও ইদানিং ভালো দেখতে পায় না। মাকে প্রায়ই ডাক্তারের কাছে নিতে হয়। দোলা সেজান দুজনেই চাকুরী করে। যে দিনকাল পড়েছে দুজনে আয় না করলে ভালো ভাবে বেঁচে থাকা যায় না। ফ্লাটটা কিনেছে সপ্তম ফ্লোরে তাই একটু সস্তায়-ই পেয়েছে। কিন্তু মাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়াটাই হয়েছে সমস্যা। আগের বাসা যেখানে ছিল মা নিজেই লাঠি ভর দিয়ে একা একা যেতে পারত। কিন্তু এখান থেকে সে কী করে যাবে? আর ওদেরও সময় নেয় যে মাকে নিয়ে দুদিন পর পর ডাক্তারের কাছে নিয়ে দৌড়াবে! মাকে নিয়ে সৃষ্ট এই সমস্যার সমাধান পেতে বন্ধুদেরকে আমন্ত্রণ জানায় দোলা আর সেজান। সবাই মিলে পরামর্শ করে একটা বিষয়ে একমত হয়...সামান্য কিছু টাকা খরচ করলে মাকে আর প্রতিদিন হাসপাতালেও নিতে হবে না। আর মায়ের ঘ্যান ঘ্যানও শুনতে হবে না! "এভাবে একা একা কীভাবে বাসায় থাকব? আগে তো একটু বের হতে পারতাম। সিঁড়ি টপকাতে হত না। এখন আমি বন্দী হয়ে গেছি! আলো বাতাস কিচ্ছু নাই! ও বাজান জানালা দিয়ে ওতো কিছু দেখতে পাইনা?"
-মা কেন এতো বাচ্চাদের মত ঘ্যান ঘ্যান কর? জানালা দিয়ে কী দেখবা? তুমি তো চোখেই দেখতে পাওনা"! হুস্কির গ্লাসে খানিকটা চুমুক দিয়ে সেজান মাকে বলে কথাটা। বয়সের কারনে অসুস্থতা তার উপর চোখে দেখেনা। "অন্ধ মানুষ নিয়ে হয়েছে যত জ্বালা!" বিড়বিড় করে শেষ চুমুকে গ্লাস শেষ করে বিরক্তি প্রকাশ করে। এই ঝামেলা থেকে মুক্তি নিতেই মাকে রাজি করাতে চেষ্টা করে যায়।
-মা ওখানে তোমার বয়সী অনেকেই আছে। সবাই একসাথে গল্প করে, গেইম খেলে, পার্টি দেয়। ঠিকমত টাইম টু টাইম ডাক্তার এসে দেখে যাবে। আর তোমাকে নিয়ে আমাদেরকে টেনশানে থাকতে হবে না।
-কিন্তু তোরা আমাকে নিয়ে কেন টেনশন করিস?
মায়ের এমন কথায় দোলা এসে মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে-মা কিযে বলেন না! আমরা টেনশান না করলে কে করবে? আমি তো একদমই কাজে মন বসাতে পারি না। আপনি কী করছেন? ঠিক আছেন কিনা। বাথ্রুমে পড়ে গেলেন কিনা !
-কি যে বল বৌমা বাথ্রুমে যাবার মত শক্তি তো আমার আছে এখনো,পড়ব কেন ?
-মা আপনি চোখে দেখেন না এটা কেন ভুলে যান !
-না বাপু আমি কোথাও যাচ্ছি না ...আমি এইখানে আমার দাদু ভায়ের সাথে থাকব! আমাকে নিয়ে তোমাদেরকে ভাবতে হবে না। দাদুভাই আমার কাছে থাকলে তোমাদেরকেও আমার লাগবে না। কথাটা বলে কোলে বসে থাকা আট বছরের দীপকে বুকে টেনে নেয়।
-মা বাচ্চাদের মত জেদ করবা নাতো? তুমি যদি ঠিকমত দেখতে পেতে তা হলে না একটা কথা ছিল! কিন্তু তুমি বুড়া হৈছো তার উপর অসুস্থ থাক। কেন বুঝো না তোমারে দেখার এই বাসায় কেউ নাই। আমি যা করছি তোমার ভালোর জন্যই করছি। আর মাঝে মাঝে তো আমরা যাব তোমাকে দেখ্তে না কী?
রাগে সেজানের কপাল থেকে টপ টপ করে ঘাম ঝরে পড়ে।
মা বাবাকে দাদির সাথে এত কথা বলতে দেখে দীপ বলে উঠে- বাবা তোমরা কেউ ভেব না...এই আমি দাদীভাইকে দেখে রাখব!
খুব সাহস দেখিয়ে কথাটা বলে দীপ । দাদী চলে গেলে সে বুয়ার কাছে থাকবে তা সে চায় না। দাদীভাই তাকে কত সুন্দর সুন্দর রুপকথার গল্প বলে,গ্রামের গল্প বলে। এই বাসায় একমাত্র দাদীভাই তাকে অনেক বেশী ভালবাসে।
সেজান মাকে কড়া করে বলে সব গুছিয়ে নিতে। কাল সকালেই যেতে হবে। ওরা সবাই মায়ের ঘর থেকে বয়ের হয়ে যায়।

সেজানের মায়ের মনে পড়ে- ছেলে দুরন্তপনায় মাঝে মাঝে এমন এমন কাজ করে বসত? তার জন্য দোষের ভাগটা তাঁকেই ঘাড়ে নিতে হত। "এতো আদর দিয়ে দিয়ে ছেলেটাকে অকম্যের বানাই ফেলছো" স্বামীর এমন অনুযোগ প্রায়ই শুনতে হত তাঁকে। সারাদিন বন্ধুদের সাথে গেম আর ডিভিডিতে কার্টুন,ডিস্কোভারি দেখা। এই থেকে কোনভাবেই যখন সেজানকে বের করা যাচ্ছেনা? তখন মা নিজের জমানো টাকায় কবুতরের ফার্ম করে দেয় বাসায়। যা ছিল শহরের বাসিন্দার জন্য খুবই বিরক্তের। তবুও মায়ের কথা শুনে কিশোর সেজান করেছিল কেবল মাকে খুশি করতে। মায়ের জন্য তার কত ভাবনা! সেই সেজান আজ এ কী ভাবনা ভাবছে মায়ের জন্য ...!? আর কোন সন্তান তাঁর কোলজুড়ে আসেনি। সে জানেনা আরো একটা সন্তান থাকলে আজকের দিনটা তাকে দেখ্তে হত কিনা! "ছোট্ট সেজানই অনেক আপন ছিল। কেন বড় হলি বাবা?" দীর্ঘশ্বাসটা ঢিমে তালে নেমে রক্ত ঝরায় বুকে। জীর্ণ ছোট্ট লাগেসটা গোছাতে গোছাতে মনে পড়ে ছেলের দুরন্ত কৈশোরের হাজারও কথা।

সকাল হতেই সেজান দোলা রেডী হয়ে মাকে নিতে রুমে ঢুকে। সেজান বলে-"আরে একটু তাড়াতাড়ি করবা না? মাকে ওখানে দিয়েই অফিসে যেতে হবে একটা জরুরী মিটিং আছে"
বিছানার উপর মা কাত হয়ে শুয়ে আছে। বুকের মাঝে ফ্রেমবন্দী একটা ছবি। মা তো চোখে দেখতে পায় না। তাহলে এইটা কীসের ছবি মা বুকে ধরে রেখেছে? এক দৃষ্টিতে সেজানের দিকে তাকিয়ে আছে পাথরের চোখ। সেজান সামনে এগিয়ে গিয়ে মায়ের বুকের উপর থেকে ছবিটা হাতে নেয়- যেদিন প্রথম গোঁফ কেটে একটা হুলুস্থুল ঘটনা ঘটিয়েছিল? সেই দিনের ছবি। মা বাবা সবাই হাসছে আর সেজান মায়ের বুকে মুখ লুকিয়ে রেখেছে। সেদিন ছবিটা বড় চাচা তুলেছিলেন মজা করে। অথচ মা কত যত্ন করেই না রেখেছে! মায়ের গাঁয়ে হাত দিয়ে চমকে উঠে "বরফের মত ঠাণ্ডা মায়ের শরীর!" দিপু এসে দাদীকে জড়িয়ে ধরে । কিন্তু একটুও নড়ে না সে। সেজান বুঝতে পারে অনেক বেশী অভিমান করেছে মা। সে বুঝতে পারে মায়ের এই অভিমানের কারনটা কী! যদিও অনেক দেরী হয়ে গেছে। "দাদী ভাই এই দেখ আমিও ব্যাগ গুছিয়েছি তোমার সাথে যাব বলে। তোমাকে একা আমি যেতে দেব না দাদী" সেজান নিজের হাত মুষ্টিবদ্ধ করে বুকের ভীতরে তোলপাড় করা যুদ্ধটাকে থামাতে চায়। সে অনুভব করে তার দুচোখেই পরাজয়ের আধাঁর নামতে শুরু করেছে।

এই ঘটনার পর থেকে দীপের যে কী হল!? সে কারো সাথে কথা বলে না। খেতে চায়না এবং কিছুই মনে রাখতে পারে না! কোথাও একটু শব্দ হলেও সে ভয় পায়। এমন কী দোলা বা সেজান কথা বললেও,সে ভয়ে জড়সড় হয়ে কাঁপতে থাকে। বাবাকেই খুব বেশি ভয় পায়। কতদিন ছেলেটাকে স্পর্শ করে দেখে না সেজান! সে সারাদিন দাদির খাটে বসে থাকে। আর ক্যামন যেন ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে কাউকে খুঁজে যায়। সেজান আর দোলা ছেলেকে ডাক্তারের কাছে নিয়মিত নিয়ে যায়। ডাক্তার বলেছে দীপ কোন ঘটনা থেকে বড় ধরণের মানসিক আঘাত পেয়েছে। যা থেকে ওর মনের মাঝে একটা ভয় বিস্তার করেছে। ওকে খুব ভালো সেবা দিতে হবে। ও যেমনটা চায় সেভাবেই রাখতে হবে। সাথে চিকিৎসা চলবে। দোলা এখন চাকুরী ছেড়ে দিয়ে ছেলের দেখাশুনা নিজেই করে। কখনো কখনো সে ভীষণভাবে অনুতপ্ত হয়। "শাশুড়িকে বাড়ীতে না রেখে আশ্রমে রাখার জন্য স্বামীর সাথে সে যদি তর্ক না করত? যদি স্বামীকে বুঝিয়ে তাঁর দেখাশুনা করতে একটা মানুষ রেখেও দিত। তাহলে আজ এভাবে নিজেকে শাস্তি পেতে হত না! এই শাস্তি তার প্রাপ্য ছিল!" কথাগুলো মনে হতেই মনের মাঝে ব্যথা অনুভূত হয়। কিন্তু আশ্চর্য...! ওর চোখ দিয়ে একফোঁটা পানিও বের হয় না। হৃদয়,চোখ সব যেন শোকে দুঃখে রোদে পুড়া খাঁ খাঁ জমি হয়ে গেছে! এখন তারও কারোর সাথে খুব একটা কথা বলতে ইচ্ছে হয় না।

আগের মত করে সেই উচ্ছল,সুখের স্রোতে সেজানও আর ভাসে না! অফিস,কাজ কোনকিছুই এখন আর ভালো লাগে না। মাঝে মাঝে ভাবে সবকিছু ভুলে বাস্তবতাকে মেনে নিয়ে আবার আগের মত হয়ে যাবে। আর তাই নিজেকে সান্ত্বনা দেয় - "আচ্ছা ভুল তো মানুষই করে?" নিজেই আবার আহত হয় ভেবে-"এটা কোনভাবেই ভুল নয়! সে রীতিমত পাপ করেছে!" সমস্ত শরীর কাঁপিয়ে দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে আসে। ভাবে-"মিথ্যে সান্ত্বনা নিয়ে যারা আনন্দ পায় তারাই সুখে থাকে। আর যারা এমনটা পারে না,কষ্টই কেবল তাদেরকে ঘিরে ধরে।" সে পারবে না মিথ্যে সান্ত্বনা নিয়ে বেঁচে থাকতে। দীপের জন্যই পারবে না...।
আগে হুইস্কির স্বাদ সে মাঝে মাঝে নিত। আর এখন অফিসে কাজের ফাঁকে ফাঁকে। আর কাজ শেষ করে মধ্যরাত পর্যন্ত এই হুইস্কিই তার একমাত্র সঙ্গী...! মায়ের সাথে সাথে যেন সময়টাও থমকে গেছে...। প্রতিটা মুহূর্ত স্মৃতিগুলো সব তাজা হয়ে এসে ওকে জড়িয়ে ধরে সাপের মত। দেয়ালে রাখা ফ্রেমে বন্দি ছবিটা দেখতে দেখতে চোখ ঝাপ্সা হয়ে আসে। অনুভব করে-"ভালবাসার অনেকগুলো রঙ থাকে। যা ছড়িয়ে থাকে অনেকগুলো সম্পর্কের মাঝে। কিন্তু দুঃখ...! দুঃখের রঙ একটাই-তা যে রঙ থেকেই আসুক না কেন!" কথাগুলো বুকে চাপ চাপ ব্যথা আনে। হু হু করে কেঁদে যায় হৃদয়! ঢক ঢক করে গ্লাস ভরে কেবল হুইস্কিই গিলে খায়। পেটে প্রচণ্ড ব্যথা! ব্যথায় পেট চেপে ধরেই খায়। প্রতিদিন দুই তিনটা গ্লাসের উপর দিয়ে ঝড় বয়ে যায়। সে ঝড়ে প্রতিদিনই সে রক্তাক্ত হয়...ইচ্ছে করেই হয়। একমাত্র এভাবেই যেন সে,কিছুটা স্বস্তি খুঁজে পায়।

আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
মামুনুর রশীদ ভূঁইয়া আরেকটি চমৎকার গল্প। ধন্যবাদ সুন্দর এ গল্পটির জন্য। সময় পেলে আসবেন আমার পাতায়।
তানি হক Ovinondon prio apu
অনেক ধন্যবাদ প্রিয় নিরন্তর শুভকামনা।
শামীম খান অভিনন্দন রইল আপা ।
অনেক অনেক ধন্যবাদ নিরন্তর শুভকামনা ।
Fahmida Bari Bipu অনেক অনেক অভিনন্দন আপা।
অনেক অনেক ধন্যবাদ আপু নিরন্তর শুভকামনা।
শাহ আজিজ সেজানের কাহীনি এই সমাজের প্রতিচ্ছবি , ভাল লাগল ।
সময় করে পড়ার জন্য আন্তরিক ধন্যবাদ । ভালো থাকুন । নিরন্তর শুভকামনা রইল।
মোহাম্মদ আহসান ভালো লেগেছে
ধন্যবাদ শুভকামনা রইল
অর্বাচীন কল্পকার আসলেই, গল্পটা আরো বড় করে উপন্যাস করে ফেলেন :)
ধন্যবাদ সতত শুভকামনা ।
মোজাম্মেল কবির গল্পটা উপন্যাস হতে পারতো...
অনেক অনেক ধন্যবাদ পড়ে পরামর্শ দেবার জন্য। নিরন্তর শুভকামনা ।

২৭ মে - ২০১১ গল্প/কবিতা: ১২০ টি

সমন্বিত স্কোর

৪.৪

বিচারক স্কোরঃ ২.৯৬ / ৭.০ পাঠক স্কোরঃ ১.৪৪ / ৩.০

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "স্থিতিশীলতা”
কবিতার বিষয় "স্থিতিশীলতা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪