"সারাটা জীবন আমাকে জ্বালিয়ে শেষ করলে! বিয়ের আগে কত বড় বড় বুলি আওড়াতে। ছয় মাসে একবার দেশের দর্শনীয় জায়গাগুলোতে ঘুরতে নিয়ে যাবে। বছরে দশটা শাড়ী কিনে দেবে। সপ্তাহে একটা ছবি দেখাবে। কিন্তু কি দিয়েছো আমাকে হ্যা !" একটু থেমে আবার শুরু করে- "ছয় মাসে তো দূরে থাক ছয় বছরেও একবার নিলে না। আর দশটা তো দূরে থাক বছরে দুই ঈদে দুইটা শাড়ীও কিনে দিতে পারো না। আর ছবি? দেখতে চাইলেইতো বল "টিভিতেই তো দেখায় কত ছবি শুধু শুধু হলে গিয়ে সময় নষ্ট" হায় আল্লাহ এই আমার কপালে ছিল? এ জানলে আমি এই পাষণ্ড লোকটাকে কোন দিন বিয়ে করতাম না। সেই সকালে বের হয় আর ফেরে রাত একটা দুইটায়। মাঝে মাঝে তো তাও ফেরে না । আমি কোনদিন একদিকে চলে যাব। আমি এমন জীবন চাই না । নাম কিনবে উনি! এই প্রফেশনে কেউ কোনদিন নাম কিনেছে? গাধার মত খেটে খেটে যায় অথচ মাস শেষে বেতনও নাই! তবুও ভাবখানা একদিন টাকার খনি পেয়ে যাবে। সব আমার কপাল সব আমার ভুল! হু হু হু "স্ত্রী রুবানা বকবক করেই যাচ্ছে একা একা। আর ফুচফুচ করে কেঁদে যাচ্ছে। জামিলের ভাল লাগে না এই অভাবের সংসার। সারাদিন এত শ্রম দিচ্ছে কিন্তু তারপরও মাসের শেষে ঠিকমত বেতনটাই পায় না। জিনিষ পত্রের যে দাম বেতনের টাকা সময় মত পেলেও তা দিয়ে বড়জোর মাসের তিনভাগ চলে। আর সেখানে বেতন না পেলে...? নিজের অজান্তেই বুকচিরে দীর্ঘশ্বাসটা বের হয়ে আসে। মোবাইলের রিঙটোনের শব্দে ধড়ফড় করে বিছানায় উঠে বসে জামিল । সে এতক্ষণ স্বপ্ন দেখছিল!? ঘড়ি দেখে ভোর পাঁচটা। মোবাইলের স্ক্রিনে বসের ফোন দেখে তাড়াতাড়ি বলে-
-হ্যালো স্যার!
-জামিল সাহেব ছয়টার মধ্যে আনন্দ আশ্রমে চলে যাবেন। ওখানে আশ্রমের কর্ণধারের একটা ইন্টারভিউ নিয়ে দশটার মধ্যে অফিসে আসবেন ।
-কিন্তু স্যার আমি তো বাসায় এসেছি রাত দুইটার পরে,মানে একটু...রেষ্টের দরকার...কথা শেষ হয় না
-ঠিক দশটায় অফিসে আমার সাথে দেখা করবেন। কথাটা বলেই বস লাইনটা কেটে দিলেন। জামিলের বুক চীরে আবারও একটা ঝড় হাওয়া বের হয়ে এসে বুকটা ভারি করে দেয়। হঠাৎ চোখ যায় ঘুমন্ত রুবানার দিকে। কি সুন্দর শান্ত কোমল শিশুরমত সে ঘুমিয়ে আছে। সংসারে এত অভাব কিন্তু রুবানার কোন অভিযোগ নেই, নেই কোন চাহিদা। আর তাই নিজেই গুমরে কাঁদে প্রিয় সাথীকে পর্যাপ্ত প্রাপ্য সুখ স্বাচ্ছন্দ্যটুকু দিতে না পারার অপরাধে। স্ত্রীর গায়ের চাদরটা টেনে দেয় গলা পর্যন্ত। রুবানা একটু নড়ে ওঠে। কয়েক মুহূর্ত অপলক চেয়ে থেকে একটা মুচকি হাসি দিয়ে স্ত্রীর কপালে আদর করে দেয়।
রেডি হয়ে কলম কাগজ নিয়ে লেখে-"মিষ্টি সোনা বউ খুব জরুরী একটা ইন্টারভিউ নিতে হবে। আগে জানতাম না বস ভোরে ফোন করেছে বিধায় ছুটে আসতে হল। কাজ শেষ করে চলে আসব তাড়াতাড়ি। রাগ কর না প্লিজ। ভালবাসা ও ভালবাসা মাখা আদর নিও...উম্মম্মমাহ" জামিল চিরকুটটা টেবিলে রেখে বের হয়ে একটা রিক্সা নিয়ে ছুটে চলে আনন্দ আশ্রমের দিকে। কিন্তু সে কিছুতেই বুঝে পাচ্ছে না,একজন আশ্রমের কর্ণধারের ইন্টারভিউ কেন নিতে হবে? কে সে? আর এত ভোরেই বা কেন? বেশ একটা বিরক্তিকর ভাব নিয়ে রিক্সা থেকে নেমে আশ্রমের গেইটে হাত দেবার আগেই দরজা খুলে যায়। গম্ভীর প্রকৃতির একজন বয়স্ক লোক জামিলকে সাথে নিয়ে দোতলায় একটা ঘরের সামনে ইশারায় দাঁড়াতে বলে নিজে ভীতরে ঢোকে। জামিল বেশ ভাল করে দেখে নেয় আশ্রমের ভীতরটা। আশ্রমের নাম "আনন্দ আশ্রম"হলেও আনন্দের মত কিছুই তার নজরে পড়ল না! নানা বয়সের বেশ কিছু বাচ্চা ছেলে মেয়ে ছোট্ট মাঠে হাঁটাহাঁটি করছে। খুব নীচু শব্দে পুঁথি পাঠের মত শব্দ আসছে কিন্তু জামিল বুঝতে পারছে এটা আসলে পুঁথি পাঠ না। তাহলে কী? ভাবনায় ছেদ পড়ে লোকটি বের হয়ে আসায়। এবার সে ইশারায় তাকে ভীতরে যেতে বলছে। ভীতরে ঢুকে সে দেখতে পেল ঘরটি বেশ বড়। তবে সেই তুলনায় আসবাব পত্র কিছুই নেই! একটা চেয়ার,ছোট্ট একটা টুল আর একটা চৌকি ছাড়া। একটা লোক চৌকিতে আধশোয়া অবস্থায় আছেন। মাঝেই মাঝেই খকখক করে কাশি দিয়ে জানান দিচ্ছেন তিনি খুবই অসুস্থ। চৌকিতে থাকা লোকটি এবার জামিলকে ইশারায় চেয়ারটা দেখিয়ে দিয়ে বসতে বললেন। আর যে লোকটি জামিলকে নিয়ে এসেছিল তাকে চলে যেতে বললেন । কী ঘটতে যাচ্ছে তা জানার আগ্রহে জামিল বসল। কিন্তু কীভাবে যে ইন্টারভিউ শুরু করবে ঠিক বুঝতে পারল না। তার দীর্ঘ জীবনের কাজের অভিজ্ঞতাও যেন আজ তাকে উপহাস করছে। কারো সম্পর্কে কিছু না জেনে সাক্ষাৎকার নেয়া এই প্রথম। কিছুই মাথায় আসছে না। কত বড় বড় রাজনীতিবীদ,কত ঝানু ব্যবসায়ী, নাট্যকার,শিল্পি কুশলী এমন কি দাগী আসামী সন্ত্রাসী ট্যারাবিল্লুর সাক্ষাৎকারও সে নিয়েছে। কিন্তু আজ কেন এমন লাগছে? অজান্তেই ঘামছে সে। টিমটিম করে হারিকেন জ্বলছে! মাথার উপরের দিকে তাকাতেই দেখল কোন সিলিং ফ্যান নেই। লোকটাও কিছু বলছে না। জামিল একটু নড়েচড়ে বসলো। ট্রে হাতে বার তের বছরের একটা কিশোরী ঘরে প্রবেশ করল,সাথে সেই প্রথম দেখা লোকটি। লোকটা টুলটা এনে জামিলের সামনে রাখতেই তার উপর ট্রে রেখে মেয়েটা বের হয়ে গেল। দুটো আটার রুটি, সামান্য আলুভাজি আর এককাপ র-চা । জামিল কী করবে ভেবে পেল না। লোকটি তাকে খেতে বলল। এবার সামনে আধশোয়া থাকা মানুষটির দিকে তাকালো জামিল। এই প্রথম কথা বলল ভদ্রলোক-
-আমার নাস্তা আরও এক ঘন্টা আগে সেরেছি। আপনি খেয়ে নিন তারপর কথা বলি।
লোকটার কণ্ঠস্বর সাংবাদিক জামিলকে আরো বেশি অবাক করে দিয়ে ওকে ভাবিয়ে তোলে। এবার কেমন যেন একটা আগ্রহ তৈরী হল সাক্ষাৎকার নিতে। মনে মনে বেশ কিছু প্রশ্ন তৈরি করে ফেলল! একটা অন্যরকম অনুভুতি শিহরণ জাগালো মনে। ওর সমস্ত ইন্দ্রিয় বলছে- এতো দিনে সে মনে হয় একটা মনের মত কাজ পেয়েছে। চায়ে চুমুক দিতেই ওকে চমকে দিল হঠাৎ কথা বলে উঠা কণ্ঠস্বরটি। যে কণ্ঠ শুনে আর একটু হলেই চলাত করে চা পড়ে যেত ওর কাপড়ে! নিজেকে সামলে নিয়ে সাথে আনা টেপরেকর্ডার চালু করে সে। এবার কণ্ঠটি বিরক্ত নিয়ে বলে- "ওটা বন্ধ করুন!" লম্বা লম্বা পুরুষালি হাত দেখিয়ে দেয় টেপরেকর্ডারটা। কিছু না বলেই জামিল বন্ধ করে দেয়। লোকটি শর্ত দিলেন কোন ধরনের প্রশ্ন করা যাবে না। উনি নিজের মত করে বলে যাবেন আর জামিল তা শুনে শুনে যদি কিছু কাগজে টুকে নিতে হয় তা নিবেন। তবে উনি কথা বলা শুরু করলে কথার মাঝে কোন ধরনের কথা বলতে পারবেন না।
শর্ত শুনে মেজাজটা খারাপ হল। জামিল ভাবে "ধুর খ্যাতা পুড়ি এমন সাক্ষাৎকারের! যে ফিচার লিখবে সে কিছু জানার থাকলেও কিছুই জিজ্ঞাসা করা যাবে না? আসছেন অ্যামেরিকার প্রেসিডেন্ট!"ভীষণ বিরক্ত লাগে জামিলের। কিন্তু মনে পড়ে বসের কথা। "জামিল সাহেব যেভাবেই হোক এই ইন্টার্ভিউ নিয়ে ছবিসহ আর্টিক্যাল লিখে আজকে রাতের ভীতর জমা দিতে হবে!" জামিলের কেন যেন মনে হয় এই ফিচার নিয়ে বসের কোন অভিসন্ধি আছে! বস অনেক চতুর একজন তা সে খুব ভালো করেই জানে। উনি যখন কিছুই না জানিয়ে এখানে পাঠিয়েছে? তখন নিশ্চয় চমকপ্রদ কিছু আছে এখানে! জানার আগ্রহটা এবার বাড়ে জামিলের। আর তাই সব শর্ত মেনে নিয়ে চুপচাপ কাগজ কলম নিয়ে লিখে যায়। এবার কাশি দিয়ে গলাটা পরিষ্কার করে নিয়ে লোকটা বলে যায়-
আমার নাম হরিপদ রায়। এই বাংলাদেশেই আমার জন্ম। আমার বয়স তখন আট বছর। ১৯৭১ সালে জ্যাঠা-জ্যাঠি ,জ্যাঠতো ভাইবোন,বাবা মা,ঠাকুর মা আর বোন সুস্মিতাকে নিয়ে আমাদের সুখের সংসার ছিল। চারিদিকে তখন ভয়াবহ অবস্থা? জ্যাঠা মশাই এদেশে আর থাকতে চাইলেন না। তিনি পরিবার নিয়ে ওপারে চলে গেলেন। উনি চলে গেলে বাবা বড্ড একা হয়ে গেলেন। কিন্তু তবুও দেশ ছেড়ে,বাড়ী ছেড়ে যেতে চাইলেন না। আমার বাবা ছিলেন একজন স্কুল শিক্ষক। খুবই সাধারন একজন মানুষ। তাঁর যত বন্ধুবান্ধব ছিলেন সবাই তাঁকে আশ্বাস দিলেন যে,তাঁদের জীবন থাকতে আমার বাবার এবং পরিবারের কিছুই হবে না। আর তাই যুদ্ধের সময়ে আমাদের কোন ক্ষতি হয়নি। আমরা বাবারই এক বন্ধু রইস উদ্দীনের গ্রামের বাড়ীতে ছিলাম। আমরা গ্রামে গেলে আমাদের বাড়ীতে বাবার আরেক বন্ধু রশিদ সাহেব থেকে বাড়ীটি রক্ষা করেন। যুদ্ধ শেষ হলে আমরা আমাদের বাড়িতে ফিরে আসি। যুদ্ধের ভয়াবহ দিনে কিছু না হলেও,তার তিন চার মাস পরে স্বাধীন দেশেই ঘটে যায় একটি ঘটনা! একদিন রাতে কয়েকজন মুখোশধারিরা এসে,আমার বাবার বুকে বন্দুক ধরে পনেরো বছরের বোন সুস্মিতাকে তুলে নিয়ে যায়! সুস্মিতার শোকে মা বিছানা নিলেন। যখন খুঁজেও সুস্মিকে কোথাও পাওয়া গেল না। তখন মা আর এইদেশে থাকতে চাইলেন না এবং প্রতিজ্ঞা করলেন তিনি এই দেশের একফোটা দানা মুখে দিবেন না।
জানালা দিয়ে আসা মিষ্টি আলোর দিকে তাকিয়ে কী যেন ভাবলেন হরিপদ বাবু। জামিলের মনে হল লোকটা নিজেকে সামলে নিতে সময় নিচ্ছে। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আবার শুরু করলেন-
বোন সুস্মিতার সাথে আমার কেটেছে শৈশব। সেই ছিল আমার একমাত্র বন্ধু ও খেলার সাথী। আমাকে বাবা মা একরকম লুকিয়ে রাখতেন। কখনো কারো সামনে আসতে দিতেন না! এমনকি অনেকেই জানত না যে আমি এই বাড়ীরই কেউ। এক মাত্র বোনের শোকে আমি ছাঁদের চিলে কোঠায় বসে চুপিচুপি কেঁদে একাকার হতাম। তবে আমার মন বলতো সুস্মি একদিন ফিরে আসবে। মাকে নিয়ে বাবা বিপদে পড়ে গেলেন। কী করবেন ভেবে পেলেন না। কন্যা শোকে মা তার সংসার ভুলে গেলেন। ঠাকুর মাও অসুস্থ হয়ে পড়লেন। আর তাই বাবা ঠিক করলেন এদেশে তিনি আর থাকবেন না। মেয়েকে হারিয়েছেন কিন্তু স্ত্রীকে হারাতে চান না। আর ঠাকুর মা সেতো শুধু তার একার নয় জ্যাঠমশাই এরও মা সে। সবাই মিলে যখন ওপারে চলে যাবার জন্য মনস্থির করলাম বাঁধ সাধলেন ঠাকুর মা। তিনি তাঁর এই স্বামীর ভিটা ছেড়ে একচুলও নড়বেন না। বাবা পড়লেন বিপাকে। এক দিকে স্ত্রীর জেদ এ দেশের অন্ন মুখে না নিয়ে তিনি মারা যাবেন। আরেক দিকে গর্ভধারিণী মায়ের জেদ পতিদেবতার স্মৃতি আকড়ে পরম শান্তিতে চিতার ধুলো হবার। শেষ পর্যন্ত বাবা,মা আর আমাকে নিয়ে রওনা হলেন ওপারে। রওনা দেবার সময়ে ঠাকুরমাকে কোথাও পাওয়া গেল না। উনি সামনে আসবে না বলে পালিয়েছে আমি নিশ্চিত। বাবা তাঁর মায়ের জন্য অপেক্ষা করলেন না। আমরা চলে গেলাম জ্যাঠা মশাইয়ের কাছে।
আমি তখন সতের বছরের কিশোর। আমার বাবা শিক্ষক হলেও আমাকে কোনদিন স্কুলে পাঠাননি। বাসায় তিনি নিজেই আমাকে হাতে কলমে যেটুকু শিখিয়েছেন। বাবা মায়ের ভয় পাছে আমাকেও তাঁদের হারাতে হয়। আমাকে লুকিয়ে রাখলেও যে দেশে যে বাড়ীতে আমার জন্ম? আমার খেলার সাথী সুস্মিতার জীবন্ত ছুটে চলা স্মৃতি। তা আমাকে বারবার হাত ছানি দিয়ে ডাকতে থাকে। আমি অনুভব করি-আমাকে কোন বাঁধায়ই যেন ওখানে জেতে আটকে রাখতে পারবে না! আমার আর সুস্মির একটা মাটির ঘরছিল। যেখানে আমরা পুতুল নিয়ে খেলা করতাম। এক এক দেশের মাটিরও যে ভিন্ন ভিন্ন রং থাকে তা আমি তখনই প্রথম জানতে পারি! আর মাটির যে কী সুন্দর একটা ঘ্রাণ আছে? তা আমি পেয়েছিলাম আমাদের মাটির ঘর থেকে। ওপারে গিয়েও আমি যখন ঘুমাই, তখন সেই মাটির সুন্দর গন্ধটা পেতাম। ঠাকুরমার জন্য আমার মন কাঁদতে লাগল। একদিন কাউকে কিছু না বলে চলে এলাম এপারে আমার স্বর্গীয় ভুমিতে। কিন্তু একী! আমাদের বাড়ীতে ঠুকে দেখি ছোট ছোট চারটা বাচ্চা খেলা করছে! বাসার ভীতরে কেউ নেই। কিছুক্ষন অপেক্ষা করতেই ঠাকুরমাকে দেখতে পেলাম। আমার ঠাকুরমা মানুষের বাসায় ভিক্ষা করে!? সব বাসা থেকে ভাতের মাড় এনে বাচ্চাদেরকে নিয়ে কোন রকমে খায় আর এই বাড়ীর বারান্দায় ঘুমায়।
বাবা ভেবেছিলো ঠাকুরমার থাকা খাওয়ার জায়গা যদি না থাকে তাহলে সে বাবার সাথে ঠিকই যাবে। আর তাই সবার অগোচরে বাবা বাড়ীটি বিক্রি করে দেয় তারই বন্ধু রশিদের কাছে। রশিদ সাহেব বাডীটি ভাড়া দিয়েছেন। তবে শর্ত যতদিন বুড়ী বাঁচবেন পিছনের বারান্দাটায় তাঁকে থাকার জায়গা দিতে হবে। প্রথমে উনি আমাকে চিনতে পারেনি! কিন্তু যখন আমি ঠাউমা বলে ডাক দিলাম? আমার কন্ঠ শুনে তিনি আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। তারপর মনে হল ধীরে ধীরে উনি আমাকে যেন গল্প বললেন-
- আমরা এখান থেকে চলে যাবার প্রায় পাঁচ বছর পরে সুস্মিতা নিজে থেকেই ফিরে আসে। সে ততদিনে মুসলমান ধর্ম নিয়ে ঘর করছে রইস উদ্দীনের ছেলে রুবেলের সাথে। সেদিন রুবেলই তাঁর বন্ধুবান্ধবকে সঙ্গী করে সুস্মিতাকে তুলে নিয়ে যায়। তারমানে আমরা যখন যুদ্ধের সময় রইস সাহেবের গ্রামের বাড়ীতে উঠেছিলাম? তখন সবার অগোচরে রুবেল আর সুস্মিতার মাঝে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। রুবেল আর সুস্মিতার সম্পর্ক রইস সাহেব মেনে নেননি কোনদিন। সুস্মির ঘরে ততদিনে তিনটা ছেলে আর একটা মেয়ের জন্ম হয়ে যায়। একদিন রুবেল স্ত্রী সন্তানকে রেখে কোথায় যেন নিরুদ্দেশ হয়ে যায়! আর সন্তানদের নিয়ে বিপাকে পড়ে সিস্মিতা। কোন দিশা না পেয়ে সে ফিরে আসে আমাদের বাড়ীতে। এখানে এসে কাউকে না পেয়ে ভেঙে পড়লেও বুড়ী ঠাকুরমাকে পেয়ে ভরসা পায়। চার সন্তানকে নিয়ে থেকে যায় এখানেই। কিন্তু বিধি যার কপালে সুখ না লিখে সে কী করে সুখী হবে? ক্ষুধার জ্বালায় ক্লাস এইট পাশ সুস্মি রাস্তায় নেমে পড়ে! একদিন বুড়ীকে নিয়ে সন্তানদেরসহ ভিক্ষা করতে গিয়ে সে রোড এক্সিডেন্টে মারা যায়। এই দুর্ঘটনা চার বাচ্চা আর বুড়ীকে জানে বাঁচিয়ে দিলেও ভাসিয়ে দিয়ে যায় অথই সমুদ্রে ।
রশিদ সাহেব বাবাকে চিঠির মাধ্যামে সব কিছু জানালেও বাবা তা কাউকেই জানানো তো দূরে থাক! এই নিয়ে কোন কথা কোনদিন বলেন নি! বাবার প্রতি ভীষন ঘৃণা নিয়ে ফিরে গেলাম মায়ের কাছে। ভাবলাম তাকে সব কিছু খুলে যদি বলি তিনি ঠাউমা আর বাচ্চাদের কথা ভেবে কিছু একটা করেন। বুড়ীকে নিয়ে জেতে চাইলাম কিন্তু সেই একই কথা তার "দিন শেষ সে এই ভিটা ছেড়ে যাবে না । যেতেই যদি হয় একবারে শ্মশানে যাবে।"
আমি মাকে সব কিছু খুলে বলতেই শুধু চোখের পানি ফেললেন। জাত কূল কত কীযে বললেন! আমার মাথায় কিছুই ঠুকল না। যেহেতু পড়াশুনা করিনি তাই যে কারনে বাবা মা ভয় পেতেন,আমাকে লুকিয়ে রাখতেন। শুধুমাত্র সুস্মিতার বাচ্চাদেরকে বাঁচানোর জন্য আমি তাই করলাম। মনে মনে আমিও প্রতিজ্ঞা করলাম বাবার এক ফোটা সম্পত্তি আমি নেব না। যে করেই হোক ঐ বাড়ী আর বাচ্চাদের আমি দেখব। প্রয়োজনে রক্ত বিক্রি করে হলেও। একদিন মাকে একটা চিঠি লিখে চলে গেলাম আমার নতুন ঠিকানায়।
এ এক অন্যরকম ঠিকানা! কাজের বিনিময়ে,রোজগারের বিনিময়ে দুঃখ,ব্যথা,কষ্ট বুকের মাঝে চাঁপা দিয়ে হাসিমুখে অন্যদেরকে আনন্দ দেয়া। এভাবে জন্ম নেয়াটাই যেন এক অভিশাপ। বুঝতে বাকি রইল না বাবা মা এই অভিশপ্ত জীবনের কথা ভেবেই হয়ত আমাকে লুকিয়ে রাখতেন! এখানে নিজেই নিজেকে খুশি রাখা,সবাই মিলেমিশে থাকা। যারা বড় আছেন তাদেরকে শ্রদ্ধা করা ছোটদের স্নেহ ভালবাসা দেয়া। তবে ভীষণ প্রতিযোগিতা...! প্রতিযোগিতা অর্থ উপার্জনে,প্রতিযোগিতা এই জগতে সুবিদিত হবার জন্য। এ এক অন্যরকম বেঁচে থাকার লড়াই...। আমাকে পেয়ে গুরু ভীষন খুশি হলেন। নিজের সন্তানের মত আমাকে ভালবাসা দিলেন। সবাই যখন কাজে যায় আমি তখন ভেসে বেড়াই সুস্মিতার সন্তানদেরকে নিয়ে আমার চীরচেনা বাল্যভুমিতে। সুস্মি মরে যায়নি সে বেঁচে আছে ওর মেয়ের মাঝে। মেয়েটা অবিকল মায়ের মত দেখতে। ওদের কথা ভেবে না পারি খেতে না পারি ঘুমাতে। গুরুকে আমি মা'জি বলে ডাকি। উনি আমাকে আদর করে জিজ্ঞাসা করতেই সব কিছু খুলে বলি তাঁকে। "আরে বেটা এই কথা? সোচ না মাত...পনেরদিন ম্যা টাকা পেয়ে যাবি। কিন্তু তোকে যে কাম প্যাঁ যেতে হবে। বসে থাকলে তোকে কে খাওয়াবে?" তারপর খুশি মনে বের হয়ে যাই দলের সাথে কাজে। যে কাজ পাই তাই করি...। কেবল যে কোথাও কোন শিশু জন্ম নিলে নাচানাচি করে টাকা পাই,তা নয়। সারাদিন ইট ভাঙার কাজও করি! আর রাতে মা'জি জলসার আয়োজন করে সেখানে আসা অতিথিদের মনোরঞ্জন করতে হয়। আমাকে নিয়ে অতিথিরা কাড়াকাড়ি শুরু করে দিত। যে বেশি টাকা দিত আমি তাঁর সব চাওয়া পূরণ করতাম।
এবার হরিপদ বাবু থামলেন। হয়ত পূরণ কোন কষ্টের কথা মনে পড়ে গেছে! একটু নড়ে বসলেন। যা থেকে জামিলের বুঝতে কষ্ট হল না এই ব্যপারে উনি আর কিছুই বলতে চায়ছেন না। একটা দীর্ঘশ্বাসের মাঝে কষ্টটাকে লুকিয়ে রেখে আবার বলতে শুরু করলেন।
- জীবনে এত পরিশ্রম কোনদিন করিনি! কিন্তু সুস্মির সন্তানদের কথা ভাবলেই আমার পরিশ্রম বেড়ে যেত বহুগুণ। মা'জি যা যা করতে বললেন আমি তাই তাই করলাম! আর তাই খুশি হয়ে সত্যিই পনের দিনের মাথায় উনি আমাকে টাকা দিলেন। তিনদিনের কথা বলে আমি চলে আসি এখানে। রশিদ কাকাকে খুলে বলি আমি এই বাড়ীটি নিয়ে কী করতে চাই। এবং এটাও বলি আমি কতটা পরিশ্রম করে এই টাকা নিয়ে এসেছি! উনি সবশুনে কেঁদে ফেলেন এবং আমাকে বাড়ীটি লিখে দেন। সেই থেকে এই আমার "আনন্দ আশ্রম।" খুশিতে চকচক করে জ্বলে উঠে হরিপদ বাবুর দু'চোখ।
এই আশ্রম রশিদ চাচা নিজেই দেখাশুনা করতেন। আমি তার কাছে টাকা পাঠাতাম। আমার জেদ চেপে গেলো অনেক। আমি অনেক খাটতে লাগলাম। আমি মা বা বাবার সাথে কোন দিন দেখা করিনি। বাড়ীর সামনে দিয়ে যখন যেতাম হু হু করে মনটা কেঁদে উঠত। আমার সামনে দিয়ে জ্যাঠাত ভাইবোনরা চলে যেত। অথচ আমার সাথে কথা বলতো না! চিনেও না চেনার ভান করত। তারপর কাজের এত চাপ ছিল যে গত দশ বছরে আমি আর আসতে পারিনি। একদিন রশিদ চাচা মারা গেলেন। তিনিই দায়িত্ব দিয়ে যান তপন বাবুকে। ঐ যে যিনি একটু আগে এখানে ছিলেন। আর হ্যাঁ যে মেয়েটাকে দেখলেন? ঐ যে মেয়েটা? ওটা আমার সুস্মির মেয়ে। এখন আমার আশ্রমে মোট পঞ্চাশটার মত শিশু আছে। কিন্তু...।
থেমে গেলেন হরিবাবু । জামিল তাকিয়ে আছে ছায়া ছায়া অন্ধকারের মাঝে বসে থাকা লোকটির মুখের দিকে। খুব চেষ্টা করেও মুখটা দেখতে পেলেন না। কি বলবেন তাও মনের মাঝে হাতড়ে চলেছে! তার মনে হচ্ছিল এতক্ষণ অন্যকোন জগতে ছিলেন তিনি। ভীষন অস্থির লাগছে... মনে হচ্ছে এককাপ চা হলে ভাল হত । এদিক ওদিক তাকালেন বেশ নিস্তব্ধতা। নীরবতা ভাঙলেন হরিবাবুই...
কিন্তু এখন আমার দিন শেষ। বিধাতা সব সময়ই আমার সাথে লুকোচুরি খেলেছেন...এবারো তার ব্যাতিক্রম হল না । ডাক্তার বলেছিলেন এই সংসারের আলো আমার জীবনে আর মাত্র ত্রিশ দিনের। আমার জন্মভুমির মাটি,আমার প্রাণের যে প্রেম তা যে মিশে আছে এই সবুজেরই পাতায়। ত্রিশ দিন নয় দিব্যি পঁয়ষট্টি দিন এই মাটির প্রলেপ আমার যন্ত্রণা মুছে দিয়েছে! দিয়েছে কিছুটা সময় যার কারনে আজ এই না বলা কথা বলে যাওয়া। আমি যখন এই ধরায় থাকব না এই যে পঞ্চাশটি শিশু এদেরকে কে দেখবে? কে নেবে এদের সোনালি দিনের ভার? কে শেখাবে এদের বজ্রপাতের আলোর ছটায় আর কালো মেঘের ডানায় ডানায় কেমন করে উড়তে হয়? আমার হাতে সময় খুব কম। আমি শুধু এই আশ্রমের দায়িত্ব নয়,পঞ্চাশটি শিশুর একটি বন্ধন দীপ্ত পরিবার আপনাকে সঁপে দিতে চাই। আমি জানি আপনি তা পারবেন। জানেন আমি মরে যাব বলে এই বাচ্চাদের যতটা না কষ্ট হচ্ছে? তার চেয়ে তারা আর একসাথে থাকতে পারবে না এই বেদনায় কোরআন পাঠ করছে,পুজো দিচ্ছে। ছোট ছোট বাচ্চাগুলো ঈশ্বরকে ডাকছে "হে ঈশ্বর আমরা যেন কেউ ঘর হারা না হই! আমরা যেন বিচ্ছিন্ন না হই !"
-কিন্তু আমি কেন? অবাক হয়ে মুখ ফসকে কথাটা বের হয়ে গেল।
-আপনিও জানেন কেন আমি আপনাকে বেছে নিয়েছি এই এত বড় একটা দেশের মাঝে।
-না আমি জানি না! আর আমি কেমন করে এই গুরু দায়িত্ব পালন করব?
-আপনি অনেক ভাল এবং সৎ একজন মানুষ। সব থেকে বড় কথা আপনি লোভী না। আপনাকে টাকা দিয়ে বা বাড়ী গাড়ীর প্রস্তাব দিয়েও কেউ কিনতে পারেনি! পারিশ্রমিকের চেয়ে সত্য সন্ধানে কঠোর পরিশ্রম যার পরম ধর্ম!
-কিন্তু আপনি আমার সম্পর্কে ...! কথা শেষ হবার আগেই উনি বললেন-
-আমার পাহাড় ভাঙা পরিশ্রমের পারিশ্রমিকে পাওয়া ধন আমি তো কেবল যার হাতে নিশ্চিন্তে তুলে দিতে পারি।
তাকে তো মানুষ হতে হবে! তাই মানুষ খুঁজে বের করেছি অনেক সময় দিয়ে...!
নিজের সম্পর্কে এত ভালো ভালো কথা শুনে চোখ ভিজে আসে জামিলের। যেখানে প্রতিনিয়ত নিজেকে সে একজন পরাজিত মানুষ ভাবছে। ভীতরে ভীতরে তিলে তিলে আত্ম দংশনে শেষ হচ্ছে। সেখানে তাকে নিয়ে কেউ একজন,এত সম্মান দিয়ে গুরুত্ব সহকারে গুরু দায়িত্ব দিতে চায়ছেন? জামিল আর কিছুই বলতে পারল না। সে বুঝে গেল এখানে কিছু বলে কোন লাভ হবে না...। তাই ক্ষীণ স্বরে বলল-
-আমি কি আপনার একটা ছবি তুলতে পারি ?
-দুঃখিত !
কথাটা বলেই অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নিলেন। ভাবখানা অনেক কথা বলেছি এবার তুমি যাও...! জামিল আর কোন কথা না বলে বিদায় নিয়ে বের হয়ে আসে। সে বেশ চিন্তায় পড়ে গেল। বেলা বারোটা বেজে গেছে। রিক্সায় উঠে ফোন খুলে দেখে বারটা মিসকল। রুবাও বেশ কয়েকবার কল দিয়েছে! আর বসতো রেগে আগুন হয়ে আছে সন্দেহ নেই। ফোন খুলতেই সাথে সাথে ফোনটা বেজে উঠলো! কানে লাগাতেই বসের ঝাড়ি
-'জামিল সাহেব আপনি কোথায় থাকেন? এভাবে কী চাকুরী ধরে রাখতে পারবেন?” জামিল স্যার স্যার করে যায় কিন্তু ওর কথা শুনেই না বস। কয়েক মুহুর্ত পরে বসের কন্ঠ বদলে যায়
-জামিল সাহেব রিপোর্টটা এমনভাবে করবেন যেন বিত্তবানরা এই আশ্রমটিকে দেখাশুনা করতে আগ্রহী হয় এবং মিডিয়ায় হৈ হৈ রৈ রৈ পড়ে যায়। বুঝতে পারছেন আমি কী বলছি?” আমতা আমতা করে জামিল বলে
-"হ্যাঁ স্যার বুঝতে পারছি।"
-"আপনার প্রোমোশন এবার কেউ ঠেকাতে পারবে না মনে রাখবেন। আপনার পরিশ্রম সার্থক আজ!" জামিল কিছুই বলে না একটা দীর্ঘশ্বাস চেপে ভাবে"এসব বুলি কাজটা যেন একশত ভাগ আদায় হয় সেজন্য বলা। কাজ আদায় হলে আর প্রোমোশন!? একটা কারণ দেখিয়ে ব্যবসা লস বলে ভেঙ্গে চুরে পড়বে! সাংবাদিকরা কত কষ্ট করে,জীবন বাজি রেখে হলেও সংবাদ এনে এনে জড় করছে। তাদের বেতন দিতে পারেনা পত্রিকার মালিক! টাকার অভাবে সাংবাদিকদের ঘরে অশান্তি আর জ্বালা। অথচ যে বেটা বিজ্ঞাপনের টাকা তুলতে মার্কেটে যায়? তার বাড়িতে দালান উঠে! আমরা যেন কিছুই বুঝি না। মালিকেরও ভাবখানা সেও কিছুই জানে না! শালা কী দুঃখে যে এই প্রফেশনে আসছিলাম! কাজ আদায় করার জন্য মালিকের এসব মিষ্টি মিষ্টি কথা...কাজ শেষ হলে কেবল শুধু ঝাড়ি।"
মেজাজের সাথে সাথে পাল্লা দিয়ে দুপুরের কড়া রোদ কাঁটার মত করে ফুটছে গায়ে...! কিন্তু কি করবে জামিল এখন? ওর আর রুবার বিয়ে হয়েছে আজ আট বছর তবু কোন সন্তানাদি নেই। তাহলে কি এই জন্য আল্লাহ আমাদের নিঃসন্তান রেখেছেন !? আশ্রম থেকে বের হবার সময় ছোট্ট চার পাঁচ বছরের একটা বাচ্চার সাথে চোখাচুখী হয়েছিল। কি শান্ত আর নিষ্পাপ চাহনি। কোন টু শব্দটি নেই! এই আশ্রমের সামনে দিয়ে সে কতদিন গেছে কিন্তু কোন দিন ভীতরে ঢোকা তো দূরে থাক! উকি মেরেও কখনো দেখেনি! এমন কী কে এই আশ্রমের মালিক বা এই আশ্রমে থাকা মানুষের জীবন কীভাবে চলে? তারা কী খায় না খায় কিছুই জামিলের জানতে কখনও ইচ্ছে হয়নি! কিন্তু আজ সে এখানে এসে নিজেকে বড় বেশী অপরাধী ভাবছে। নিজের এলাকার এমন সুন্দর একটা মহৎ ও সুন্দর জায়গা নিয়ে কেন সে কোন দিন লেখেনি? কেন সে আসেনি এখানে? নিজের মন থেকেই জামিল একটা তাগাদা অনুভব করছে নিজেকে সে যেভাবেই হোক প্রুভ করবে যে সেও দায়িত্ব পেলে তা পালন করতে পারে। হরিপদ বাবুর তো শিক্ষা ছিল না,ছিল না টাকার জোর। আত্মবলেই সে এতদুর এসেছে । অন্যদেশে থেকে রোজগার করে,কষ্ট করে নিজের জন্মভুমির অনাথ বাচ্চাদের জন্য কাজ করেছে। সেতো চাইলে বোনের বাচ্চাদের ঐ দেশে নিয়ে রাখতে পারত! তাকে সব কাহিনী শোনাবার কারন একটাই "নে দেখাতো ব্যাটা কিছু করে! আমিতো তোদের মত স্বাভাবিক না! ভালবাসা,বন্ধন, স্বপ্ন ,সবতো তোদের একান্ত পাওনা। আমি তো জন্ম নিয়েছি অন্য জগতে এসব টানে না আমাকে তবুও...! তোদের সমাজে কত পুরুষ আছে লাখপতি,কোটিপতি,টাকা খরচ করবার জায়গা পায়না বাজে জায়গায় খরচ করে নেশা করে টাকা উড়ায়। যা না জাগিয়ে তোল তাদের বিবেকটাকে কলমের খোঁচা দিয়ে । আমারতো শিক্ষাও নেই,নেই কোন জোর কিন্তু তোর তো শিক্ষাও আছে। আর আছে কলমের জোর ! দেখা না ব্যাটা পারলে কিছু করে"!
এমন সময় হঠাৎ বসের বলা কথাগুলো মনে পড়ল-"জামিল সাহেব রিপোর্টটা এমনভাবে করবেন যেন বিত্তবানরা এই আশ্রমটিকে দেখাশুনা করতে আগ্রহী হয়!" আচ্ছা ঘটনা তাহলে এখানে! জামিল প্রতিজ্ঞা করে সে "আনন্দ আশ্রম"এর দায়িত্ব নিবে। কোন অসৎ কুটিল ব্যক্তির চক্রান্তে শিশুদের ভবিষ্যৎ অন্ধকারে ঢেকে দিতে দেবে না।
মনের মাঝে একটা আলোর দ্যুতি ঝিকমিক করে জ্বলে উঠতে দেখল জামিল। বাসায় গিয়ে রুবানার সাথে সব আলাপ করে যখন নিজের ইচ্ছের কথা বলল...'আল্লাহ আমাদের সন্তান এখনো দেয়নি হয়ত এই অনাথ বাচ্চাগুলোর দায়িত্ব নিতে পারি সেজন্য...প্লিজ তুমি আমি...' জামিলের কথা শেষ হবার আগেই রুবানা হুঙ্কার ছাড়ে "তারমানে তুমি বলতে চাচ্ছ আমার গর্ভে কোনদিন সন্তান হবে না? অচেনা অজানা অন্যের বাচ্চাকে আমি নিজের করে বড় করব অথচ তার সাথে আমার রক্তের কোন সম্পর্ক হবে না?”
"এভাবে কেন দেখছ! রক্তের সম্পর্কের চেয়ে কী মমত্ব আর আত্মার সম্পর্ক বড় নয়...!” রুবানা চোখ মুখ বিকৃত করে বলে উঠে-"হরিপদ বাবু বাচ্চাগুলোকে লালন পালন করে পিতৃত্বের স্বাদ নিয়েছে কারণ সে কোনদিনই পিতা হতে পারবে না। কিন্তু তুমি কেন এভাবে পিতৃত্বের স্বাদ নিতে চাইছো এটাই আমার বোধগম্য হচ্ছে না! কেন সমাজের চোখে দেখাতে চাইছ তুমি আমি...”জামিল বুঝতে পারলো রুবানা ও তার জীবনে এই অবুঝ অনাথ শিশুগুলোকে নিয়ে বৈরী হাওয়ার ঝড় উঠেছে। জোর করে আর যাই হোক রুবানার মনের বিদ্বেষ কমানো যাবেনা!
খবরের কাগজে হরিপদ বাবুর জীবন বৃত্তান্ত নিয়ে একটা আর্টিকেল লিখে যখন জামিল সেদিনের টেপরেকর্ড এবং আশ্রমের তোলা ছবিগুলো খুঁজতে লাগল। তখন তা কোথাও খুঁজে পাওয়া গেল না। সে জানে এই কাজ রুবানাই করেছে। সে এও জানে সময়ে অভিমানী স্ত্রীকে সে নিজের পাশেই পাবে! রুবানার মনের মাঝে যে ঝড় উঠেছে তার আঘাত,জামিলের মত পরিশ্রমী কর্মঠ মানুষের মনটাকে মুহূর্তেই দুর্বল করে দেয়।
হরিপদ বাবু মারা গেলে আশ্রমের বাচ্চাগুলোর কী অবস্থা হবে? এই দুশ্চিন্তায় জামিল নাওয়া খাওয়া ভুলে গেল। ছুটে গেল এলাকার সব ধনি ব্যক্তিদের কাছে। প্রতিজ্ঞা করল যেভাবেই হোক এই আশ্রম সে টিকিয়ে রাখবে। সমাজে প্রায় উপেক্ষিত হরিপদ বাবুর মত একজন মানুষ যদি এই মহৎ কাজ করতে পারে? তাহলে সমাজে যারা গণ্যমান্য,যাদের সমাজে আধিপত্য তাদেরকে সে যেভাবেই হোক এই কাজে আনতে উৎসাহিত করবে। এই কাজে হরিপদ বাবুর মত মানুষের যেমন দায়বদ্ধতা আছে,তেমনি আছে সমাজের প্রতিটি মানুষেরই! সবাইকে এই কাজে উদ্বুদ্ধ করতে সাংবাদিকতার মত প্রফেশনই সবচেয়ে বড় ভুমিকা রাখবে। কথাটা মনে হতেই কেন হরিপদ বাবু লাখো মানুষের ভিড়ে তাকে দায়িত্ব দিতে চেয়েছে তা পরিষ্কার হয়ে যায়। গলায় ঝুলানো সাংবাদিকতার আইডি কার্ডটি এতদিন বাম পাশের শার্টের বুক পকেটের ভীতরে রেখে দিত। আজ পরিচয় পত্রটি বের করে চুমু খায়! আলোকিত হাসি খেলে যায় সারা মন জুড়ে।
২৭ মে - ২০১১
গল্প/কবিতা:
১২০ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪