প্রতিটা মানুষের জীবনে শিক্ষা ও শিক্ষক খুব বড় ধরনের ভূমিকা রাখে। শিক্ষক ছাড়া যেমন শিক্ষা গ্রহণ করা সম্ভব নয়! ঠিক তেমনি শিক্ষাহীন জীবনে মানুষের মত মানুষ হয়ে;সফলতা অর্জন করাও একেবারেই অসম্ভব! একটা পাখিও তার ছোট ছোট বাচ্চাগুলোকে চলতে শেখায়,খাবার খেতে শেখায়,পথ দেখায়,উড়তে শেখায়! যেমন পাখির বাচ্চা বড় হতে হতে কীভাবে সুন্দর জীবন যাপন করা যায়,তা নিজেই তার শিক্ষাগুরু মায়ের শেখানো শিক্ষাকেই কাজে লাগায়! তেমনিভাবে আমাদের বাবা মা আমাদের কচিহাত ধরে পথ দেখিয়ে নিয়ে যায় পাঠশালায়। যেখানে পাওয়া যায় শিক্ষা,দীক্ষায় পারদর্শী জ্ঞানগুরুদের সান্নিধ্য! যেখানে জ্ঞানের আলোতে আলোকিত হয়ে একে একে নিজেকে গড়ে তোলা যায়,পৃথিবীর মঙ্গলময় একজন মানুষ হিসাবে। কিন্তু কতজনই বা সত্যিকার শিক্ষায় আমরা শিক্ষিত হতে পারি? আর কতজন শিক্ষকই বা তাদের নিজেদের জ্ঞানের ভাণ্ডার নিখাদ রেখে গড়ে তুলতে পারে নরম মাটির মনে হীরের চমক?
একজন ছাত্রছাত্রী নিজের জীবনের শিক্ষার আলো সমাজে ছড়িয়ে দিয়েই,আলোময় ভুবন গড়ে তুলতে সক্ষম হয়। কিন্তু সেইসব ছাত্রছাত্রীকে বাবা মা নিশ্চিন্তে যেসব শিক্ষকের হাতে তুলে দেয়,তারা আসলে কতটা তাদের দায়িত্ব পালন নিঃস্বার্থভাবে করে থাকে!? বিশ্বাসভাজন,শ্রদ্ধেয় শিক্ষকেরা আদৌতে কী বাবা মায়ের অগোচরে তাঁদের সন্তানদেরকে সার্বিক শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলতে সক্ষম হন? তাঁরা কজনেই বা সমাজের প্রতি তাঁদের দায়িত্ব পালনে শতভাগ নিষ্ঠার পরিচয় দিয়ে থাকেন? আর কজন বাবা মা-ই বা এখনকার দিনে শিক্ষকের প্রতি সন্তানের শ্রদ্ধা ও সম্মানবোধ সম্পর্কে জ্ঞান দিয়ে থাকেন!? যুগের সাথে সাথে আমরা মানুষ পরিবর্তিত হচ্ছি প্রতি নিয়ত। কিন্তু আমরা ভুলে গেছি শিক্ষকের প্রতি সম্মানবোধটুকু ভুলে যাওয়াই,শিক্ষার অস্তিত্বকে ধ্বংস করার প্রধান অন্তরায়। যেখানে সম্মান নেই সেখানে শেখার মন মানসিকতা,সহনশীলতা কিছুই থাকে না।
আমাদের সময় বাবা মা ঘর থেকেই আদব,সম্মান লাজলজ্জার শিক্ষা সেই শিশুকাল থেকেই বুঝিয়ে দিতেন। তাঁরা বলতে ভুলতেন না-গুরুজনকে সম্মান দেয়া তোমার শিক্ষার প্রথম ধাপ। কিছু কিছু কবিতাও পড়ে আমাদেরকে বুঝিয়ে দিতেন- এখানে কবি কাজী কাদের নেওয়াজ-এর “শিক্ষকের মর্যাদা” কবিতাটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য-
“বাদশাহ আলমগীর-
কুমারে তাঁহার পড়াইত এক মৌলভী দিল্লীর।
একদা প্রভাতে গিয়া
দেখেন বাদশাহ-শাহজাদা এক পাত্র হস্তে নিয়া
ঢালিতেছে বারি গুরুর চরণে
পুলকিত হৃদে আনত-নয়নে,
শিক্ষক শুধু নিজ হাত দিয়া নিজেরি পায়ের ধুলি
ধুয়ে মুছে সব করিছেন সাফ্ সঞ্চারি অঙ্গুলি।
শিক্ষক মৌলভী
ভাবিলেন আজি নিস্তার নাহি, যায় বুঝি তার সবি।
দিল্লীপতির পুত্রের করে
লইয়াছে পানি চরণের পরে,
স্পর্ধার কাজ হেন অপরাধ কে করেছে কোন্ কালে!
ভাবিতে ভাবিতে চিন্তার রেখা দেখা দিল তার ভালে।
হঠাৎ কি ভাবি উঠি
কহিলেন, আমি ভয় করি না'ক, যায় যাবে শির টুটি,
শিক্ষক আমি শ্রেষ্ঠ সবার
দিল্লীর পতি সে তো কোন্ ছার,
ভয় করি না'ক, ধারি না'ক ধার, মনে আছে মোর বল,
বাদশাহ্ শুধালে শাস্ত্রের কথা শুনাব অনর্গল।
যায় যাবে প্রাণ তাহে,
প্রাণের চেয়েও মান বড়,আমি বোঝাব শাহানশাহে।
তার পরদিন প্রাতে
বাদশাহর দূত শিক্ষকে ডেকে নিয়ে গেল কেল্লাতে।
খাস কামরাতে যবে
শিক্ষকে ডাকি বাদশা কহেন, ''শুনুন জনাব তবে,
পুত্র আমার আপনার কাছে সৌজন্য কি কিছু শিখিয়াছে?
বরং শিখেছে বেয়াদবি আর গুরুজনে অবহেলা,
নহিলে সেদিন দেখিলাম যাহা স্বয়ং সকাল বেলা''
শিক্ষক কন-''জাহপানা, আমি বুঝিতে পারিনি হায়,
কি কথা বলিতে আজিকে আমায় ডেকেছেন নিরালায়?''
বাদশাহ্ কহেন, ''সেদিন প্রভাতে দেখিলাম আমি দাঁড়ায়ে তফাতে
নিজ হাতে যবে চরণ আপনি করেন প্রক্ষালন,
পুত্র আমার জল ঢালি শুধু ভিজাইছে ও চরণ।
নিজ হাতখানি আপনার পায়ে বুলাইয়া সযতনে
ধুয়ে দিল না'ক কেন সে চরণ, স্মরি ব্যথা পাই মনে।''
উচ্ছ্বাস ভরে শিক্ষকে আজি দাঁড়ায়ে সগৌরবে
কুর্ণিশ করি বাদশাহে তবে কহেন উচ্চরবে-
''আজ হতে চির-উন্নত হল শিক্ষাগুরুর শির,
সত্যই তুমি মহান উদার বাদশাহ্ আলমগীর।''”
কবিতাটি শেষ করেই বাবা মা নিজেরাই জিজ্ঞাসা করতেন কবিতা থেকে কী শিক্ষা পেয়েছি!? ভালো মন্দ,আলো অন্ধকার এসব কিছুই বাবা মা হাতে কলমে চিনিয়ে দেবার কাজটি করতেন। অথচ আমরা? আজ আমরা আমাদের সন্তানকে সুস্থ,সুন্দর শিক্ষা দিতে পারছি না! পারছি না তাদেরকে ভালো মন্দ চেনার কৌশল শেখাতে! কিন্তু কেন? কেন আমরা আধুনিক হয়েছি বলে চিৎকার করলেও,সন্তানকে সভ্য মানুষ করেছি বলে গর্ব করতে পারি না!?কেন আজ আমাদের সন্তানরা প্রতিনিয়ত ব্যবহৃত হচ্ছে স্বার্থপর কিছু মানুষের স্বার্থ উদ্ধারে!? লোভ,লালসা আর অনৈতিকতার খোলসে কেন আজ আমাদের সন্তানরা দিনে দিনে বীরের রক্ত শরীরে নিয়ে বানিয়া জাতিতে পরিণত হচ্ছে!? আমরা নিজেরাইবা কতটা সুশিক্ষায় শিক্ষিত হতে পেরেছি?
জীবনে ঘটে যাওয়া আলো আঁধার চিনে নেবার যে যাদুর ছোঁয়া পেয়েছিলাম শৈশবে,তা কতটাই বা পেরেছি কাজে লাগাতে!? যখন দেখি আমার সন্তানেরা,আমার ভাইয়েরা নিজেদেরকে বিকিয়ে দিয়ে অসম্মান করে শিক্ষা গুরুকে! যখন ছোট ছোট কিছু ভুলের জন্য পুরো সমাজে অস্থিরতার জাল বুনে যায় নির্বিঘ্নে! তখন নদীর পানি শুঁকিয়ে যাওয়া মাছের মত আমি ছটফট করি ভুলের তৃষ্ণায়! কাদামাটি মেখে আমি হাতড়ে চলি হারানো শিক্ষাপাঠ! দেখি মনের মাঝে জ্বলজ্বল করে জ্বলে যায়,জীবনে ঘটে যাওয়া কিছু ঘটনা...
তখন ক্লাস সিক্সে পড়ি। প্রাইমারী স্কুল জীবন শেষ করে হাইস্কুল জীবনের সদ্য স্বাদে টগবগ করছি! কিন্তু কয়েকদিনের মাঝেই সেই মিষ্টি স্বাদে নদীর স্রোতের মত ভেসে এলো কুইনাইনের মত তিক্ততা! একদিন স্কুলে গিয়ে দেখতে পেলাম- স্কুলের বর্তমান প্রধান শিক্ষিকাকে অপসারণ এবং আরেকজন শিক্ষিকাকে ঐ পদ দেবার আন্দোলনে স্কুলের ভীতরেই মেয়েরা সবাই ক্লাস বর্জন করে আন্দোলন শুরু করেছে। আমার কাছে আন্দোলন মানেই ছিল অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায় প্রতিষ্ঠা করার জন্যই আন্দোলন। প্রধান শিক্ষিকা যিনি ছিলেন উনি আমার কাছে কোন দিক দিয়েই খারাপ মনে হয়নি। তবে যেহেতু তখন আমি স্কুল এবং ক্লাসে একেবারেই নতুন,তাই অন্যায় জেনেও আন্দোলনে অসমর্থন দিতে পারছিলাম না! কিন্তু সবাই যখন ক্লাস বর্জন করে মাঠে থাকে,আমি তখন একা একা ক্লাসে বসে থাকি।
আন্দোলন আমার কাছে তখন একটা ভয়াবহ ব্যাপার ছিল। বাসা থেকে কড়া নিষেধ কোন আন্দোলন, মিটিং মিছিলে যাওয়া যাবে না। আব্বাকে ভয় পেতাম বাঘের মত। একদিন আন্দোলনের মুহূর্তে ক্লাসে বসে আছি,একজন মেয়ে এসে আমাকে ক্লাস থেকে বের হয়ে তার সাথে মাঠে যেখানে সবাই স্লোগান দিচ্ছে ওখানে যেতে বলল। আমি যেতে চাইলাম না দেখে সে চলে যাবার কিছুক্ষণ পর আরও কিছু মেয়ে এসে আমাকে বলল
-সহকারী প্রধান শিক্ষিকা রেহানা আপা তোমাকে ডাকছে।
উনাকেই এখন সবাই প্রধান শিক্ষিকা হিসাবে চায়ছে। মেয়েগুলোর সাথে আমি সহকারী প্রধান শিক্ষিকার অফিস রূমে গেলাম। উনি যা বললেন তা শুনে আমি ঐ বয়সেই অবাক হয়ে গেলাম। উনি বললেন
- বর্তমান প্রধান শিক্ষিকার ছেলে মেয়ে হয় না উনি বাজা। তুমি কী জানো না বাজা মানুষের মুখ দেখে যেখানে সকাল শুরু হয়ে দিন খারাপ যায়,সেখানে এই বাজা শিক্ষিকার নেতৃত্বে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কতটুকু ভালো ফল আশা করা যায়?
আমি কিছুই বলতে পারিনি ভয়ে। মেয়েরা আমাকে বলল "হয় আন্দোলনে যোগ দিতে হবে না হয় স্কুলে আসা বন্ধ দিতে হবে।" আমি দ্বিতীয়টি বেছে নিয়েছিলাম। দীর্ঘ সময় আন্দোলনের ফলাফলে রেহানা আপাই প্রধান শিক্ষিকা হয়েছিলেন। পরে জেনেছিলাম উনিই ছাত্রীদেরকে উস্কিয়ে এই আন্দোলন করিয়ে ছিলেন আরও কিছু শিক্ষককে সাথে নিয়ে। প্রধান শিক্ষিকা যিনি ছিলেন তিনি চাকুরী ছেড়ে দিয়েছিলেন এবং পরে ভীষণ অসুস্থ্য হয়ে পড়েছিলেন। উনাকে যেদিন স্কুল থেকে বিদায় দেয়া হয় সেদিন আমি শেষ বারের মত ঐ স্কুলে গিয়েছিলাম। সেদিন উনি কেঁদে কেঁদে বলেছিলেন "আমি এতদিন এই স্কুলের প্রতিটা মেয়েকে আমার সন্তান ভেবে নিঃসন্তান হবার জ্বালা ভুলে ছিলাম। মেয়েরা তোমরা আমাকে মনে পড়লে আমার কাছে নির্দ্বিধায় চলে এসো !" আমি উনার বক্তৃতা শুনোতে শুনতে তাকিয়েছিলাম নতুন প্রধান শিক্ষিকার দিকে! দেখি উনি শাড়ীর আঁচলে চোখ মুছে নিচ্ছেন। সেদিন ভীষণ ঘৃণা লাগছিল প্রধান শিক্ষিকার অভিনয় দেখে। কিন্তু তাকে অসম্মান করে কিছু বলার সাহস আমার মাঝে ছিল না!
একজন রেহানা আপার মত শিক্ষকের ইন্ধনে সেদিন মেয়েরা যেমন কোমরে ওড়না পেঁচিয়ে আন্দোলন করেছিল। পরবর্তিতে সেইসব মেয়েরাই নানা রকম দোষে দোষী সাব্যস্ত হয়ে স্কুল থেকে বহিষ্কার হয়ে অন্য স্কুলে গিয়েছিল। নতুন প্রধান শিক্ষিকা বললেন "এইসব মেয়েরা আজ উস্কানি পেয়ে যদি একজন শিক্ষকের বিরুদ্ধে গিয়ে আন্দোলন করতে পারে!কাল অন্যের উস্কানি পেয়ে আমাকে সরাতে যে এরা আন্দোলন করবে না তা কে জানে!” শিক্ষক ছাত্রীদেরকে চিনতে একটুও ভুল না করলেও,ছাত্রীরা তাঁকে না চিনেই ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করেছিল।
এরপর এই স্কুল আমার আর ভালো লাগছিল না বলে,বাবা মা আরেকটা গার্লস স্কুলে ভর্তি করে দিলেন। এই স্কুল থেকেই বড় আপা ও মেঝ আপা লেখাপড়া করেছে। শিক্ষকরা সবাই আমাদের পুরো পরিবারকেই খুব ভাল করে চেনে। স্কুলটা খুব ভালো লাগল। তারপর ক্লাস এইটে যখন পড়ি তখন একদিন দেখি ক্লাসের ইংরেজি শিক্ষক ক্লাস ওয়ার্ক দিয়ে শুধু ঘুমায়। ক্লাসেরই মনিটর বলল "চলো আমরা প্রধান শিক্ষিকার কাছে গিয়ে এই স্যারকে চাইনা এইটা বলি। না শুনলে আমরা এই শিক্ষকের ক্লাসে আর আসবো না।"
সবাই প্রধান শিক্ষিকাকে নালিশ করেও যখন কাজ হল না তখন সিদ্ধান্ত নিলো আগামী কাল কেউ প্রথম পিরিয়ডে স্কুলে আসব না! যেহেতু আমাদের প্রথম পিরিয়ড ছিল ঐ ইংরেজি শিক্ষকের। সেহেতু পরেরদিন ক্লাসের সবাই দ্বিতীয় পিরিয়ড থেকে ক্লাসে আসবে। আমি যখন বাসায় বললাম যে স্কুলে যাবো না,তখন আম্মা রেগে গেলেন। বললেন "কেন স্কুলে যাবে না? ক্লাসের পড়া কী হয়নি? নাকি হোমওয়ার্ক করিনি?” যখন কু কা করেও মাকে খুশি করতে পারলাম না,তখন বাধ্য হয়ে সত্য বললাম। সত্য শুনে মা মহা রেগে গেলেন! বড় বোনকে বললেন- "তুই ওকে সাথে করে স্কুলে গিয়ে ক্লাসে বসিয়ে তারপর আসবি।" আমাকে বললেন "শিক্ষক যদি দোষ করে তার জন্য স্কুল কমিটি আছে, প্রধান শিক্ষক আছে তারাই ব্যবস্থা নিবে। সব আন্দোলন শিখে গেছে বেশ।"
যাইহোক আমি এখন কোথায় যাই! বড় আপুকে বুঝিয়ে কাজ হল না যে, কেউ আজ স্কুলে আসবে না। আমি একা একা ক্লাসে কী করব? কিন্তু আপু কিছুই শুনল না। বরং সে আমাকে বুঝাল- "তুমি যে স্যারের কথা বলছ তুমি কী জানো সে নামকরা একটা ইউনিভারসিটি থেকে ইংরেজিতে ডাবল এম এ করেছে! তোমার কী ধারণা আছে এই স্যার কোলকাতার একটা স্কুলে চাকুরী পেয়েও যায়নি কেবল এই স্কুল আর ছাত্রীদেরকে ভালবাসে!” ইংরেজিতে ডাবল এমএ!? তখন ডাবল এমএ সম্পর্কে কিছুই না বুঝলেও...ধরে নিয়েছিলাম অনেক শিক্ষিত এবং তিনি অসাধ্যকে জয় করেছেন এমন একজন কেউ! আর তাই আপুর কথা শুনে কেমন একটা অনুভূতি খেলে গেল মনে। বারবার মন বলছিল অনেক বড় ভুল হয়ে গেছে। ক্লাসের কেউ হয়ত স্যার সম্পর্কে এতটা জানে না। কেন যেন মনে হল এতবড় একজন শিক্ষক সম্পর্কে ক্লাসের সবার সামান্যতম হলেও ধারণা থাকা খুব দরকার ছিল!
বড় আপু আমাকে ক্লাসে দিয়ে চলে গেল। যথারীতি ক্লাস শুরু হতেই স্যার ক্লাসে এসে হাজির। উনি ক্লাসে ঢুকে দেখে আমি একা ওত বড় একটা ক্লাসে। ৩০ জন ছাত্রীর মাঝে একা একা আমি বসে আছি সামনের বেঞ্চে...! স্যার কিছুই বললেন না কিছুক্ষণ। তিনি বুঝতে পারলেন কিছু একটা ষড়যন্ত্র হয়েছে! ক্লাস থেকে বের হয়ে প্রধান শিক্ষিকাকে ডেকে আনলেন। সাথে দেখি আরও দুজন শিক্ষক। আমি ভীষণ ভয় আর লজ্জা পেতে লাগলাম। ইংরেজি স্যার বললেন- "তুমি ভাগ্যিস আজ ক্লাসে আসছো মেয়ে! না হলে আমি ধরে নিতাম তুমিই এই আন্দোলনের পিছনে আছো। আন্দোলনের স্কুল থেকে যে বদলি হয়ে আসছো!” আমি আরও লজ্জা পেলাম। অনেক কষ্টে কান্না রোধ করে দোয়া পড়তে লাগলাম! ২য় পিরিয়ডে যখন একে একে কিছু ছাত্রী ক্লাসে এলো এবং আমাকে দেখল,তখন ওরা সবাই আমাকে বকা দিতে লাগল। আমি স্যার সম্পর্কে বড় আপুর কাছ থেকে শোনা কথাগুলো বলতেই সবার মুখের উপর একটা ভয়ের ছায়া দেখতে পেলাম। সবাই আরও বেশি আশ্চর্য হল ক্লাস মনিটরের অনুপস্থিতি দেখে! কিছুক্ষণ পরে প্রধান শিক্ষিকা আবার ক্লাসে এসে ক্লাসের সবাইকে আচ্ছা করে বকা দিলেন! এবং বললেন"কাল আমার অভিবাবক ছাড়া সবার অভিবাবককে স্কুলে আসতে হবে!” আমি ভীষণ খুশি হলেও অন্য সবাই অনেক বেশি ভয় পেয়ে গেল।
পরেরদিন অভিবাবক এবং ছাত্রীদের সামনে প্রথমেই ইংরেজি শিক্ষক ভীষণ লজ্জিত হলেন...। তারপর তিনি বললেন "আমি আসলে ঘুমাই না। ক্লাসে ওয়ার্ক দিয়ে আমি চোখ বুঝে থাকি ওদেরকে সুযোগ দিয়ে দেখি ওরা কে কী করছে। কে গল্প করছে বা কে কারটা দেখে লিখছে! নাকি নিজে নিজেই ওয়ার্কটা করার চেষ্টা করছে।"
তখন আমার মনে পড়ল -তাইতো! স্যার যদি ঘুমাবে তাহলে কী করে কেউ একটু ফিসফাস করলেই তার দিকে চক বা ডাস্টার ছুটে আসবে? কে বই দেখে দেখে লিখেছে এইটাই বা সে জানত কি করে?! এবার আমরাই সবাই লজ্জা পেলাম।
পরে জেনেছিলাম ক্লাসমেটরা সবাই বাসায় গেলে ওদের অভিবাবকরা ওদেরকে ভীষণভাবে বকাবকি করেছিল। "আর কোনদিন কেউ কোন শিক্ষকের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে গেলে আগে তাদেরকে জানাতে বলেছে। তাঁরা যদি ব্যাপারটা নিষ্পত্তি না করতে পারে! তাহলে তাঁরাই দেখবে সঠিক কী ব্যবস্থা নেয়া যায়। এটা তাদের দায়িত্ব,ছাত্রছাত্রীর না!” এই বলে অনেক শাসন করেছে। আমাদের এই স্কুলে উস্কে দেবার কেউ ছিলনা বলে ইংরেজি শিক্ষকের বিরুদ্ধে আন্দোলন জোরালো হয়নি। সেদিন আমি একা ক্লাসে উপস্থিত থাকার জন্য স্যার আমাকে তার কোচিং ক্লাসে বিনা বেতনে গ্রামার ক্লাস শিখিয়েছিল। বাসায় এসে মাকে ধন্যবাদ দিয়েছিল শিক্ষকের প্রতি সম্মান ও আস্থা রাখার জন্য।
বাবা মায়ের কাজ ছেলে মেয়েকে লেখাপড়া শেখাতে স্কুলে পাঠানো কেবল নয়! মানুষকে তথা বড়দেরকে,শিক্ষকদেরকে সম্মান দেয়াটাও শেখাতে হয়। ছেলে মেয়ের জীবনে শিক্ষা দেবার দায়িত্ব ভার কেবল স্কুল,কলেজের শিক্ষকদের নয়,প্রতিটা বাবা মায়েরও সন্তানের শিক্ষা জীবনে যথাযত গুরু দায়িত্ব পালন করা বাঞ্ছনীয়! সন্তানকে সুশিক্ষায় শিক্ষিত করায় শিক্ষকের পাশাপাশি বাবা মায়ের ভূমিকা অনিবার্য। বাবা মাকেই সন্তানকে বুঝাতে হবে-আন্দোলন করা ভালো তবে তা যেন হয় অন্যায়ের বিরুদ্ধে,ন্যায় প্রতিষ্ঠায়! আন্দোলনের নামে কোন অন্যায়কে যেন প্রশ্রয় দেয়া না হয়।
আমাদের দেশে কিছু কিছু শিক্ষক নিজেদের ফায়দার জন্য ছাত্রছাত্রীকে ব্যবহার করে থাকে। যা শিক্ষার পরিবেশ শুধু নয়,ভবিষ্যতকেও অন্ধকারের দিকে ঠেলে দেয়। সবাইকে মনে রাখতে হবে শিক্ষার আলোই আলোকিত মানুষ,কখনো নিজের স্বার্থ দেখে না। ছাত্রকে সুশিক্ষায় তাঁর নিজের চেয়েও দীক্ষিত করতে পেরে একজন শিক্ষক আনন্দাশ্রুজলে ভিজে গর্বিত হন! ক্ষমতা নয়,তাঁরা সমাজকে একজন সুদক্ষ মানুষ দিয়েই জীবনে আত্মতৃপ্তি খুঁজে নেন...।
(বিঃ দ্রঃ-উল্লিখিত কবিতাটি গুগুল থেকে নেয়া)