পল্টু বললো, ‘তিনরাস্তার মোড়ে একটা বিরাট তোরণ বানাতে হবে, কী বলিস? তোরণের উপরে বড় করে লেখা থাকবে, হে মহান গাবলু, তোমার এই মাতৃভূমে তোমায় স্বাগতম। আমাদের সশ্রদ্ধ সালাম গ্রহণ কর হে মনীষী।’
আমি পল্টুর মুলোর মত কানগুলো ধরে পাতলা একটা মোচড় দিলাম, ‘পুরো রবীন্দ্রনাথের আমলের ডায়লগ ঝেড়ে দিয়েছিস পাগলা! গাবলু ভাই কোথাকার কোন মনীষীরে, ব্যাটা বুরবক! এসব তোরণ-ফোরণের চিন্তা বাদ দে, পারলে চাঁদা তুলে একটা বড় মুরগী কিনে রোস্ট করার ব্যবস্থা কর। আমি গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি, গাবলু ভাই তোরণের চাইতে মুরগীর রোস্ট বেশী পছন্দ করবে। অবশ্য আমিও মুরগীর রোস্ট খুব পছন্দ করি।’
পল্টু আমাকে ধমক লাগাল, ‘তুই একটা ছাগল। সাধারণ ছাগল না, ক্লিয়ার ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগল। কোথায় তোরণ আর কোথায় মুরগীর রোস্ট! তোরণ না বানালেও অন্তত গাঁদা ফুলের একটা মালার কথা বলতে পারতিস।’
আমি পল্টুকে ভেংচি কাটলাম, ‘ইস, আমি একাই ছাগল! তুই ব্যাটা একটা খরগোশ, না খরগোশ না, খরগোশ ভালো প্রাণী। তুই একটা চামচিকা! গাঁদা ফুলের মালা কি খাওয়া যায়? তার চেয়ে কোনো খাবার জিনিস দিয়ে গাবলু ভাইকে বরণ করার চিন্তা কর। জানিস না, গাবলু ভাই খুব ভোজনরসিক। একবার ৩৬টা রুটি আর ১০ প্লেট মাংস ১০ মিনিটে খেয়ে ফেলেছিল।’
গাবলু ভাই আমাদের পাড়ার শ্রদ্ধেয় বড় ভাই। বিলেত থেকে অনেকদিন পর দেশে ফিরছে। সেই কখন স্কলারশীপ নিয়ে পড়তে গিয়েছিল ইংল্যান্ডে। গ্র্যাজুয়েশন শেষ করে তবেই আসছে। আমরা গাবলু ভাইকে নিয়ে মোটামুটি গর্বিত। গাবলু ভাই বিদেশী ডিগ্রী নিয়ে দেশে ফিরছে, এটা ভাবলেই আমার ইচ্ছে করে দৌড় মেরে মর্জিনাদের বাসার সামনে চলে যেতে। অবশ্য যেকোন কিছু হলেই আমার দৌড়ে মর্জিনাদের বাসার সামনে চলে যেতে ইচ্ছে করে। মর্জিনাও আমাকে দেখলে খুব খুশী হয়। একদিন তো বলেই ফেলেছিল, ‘ক্যাবলা ভাই কতদিন ভেবেছি, যাই আজকে চিড়িয়াখানায় গিয়ে বান্দর দেখে আসি। অমনি কোত্থেকে তুমি এসে তোমার চাঁদবদনটা দেখিয়ে আমার মনের ইচ্ছাটা পূরণ করে দাও। আচ্ছা তুমি কি টেলিপ্যাথি জানো?’
মর্জিনার কথা মনে হলেই আমি উদাস হয়ে যাই। পল্টু আমার লুঙ্গি টান মেরে বললো, ‘কিরে ব্যাটা ক্যাবলা, চোখ বন্ধ করে মিচকে মিচকে হাসছিস ক্যান? গাবলু ভাইয়ের জন্য কিছু করবি না?’
ইচ্ছে হল পল্টুর কানদুটো মুচড়ে টিউবওয়েল বানিয়ে ফেলি। মর্জিনাকে নিয়ে ভাবছিলাম, এমন সময় লুঙ্গিটা টান মারল। ব্যাটা বদের শর্ষে ক্ষেত!
২।
গাবলু ভাইয়ের পিছনে আমি আর পল্টু অতন্দ্র প্রহরীর মত ঘুরে বেড়াচ্ছি। গাবলু ভাই দেশে এসেছে তিন দিন হল, এখনো ভালো করে খাওয়া-দাওয়া করতে পারেনি। ওখানকার খাবার খেতে খেতে উনি এখন বাংলাদেশী খাবারে অনভ্যস্ত হয়ে গেছেন।
আমরা পাড়ার রাস্তা দিয়ে হাঁটছিলাম। রাস্তার পাশের ডাস্টবিনের ময়লাগুলো উপচে পড়ে রাস্তার অর্ধেক পর্যন্ত চলে এসেছে। গাবলু ভাই রীতিমত আয়োজন করে নাক চেপে ধরলেন, ‘ইস, কী দুর্গন্ধ রে বাবা, গন্ধে তো পুরা টাইফয়েড হয়ে যাবে মনে হচ্ছে!’
আমি বললাম, ‘শুধু টাইফয়েড না, আমাশয় কিংবা ডিপথেরিয়াও হতে পারে!’
গাবলু ভাই বললেন, ‘তোরা এই দুর্গন্ধের মধ্যে নিঃশ্বাস নিচ্ছিস কীভাবে?’
আমি একটা চিমসে হাসি দিলাম, ‘এটাকে তুমি দুর্গন্ধ বলছ, এটা তো সুগন্ধ! আমি প্রত্যেকদিন সকালবেলা উঠে এখানে এসে গন্ধ শুঁকে যাই। কোনদিন গন্ধ শুঁকতে না পারলে আমার সারাদিনটাই খারাপ কাটে।’
গাবলু ভাইকে দেখে মনে হল উনি আমার মানসিক সমস্যা নিয়ে উদ্বিগ্ন বোধ করছেন। কিছু একটা বলতে যাবেন, তার আগেই বিকট আর্তনাদ করে উঠলেন, ‘আরে দ্যাখ, একটা লোক রাস্তার পাশে খোলা জায়গায় প্রস্রাব করছে!’
আমি তাকিয়ে দেখি এক লোক নিশ্চিন্ত মনে মালকোচা মেরে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিচ্ছে। পল্টু বললো, ‘এতে অবাক হওয়ার কী আছে, এটা তো স্বাভাবিক ঘটনা!’
গাবলু ভাইকে দেখে মনে হল মাথা ঘুরে পড়ে যাবেন। পড়লে ব্যাথা পাবেন, এই ভয়ে মাথা ঘুরানো বন্ধ রেখেছেন। বললেন, ‘এটা শুধু এই দেশেই সম্ভব, বিদেশে তুই এটা চিন্তাও করতে পারবি না।’
আমি জ্ঞানীর মত মাথা ঝাঁকালাম, ‘বিদেশে তোমরা অনেক ভুল ধারণা নিয়ে বেঁচে থাকো। এটা যেহেতু প্রকৃতির ডাক, তাই প্রকৃতির সান্নিধ্যে করাটাই সবচেয়ে ভাল। আর বিষম বেগ চাপলে একটা বোঝা বয়ে নিয়ে বেড়ানোর চেয়ে মাইনাস করে হালকা হয়ে যাওয়াই ভাল না? কে আবার কষ্ট করে টয়লেট খুঁজতে যাবে!’
৩।
গাবলু ভাই মন খারাপ করে বারান্দায় বসে আছেন। গাবলু ভাইয়ের মন খারাপ দেখে আমিও মন খারাপ করার চেষ্টা করলাম। কিন্তু মন খারাপ করলেই আমার খালি ক্ষিধে পায়। ধুর, এতো দেখি বিরাট যন্ত্রণা। গাবলু ভাই বললেন, ‘আছা ক্যাবলা, এদিকে রাস্তাঘাটগুলো দেখি সবই ভাঙা, এলাকার মেম্বার-চেয়ারম্যানরা এগুলো ঠিক করে দেয় না?’
আমি উদাস হয়ে জবাব দিলাম, ‘ঠিক করে দেবে না কেন! ঠিক করে, আবার দুইদিন পরে নষ্ট হয়ে যায়। টেন্ডারের বেশীরভাগ টাকা ওরা নিজেরা খেয়ে ফেলে তো তাই।’
গাবলু ভাই অবাক হলেন, ‘এগুলোর কেউ প্রতিবাদ করে না?’
‘প্রতিবাদ কে করবে, সবাই তো নিজের আখের গোছানো নিয়ে ব্যস্ত। যে যেদিকে পারছে দুর্নীতি করছে।’
গাবলু ভাইকে দেখে মনে হল এইমাত্র একগ্লাস চিরতার রস খেয়েছেন। মুখটাকে কালো করে বললেন, ‘এখানে সবাই ইচ্ছেমত জায়গা জমি দখল করে নেয়, তাই না রে? প্রশাসন বলতে কিছু নেই।’
গাবলু ভাইয়ের কঠিন কঠিন কথা শুনতে আমার একটুও ইচ্ছে করছে না। একবার মর্জিনাদের বাসার সামনে যেতে পারলে ভাল হত। গাবলু ভাইকে বললাম, ‘যার শক্তি আছে সে সবকিছু দখল করে নেবে এটাই স্বাভাবিক। এভাবেই তো দেশটা চলছে।’
গাবলু ভাই হঠাৎ আমার কাঁধে হাত দিলেন। আমি ভয় পেয়ে গেলাম, মারবে না তো। মালকোচা মেরে দৌড় দেব কিনা ভাবছি। অনেক দূর থেকে উনার কন্ঠ ভেসে এল, ‘ক্যাবলা, তোর তো ভার্সিটির পড়াশোনা প্রায় শেষের দিকে, তাই না?’
আমি একটু অবাক হলাম, ‘হ্যাঁ, মাস্টার্স পরীক্ষা দিচ্ছি। কিন্তু একথা কেন জিজ্ঞেস করছো?’
গাবলু ভাইকে দেখে মনে হল না আমার কথা শুনেছেন। বললেন, ‘এদেশ থেকে চল পালাই। আমি তো যাবই, তুইও চলে আয়। ওখানে অনেক ভার্সিটি, তুই পোস্ট গ্র্যাজুয়েশনের জন্য স্কলারশীপের আবেদন কর, পেয়ে যাবি। চল, এদেশটা বসবাসের অযোগ্য হয়ে গেছে রে।’
গাবলু ভাইয়ের কথা শুনে আমার বুকটা কেমন যেন মুচড়ে উঠলো, বললাম, ‘আচ্ছা ওখানে কি রাত পোহালে পাখির কিচিরমিচির শোনা যায়? কৃষক লাঙ্গল কাঁধে করে হালের বলদ নিয়ে ক্ষেতের দিকে ছোটে?’
গাবলু ভাই অবাক হলেন, ‘নাতো, উন্নত দেশে তুই এগুলো কোথায় পাবি?’
‘ওখানে কি দুপুরবেলা ঘুমপাড়ানি মাসি-পিসির গান শুনিয়ে মায়েরা শিশুদের আগলে রাখে পরম যত্নে?’
‘না, বিদেশে লোকের অত সময় আছে নাকি! শিশুরা তো থাকে চাইল্ড কেয়ার হোমে।’
‘ওখানে কি বাউল একতারা হাতে গান গাইতে গাইতে ঘুরে বেড়ায় গ্রামের পর গ্রাম? মাঝি মনের সুখে নৌকা বায়? রাখাল গরু চরাতে নিয়ে যায় মাঠে?’
গাবলু ভাই হেসে ফেললেন, ‘আরে না, এগুলো তুই বিদেশে কোথায় পাবি? এগুলো তো শুধু এদেশেই হয়।’
আমার হাতদুটো মুষ্টিবদ্ধ হয়, চোয়াল শক্ত হয়ে আসে। ধীরে ধীরে বলি, কিন্তু এগুলো ছাড়া তো আমি বাঁচতে পারবো না। আমি যদি সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে এই দেশের মাটিতে নিঃশ্বাস নিতে না পারি, আমি তো দমবন্ধ হয়ে মারা যাব। এই দেশটা নিয়ে যে আমার অনেক গর্ব, অনেক অহংকার।’
গাবলু ভাই মাথা নিচু করে রাখে। আমি তাকিয়ে থাকি অস্তগামী সূর্যের দিকে, রাত নামছে। তবে রাতের আঁধার কেটে গিয়ে পুবদিকে আবার নতুন সূর্য উঠবে। আমি একটি শুভ্র সকালের প্রত্যাশায় আশায় বুক বাঁধি।