রাজ প্রাসাদ। আজব দেশের আজব রাজার আজব প্রাসাদ আর তার আজব আজব সব কা-ন্ড-কারখানা। তিন ইঞ্চি উঁচু সিংহাসনে বসে আছেন আনুমানিক পাঁচ ইঞ্চি উচ্চতার মহারাজা। এ দেশের মানুষের উচ্চতা অনুযায়ী রাজা মহাশয় একটু বেঁটে খাটো। কিন্তু তা হলেও তার প্রতাপ প্রতিপত্তি নেহায়েত কম নয়। বহাল তবিয়তেই তিনি দিব্যি তার রাজ্য চালাচ্ছেন তিন ইঞ্চি উঁচু ঐ সিংহাসনে বসেই। তার ভয়ে তটস্থ সবাই। রাজ দরবারে পিন পতন নীরবতা।
এমনই যখন পরিবেশ চারদিকে; ঠিক তখনই, চার গুণ চার (নামতার হিসেব অনুযায়ী ) ষোল জন ষণ্ডামার্কা বেহারার কাঁধে চড়ে আকমল ও বুড়ো এলো সেখানটায়। একেবারেই খাঁচাশুদ্ধ বন্দি অবস্থায় ওদের নিয়ে বেহারারা হেঁইয়ো হেঁইয়ো রব তুলে প্রবেশ করল রাজ প্রাসাদে। কপাল ভাল বেলা তখন দ্বি-প্রহর। দিনের শুরুতে রাজার হাতে পড়া প্রজাদের বিচার আচার প্রায় শেষ পর্যায়ে পেঁৗছেছিল। নতুবা দিনের শুরুতে এমন অদ্ভুত কাণ্ড ঘটলে বিচার প্রার্থীর সাধারণ প্রজাদের যে কপাল পুড়ত তাতে কোন সন্দেহই নেই।
রাজা কিছুক্ষণ কঠোর নেত্রে চেয়ে রইল ওদের দু'জনার দিকে। তারপর মন্ত্রী পরিষদের দিকে চোখ ইশারা করে জানতে চাইল ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ। ঘটনার আকস্মিকতায় ততক্ষণে কারও মুখে রা'টুকুও নেই; কাজেই মন্ত্রী পরিষদও কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে চেয়ে রইল ওদের দিকে। শেষে খাঁচার সাথে আসা লম্বা চৌকোনা দেখতে প্রধান ব্যক্তিটিই বলল, 'এদের একজন অশুভ আত্মা অপর জন আজব দেশের অজানা-অচেনা মানুষ। জাঁহাপনা, গোস্তাকি মাপ করলে এদের অপরাধটুকু জানিয়ে দিই।'
নড়েচড়ে বসে রাজা বলল, 'বড় অদ্ভুত কাণ্ডকারখানা! তুমি নির্ভয়ে তোমার ওজর জাঁহাপনার সামনে পেশ করতে পার।'
প্রায় আট ইঞ্চির কাছাকাছি লম্বা চৌকশ লোকটা খানিক ইতস্তত করে গোঁফে দু'বার তা দিয়ে বলল, 'আজব দেশের এই অদ্ভুত লোকটাকে রাত পোহানো এক ভোরে আমরা ইলিবিলি প্রদেশের ইচিং গ্রাম থেকে বন্দি করেছি, জাঁহাপনা।'
কথার মধ্যিখানে একেবারে ছিচকে চোরের মতো লোকটা দু'বার ভিল ভিল করে এদিক সেদিক চেয়ে নিল। যেন রাজা তার বলা কথা সঠিক হজম করতে পেরেছে কিনা তার একটা গোপন মহড়া মনে মনে দিয়ে নিল সে। অথচ রাজার দিকে সরাসরি তাকাতেও তার বেজায় ভয়।
তারপর কোন ভূমিকা না করেই লোকটা আবার বলতে শুরু করল।
'দেখতে একবারে বাচ্চা ছেলের মতো হলেও উচ্চতায় সে আমার সমান। মুখে একটা গোঁফ গজায়নি জাঁহাপনা; অথচ আকার আকৃতিতে যেন একজন পূর্ণ বয়স্ক মানুষ। ওদিকে আবার সাথে করে নিয়ে এসেছে ইচিং গ্রামেরই সদ্য মরা এক বুড়োর প্রেতাত্মা কে। এর চেয়ে অদ্ভুত বিষয় আর কী হতে পারে যে, সে আমাদের ভাষায় অনর্গল কথা বলতে পারে। আপনি এর সঠিক বিচার করুন জাঁহাপনা।' কথাগুলো সব বলতে পেরে লোকটা যেন ঢোক গিলে হাঁফ ছেড়ে বাঁচল।
মহারাজা এতক্ষণ তার সিংহাসনের আরাম কেদারায় আয়েশে গা এলিয়ে গোঁফে তা দিতে দিতে লোকটার বক্তব্য শুনছিল। মাঝে একটু ঝিমুনিও চলে এসেছিল তার; কথা শেষ হতেই হঠাৎ যেন তার ধ্যান ছুটে গেল। দু'বার মাথা নেড়ে পুরো ঘটনা তার আয়ত্তে চলে আসার বিষয়টা সবার কাছে পরিষ্কার করে দিল। তারপর প্রধান মন্ত্রীর দিকে এক পলক চেয়ে তার বুঝা বিষয়টার পূর্ণাঙ্গ বিবরণ চেয়ে চোখের ইশারা করল। যেন প্রধান মন্ত্রী ভালই জানে রাজা মনে মনে কী বুঝেছেন।
উপযুক্ত রাজার প্রধান মন্ত্রী মোটেও কিছু কম যায় না। কোন ভূমিকা না করে সেও বলল, 'জাঁহাপনা তাহলে প্রশ্নটা আপনিই করুন; তার নাম ধাম পরিচয় আর বয়সটা আন্দাজ কত?'
মনে মনে মহারাজা হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। সময়মতো প্রশ্নটা প্রধান মন্ত্রী যোগান দিতে না পারলে মহারাজার বিপদে পড়াটা ছিল একান্তই সময়ের ব্যাপার। কেনানা বক্তব্য শোনার মাঝে বে-মালুম ঘুমিয়ে পড়েছিল সে। এখন শেষে এসে তার মিথ্যে অভিনয়টা গোড়াতেই যে ধরা পড়ে যেত তাতে কোন সন্দেহ নেই।
গোঁফের কোনে কোনে উঁকি দিল মহারাজার মুখের চোরা হাসি। কি বলবে না বলবে ভেবে নিতে সময় নিল সে আরও কিছুক্ষণ। তারপর বেশ বড় সড় ভূমিকা করে বলল, 'বিলক্ষণ কুলক্ষণ, বিলক্ষণ কুলক্ষণ।'
তারপর গোঁফে বার দু'য়েক তা দিয়ে নিয়ে কিছুটা উত্তেজিত হয়ে বাকিটা শুরু করল এবার সে। যেন রাজার রাজাগিরি ধরে রাখতে সু-কৌশল রাজ-নীতির আশ্রয় নিয়ে নিল কথা শুরুর আগেই। বলল, 'আগন্তুক বিদেশি, আমাদের দেশের অতিথি কিন্তু সসম্মানে না এসে খাঁচায় বন্দি কেন? নিশ্চয় কোন অপশক্তি।'
রাজার কথায় প্রতিবাদ করার মতো কেউ নেই। তবে মাথা নেড়ে উজির-নাজির আর মন্ত্রীদের অনেকেই সমর্থন জানাল তাকে। সমর্থন পেয়ে রাজা বলল, 'দেখতে বাচ্চা ছেলের মতো অথচ উচ্চতায় আমার চেয়েও লম্বা।'
রাজ দরবারে এবার মৃদু হাসির রোল উঠল। রাজা তার প্রশ্নে অটল। বলল, 'নাম পরিচয় জানার আগে জানতে চাই তোমার বয়সটা আন্দাজ কত?'
রাজার কথায় একটু হলেও ঘাবড়ে গিয়েছিল আকমল। তবে অনেক-ক্ষণ পর কথা বলার সুযোগ পেয়ে আমতা আমতা করে বলল, 'মায়ের মুখে যা শুনেছি তাতে দশ ছাড়িয়েছি আমি।'
অবাক হয়ে রাজা এবার জানতে চাইল, 'কী দশ? সপ্তাহ না দিন?'
'সপ্তাহ-দিন হতে যাবে কেন?' যারপরনাই অবাক হয়ে জানতে চাইল আকমল।
'তাহলে কী দশ মাস?' চোখ মাথায় তুলে বলল রাজা।
আকমল কী বলবে হঠাৎ ভেবে পেল না। বেশি অবাক হয়ে গেলে মানুষ, যা হয়; চোখ বন্ধ করে নিজের মনেই একবার বলল সে 'আশ্চর্য!'
তারপর সরাসরি রাজার দিকে তাকিয়ে বলল, 'কী সব আবোল তাবোল বকছ তুমি। দিন-সপ্তাহ-মাস কী একটা বয়স হল? নাকি এ বয়সে মানুষ কথা বলতে শেখে? এতো সহজ হিসেব দশ বছর।'
অক্কা না পেলেও রাজার প্রায় অক্কা পাওয়ার মতোই দশা হল। মুখে সহসা কথা আটকে গেল তার। মন্ত্রীদের অনেকেই আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে চেঁচিয়ে বলল, 'এ ডাঁহা মিথ্যা কথা, জাঁহাপনা।'
পুরো রাজ দরবার জুড়ে ভূতুড়ে অবস্থার সৃষ্টি হল দিন দুপুরে। সবাই কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে একে অপরের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করতে লাগল। শেষে রাজাই পুরো বিষয়টার ইতি টেনে বলল, 'এ হল আজব দেশের আজব মানুষ। সুতরাং আজব কাণ্ড-কারখানা হতেই পারে।'
এমন সময় বয়োবৃদ্ধ রাজ জ্যোতিষী রাজ দরবারে উপস্থিত হয়ে বলল, ' অনুমতি দিলে একটা কথা বলি জাঁহাপনা।'
'কী কথা তা নির্ভয়ে বলতে পার রাজ জ্যোতিষ।' বলল রাজা।
রাজার অনুমতি পেয়ে থুত্থুড়ে রাজ জ্যোতিষী ভাঙা ভাঙা গলায় বলল, 'বয়স-টাতো আমার মোটেও কম হয়নি। দশ মাস দশদিন চলছে আজ দিয়ে, আমি যা দেখেছি এই দুই পোড়া চোখে; তা এই দেশে খুব কম লোকই দেখেছে। আমার ধারণা ভিন দেশের এই ছেলেটা ঠিকই বলেছে, ওর বয়স দশ বছরই বটে।'
পলক বিহীন কটমট চোখে রাজা কিছুক্ষণ জ্যোতিষীর দিকে চেয়ে থেকে বলল, 'বেশ মেনে নিলাম তোমার কথা। কিন্তু রাজ দরবারে কোন কথা বলতে হলে প্রমাণ ছাড়া কথা বলাটা অন্যায় তা তুমি জান?'
'আলবৎ জানি জাঁহাপনা। আর সেজন্যই তো আমি আমার প্রমাণ সঙ্গে নিয়েই রাজ দরবারে উপস্থিত হয়েছি জাঁহাপনা। অনুমতি দেন তো এখুনি তা আপনাদের সামনে পেশ করছি।' অত্যন্ত বিনয়ের সাথে বলল বয়োবৃদ্ধ জ্যোতিষী।
রাজা খানিকটা চিন্তিত হয়ে বলল, 'ঠিক আছে দিলাম অনুমতি। তবে মনে থাকে যেন শুধু মাত্র অকাট্য প্রমাণই রাজ দরবারে গৃহীত হয়। মামুলি কথার পরিণতি.............' বাকিটা নিজের গর্দানে আঙুল দিয়ে পোঁচ দিয়ে বুঝিয়ে দিল রাজা কী হতে পারে।
'তথাস্তু...তথাস্তু।' বলে আনুগত্য প্রকাশ করল জ্যোতিষী। তারপর তার জামায় ঝোলানো পণ্ডিতি চশমাটা পরে নিল কায়দা করে। তার লম্বা ঝোলা থেকে টেনে বের করল একটা অতি জরাজীর্ণ পুরানো খাতা। সেটাতে খানিক চোখ বুলিয়ে নিয়ে বলল, 'আমার প্র-পিতামহের দাদার দাদা, যিনি প্রায় পাঁচ বছর আগেই গত হয়েছেন। বেঁচেও ছিলেন তিনি প্রায় বার মাস এগার দিন।'
এ পর্যন্ত বলে থামল জ্যোতিষী। সবাই বিস্ময়ে হতবাক হয়ে চেয়ে রইল ওর মুখের দিকে। এত ঘটনার পর আকমলের আর বুঝতে বাকি রইল না বার মাস বেঁচে থাকাটা এদের জন্য অত্যন্ত বিস্ময়ের ব্যপার। সেখানে আকমলের দশ বছর বয়সটা এদের কাছে বিশ্বাস না হওয়ারই কথা।
তার কাঁধে ঝোলানো অন্য আর একটা ঝোলায় গোপনে রাখা একটা কৌটা বের করল জ্যেতিষী। চক চকে দেখতে রূপার কৌটার উপর সোনালি কারুকাজ করা। রাজ দরবারে উপস্থিত সবার দৃষ্টি এখন সেদিকেই নিবদ্ধ। জ্যেতিষী অবলিলাক্রমে সেই কৌটা খুলে পানের পিক ফেলে আবার বন্ধ করে ফেলল সেই কৌটার মুখটা। সম্ভবত বিষ্ময়ের রেশটা একটু ম্লান করে দিতেই জ্যেতিষীর এই অভিনব কৌশল। তারপর স্বাভাবিক ভাব্ইে আবার শুরু করল জ্যেতিষী।
'তিনি তার এই খাতায় লিখে রেখে গেছেন। এই বিশ্ব ভ্রমাণ্ডে এমনও দেশ আছে যেই দেশে মানুষেরা একশ বছর পর্যন্তও বাঁচে। উচ্চতায় তারা আমাদের এক একজন পূর্ণ বয়স্ক মানুষের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি লম্বা হয়। শক্তি সামর্থও তাদের আমাদের চাইতে অনেক বেশি। অথচ এসব দেশের লোকেরা এতই বোকা যে এই একশ বছর জীবন কাল কাটাতে তারা স্রেফ মাটি দিয়ে ঘর তৈরি করে থাকে। তাদের মধ্যে যারা বেশি বুদ্ধিমান তারা মাটি পুড়িয়ে লাল বর্ণ চৌকা আকৃতির এক ধরণের বস্তু তৈরি করে। সেটাকে তারা পাথরের মতো শক্ত মনে করে অথচ তা পাথরের চাইতে অনেক নরম। আর তাতে এক ধরণের আঠার প্রলেপ দিয়ে তারা তাদের উঁচু উঁচু অট্টালিকা নির্মাণ করে। অথচ তাদের তৈরি এসব অট্টালিকা মাত্র ক'একশ বছর টিকে থাকে।'
এরপর জ্যেতিষী তার পান খাওয়া মুখে একটু মুখটিপে হেসে উপবিষ্ট সভাসদ বৃন্দের দিকে তাকাল। বক্তব্যের মাঝে গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্যটি রাখার আগে বক্তার এমন অভিব্যক্তি দর্শকের মনোযোগ বিশেষ ভাবে আকৃষ্ট করে। এ ক্ষেত্রেও তার কোন ব্যতিক্রম হলো না। সবাই এবার নড়ে চড়ে বসল মূল বক্তব্যটি শোনার জন্য। জ্যেতিষীও তার আচরণে বলার আগেই শ্রোতাদের মনোযোগ আকর্ষণ করতে পারার আনন্দে স্ফীত হয়ে উঠল। তারপর ধীরে ধীরে আবার শুরু করল।
'পরের পৃষ্টায় দাদা যা লিখেছেন তা রীতিমতো হাস্যকর। তিনি লিখেছেন এসব দেশের পণ্ডিতরা মানুষ হওয়া সত্বেও নিজেদের বাঁদরামো আচরণের কারণে বাঁদরের বংশধর হিসাবে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন। তাই তারা রায় দিয়েছেন এরা মানুষ হলেও এদের উৎপত্তি বাঁদর থেকে। সেজন্য দাদা এদের নাম রেখেছেন বাঁদর মানুষ হিসাবে। সব শেষে তিনি লিখেছেন এদের সম্বন্ধে বিস্তারিত আর কিছু জানা যায় না।'
খাতার পৃষ্ঠা থেকে মুখ তুলে বয়োবৃদ্ধ জ্যোতিষী এবার বলল, 'আসলে এরা যথার্থ্যই বাঁদর জাঁহাপনা। নিজেদের নিজের থেকে ভাল আর কে চিনতে পারে। এরা যে উঁচু উঁচু অট্টালিকা গুলো নির্মাণ করে সামান্য একটু ভূমিকম্প হলেই সেগুলো তাদের নিজেদের উপরই ভেঙে পড়ে। তখন সেসবের নিচে চাপা পড়ে নিজেরাই বে-ঘোরে প্রাণ হারায়। তাই এদের বাঁদর ছাড়া আর কী বলা যায়? অথচ আমরা পিতল গলিয়ে, পাথর কেটে যে সব ঘর নির্মাণ করি তা কেউ ভাঙতে দেখেনি কখনোই। উপরন্তু তা টিকে থাকে কয়েক হাজার বছর।'
জ্যোতিষীর কথা শেষ হওয়া মাত্রই উপস্থিত সবাই এ ওর মুখ চাওয়া-চাওয়ি করতে শুরু করল। বিষয়টা লক্ষ্য করে জ্যোতিষী আবার বলল, 'তবে আমার শেষ কথা এটাই, এদের বর্ণনা থেকে আমি যতটুকু জেনেছি; লম্বায় এরা আরও অনেক উঁচু হওয়ার কথা। অথচ ছেলেটির বয়স দশ বছর হওয়া সত্বেও দেখতে সে আমাদেরই মতো একজন পূর্ণ বয়স্ক মানুষের সমান। এছাড়াও সে আমাদেরই ভাষায় অনর্গল কথা বলতে ও বুঝতে পারে। নিশ্চয় এর মধ্যে কোন কিন্তু আছে......কিংবা কোন অশুভ লক্ষণ।'
সঙ্গে সঙ্গে রাজা তার কথায় সায় দিয়ে বলল, 'তুমি ঠিকই বলেছ জ্যোতিষী। আমিও এর মধ্যে অশুভ লক্ষণ খুঁজে পেয়েছি। ওদের কিছুতেই ছেড়ে দেয়া ঠিক হবে না। মৃতু্যদণ্ডই হবে তাদের একমাত্র শাস্তি। তবে তার আগে আমি তার কাছে জানতে চাই, তোমার বয়স দশ বছর হলে দেহের আকৃতি এত ছোট হওয়ার কারণ কী? আর আমাদের ভাষাই বা তুমি রপ্ত করলে কী করে? যদি সত্যি কথাটা ভালই ভালই বলে ফেল তাহলে তোমার দণ্ড মওকুফ করা যেতে পারে বে-ওকুফ।'
এতক্ষণ পর কথা বলার আবার সুযোগ পেয়ে মনে মনে আকমল বলল,
'আজব দেশের ক্ষুদে রাজা
আজব তোমার বাহানা
সত্যি ছাড়া মিথ্যে কথা
আমার বলা সাজেনা।'
কেননা এটাই ছিল তার জন্যে মায়ের রেখে যাওয়া শেষ আদেশ। মায়ের সব আদেশই সে মাথায় তুলে রেখেছে। সুতরাং যত ঘটনাই ঘটুক, আর যত বিপদেই পড়ুক সত্যি ছাড়া মিথ্যে সে বলতে পারবে না কখনো। এদেশে এসে এর আগে সে দু'বার দু'জায়গায় পরী হিনার নাম বলে ঠকেছে। তাই নাম না করে বলল, 'এদেশে যে আমাকে নিয়ে এসেছে সেই ভাল জানে, আমি এই কেরামতির কিছুই জানিনা।'
'সে কে?' গুরু-গম্ভীর প্রশ্ন এবার রাজার।
আর উপায় নেই, গোপন কথা প্রকাশ করা ছাড়া। তাই সরাসরি বলল আকমল, 'পরী হিনা।'
'পরী হিনা? সে আবার কে?' অবাক রাজার পরবর্তী প্রশ্ন।
'তাকে তোমরা চিনবে না। বেশি দুর কী, আমিও তাকে চিনতাম না; কোনদিন দেখিওনি।' প্রাথমিক যা বলার বলল আকমল। কিন্তু রাজা তাতে মোটেও সন্তুষ্ট হলো বলে মনে হলো না।
রাজা এবার তার মন্ত্রী পরিষদ বর্গের দিকে তাকিয়ে বলল, 'আমি প্রথমেই বলেছিলাম তোমাদের, এ হলো গভীর ষড়যন্ত্র। এদের পিছনে কলকাঠি নাড়ছে পরী হিনা নামে এক দুষ্ট পরী। অচিরেই তাকে আমরা খুঁজে বের করব এবং তার দশাও এদের মতোই হবে।'
বাকিটা গলায় আঙুল চালিয়ে বুঝিয়ে দিল রাজা। গলা কেটে মৃতু্যদণ্ডই যে তার জন্য মোক্ষম শাস্তি হবে তা রাজার মহড়া দেখে সবাই গোপনে বুঝে নিল। তারপর রাজা সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলতে শুরু করল, 'পরী রাজ্যের পরী হিনা এদেশের বিরুদ্ধে গভীর ষড়যন্ত্র শুরু করেছে। হয়তো তার কোন গোপন উদ্দেশ্য থাকতে পারে, তবে তোমাদের রাজাকে হত্যা করে রাজ্য দখল করাই তার মূল লক্ষ্য।
এ কথা শুনে আকমল সাথে সাথে প্রতিবাদ করে বলল, 'মিথ্যে কথা, আমাকে পরী হিনা এ দেশে নিয়ে এসেছে একটাই মাত্র উদ্দেশ্যে, তা হল... বোকাদের দেশ দেখানো। অন্য কোন উদ্দেশ্য নেই আমাদের।'
আকমলের কথা শুনে বোধহয় টনটনে রাজার আত্মসম্মান-বোধ এ বেধে গেল। কিছুক্ষণ আকমলের দিকে চেয়ে থেকে বলল, 'আমরা কী তবে বোকা? আর আমাদের দেশটাও বোকদের দেশ।'
আকমল এবার ক্ষেপে গিয়ে বলল, 'নয়তো কী, তোমরা আমাদের বাঁদর মানুষ বলো আর যাই বলো না কেন, বোকা তো তোমরাই। তোমরা যেখানে বাঁচ মাত্র আটমাস থেকে দশমাস। সেখানে তোমরা ঘর বানাও হাজার বছরের কথা চিনত্দা করে, এর চেয়ে বোকমির পরিচয় আর কী থাকতে পারে মানুষের জন্য।'
রাজা এবার হাতে তালি দিয়ে ফোড়ন কেটে বলল, 'বা বা বা বেশ বেশ, চমৎকার বলেছ। কথায় আছে, নাচতে না জানলে উঠোন বাঁকা। তোমদেরও হয়েছে সেই দশা। '
ইতিমধ্যে রাজ দরবারে মৃদু গুঞ্জন উঠেছিল। রাজা 'খা-মোশ' বলে হুঁংকার ছাড়তেই তা স্তব্ধ হল। রাজ দরবারে আবারো পিন পতন নীরবতা।
সবাই এবার উন্মুখ হলো রাজার তরফ থেকে কী ঘোষণা আসে তা শোনার জন্য। গুরু-গম্ভীর স্বরে রাজা পরবর্তী ঘোষনা দিল, 'দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অভিযোগে এদের দণ্ড বহাল রাখা হল।'
রাজার আদেশ পাওয়ার পর আর এক মুহূর্ত দেরি করা হল না। খাঁচাসহ আকমল আর বুড়ো কে নিয়ে একদল ষণ্ডামার্কা প্রহরী হেঁইয়ো হেঁইয়ো করতে করতে রওয়ানা হয়ে গেল বধ্যভূমির দিকে। সেখানে জল্লাদ আগে থেকেই তরবারি হাতে তৈরিই ছিল। আর মাত্র কিছুক্ষণ। তারপরই ওদের দু'জনার মুণ্ড ধড় থেকে আলাদা হয়ে যাবে।
মনে মনে প্রমাদ গুণল আকমল। মায়ের উপদেশের কথা মনে পড়ল তার। মা তাকে শেষ উপদেশ দিয়ে বলেছিল বিপদে-আপদে খোদাকে ডেকো। আকমল মনে মনে তাই ডাকতে লাগল।
এমন সময় হঠাৎ কোথা থেকে পরী হিনা এসে হাজির হল সেখানে। তাও একেবারে খাঁচার মধ্যে। আকমল তাকে দেখেই বলল, 'এক্ষুণি পালাও এখান থেকে, আমাদের মতো তোমার মাথার উপরেও মৃতু্যদণ্ডের আদেশ ঝুলছে।'
মৃদু হেসে পরী হিনা বলল, 'আমাকে দেখতে পেলে তো?'
'কেন, আমি তো তোমাকে ঠিকই দেখতে পাচ্ছি।' বলল আকমল।
'তা তো হল, কিন্তু শুধু তুমি দেখলেই তো হবে না। তোমার ঐ নূতন বন্ধু; বুুড়ো কে একবার জিজ্ঞেস করে দেখতো সে আমাকে দেখতে পাচ্ছে কীনা?' বলল হিনা।
আকমল তাদের মাথার উপরে ঝুলতে থাকা মৃতু্যদণ্ডের কথা বেমালুম ভুলে গিয়ে বুড়ো কে জিজ্ঞেস করল, 'দেখতো, এখানে কাউকে দেখতে পাচ্ছ কীনা?'
বুড়ো তখন ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে বলল, 'অধমের এই দুই পোড়া চোখে দেখব আর কী, এক চোখে দেখছি শর্ষেফুল অন্য চোখে জল্লাদের তরবারি।'
আকমল বুড়োর কথায় খুব সহজেই বুঝে নিল পরী হিনাকে আদৌ দেখতে পাচ্ছে না কেউ। কিন্তু বুড়ো-কেও এই বিপদের মুহূর্তে সান্ত্বনা দেয়া দরকার। তাই একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আকমল বলল, 'জানিনা খোদার কী ইচ্ছা, তবে হয়তো আমরা মুক্তি পেয়ে যাব ঐ জল্লাদের হাত থেকে।'
দেখে-শুনে মনে হল বুড়োর মোটেও বিশ্বাস হল না আকমলের কথা। সে জোরে জোরে কাঁপতে লাগল আর মুখে ফিস্ ফিস্ করে কিছু আওড়াতে লাগল। এমন সময় দু'জন প্রহরী এসে প্রথমে বুড়োকেই টেনে হিঁচড়ে খাঁচা থেকে বের করে নিয়ে গেল। তারপর তাকে কাল কাপড়ের লম্বা ফাঁসির টুপি পরানো হল। সেই টুপিতেই মুখ-চোখ-কান ঢেকে গেল তার। জল্লাদের চক চকে তরবারিতে সূর্যের আলো পড়ে ঝিলিক খেলে যেতে লাগল। আর বুঝি সময় নেই। জল্লাদের জেল্লা ধরা তরবারির ঝলকানি দেখে আর তার হাবভাবে মনে হতে লাগল, তরবারি চালানোর আগেই বুঝি মুণ্ড ধড় থেকে আলাদা হয়ে যাবে। বুড়োকে টুপি পরানোর পর কাঁপুনিটা অনেক কমেছে তার। দেখে মানুষ যতটা ভড়কে যায়; না দেখে তার চেয়ে অনেক কঠিন কাজ সহজে সমাধান করা যায়। কেননা না দেখে বিশ্বাস করা কঠিন কিন্তু কাজ করা সহজ।
বুড়োর মাথা হেঁট করে দাঁড় করানো হল। আর মাত্র এক মুহূর্তের ব্যাপার। কিন্তু ওদিকে পরী হিনার সেদিকে মোটেও ভ্রক্ষেপ নেই। একটা গাছের শিকড় আকমলের হাতে দিয়ে বলল সে, 'এই শিকড়টা খাও আর মনে মনে বল, আমি ফিরে যেতে চাই আগের বয়সে।'
মুহূর্তের মধ্যে খোল-নৈচে পাল্টে যেতে সময় লাগল না। আকমল গাছের শিকড় টা চিবিয়ে যেই না মনে মনে বলেছে আমি ফিরে যেতে চাই.... আর যায় কোথায় ? বিকট শব্দে খাঁচা ভেঙে লুটোপুটি খেল। তরবারি সহ জল্লাদ যে কোথায় ছিটকে পড়ল তার কোন হদিস পাওয়া গেল না। প্রহরীরা যে যেদিকে পারল ছুটে পালাল। কপাল একান্ত ভাল বলতে হবে বুড়োর। সময়মতো পরী হিনা তাকে ধরে তুলে নিয়েছিল হাতের মুঠোয়। বেচারা একেবারে অক্ষত অবস্থায় পরী হিনার হাতের মুঠোয় বন্দি হল।
পরী হিনা বলল, 'আর মোটেও দেরি করা যাবে না। লোক জড়ো হওয়ার আগেই আমাদের এখান থেকে পালাতে হবে।'
আকমল শুধু বলল, 'খবরদার! বুড়োকে যেন ছেড়ে দিও না। ওরা ওকে পেলেই মেরে ফেলবে।'
তারপরই সেখান থেকে ওরা দু'জনাই দে-ছুট্।
শহরময় আগেই রটে গিয়েছিল কোথা থেকে এক দৈত্য এসে ঢুকে পড়েছে শহরে। বিপদের কথা ছড়াতে বেশি সময় লাগে না। ফলে যে যার মতো শহর খালি করে পালাল। বাকিরা সুযোগ-সুবিধা মতো লুকিয়ে পড়ল। পালাতে যেয়ে দু'একটা খালি বাড়ি আকমলের পায়ের নিচে পড়ে ধূলিসাৎ হল। পাথর আর পিতলের ঢালাই বাড়ির গর্ব তাদের এভাবেই মাটি হল। তবে কপাল ভাল বলতে হবে ওসব বাড়িঘর ছেড়ে অধিবাসীরা আগেই পালিয়েছিল। ফলে বে-ঘোরে কাউকে মরতে হল না।
একটা ছোট্ট টিলার নিচে ওরা আপাতত আশ্রয় নিল। পরী হিনা বলল, 'এক্ষুণি আমাদের এদেশ ছেড়ে পালাতে হবে। ওরা একবার টের পেলে পালানোটা অনেক শক্ত হবে আমাদের জন্য। কিন্তু এই বুড়োটাকে নিয়ে মুশকিলে পড়া গেল। ওকে এখন কোথায় রেখে যাই বলতো?'
আকমল দৃঢ় কন্ঠে বলল, 'ওকে মোটেও রেখে যাওয়া যাবে না। তাহলেই বেচারা বে-ঘোরে ওদের হাতে প্রাণ হারাবে।'
'তাহলে আর কী, তোমার বুড়ো কে তুমি আলতো করে ধরো আর চোখ বন্ধ করে মনে মনে বলো, ..... আমি ফিরে যেতে চাই নিজের দেশে।' বলল হিনা।
আকমল তাই করল। মনে মনে শুধু একবার যেই না বলেছে,'....আমি ফিরে যেতে ..........'অমনি ভস্ করে শুধু শব্দ হল। আর সঙ্গে সঙ্গেই ঘটে গেল বিষ্ময়কর আর এক ঘটনা। যা কেউ কখনো কল্পনাও করেনি। শুধু কল্পনা বললে ভুলই বলা হবে বরং বলতে হবে এমন ঘটনা কোথাও ঘটতে পারে তা মনে মনে ভাবেনি কেউ কখনো। সে ঘটনাটা কী, জান তোমরা? না, আজ আর বলছি না সে কথা।
শুধু জেনে রাখ, জীবন টা সময়ের খেলা আর সময়ের সাথে পাল্লা দিয়েই মানুষের যাপিত জীবন। সময়টা যেভাবে ধরা হয়েছে সেভাবেই আমরা অতিবাহিত করছি আমাদের জীবনকে। সময়ের সামান্য হেরফের মানুষের জীবনে অনেক পরিবর্তন নিয়ে আসে। প্রতিটি ক্ষণ সময় মানুষের জীবনের অমূল্য সম্পদ অথবা ভিষণ বিপদের কারণ। প্রাপ্ত সময়ের হিসাব মানুষ কে দিতে হবে। এর উপরেই নির্ভর করে রচিত হবে মানুষের পরবর্তী জীবনের বাকি রহস্যের চুল-চেরা হিসাবের পটভূমি।