আবু ওসমান ও পরী হিনা ( তৃতীয় পর্ব )

গ্রাম-বাংলা (নভেম্বর ২০১১)

হোসেন মোশাররফ
  • ৮২
  • 0
(আবহমান কাল ধরে গ্রাম বাংলায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে নানা দেশী-বিদেশী কল্প-কাহিনী, রূপকথা আর লোক-কাহিনী। এসব কাহিনীর না আছে কোন দেশভাগ না আছে কোন জাতিভেদ। অনায়াসে তা এতদিন লোকের মুখে মুখে ফিরেছে। কিন্তু ইদানীং লৰ্য করা যায় আধুনিকতার ছোঁয়ায় তা হারিয়ে যেতে বসেছে। আবার তা ফিরিয়ে আনতে আপনাদের সামনে আমার এই ক্ষুদ্র প্রয়াস, করজোড়ে নিবেদন করছি আপনাদের সামনে পরী হিনার তৃতীয় অধ্যায়....)



পৃথিবীতে মানুষ আসে যেমন শূন্য হাতে প্রস্থানও তার তেমনি শূন্য হাতেই, এটা সবার
বেলায় সত্য। যার জীবন আছে তাকে মৃত্যুবরণ করতে হবে এটাও তেমনি দিনের মতোই সত্য। মধ্যখানে জীবনটাই শুধু মিথ্যা, দু'দিনের এই খেলাঘরে খেলতে এসে মানুষ ভুলেই যায় খেলার মাঝে তার পৃথিবীর জীবন ষোলআনাই ফাঁকি।


খেলছে মানুষ,খেলতে থাক; নিত্য খেলার নেই তো শেষ।
দিন ফুরালে ভাঙবে মেলা, থাকবে না তার একটু রেশ।
বন্ধ হবে বেচা-কেনা, শূন্য পড়ে থাকবে হাট।
শূন্য হাতে ফিরবে সবাই এ জীবনের চুকিয়ে পাট।

নীল নদ ঘেঁষে সুরম্য প্রাসাদ গড়ে তুলতে আবুওসমানের বেশি সময় লাগেনি। অল্প সময়ের মধ্যে পরী হিনাই তৈরি করে দিয়েছে প্রাসাদটি। একদিকে সম্পদ অপরদিকে পরী হিনার জাদুকরী ক্ষমতা; আবুওসমানের জীবনে অল্পসময়ে এনে দিয়েছে প্রাচুর্য। একসময় আবুওসমানের কিছুই ছিল না। এখন তার সবই আছে, নেই শুধু একটু শান্তি। অর্থ-সম্পদের প্রাচুর্য মানুষকে দিতে পারে মিথ্যা সুখ আর কেড়ে নেয় মনের শান্তি। আবুওসমান তার মনের শান্তি ফিরিয়ে আনতে দু'হাতে তার সম্পদ বিলিয়ে দিতে লাগল গরিব আর দরিদ্র মানুষের মধ্যে। সপ্তায় একদিন সে তার সম্পদ দু'হাতে বিলায় দরিদ্র মানুষের মধ্যে। সেদিন দূর দূরান্ত থেকে দরিদ্র মানুষ এসে ভিড় জমায় তার বাড়ির সামনে। আর এভাবেই চলতে থাকে পরী হিনার কাছ থেকে পাওয়া তার সম্পদের বিলি-বণ্টন। এছাড়া বেড়েছে তার ব্যবসা বাণিজ্য। আবুওসমান এখন সবার কাছে প্রিয় নাম। সবাই তাকে জানে একজন দানবীর হিসাবে।
এদিকে সেদিন রাতে ব্যর্থ হয়ে ফিরে যাওয়ার পর থেকেই ডাকাত সর্দারের ঘুম হারাম হয়েছে। অনেক চেষ্টা করেও সে আবুওসমানের সন্ধান আর পায়নি। কিন্তু সম্পদের মোহ তো সহজে ছাড়া যায় না। মনে মনে তারা গোয়েন্দা নামিয়ে দিল পুরো শহরে। ডাকাতি বাদ দিয়ে তারা এখন পুরো শহর জুড়ে ছড়িয়ে পড়ল। কেউ ভিক্ষুক, কেউ ফেরিওয়ালা কিংবা সামান্য পণ্য বিক্রেতা হকার হয়ে ঘুরতে লাগল মানুষের দ্বারে দ্বারে। সর্দার নিজে সাজল একজন জবরদস্ত পির-ফকির। এরা সবাই সহজেই মানুষের ঘরের আঙিনায় ঢুকে ঢুকে খুঁজতে শুরু করল আবুওসমান কে। কিন্তু কোথাও তার সন্ধান পেল না ওরা। সর্দার নিজেও গরুয়া রঙের একটা আলখাল্লা পরে হাতে এক বিশাল তজবি নিয়ে ঘুরতে লাগল পথে পথে। কিন্তু সব প্রচেষ্টাই তাদের ব্যর্থ হল। দিন শেষে রাত নামলে শহর থেকে দূরে এক পাহাড়ের আড়ালে গোপন জায়গায় তারা মিলিত হয় সলা-পরামর্শের জন্য। কিন্তু তাদের সেই সলা-পরামর্শ কোন কাজেই লাগল না। আবুওসমান কে কোথাও খুঁজে পাওয়া গেল না গত কয়েকদিনে।
কিন্তু হাল ছেড়ে দেয়ার পাত্র নয় সর্দার। দিকে দিকে নূতন নূতন জায়গা খুঁজে সে তার অভিযান অব্যাহত রাখল। শেষে একদিন তার ভাগ্য খুলল। তজবি গুনতে গুনতে সে যখন রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল তখন সে লৰ্য করল রাস্তার পাশে কিছু দরিদ্য লোকের জটলা। সে তাদের জটলা করার কারণ জিজ্ঞাসা করল। গরিব লোকগুলো তাকে বলল, 'এখানে আজ আমাদের সাহায্য দেয়া হবে তাই আমরা এখানে এসেছি।' সর্দার তাদের সাহায্যদাতার নাম জিজ্ঞেস করতেই তার সমস্বরে বলল, 'আবুওসমান।' সঙ্গে সঙ্গে যেন বিদ্যুৎ খেলে গেল সর্দারের মাথায়। সে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, 'কোন আবুওসমান?'
তখন এক বৃদ্ধ লোক এগিয়ে এসে বলল, 'তুমি চেননা বুঝি তাকে? তাকে তো এখানে সবাই চেনে। আগে সে আমাদের মতোই দরিদ্র দীন-হীন ছিল। কপাল গুণে সে আজ অনেক বড়লোক হয়েছে। কিন্তু খোদার মেহেরবানি সে আমাদের মোটেও ভুলে যায়নি। তার সাহায্য নিয়েই আমরা বেঁচে আছি।'
সর্দারের আর বুঝতে বাকি রইল না এই সেই আবুওসমান যাকে তারা এতদিন ধরে হন্য হয়ে খুঁজে এসেছে। দাঁতে দাঁতে চেপে সর্দার আর একবার উচ্চারণ করল, 'আবুওসমান তোকে এবার পেয়েছি, আর রৰা নেই তোর?'
বুড়ো লোকটা তার কথা বুঝতে না পেরে বলল, 'হ্যাঁ, তুমি ঠিকই ধরেছ। তার মতো লোক হয়না। এখানে একটু দাঁড়িয়ে থাকলেই দেখতে পাবে সে কেমন দু'হাতে তার সম্পদ গরিব দুঃখীদের মধ্যে বিলায়। খোদা তার সম্পদ যেন আরও বাড়িয়ে দেয়।' তারপর বুড়ো লোকটা এভাবেই তার নামে আরও দোয়া করতে করতে সেখান থেকে প্রস্থান করল।
সর্দারের আর সহ্য হল না। তারপরও সে নিজেকে সামলে নিয়ে সেখানে আরও কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল। এক সময় সে দেখতে পেল আবুওসমান সত্যিই বেরিয়ে এসে সবার হাতে হাতে তুলে দিতে লাগল তার দানকৃত দ্রব্য-সামগ্রী। সব দেখে শুনে সর্দার আবার একবার উচ্চারণ করল, 'আবুওসমান তুই ধরা পড়ে গেছিস , আজ রাতই তোর শেষ রাত।'
এদিকে কী এক কাজে পরী হিনা এসে দাঁড়িয়েছিল জানালায়। জানালার স্বচ্ছ পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে রাস্তার দিকে চোখ রাখতেই নজরে এলো তার ডাকাত সর্দার কে। প্রথমে চিনতে পারল না সে ডাকাত সর্দার কে। কিন্তু চেনা চেনা চেহারার এক অপরিচিত লোককে ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তার মনে সন্দেহ জেগে উঠল। উপরন্তু লোকটা সাহায্য না নিয়ে চোরের মতো এদিক সেদিক তাকাচ্ছে। তার চেহারার আড়ালে কোথায় যেন এক পরিচিত মুখ আবিষ্কার করে ফেলল সে। কিন্তু কোথায় দেখেছে তাকে মনে করতে পারল না প্রথমে। একটু পরেই মনে পড়ে গেল তার; এ সেই ডাকাত সর্দার। ছদ্মবেশ ধরে এখানে এসেছে সম্ভবত আবুওসমানের বাড়ি চিনতে। মনে মনে বলল এবার পরী হিনা, 'সর্দারজি তুমি এতদিন ঘুঘু দেখেছ, ফাঁদ দেখনি; এবার দেখবে.....'
সবাই সেখান থেকে চলে যাওয়ার পর সর্দার ভালভাবে বার বার দেখে নিল আবু ওসমানের বাড়িটা। ভুল হয়ে যেতে পারে ভেবে আবার ফিরে এলো সেখানটায়। রাতের অন্ধকারেও সে অনায়াসে চিনে নিতে পারবে বাড়িটা। হাজার হোক সর্দারের চোখ, আজ পর্যন্ত কেউ ফাঁকি দিতে পারেনি তার চোখ কে। মনে মনে আর একবার দম্ভোক্তি করে বলল সে, 'আবুওসমান আজ তোকে আমার হাত থেকে কে বাঁচাবে? সব লীলা খেলা শেষ হবে আজ তোর।' তারপর সেখান থেকে দ্রুত প্রস্থান করল সে।
আবু ওসমানের ঘরে এক নূতন ক্রীতদাস কিনে আনা হয়েছিল মাত্র কিছুদিন আগে। তার নাম ওমর আলি। কালো আফ্রিকান সে। বেশ প্রভুভক্ত আর খোশ-মেজাজি ছেলে। অল্পদিনেই সবার মন জয় করে ফেলল। পরী হিনারও একান্তই অনুগত হয়ে পড়ল সে। পরী হিনাও সময় মতো তাকে নানা কাজে লাগায়। আজ রাত নামলে পরী হিনা তাকে ডেকে বলল, 'বাবা ওমর আলি , আজ রাতের মতো তুমি আমার একটা কথা রাখবে?'
খোজা দাস ওমর আলি এর আগেও বেশ কয়েক বার হাত বদল হয়ে আবু ওসমানের হাতে পড়েছে। তার আগের প্রভুদের সবাই ছিল নিষ্ঠুর প্রকৃতির, তাকে তারা পশুর মতো খাটিয়ে নিতেই বেশি পছন্দ করত। কিন্তু আবুওসমানের হাতে পড়ে প্রথম সে নিজেকে মানুষ হিসাবে আবিষ্কার করেছে। তার সাথে উপরি পাওনা হিসাবে পেয়েছে সে পরী হিনাকে। তার মধুর ব্যবহার তাকে শুধু চমৎকৃতই করেনি জাগিয়ে তুলেছে তার মনের সুকুমার বৃত্তিগুলোকেও। ফলে সে বাধ্যগত হয়েছে পরী হিনার। আজ তার প্রস্তাব শুনে বিনা দ্বিধায় বলল ওমর আলি, 'আলবৎ পারব। শুধু আজ রাত কেন, যদি চাও; বাকি জীবনটাই তোমার গোলামি করতে রাজি আছি।'
'না, তার আর দরকার হবে না। তবে আজ রাতে তোমাকে হতে হবে আবুওসমান। আজ রাতে তুমি আর কারো দাস নও; তুমিই হবে ওমর আলির প্রভু আবুওসমান। আপত্তি আছে?' বলল পরী হিনা।
দাঁতে জীব কেটে ওমর আলি বলল, 'গোস্তাকি মাপ করলে একটা কথা বলি।'
'তুমি নির্ভয়ে তোমার সব কথা বলতে পার, বাবা ওমর আলি।' বলল হিনা।
'একজন দাস হয়ে মনিব সাজা বড়ই অন্যায় কাজ, মালকিন। মনিব বিষয়টা জেনে গেলে নিশ্চয় আমার মাথাটাই কাটা যাবে।' বড় বিনয়ের সাথে বলল ওমর আলি।
'তা গেলই কাটা, একদিন না একদিন তো মরতেই হবে। তা সেটা যদি মাথা কেটেই হয় তাতে কী আর এমন অসুবিধে তোমার, বাবা ওমর আলি?' মৃদু হেসে বলল পরী হিনা।
'তা ঠিকই বলেছ, মালকিন। এমন মনিবের হাতে মাথা কাটা যাওয়াও গোলামের জন্য সৌভাগ্যের বিষয়।' ভক্তিতে গদ গদ হয়ে বলল এবার ওমর আলি।
সম্মতি পেয়ে পরী হিনা আহ্লাদে আটখানা হয়ে আদুরে গলায় বলল,' তাহলে আজ রাতে কেউ যদি তোমাকে জিজ্ঞেস করে তোমার নাম কি, তাহলে কী উত্তর দেবে বাবা ওমর আলি?'
একান্ত বাধ্যগত ক্রীতদাসের মতোই ওমর আলি জবাব দিল, 'আবু ওসমান।'
'যদি সে ডাকাত হয়? আর তার খঞ্জর তোমার গর্দানের উপর রেখে বলে তোমার নাম কী?' ভয়ার্ত কণ্ঠে বলল পরী হিনা।
ওমর আলি আগের মতোই স্বাভাবিক গলায় আবার বলল, 'আবু ও-স-মা-ন ।'
'বাহ্!' খুশিতে আটখানা হয়ে হাতে মৃদু তালি দিতে দিতে পরী হিনা উৎসাহ দিল ওমর আলিকে। তারপর ফিস্ ফিস্ করে ঠোঁটে আঙুল চাপা দিয়ে বলল সে, 'তবে সাবধান, এ কথা যেন আমাদের মনিব কিছুতেই জানতে না পারে।'

সেদিন একটু রাত নামলে সবাই যখন ঘুমিয়ে গেল। তখন পরী হিনা উঠে পড়ল ঘুম থেকে। আজ রাতে তার চোখে আর ঘুম নেই। এক রাতের মধ্যেই তৈরি করে ফেলল আর একটা নকল প্রাসাদ। দেখতে অবিকল আবুওসমানের জন্যে তৈরি করে দেয়া আগের প্রাসাদটির মতোই। নকল প্রাসাদটিকে বসিয়েও দিল আগের প্রাসাদের সামনে। তারপর ওমর আলি কে ঘুম থেকে ডেকে তুলে বলল, 'বল, এখন তোমার নাম কি, বাবা ওমর আলি?'
ওমর আলি নিশ্চিন্তে উত্তর দিল, 'আবুওসমান।'
আর সঙ্গে সঙ্গে তার চেহারাটাও অবিকল আবুওসমানের মতোই হয়ে গেল। কিন্তু ওমর আলি সেটা বুঝতে পারল না। তার কাছে মনে হল সে আগের মতোই আছে। পরী হিনা এবার ফিস্ ফিস্ করে বলল, 'ঠিক আছে।' তারপর সে এক টুকরো কাপড় দিয়ে ওমর আলির চোখ বেঁধে দিয়ে তাকে একটা লাঠির প্রান্ত ধরতে বলল। ওমর আলি সেটা ধরতেই তাকে এক হেঁচকা টানে নিয়ে এল তার তৈরি করা নূতন প্রাসাদে। তার চোখ খুলে দিয়ে আবার বলল পরী হিনা, 'এবার বলতো তুমি কে?' ওমর আলি আগের মতোই উত্তর দিল, 'আবু ওসমান।' পরী হিনা এবার মৃদু হাসতে হাসতে বলল, 'ঠিক আছে, ভুল হয়না যেন।'
রাত যখন গভীর হল তখন পুরো ডাকাত দলটি নিয়ে সর্দার সেখানে এসে হাজির হল। নকল প্রাসাদটিকেই সে মনে করল আবু ওসমানের প্রাসাদ। প্রাচীর টপকে নিঃশব্দে ভিতরে ঢুকে পড়ল পুরো ডাকাত দলটি। যে করেই হোক, আজ আবুওসমানের মাথা না নিয়ে তারা আর ফিরবে না। এদিকে পরী হিনা ডাকাতদল ঢুকতে দেখেই চোখের ধাঁধাঁ তৈরি করে ফেলল। ঘরের এক এক কক্ষকে দেখে মনে হতে লাগল সারি সারি অনেকগুলো কক্ষ। আর প্রতিটি কৰের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে এক একজন আবুওসমান রূপী ওমর আলি। সর্দার উত্তেজনার বশে প্রথম দরজায় দণ্ডায়মান আবুওসমান কে দেখে কতল করতে উদ্যত হল। কিন্তু পাশে থেকে তার এক চেলা তাকে থামিয়ে দিয়ে উত্তেজনা প্রশমিত করার জন্য চোখের ইঙ্গিত করল। তারপর ধরা গলায় চাপা স্বরে বলল, 'ও-স্তাদ-দ এ যে জাদুকরী কারবার।'
অন্ধকারে এতক্ষণ খেয়াল না করলেও মশালের ৰীণ আলোয় এবার লৰ্য করল সর্দার ভুল পথে পা বাড়িয়েছে সে। সারি সারি কৰের সবগুলো দরজায় দণ্ডায়মান এক একজন আবুওসমান। বেকায়দায় পড়ে গেল ডাকাত সর্দার, কিন্তু এত সহজে সেও ছেড়ে দেয়ার পাত্র নয়। উদ্যত তলোয়ার হাতে গুরু-গম্ভীর স্বরে প্রথম জন কে সে বলল, ' বাঁচতে চাস তো, বল তোর নাম কি?'
নির্ভয়ে ওমর আলি জবাব দিল, ' আবুওসমান।'
আর সঙ্গে সঙ্গে সেই সাথে সব গুলো দরজা থেকেই একই শব্দের প্রতিধ্বনি ভেসে এল। ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল সর্দার। কিন্তু হাল ছেড়ে দিতে সে মোটেও রাজি নয়। এতগুলো আবুওসমান কে খতম করতে তার একটা হুকুমই যথেষ্ট। রাগে গজ গজ করতে করতে বলল সে, 'ঠিক আছে, তোরা সবাই আবুওসমান। আজ রাতে তোদের সবার গর্দান নেব।'
কিন্তু সর্দারের হুকুম দেয়ার আগেই একসাথে সবগুলো আবুওসমান কালো আফ্রিকান ক্রীতদাস ওমর আলি হয়ে গেল। মশালের আলোয় এবার বিস্ময়ে হতবাক হয়ে চেয়ে রইল সর্দার। তার এই বিপদের মূহুর্তে পাশ থেকে তার এক চেলা তাকে সৎ উপদেশ দিয়ে বলল, 'ওস্তাদ এখনই সটকে পড়া ভাল। আর এক মূহুর্ত দেরি করলেই বিপদ। জাদুর খেল্ শুরু হয়েছে এখানে।'
হিতাহিত জ্ঞান শূন্য হয়ে সর্দার শুধু একবার বলল , 'পালা--'
সঙ্গে সঙ্গে যে যার মতো ছুটতে শুরু করল। পরী হিনা এতক্ষণ অন্ধকারে আড়াল হয়ে ছিল; এবার বের হয়ে এসে বলল, 'সর্দারজি বেশতো খেলা জমেছিল; রাত শেষ হতে এখনো অনেক বাকি। এত তাড়াতাড়ি পালালে হয়?'
হিনার গলার শব্দ পেয়ে ঘুরে দাঁড়াল সর্দার। তারপর হুঙ্কার ছেড়ে দিয়ে বলল, ' মায়াবী হিনা তোর জাদু দিয়ে তুই আমার হাত থেকে আবুওসমান কে বাঁচাতে পারবি না। আজ পর্যন্ত কেউ আমার হাত থেকে বাঁচতে পারেনি, তুইও পারবি না; তোর আবুওসমানও না।'
হাসতে হাসতে পরী হিনা এবার বলল, 'আমি তো ডালে ডালে থাকিনা, আমি থাকি পাতায় পাতায়। এলেই আবার দেখা হবে।'


সর্দারের আর বুঝতে বাকি রইলো না হিনার সাথে ঐন্দ্রজালিক শক্তি আছে; যা তাকে বার বার রৰা করছে। সকাল হওয়ার আগেই তারা তাদের গোপন আস্তানায় ফিরে এল আবার। তারপর দাঁতে দাঁত চেপে সর্দার আবার উচ্চারণ করল, 'আবুওসমান পৃথিবীর কোন যাদুই তোকে আমার হাত থেকে বাঁচাতে পারবে না। এবার হবে তোর সাথে আমার আসল খেলা।'
হাল ছেড়ে দেয়ার পাত্র ডাকাত সর্দার নয় তবে কিছুদিনের জন্য তাকে রণে ভঙ্গ দিতেই হল। নূতন কৌশল খুঁজতে তাদের আবার রওনা হতেই হল ফেলে আসা সেই পাহাড়ের গুহায়। গুহামুখে দাঁড়িয়ে ডাকাত সর্দার আর একবার হুঙ্কার ছেড়ে বলল, 'আবুওসমান, আজ পর্যন্ত আমার চোখকে ফাঁকি দিয়ে কেউ বাঁচতে পারেনি....তুই মনে করিস না বেঁচে গেছিস, মরতে তোকে হবেই।'

ডাকাতরা আবার কী ফন্দি আঁটল বোঝা গেল না। তবে কিছু দিনের জন্য ডাকাতদের সব রকম উৎপাত বন্ধ হল। এরই মধ্যে আবুওসমানের ব্যবসা দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ল। কপালে থাকলে বড়লোক হতে সময় লাগে না, আবুওসমানের কপাল খুলল। তার জাহাজ পানিতে ভাসল। দেশ ছাড়িয়ে বিদেশে যেতে লাগল আবুওসমানের জাহাজ। কিন্তু কেউ জানল না আবুওসমানের হঠাৎ বড়লোক হওয়ার পিছনের গোপন রহস্য। এমনকি পরী হিনা যে ডাকাতদের আস্তানা থেকে ফিরে এসেছে তাও কেউ জানল না কোনদিন। তার স্বর্ণ প্রাপ্তির কথা প্রতিবেশী জাসিমই শুধু জেনেছিল; সে আগেই পৃথিবী ছেড়ে বিদায় নিয়েছে। তার স্ত্রীও স্বচৰে ডাকাতদের হাতে স্বামীর হত্যা দৃশ্য দেখার পর থেকে বদ্ধ উন্মাদ হয়ে গেছে। ডাকাতরা ছাড়া কেউই তার ধন-সম্পদ প্রাপ্তির গোপন রহস্য সম্বন্ধে অবগত নয়। ফলে অনেকটাই নিশ্চিন্ত জীবন-যাপন করতে লাগল আবুওসমান।

সুখের দিন যেন ফিরে এসেছে আবার আবুওসমানের জীবনে। বাড়ির ছাদে দাঁড়িয়ে আবুওসমান দেখতে থাকে তার জাহাজগুলো নোঙর ফেলছে কিংবা বন্দর ছেড়ে চলে যাচ্ছে। অতীত জীবনের দুঃসহ কষ্টগুলো হারিয়ে গেছে তার জীবন থেকে। ডাকাতদের কথা প্রায় ভুলেই গেছে আবুওসমান। শান্ত-নিরিবিলি বয়ে চলা নীল নদের মতোই আবুওসমানের জীবনেও ফিরে এসেছে যেন শান্তি ও নিরাপত্তা।
অদৃশ্যের এক ভাগ্য নিয়ন্তার নিয়ন্ত্রণে আটকে আছে মানুষের জীবন। কেউ জানে না আগামীকাল তার ভাগ্যে কী লেখা আছে। কিংবা গতকালই সে যা ফেলে এসেছে তার পরিণতিই কী হবে। এ এক আশ্চর্য খেলা পৃথিবী জুড়ে নিরন্তর চলছে। যার কোন শেষ নেই কিংবা কোন সঠিক পরিসমাপ্তিও নেই। অথচ মানুষ কে তা খেলতে হবে। যে খেলতে চায় না তাকে নিয়ে খেলছে অন্যেরা। আর সবাইকে নিয়ে খেলছে সেই মহান সৃষ্টিকর্তা, যার উপরে কারো ক্ষমতাই চলে না। এই খেলায় কে হারবে কে জিতবে কেউ জানেনা তবে পৃথিবী যতদিন আছে ততদিন চলতেই থাকবে অদৃশ্যের এই খেলা। আর এটাই পৃথিবীর সবচে আশ্চর্যজনক রহস্য |
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
হোসেন মোশাররফ গল্প-কবিতায় যে কজন রূপকথায় ভক্ত পাঠক আছেন, তাদের মধ্যে আপনিও একজন ....আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ, মামুন ম . আজিজ ভাই .....মন্তব্যের জন্যও আলাদা করে ধন্যবাদ জানাচ্ছি ........
মামুন ম. আজিজ রূপকথা পড়েই পড়া শিখেছি। সেই রূপকথা ভালো না লেগে পারে।
হোসেন মোশাররফ আপনার সাথে আমি একমত > রোদেলা শিশির (লাইজু মনি ),চলতে চলতে থেমে না যাওয়াটাই কর্ম আর পথ না হারানোটাই ধর্ম .......মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ ...
রোদেলা শিশির (লাইজু মনি ) এই খেলায় কে হারবে কে জিতবে কেউ জানে না ..........! প্রতিনিয়ত আমরা খেলেই যাচ্ছি .... ! পথ আছে , কিন্তু পথের শেষ নেই ! অনন্ত পথ চলা-ই মানবের ধর্ম , আর আর চলতে চলতে থেমে না যাওয়া-ই কর্ম ! ..... ঠিক বলিনি .স্যার ..?
হোসেন মোশাররফ মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ > আবু ওয়াফা মহম্মদ মুফতি | আপনার পরামর্শ মাথায় রাখলাম, তবে রূপকথার কোন স্থান কাল পাত্র নেই....এখানে গল্পের রস আহরণ করাটাই পাঠকের মূল লক্ষ থাকে .....
আবু ওয়াফা মোঃ মুফতি বেশ ভাল আলগল বরাবরের মত | আপনার লেখার হাত চমত্কার! তবে রুপকথাগুলো যদি আমাদের সমাজ সংস্কৃতির প্রেক্ষাপটে সাজান তবে নতুন প্রজন্ম পড়তে পড়তে মজায় মজায় শিখতে পারবে | যা তাদের নিজেদের জানতে বুঝতে করনীয় নির্ধারনে কাজে আসবে |
হোসেন মোশাররফ মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ > তানি হক, আর হ্যা পিছনের পর্বগুলো পড়ার আমন্ত্রণ থাকল.....সতত ভাল থাকুন .......
তানি হক মোশাররফ ভাই ..গল্পটি পড়তে পড়তে একেবারে সেই মায়াবী জগতে ঢুকে গিয়েছিলাম!খুব ভালো লাগলো এই ভিন্ন টাইপের গল্প . সময় করে পেছনের পর্ব গুলো পড়ব..ভালো থাকবেন
হোসেন মোশাররফ মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ > সামসুন্নাহার (সুমি ) ...সতত ভাল থাকুন......
সুমননাহার (সুমি ) চমত্কার লিখা সুভকামনা roilo

২৫ জানুয়ারী - ২০১১ গল্প/কবিতা: ৪০ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

বিজ্ঞপ্তি

“মে ২০২৪” সংখ্যার জন্য গল্প/কবিতা প্রদানের সময় শেষ। আপনাদের পাঠানো গল্প/কবিতা গুলো রিভিউ হচ্ছে। ১ মে, ২০২৪ থেকে গল্প/কবিতা গুলো ভোটের জন্য উন্মুক্ত করা হবে এবং আগামি সংখ্যার বিষয় জানিয়ে দেয়া হবে।

প্রতিযোগিতার নিয়মাবলী