প্রাচীন কালে এক সময় মিশর ছিল সমৃদ্ধিশালী দেশ। কিন্তু হলে কী হবে প্রদীপের নিচে থাকে অন্ধকার। আর যুগে যুগে দেশে দেশে তা সত্যি হয়েছে সাধারণ মানুষের জীবনে। মিশরের রাজধানী কায়রো শহরে তখন বাস করত এক গরিব মুচি। তার নাম ছিল ওসমান। নিরীহ গোবেচারা এই লোকটির না ছিল কোন উচ্চাঙ্ক্ষা না উচ্চাশা। অল্পতে সে ছিল তুষ্ট। সারাদিন ধরে রাসত্দার ধারে একটু খানি চামড়ার আসনে বসে সে পরের জুতো সেলাই করত। এতে তার সামান্য যা আয় হতো তাতেই তার দিনগুলো কোনরকমে কেটে যেত। বাড়িতে আপন বলতে কদাকার এক স্ত্রীই শুধু ছিল তার। সম্ভবত পৃথিবীতে ওসমানের জন্ম না হলে বাবা মা পরিজন হারা এই মেয়েটিকে কেউ বিয়ে করত কিনা সন্দেহ। দুনিয়াতে খোদার লীলা খেলা বোঝা দায়। গরিব আর মুচি হওয়ায় তার যারা নিকট আত্মীয় ছিল তারাও তার পরিচয় দিতে লজ্জা পেত। এতে অবশ্য ওসমানের মনে কোন দুঃখ ছিল না। সে মনে মনে ভাবত দু'হাতে পরিশ্রম করার ফলে সে যা দু'পয়সা উপার্জন করে তাই তার সংসারে স্বর্গসুখ এনে দেয়। সুতরাং সবাই তাকে ত্যাগ করে চলে গেলেও খোদা তাকে স্বর্গেই রেখেছে। কেননা এই পৃথিবীতে অল্পতে যারা তুষ্ট থাকতে পারে তাদের কাছেই স্বর্গ এসে ধরা দেয়।
অল্পতে তুষ্ট যারা, স্বর্গসুখ পায় তারা।
বেশি সম্পদে বেশি লোভ, বাড়ে যত দুর্ভোগ।
এদিকে ওসমানের ছিল না কোন সনত্দানাদি। তারপরও নিত্য অভাব তাদের লেগেই থাকত। এক ঈদের রাতে ওসমানের ঘরে ছিল না একটা শুকনো রম্নটি কিংবা অন্য কোন খাবার। ভীষণ চিনত্দায় পড়ে গেল সে। কিন্তু স্ত্রী তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলল, 'তুমি বেশি বেশি চিনত্দা করো না। এই ঈদের রাত খোদারই দেয়া রাত সুতরাং চিনত্দা যা তাতো তারই থাকা উচিত। আমরা ভেবে লাভ কী?'
কিন্তু ওসমানের দুশ্চিনত্দা তাতে দুর হল না। সে বলল, 'কাল ঈদের দিন। সবাই তো নূতন জুতো পায়ে দিয়ে বের হবে রাসত্দায়। পুরনো ছেঁড়া জুতো কেউ পরবে না ফলে আমার কাজও বন্ধ। তাহলে আমাদের উপায় কী হবে? ঈদের দিন না খেয়ে উপোস দেবে ?'
তার স্ত্রী দেখতে যেমনই হোক, সে ছিল দারম্নণ বুদ্ধিমতী মেয়ে। ওসমানের এই বিপদের দিনে সে তাকে মোটেও হতাশ করল না। বরং বলল, 'খোদা যদি এভাবেই আমাদের ঈদের দিনটি লিখে রাখে কপালে তাহলে এই ঈদটি হবে আমাদের সবচে' আনন্দের দিন।'
স্ত্রীর কথা শুনে ওসমান আর কোন জবাব খুঁজে পেল না। সেই রাতে তারা অভুক্ত অবস্থায় ঘুমিয়ে পড়ল দু'জনা। রাত যখন গভীর হল তখন ক্ষুধার তাড়নায় ওসমানের ঘুম ভেঙে গেল। পাশে তার অভুক্ত স্ত্রী ঘুমের ভান করে পড়ে ছিল। ওসমান বুঝল যে করেই হোক, তাকে একটা ব্যবস্থা করতেই হবে। কিন্তু এই রাতে সে কোথায় যাবে আর কে বা তাকে সাহায্য করবে। কিন্তু তাহলেও ঘরে বসে উপোস দিয়ে তো আর মরা যায় না। মনে মনে একটা সিদ্ধানত্দ নিয়ে ফেলল সে। আর সামান্য বুদ্ধির লোকেরা সিদ্ধানত্দ নেয়ার পর মোটেও দেরি করে না। ওসমানও তাই করল। সে চুপি চুপি স্ত্রীকে একাকী ঘরে রেখে চোরের মত বেরিয়ে এল বাইরে।
প্রায় মধ্যরাত পর্যনত্দ আনন্দ উৎসব শেষে শহর-বাসীরা তখন ঘুমে নিমগ্ন। ওসমান রাসত্দা দিয়ে হাঁটছিল আর ভাবছিল তার দুর্ভাগ্যের কথা। কেউ যদি ভুলে তাদের খাবারের উচ্ছিষ্ট রাসত্দায় ফেলে রেখে যায় তাহলেই আজ তার কপাল খুলে যায়। কিন্তু............
যার হয় কপাল ফাটা
মেটেনা তার কোন আশা।
ওসমান শেষ পর্যনত্দ হতাশ হয়ে একটা গাছের নিচে যেয়ে বসে পড়ল। কাছেই ছিল একটা ছোটখাট পাহাড়। তার নিচে বিৰিপ্ত ভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েছিল অনেক নুড়ি পাথর। অন্ধকারে সেখান থেকে কয়েকটা নুড়ি পাথর কুড়িয়ে পেয়ে হঠাৎ যেন ওসমান ঈদের চাঁদ হাতে পেল। মনে মনে ভাবল সে এখান থেকে কয়েকটা মসৃণ নুড়ি পাথর খুঁজে নিতে পারলেই তার প্রয়োজন মিটে যায়। তারপর সে তার ছেঁড়া তালি দেয়া জামার পকেটে ছোট ছোট নুড়ি পাথর গুলো পুরে ফেলল। একবার চারপাশে তাকিয়ে দেখল কেউ তাকে দেখে ফেলল কিনা। বোকা ওসমান জানেনা তার নুড়ি কুড়ানো কেউ দেখে ফেললেও কারো কিছু যায় আসে না।
রাত যখন প্রায় শেষ শেষ তখন ওসমান তার বাড়ি ফিরে এল। সে ভেবেছিল বাড়ি ফিরে সম্ভবত তাকে স্ত্রীর গোমড়া মুখ দেখতে হবে। কিন্তু বরাবরের মতো বাড়ি ফিরে ওসমান তার স্ত্রীর মুখে হাসি দেখতে পেল। সে ভেবে পেল না রাজ্যের ক্ষুধা পেটে নিয়েও স্ত্রীর মুখের এই হাসির রহস্য কী। ওসমানের মনে পড়ল বিয়ের সময় সে প্রতিশ্রম্নতি দিয়েছিল স্ত্রীকে, তার যথাযথ ভরণ-পোষণের দায়িত্ব সে নেবে। কিন্তু তাই বলে খাওয়ার অযোগ্য পাথর দিয়ে তার ব্যবস্থা করতে হবে এমনটা সে স্বপ্নেও কোনদিন কল্পনা করেনি।
ওসমান ভয়ে ভয়ে বলল, 'আজ ঈদের দিন। কিন্তু আমি তোমার জন্য ভাল কোন খাবারের ব্যবস্থা করতে পারিনি।' তারপর তার পকেট থেকে পাথরের নুড়ি গুলো বের করে বলল, 'খোদা আমাদের জন্য ভাল কোন ব্যবস্থা না করা পর্যনত্দ আপাতত এই নুড়িগুলো দিয়ে আমরা ক্ষুধা নিবৃত্তি করতে পারি।'
ওসমানের হাত থেকে নুড়ি নিয়ে তার স্ত্রী তাতে চুম্বন করল ও পরে কপালে স্পর্শ করে বলল, 'তোমার হাত থেকে পাওয়া নুড়িগুলোই আমাদের আজকের ঈদের দিনের বেহেসত্দের মেওয়া। ' তারপর সে নুড়ি গুলো পরম আদরের সাথে বুকে চেপে ধরল ও পরে আবার তাতে চুম্বন করে বলল, 'কিন্তু খোদা তার আগেই আমাদের জন্য ব্যবস্থা করে দিয়েছেন; সব তারই ইচ্ছা।'
কথা শেষ করেই আর দেরি করল না ওসমানের স্ত্রী। সে ওসমান কে বিছানায় বসিয়ে ভিতর থেকে নিয়ে এল বড় এক পাত্র। তারপর তাতে ঢেকে রাখা ডালা সরিয়ে নিতেই ওসমানের চোখ মাথায় উঠল। সুগন্ধি ফল মুল আর মিষ্টি খাদ্য দ্রব্যে পূর্ণ ছিল পাত্রটি। আর এমন মিষ্ট খাদ্য দ্রব্য আর ফল মুল জীবনে চোখে দেখেনি ওসমান; খাওয়া তো দুরের কথা। কিন্তু ওসমান তো না জেনে না শুনে কারও খাদ্যে লোভ করেনি কোনদিন। তাই সেগুলোর কোনটাতেই স্পর্শ না করে স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করল, 'এসব তুমি কোথায় পেলে?'
স্ত্রী তাকে বলল, 'তুমি আজ রাতে বাসা থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর পরই আমাদের বাড়িতে এক পরী এসেছিল। সেই দিয়ে গেছে এসব।'
ওসমান চোখ মাথায় তুলে বলল, 'এমন কথা তো জীবনেও শুনিনি কোথাও। নিশ্চয় অভাবে তোমার মাথা খারাপ হয়েছে আর না হয়তো আমি ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখছি।'
স্ত্রী তখন তাকে বলল, 'তোমার সন্দেহের কোনটাই সত্যি না। তবে আমি পরী কে বলেছিলাম এসব নিয়ে যেতে কিন্তু সে শোনেনি।'
'কী বলল সে?' জানতে চাইল ওসমান।
'বলল সে তোমার যদি কোন অসুবিধা হয় তাহলে তিনবার হাতে তালি দিলেই আমি এসে তোমার গৃহস্বামীকে সব বুঝিয়ে বলব।' বলল তার স্ত্রী।
ওসমান তখন বলল, 'তাহলে ডেকে নিয়ে এস তাকে, তার কাছে না শোনা পর্যনত্দ আমি এর একটা অংশও গ্রহণ করতে পারব না।'
ওসমানের কথা শেষ হওয়া মাত্রই তার স্ত্রী তিন বার হাতে তালি বাজাল আর ওমনি পরী এসে হাজির হল সেখানে। ওসমান তাকে দেখে অবাক হয়ে গেল। বিষ্ময়ে অভিভুত হয়ে তার দিকে কিছুৰণ চেয়ে থেকে বলল, 'তুমি কে?'
উত্তরে সে বলল, 'আমি পরী হিনা। ডালায় ঐ খাদ্যগুলো আমিই তোমাদের জন্য ঈদের দিনের উপহার হিসাবে নিয়ে এসেছি। তুমি নিঃসন্দেহে তা-থেকে খেতে পার।'
ওসমান বলল, 'তা হয় না, তোমাকে আমি চিনিনা। সাত জন্মে কেউ কোথাও দেখেছিল তাও শুনিনি কোনদিন। তাহলে কেমন করে তোমার দেয়া খাদ্য আমি গ্রহণ করতে পারি?'
পরী হিনা তখন বলল, 'সাত জন্মে তোমাদের কেউ না দেখলেও আমি ঠিকই তোমাদের দেখেছি; আর জেনে শুনেই আমি তোমার জন্য এইসব পবিত্র খাদ্য দ্রব্যের ব্যবস্থা করেছি। সুতরাং তুমি নিঃসন্দেহে ওগুলো থেকে খেতে পার।'
ওসমান একটু ইতসত্দত করে বলল, 'তুমি পরী, তোমার মন সহজ সরল;তাই তোমার কথা এমন হওয়াটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আমি তো একানত্দ নিরূপায় না হলে আমার মেহনতের বাইরে কোনকিছু স্পর্শ করিনা।'
ওসমানের কথা শুনে পরী হিনা বুঝল ওসমান দরিদ্র হলেও আসলে সে একজন নিরীহ সৎ প্রকৃতির মানুষ। তাই তখন সে বলল তাকে, 'আজ তোমার যদি একটা মেয়ে থাকত আর আমি তোমার সেই মেয়ে হতাম তাহলেও তুমি কিছু খেতে না?'
ওসমান এবার নিজের ভুল বুঝতে পেরে চুপ করল। তারপর একটু ভেবে নিয়ে বলল আবার সে, 'কিন্তু তুমি তো আমার মেয়ে হয়ে জন্মাওনি; আর তা ছাড়া তুমি পরী। যদি মানুষ হতে তাহলে সেসব ভাবনা ভাবা যেত তখন।'
সুযোগ পেয়ে পরী হিনা বলল, 'ঠিক আছে , ধরে নাও আজ থেকে আমি তোমার মেয়ে। আমি তোমার বাড়িতেই থাকব এখন থেকে।'
তার কথা শুনে ওসমান বেশ চিনত্দায় পড়ে গেল। খানিক চিনত্দা করে নিয়ে সে বলল, 'আমি গরিব মানুষ। তোমার মতো একটা মেয়ে যদি থাকে আমার বাড়িতে তাহলে লোকে প্রশ্ন করলে কী জবাব দেব তাদের।'
পরী হিনা বলল, 'তোমাকে কেউ কোন প্রশ্ন করবে না। তুমি গরিব মানুষ হওয়ায় কেউ তোমার খোঁজও রাখে না। এখন যখন শুনবে আমি তোমার মেয়ে তখন তারা ভাববে তাদের অগোচরেই আমি বড় হয়ে গেছি। তা ছাড়া আমি মানুষের রূপ ধরেই তোমার বাড়িতে থাকব।'
এরপর আর কোন কথা চলে না। ওসমানও আর কিছু বলতে পারল না তাকে।
সেই থেকে পরী হিনা ওসমানের বাড়িতেই থেকে গেল। কিন্তু ওসমানের খোঁজ-খবরও যারা এতদিন রাখেনি পরী হিনাকে দেখে মনে মনে তাদের চোখ কপালে উঠল। তারা ভাবল ওসমানের খোঁজ না রেখে বরং তারা এতদিন ভুলই করেছে। তার ঘরেই রয়েছে কীনা পরীর মতো সুন্দরী বালিকা হিনা। যা সারা কায়রো শহর চষে ফেললেও দ্বিতীয়টি আর মেলবে না। হোক সে মুচি, চোর তো না। মেহনত করে যা দু'পয়সা পায় তাই সে খায়। তার সাথে সম্পর্ক রাখতে অসুবিধাটা কোথায়? তার মতো সৎ মানুষও কায়রো শহরে খুঁজলে আর দ্বিতীয়টি পাওয়া যাবে না। তাদের চোখে তখন জুতো সারা যেন সৎ মানুষের মহান পেশা। অল্পদিনে তার অনেক বন্ধু জুটে গেল আর সবাই তাকে পরামর্শ দিল জুতো সারা বাদ দিয়ে জুতো তৈরির কারখানা খুলতে। কারখানা তৈরির মুলধন আর খরচ পাতি বন্ধুরাই দেবে তাকে। তার এই উন্নতির পিছনে পরী হিনাই যে মুল কারণ ওসমানও তা মনে মনে বুঝল।
খুব বেশিদিন লাগল না ওসমানের আঙুল ফুলে কলা গাছ হয়ে যেতে। শহরে সবাই তার প্রশংসায় পঞ্চমুখ। ওসমান যে মুচি থেকে জুতোর কারখানার মালিক হয়েছে এই কথাটা সবাই গোপনেই আলোচনা করে। সামনে সবাই তাকে রীতিমত সম্মান করে। হিনা কে পুত্রবধূ হিসাবে ঘরে তোলার জন্য শহরের ধনী শ্রেণির পরিবার গুলোর মধ্যে ভিতরে ভিতরে প্রতিযোগিতা শুরম্ন হয়ে গেল। নিকট আত্মীয় দূর আত্মীয়, পাড়া প্রতিবেশী আর পরিচিত অপরিচিত সবাই এসে ধরনা দিল তার কাছে। ধন ঐশ্বর্য আর খ্যাতি প্রতিপত্তি পেয়ে ওসমান ভুলে গেল তার অতীত জীবনের কথা। তার বাড়িতে থাকা হিনা যে তার মেয়ে না তাও সে ভুলে গেল। বরং সে মনে মনে ঠিক করে ফেলল হিনা কে কায়রোর সবচে' ধনী ব্যবসায়ীর ছেলের সাথে বিয়ে দেবে। এতে করে তার ব্যবসা আরও ফুলে ফেঁপে উঠবে। হিনাও সুখে থাকবে।
কথাটা একান ওকান হয়ে ছড়িয়ে পড়ল শহরময়। ফলে হিনা কে পাওয়ার জন্য যারা এতদিন তার সাথে বন্ধুত্ব করেছিল তারা সবাই শত্রম্ন হয়ে গেল। এই কারণে ওসমানের জীবন সংশয় দেখা দিল। বছর ঘুরে আবার ঈদ এল ওসমানের ঘরে। কিন্তু ওসমান এখন আর জানেনা ক্ষুধা কাকে বলে। বরং ঐশ্বর্য আর জলুসে ভরপুর তার ছোট্ট গৃহকোণ। ঘরে আছে সুন্দরী পরী হিনা। যা সারা কায়রো শহরে আর কারো ঘরে নেই। ধন-ঐশ্বর্য থাকলেই তো আর হিনা কে পাওয়া যায় না। দুনিয়ার সুখ বলতে যা বোঝায় তা সবই এখন ওসমানের ঘরে আছে। নেই শুধু দু'টো জিনিস। যার প্রথমটা ক্ষুধা আর দ্বিতীয়টা মনের সুখ। অথচ অতীতে তার ঘরে অভাব থাকলেও সুখের কোন অভাব ছিল না। ঈদের চাঁদ রাতে ওসমানের ঘরে বয়ে যাচ্ছিল আনন্দের বন্যা। মাত্র ক'বছর আগের দৃশ্যপট এখন পুরোটাই পাল্টে গেছে। তার দো'তলা বাড়ির উপর তলায় চলছিল নাচ আর গানের আসর। হিনার সঙ্গী-সাথিরা সবাই এসেছে। তাদের সাথে হিনাও আনন্দে মেতে উঠেছে। বাতাসে ভেসে আসছে নারী কন্ঠের হুলেস্নাড় আর হাস্যধ্বনি। পায়ের নূপুরের মুহুমর্ুহু নিক্কণ শব্দে চারদিক মুখরিত। ওসমান তখনও নিচের ঘরে বসে তার ব্যবসার হিসাব নিকাশ নিয়েই ব্যসত্দ।
এমন সময় চারদিকে হৈ হৈ রৈ রৈ শোরগোল ছড়িয়ে পড়ল। ওসমানের এক খানসামা এসে খবর দিয়ে গেল বাড়িতে ডাকাত পড়েছে। বাড়িতে তার চাকর-নকর দাস-দাসীর অভাব নেই। কিন্তু মরম্ন অঞ্চলের দুর্ধর্ষ ডাকাতের কাছে সেসব নস্যি সমতুল্য। মুহূর্তের মধ্যে সব আনন্দ উৎসব শোক উৎসবে পরিণত হল। কিছুৰণের মধ্যেই ডাকাত সর্দার এসে হাজির হল ওসমানের সামনে। বিদঘুটে তার চেহারা, ভুর ভুর দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে তার গা' থেকে। সে এক বিকট চিৎকার দিয়ে বলল, 'আজ আমার হিনাকে চাই, আর কিছু চাই না আমার।'
ওসমান কে ইতিমধ্যেই পিছমোড়া করে বেঁধে ফেলেছিল ডাকাত সর্দারের সাঙ্গ-পাঙ্গরা। পুরো বাড়িটাতে তারা হুলস্থূল কান্ড বাধিয়ে ফেলল। দু'জন দাস তাদের হুকুম তামিল করতে একটু দেরি করায় সেখানেই প্রাণ হারাল। তাদের খঞ্জরের এক এক কোপেই দাস দু'জনের কলস্না উড়ে গেল মুহূর্তেই। ডাকাত সর্দারের এক চেলা মুখে নেকাব বাঁধা অবসথায় হিনাকে ঘাড়ে করে তুলে এনে নামিয়ে দিল তাদের সর্দারের সামনে। সর্দার একবার ওসমান আবার একবার হিনার চোখে চোখে তাকাল। তারপর সে চোখের এক ইশারায় হিনাকে বুঝিয়ে দিল শেষ কথা তার পিতার সাথে বলে নিতে পারে সে। ওসমান ভয় পেলেও হিনা মোটেও ভয় পায়নি ডাকাতদের তাণ্ডব দেখে। বরং সে ওসমানের কাছে সরে এসে তার কানে কানে বলল, 'তুমি ভয় পেয়ো না, ওরা তো আর জানে না আমি মানুষ না; আমি পরী। ওরা আমার কিচ্ছু করতে পারবে না, আমি ঠিক আবার তোমার কাছে ফিরে আসব।' হিনার কথা শুনে ওসমান চমকে উঠল। সে নিজেই ভুলতে বসেছিল হিনা তার মেয়ে না, সে একজন পরী।
তারপর ওরা সোনাদানা যা লুটেছিল সেসব সহ হিনা কে পাঁজাকোলা করে ঘাড়ে নিয়ে সেখান থেকে প্রস্থান করল। একরাতে ওসমান আবার কপর্দক শূন্য হয়ে পড়ল। ডাকাত দল হিনা কে তুলে নিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি তার সমুদয় সম্পদও লুট করে নিয়ে গেল। উপরন্তু তার বাড়ি সংলগ্ন জুতোর কারখানাতেও আগুন দিয়ে গেল। তার জুতোর কারখানাটি ছিল তার বাড়ির পাশেই। ফলে বাড়িতেও আগুন লেগে গেল। কোন রকমে প্রাণে বেঁচে গেল ওসমান আর তার স্ত্রী।
পরদিন সবাই শুনল ওসমানের সর্বস্ব লুটে নিয়েছে মরম্নর দসু্যদল। এমন কী ঘোড়ায় চেপে ওরা হিনাকেও তুলে নিয়ে গেছে। ওসমান আবার আগের মতোই কপর্দক শূন্য হয়ে পড়েছে। অনেকেই ছুটে এল ওসমান কে দেখে উঃ আঃ করতে। কিন্তু ভুলেও কেউ এক দিনার দিয়ে সাহায্য করল না ওসমান কে। সব হারিয়ে এবার ঈদ ওসমানের সত্যিই ক্ষুধা আর অনাহারেই কেটে গেল।
পরদিন ওসমান আবার তার স্ত্রী কে বলল, 'দাও আমার জুতোর বাঙ্টাই দাও। আবার যেয়ে বসি পথের ধারে। পরী হিনার অল্পদিনের সুখের চেয়ে আমার অনাহারে থেকে ক্ষুধায় কষ্ট পাওয়া অনেক ভাল। তবে মানুষ চিনতাম না এতদিন, পরী হিনা এসে তা চিনিয়ে দিয়ে গেছে।'
পরদিন ওসমানকে আবার দেখা গেল কায়রোর রাসত্দায়। এক টুকরো চামড়ার আসন বিছিয়ে জুতো সারার সরঞ্জামের বাঙ্টা সামনে নিয়ে বসে পড়েছে সে। এতদিনের তোয়াজ করা পরিচিত বন্ধুরা তাকে দেখেও না দেখার ভান করে চলে যেতে লাগল একে একে। ওসমান মনে মনে খোদাকে ধন্যবাদ দিয়ে বলল, 'সময় থাকতে তুমি আমার বিপদ টুকু না দিলে বাকি জীবন টা ভুলের মধ্য দিয়েই কাটাতে হত।'
২৫ জানুয়ারী - ২০১১
গল্প/কবিতা:
৪০ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ ডিসেম্বর,২০২৪