কুয়াশার কান্না

শীত (জানুয়ারী ২০১২)

সালেহ মাহমুদ
  • ৬০
  • 0
  • ৭৭
অনেক দিন পরে বৈঠকখানার চেয়ারটায় এসে বসে আবুল মাস্টার। বড় ছেলে হামিদ আলী সাবধানে ধরে ধরে হাতলঅলা কাঠের চেয়ারে বসিয়ে দেয় তার বাবাকে। দুই কাঁধ ধরে আস্তে আস্তে হেলান দিতে সাহায্য করে। আবুল মাস্টার ছেলের যত্নটুকু বেশ উপভোগ করেন। হামিদ আলী এবার টেবিল লাগোয়া পূবমুখী জানালাটা সম্পূর্ণ খুলে দেয়। এক ঝলক ধোঁয়াটে আলো এসে ঢোকে বৈঠকখানায়। আবুল মাস্টার ছেলেকে ডাকেন, বাজান।
জ্বি আববা, কিছু লাগবে?
না, আমার চশমাটা ঘোলা হইয়া রইছে। একটু মুইছা দাও।
হামিদ আলী কাছে এসে বাবার চোখ থেকে চশমা খুলে নিজের শার্টের খুঁট দিয়ে সুন্দর করে মুছে দেয়। ভালো করে দেখে মুখের কাছে এনে ভাপ দিয়ে আবারো মোছে। বাইফোকাল চশমা। দূরের চেয়ে কাছের পাওয়ারটা অনেক বেশী। দূরের জিনিস চশমা ছাড়াই দেখতে পারেন আববা, তবে চশমা দিয়ে খুব ভালো দেখতে পান সবকিছু।
হামিদ আলী চশমাটা পরিয়ে দিয়ে পাশেই দাঁড়িয়ে থাকে। আবুল মাস্টার এবার জানালা দিয়ে বাইরে তাকান। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে উসখুস করেন। ব্যাপারটা খেয়াল করে হামিদ আলী। জিজ্ঞেস করে, আববা খারাপ লাগতাছে নাকি?
চশমাটা তো ঠিকমত পরিষ্কার হয় নাই বাজান।’ আবুল মাস্টার ধীরে ধীরে বলে।
হামিদ আলী বোঝে ব্যাপারটা। পাশে এসে বাবার কাঁধে পরম যত্নে হাত রেখে বলে- আববা চশমা পরিষ্কারই আছে, বাইরে অনেক কুয়াশা তো তাই অমন মনে হইতাছে। আবুল মাস্টার এতক্ষণে বুঝতে পারে বিষয়টা। এবার ভালো করে তাকায় বাইরে। হ্যাঁ, কুয়াশাই তো। বাইরে ঘন কুয়াশা। তবে কি শীত চলে এসেছে! আবুল মাস্টার বাংলা মাস ও তারিখ মনে করতে চেষ্টা করেন। পারেন না। ছেলের দিকে তাকান। হামিদ আলী বোঝে কিছু বলতে চায় বাবা। বাবার মাথায় হাত বুলিয়ে জিজ্ঞেস করে, কিছু বলবেন আববা।
আবুল মাস্টার সরল হাসেন। ধীরে সুস্থে ছেলের দিকে চোখ তুলে বলেন, আজকা বাংলা মাসের কত তারিখ মনে করতে পারতাছি না।
হামিদ আলী চট করে দেয়ালে ঝোলানো ক্যালেন্ডার দেখে বলে- আজকা পৌষ মাসের ৪ তারিখ আববা।
ও.... এইল্যেগাই তো এত্ত কুয়াশা। কালকা রাইতেও অনেক ঠান্ডা ঠান্ডা লাগছিল। শীত তো শুরু অইয়া গেছে তাই না বাজান।
জ্বি আববা, শীত শুরু হইয়া গেছে।
বলেই চুপ মেরে যায় হামিদ আলী। বাবার মাথার পাকা চুলের ভিতর আলগোছে হাত বুলাতে থাকে। আরাম লাগে আবুল মাস্টারের। একটু শীত শীত লাগে তার। হামিদ আলী খেয়াল করে ব্যাপারটা। বলে, আববা একটু বসেন, আমি আপনের শালটা নিয়া আসি। বলেই চট করে ভিতরে চলে যায়।
আবুল মাস্টার একা হয়ে অলস দৃষ্টি মেলে ধরে জানালার বাইরে। বৈঠকখানাটা রাস্তার পাশেই। সামনের রাস্তাটা ত্রিশ ফুট চওড়া। বেশী অর্ধেক রাস্তা পাকা, এদিকের খানিকটা জায়গা এখনো কাঁচা রয়ে গেছে, তবে ইটের সোলিং করা। বৈঠকখানাটা সেমিপাকা। এক কোনায় যেখানটায় তিনি বসে আছেন সেখানে তার বড়সড় টেবিল, মাঝখানে দেয়াল ঘেঁষে সোফাসেট সাজানো, অপর কোনায় একট খাট পাতা। মেহমান এলে এখানেই থাকতে দেয়া হয়। ঘরের মাঝামাঝি রাস্তার দিকে কাঠের দুই পালস্নার দরজা। মেঝেটা জায়গায় জায়গায় ফাটাফাটা।
আবুল মাস্টার সবকিছুই অলস দৃষ্টিতে দেখেন। অনেক কষ্ট করে তৈরি করা তার এই বাড়ীটা। শ্বশুর বাড়ীর এলাকার এই বাড়ীটা তিনি একটু একটু করে করেছেন। প্রথমে স্ত্রীর আগ্রহে গ্রামের বাড়ীর কিছু জমি বিক্রি করে জায়গা কেনেন। জায়গাটার মূল মালিক ছিল তার সম্বন্ধি। তিনি তখন শ্বশুর বাড়ীর এক কোনায় ঘর তুলে বসবাস করছিলেন। সেই সময়ই তার সম্বন্ধি প্রায় পানির দরে জায়গাটা বিক্রি করে দেন মুন্সীগঞ্জের এক লোকের কাছে। তার স্ত্রী আসমা বেগম ব্যাপারটা জানেন মাস তিনেক পরে। আর যায় কোথায়, তিনি বড় ভাইকে গিয়ে জেরা করতে শুরু করেন।
- ভাইজান আপনে জাগাটা বেচলেন কার কাছে জিগাইয়া? আমারে কি একবার জিগাইছিলেন?
- না জিগাই নাই। আমার জাগা আমি বেচমু তরে জিগামু কেন?
- কেন মানে? আপনে জাগা বেচবেন আর ভাই-বইনরে জিগাইবেন না?
- ক্যা জিগামু? তরে কইলে তুই কি করতি? তুই কি কিনতে পারতি?
বড় ভাইয়ের জবাব শুনে আসমা বেগম তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠে, কি কইলেন আপনে? আপনে জিগাইয়াই দেখতেন। আমি আমার গয়নাগাটি আর শ্বশুর বাড়ীর সম্পত্তি বেইচ্যা আপনের জাগা রাখতাম। আপনে আমারে একবার জিগাইয়াই দেখতেন। অহন কি করবেন করেন, এই জাগায় অন্য কেউরে আমি দখল লইতে দিমু না।
বড় ভাই পড়ে মহা বিপদে। একমাত্র বোন এই অসময়ে এইরকম জেদ করবে তা সে বুঝতে পারে নাই। এখন তো কিছু করার নাই। মুন্সীগঞ্জের ব্যাপারীকে তো তিনি পাকা দলিল করে বুঝিয়ে দিয়েছেন জমি। তাহলে? আসমা বেগম এবার যুদ্ধংদেহী হুংকার ছাড়ে- ভাইজান আপনে হেই বেডারে খবর দেন, আমি হের আড্ডিগুড্ডি বাইরাইয়া ভাইঙ্গা ফালামু। কত বড় সাহস, হেয় আমারে না জানাইয়া আপনের জমি কিনে? খবর দেন হেরে।
বোনের হাবভাব দেখে সটকে পড়ে বড় ভাই। খবর দেয় ব্যাপারীকে। ব্যাপারী খবর পেয়েই দৌড়ে আসে নিজের কেনা জমির দখল নিতে। আর আসমা বেগম তার আসার সংবাদ পেয়েই লাঠিয়ালদের মত পাকা একটা বাঁশ হাতে করে শাড়িটা কোমরে পেচিয়ে এসে দাঁড়ায় জায়গার উপর। তখন এই জায়গাটা থেকে সেই গেন্ডারিয়া রেল স্টেশন পর্যন্ত সোজা দেখা যায়। আসমা বেগম দেখতে পায় লোকটা পড়ি কি মরি করে দৌড়ে এদিকেই আসছে। আসমা বেগম আরো শক্ত করে দাঁড়িয়ে যায় জমিতে। লোকটা কাছাকাছি আসতেই আসমা বেগম বাঁশ নিয়ে তেড়ে যায় লোকটার দিকে।
- আজকা তরে খাইছি। শালার বিদেইশা, তুই আমার ভাইরে সোজা পাইয়া এই জমিতে হাত দিছস, আজকা তরে আমি শেষ কইরা ফালামু।
লোকটা আসমা বেগমের ভাবগতিক ভালো না দেখে দৌড়ে চেয়ারম্যানের অফিসে গিয়ে আশ্রয় নেয়। চেয়ারম্যান এসে আসমা বেগমকে নিরস্ত্র করেন। সবকিছু শুনে তিনি রায় দেন, ব্যাপারি, এই জায়গা আপনের ছাইড়া দিতে হইব। ভাই-বইনরে না জানাইয়া আপনে হেগো জমি কিন্যা অন্যায় করছেন। এহন বইন যদি দাবী না ছাড়ে তাইলে তার কাছে বেইচ্যা দিতে অইব আবার।
অনেক দেনদরবার করে শেষ পর্যন্ত আসমা বেগম ব্যাপারীর কাছ থেকে জমিটা কিনে নেয়। আর এই জমি কেনার টাকা জোগাড় করতে গিয়ে আবুল মাস্টারের গ্রামের কয়েক বিঘা ধানি জমি বিক্রি করতে হয়। তখন মনে হয়েছিল কি বোকামিটাই না তিনি করছেন স্ত্রীর জেদের মূল্য দিতে। কিন্তু আজ! সেই সময়ের ত্রিশ হাজার টাকা কাঠায় কেনা জমির আজকের মূল্য পনের/বিশ লক্ষ টাকা প্রতি কাঠা! তার স্ত্রী যদি সেদিন ভয়ংকর মূর্তি না ধরতো তাহলে আর ঢাকায় নিজের আবাস গড়া হতো না আবুল মাস্টারের।
কথাগুলো ভাবতে ভাবতে দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন তিনি। কপালে একটু চুলকানি হয়। ডান হাতটা তুলতে চান, কিন্তু পারেন না। মাথাটা আস্তে আস্তে নীচে নামিয়ে আবারো ডান হাতটা তুলতে চেষ্টা করেন। কষ্ট হলেও নিজের হাতেই চুলকাতে চেষ্টা করেন। ব্যর্থ হয়ে হাতটা নামিয়ে নেন হাতলের উপর। কিন্তু মাথা তোলেন না। ঠিক সেই সময়ই শাল নিয়ে চলে আসে হামিদ আলী। বাবাকে মাথা নীচু করে থাকতে দেখে শশব্যস্ত হয়ে উঠে বাবার গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে মাথাটা ধরে ফেলে। নীচু স্বরে জিজ্ঞেস করে, আববা খারাপ লাগতাছে?
আবুল মাস্টার মাথা নাড়ে, না বাজান, কপালটা চুলকাইতাছে তো, ডাইন হাত দিয়া চুলকাইতে চাইছিলাম, পারি নাই।
হামিদ আলী বাবার কপাল চুলকে দেয়, শালটা জড়িয়ে দেয় বাবার গায়ে। আরেকটা চেয়ার টেনে এনে বসে পড়ে বাবার পাশে। শান্তনার সুরে বলে, মন খারাপ কইরেন না আববা। আর কয়দিন গেলেই আপনার হাতটা পুরাপুরি নাড়াইতে পারবেন। ডান পাওটা তো এহনই নাড়াইতে পারেন, হাতটাও পারবেন কয়দিন পরেই। মন খারাপ কইরেন না।
কথা কয়টি বলে হামিদ আলী বাবার ডান হাতটা আলগোছে তুলে ধরে ম্যাসেজ করতে থাকে। আবুল মাস্টার আরাম পেয়ে চুপ মেরে যান। তিনিও বোঝেন আরো কয়দিন লাগবে হাতটা পুরোপুরি ভালো হতে। ডাক্তার তো তাই বললো। দুদিন আগে ডাক্তার এসে দেখে গেছে তাকে। ঔষধ বন্ধ করে দিয়েছে, আর কিছু ব্যয়াম শিখিয়ে দিয়ে গেছে হামিদ আলীকে। ওটাই এখন তার একমাত্র চিকিৎসা।
হামিদ আলীর আজ অফিস ছুটি, তাই ওর কোন তাড়া নেই। আজ সারাদিন সে বাবার পাশে থাকবে। এটা তার অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেছে। বন্ধের দিনটাতে হামিদ আলী সারাদিন বাবার যত্ন নেয় আর পুট পুট করে হাজারো কথা বলে। কত কথা তার কোন ইয়ত্তা নেই। বাবারা যেভাবে সন্তানের সাথে সারাক্ষণ কথা বলে সেভাবে সেও তার বাবার সাথে কথা বলে। বাবা কোনটার উত্তর দেন, কোনটার দেন না। কখনো কখনো মজা পেয়ে হাসেন। হামিদ আলীর স্ত্রী আর মা-ও মাঝে মাঝে এসে যোগ দেয় তাতে।
হামিদ আলী কথা পাড়ে- আববা, জামালপুর হাইস্কুলে থাকতে আপনের এক হিন্দু ছাত্র আছিল নিখিল বাবু। মনে আছে?
আবুল মাস্টার একটু চিন্তা করেন। তার মনে পড়ে নিখিলের কথা। খুব ভালো ছাত্র ছিল। ক্লাস এইটে উঠে স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দেয়। তারপর তিনি নিজে গিয়ে তাকে ধানক্ষেত থেকে ধরে আনেন। নিখিলের বাবা আপত্তি করেছিল পড়ালেখার খরচ দিতে পারবে না বলে। তখন তিনি নিজেই তার পড়ালেখার খরচের দায়িত্ব নিয়ে নেন। মেট্রিক পরীক্ষার ফরম ফিলাপের টাকাটাও তিনিই দেন। আর ছেলেটা সারাদিন তার বাড়িতেই পড়ে থাকত। রেজাল্টও ভালো করেছিল। আইকম-ও পাশ করে তার কাছে পড়ে পড়ে। তারপর শুনেছেন বি.কম পাশ করেছিল দেশ স্বাধীনের পর। কিন্তু তার সাথে কোন যোগাযোগ নেই।
আবুল মাস্টার ছেলের দিকে তাকিয়ে মাথা ঝাঁকান, হ্যাঁ নিখিল! মনে পড়ছে, ক্যান বাজান?
না তেমন কিছু না। ঐ নিখিল বাবুর বড় ভাইয়ের মেয়ে কালকা রাইতে ফোন করছিল। রায়হানরে খোজল, না পাইয়া বিস্তারিত পরিচয় দিয়া আপনের লগে দেখা করতে চাইল।
আবুল মাস্টার খুশি হয়ে ওঠেন। মৃদু হেসে বলেন, আচ্ছা, তারপর?
আমি ওরে আজকে আসতে বইলা দিছি। মনে হয় সকাল সকাল আইয়া পড়ব। কোন এনজিওতে নাকি চাকরি করে। কনফারেন্স আছিল দুইদিনের, কালকা শেষ হইছে। আজকা আপনের লগে দেখা কইরা বাইত যাইব।
ছেলের কথা শুনে মনটা খুশিতে ভরে যায় আবুল মাস্টারের। নিখিলকে খুব স্নেহ করতেন তিনি। ভালো ছাত্র ছিল বলেই একটু শাসনও করতেন বেশী বেশী। নিজের ঘরে বসিয়ে বসিয়ে পড়াতেন। আর ছেলেটা প্রতিদিনই স্কুলে আসার পথে ক্ষেতের তরিতরকারী-সবজি এসব নিয়ে বাসায় হাজির হতো, আর বলতো- স্যার আজকা সারাদিন আপনের বাসায় থাকমু। ভাবীরে বালা কইরা রানতে কইবেন। তিনি সলাজ হাসতেন, আরে বোকা ছেলে খাইবি ভালা কথা, কিন্তু এগুলা আনতে গেছস কেন?
- এইগুলা আমাগ ক্ষেতের তরকারী স্যার, আমি পরতেক দিনই আনমু। আবার যহন নতুন ধান উডব তহন ধানও আনমু স্যার, হি হি হি হি।
মজা করে কথাগুলো বলেই দাওয়ায় তরকারিগুলো রেখে দৌড়ে পালাত নিখিল। শত নিষেধ করেও তিনি নিখিলকে ফেরাতে পারেন নি। আর তিনিও মন-প্রাণ উজাড় করে পড়াতেন ছেলেটাকে। কি যে ভালো লাগতো ওর পড়া দেখে। মাঝে মাঝে মনে হতো তিনি নিজেই যেন নিখিল হয়ে গেছেন।
- আববা, কী ভাবতাছেন?
হামিদ আলীর কথায় তন্ময়তা কাটে তার। ছেলের দিকে তাকান। ধীরে-সুস্থে বলেন, তর মনে নাই নিখিলের কথা? তুই তো হের লগে কত ঘুরা ঘুরছস! হেয় তরে আর রায়হানরে গাঙে লইয়া যাইত গোসল করাইতে, মনে নাই তর?
হামিদ আলী মনে করতে চেষ্টা করে। তার মনে পড়ে ছোটবেলা কেউ একজন তাকে প্রায়ই শীতলক্ষা নদীতে গোসল করাতে নিয়ে যেত। তার কাছেই সাঁতার শিখেছে সে। রায়হানকে কাঁধে করে নিয়ে সাঁতরাতে সাঁতরাতে যখন ঘাট থেকে দূরে চলে যেত তখন সে ভয়ে চিৎকার দিয়ে উঠত। সেই লোকটি তখন হাসতে হাসতে পানি ছিটাতে ছিটাতে আবার ঘাটে ফিরে আসত। তার চেহারা আবছা আবছা মনে পড়ে তার। সে বলে,
- হ্যা আববা, মনে পড়ছে। কিন্তু চেহারাটা মনে করতে পারতাছি না।
আবুল মাস্টার খুশি হন। যাক তাহলে তাকে মনে আছে নিখিলের! তিনি ছেলেকে বলেন, যা তর মারে ক ভুনা খিচুড়ি রানতে। নিখিলে খুব পছন্দ করত, হের ভাইঝিও মনে হয় পছন্দ করব। যা কইয়া আয়।
হামিদ আলীর উঠতে ইচ্ছে করে না। বসে থেকেই ভিতরের দিকে মুখ বাড়িয়ে ডাক দেয়, আম্মা আম্মা।
মা ডাক শুনে হাত মুছতে মুছতে এসে বৈঠকখানার দরজায় দাঁড়ান। জিজ্ঞেস করেন, কিরে বাবা কি হইছে?
- আববায় ভুনা খিচুড়ি রানতে কইতাছে। জামালপুরের নিখিল কাকার ভাইঝি আইবো একটু পরে।
মা’র মুখ খুশিতে ঝলমল করে ওঠে নিখিলের কথা শুনে। হাসতে হাসতে বলেন, নিখিলের ভাইঝি আইবো এইডা কেডা কইল? নিখিলের কি আমগ কথা মনে আছে?
- আরে আম্মা হ আমি ঠিকই কইতাছি। কালকা রাইতে ফোন করছিল। আমি ওরে সকালে আইতে কইয়া দিছি।
- তাইলে এক কাম কর বাপ, দৌড় দিয়া দশ টেকার চ্যাপা শুটকি লইয়া আয়। তর আববার কাছে বউরে বওয়াইয়া থুইয়া যা। আমি কয়ডা কুমড়া পাতা পাইরা আনি।
বলেই মা চলে যান ভিতরে। সাত কাঠার ওপরে এই বাড়ীর পশ্চিম দিকে এখনো অর্ধেকটা জায়গা খালি পড়ে আছে। সেখানেই সারা বছর সব্জি চাষ করতেন আবুল মাস্টার। তিনি অসুস্থ হওয়ার পর এই সাত-আট মাস ওগুলো তার স্ত্রী আসমা বেগম আর ছেলেরাই যতটুকু পারে দেখে। তাতে সব্জি কেনার খরচ অনেকটাই বেঁচে যায় এই সংসারে।
হামিদ আলী বাজার থেকে শুঁটকি নিয়ে এসে বাড়ীতে ঢুকতে গিয়ে খেয়াল করে কিছুদূরে একটা হুডতোলা রিক্সায় শাল গায়ে জড়ানো একজন মেয়ে বসে ইতিউতি করছে। মনে হচ্ছে খুঁজছে কাউকে। রিক্সা ড্রাইভার রিক্সার হ্যান্ডেল ধরে দাঁড়িয়ে আছে। কৌতুহল বশতঃ এগিয়ে যায় হামিদ আলী। কাছাকাছি যেতেই মেয়েটি হাত উঁচিয়ে ডাক দেয় হামিদ আলীকে। হামিদ আলী জিজ্ঞেস করে, কাউকে খুঁজছেন আপনি?
- জি, আবুল মাস্টার সাহেবের বাড়ীটা খুঁজছি। লোকেশন মত এদিকেই হওয়ার কথা। আপনি কি বলতে পারেন?
- হ্যাঁ অবশ্যই, উনি আমার আববা। আপনিই কি কাল রাতে ফোন করেছিলেন?
- হ্যাঁ, আমিই ফোন করেছিলাম। তাহলে আপনার সাথেই কথা বলেছিলাম আমি, ঠিক না?
মিষ্টি করে হেসে ফেলে মেয়েটি। রিক্সার ভাড়া মিটাতে মিটাতে বলে- কি আশ্চর্য, এত মিল আপনাদের দুই ভাইয়ের! আমি আপনাকে দেখে ঠিকই অনুমান করেছিলাম, আপনি রায়হানের ভাই।
হামিদ আলী হেসে ফেলে। খুব ভালো লাগে তার। কি অকপট আর ঝরঝর করে কথা বলে মেয়েটি!
- আপনি ঠিকই বলেছেন। আমাদের দুই ভাইয়ের চেহারায় দারুন মিল। একজনকে দেখলে আর একজনকে চিনতে পারা খুব কষ্টের ব্যাপার না। চলুন, আববাকে বৈঠকখানায় বসিয়ে আপনার জন্য শুঁটকি আনতে গিয়েছিলাম।
- আমার জন্য শুঁটকি আনতে গিয়েছিলেন? বিষয়টা বুঝলাম না।’ খুব অবাক হয়ে বলে মেয়েটি।
- আরে শুনুনই না, সকালে আববাকে কথায় কথায় আপনি আসছেন বললাম। তো উনি বললেন, ভুনা খিচুড়ি রান্না করতে। আর আম্মা শুনে আমাকে শুঁটকি আনতে বললেন। আপনি শুঁটকি পছন্দ করেন তো?
মেয়েটি হামিদ আলীর কথায় আর তাদের আন্তরিকতায় মুগ্ধ বিস্ময়ে থমকে যায়। কিছু বলতে পারে না কয়েক মুহূর্ত। তার মনে হলো নিজের বাড়ী যাচ্ছে সে। এত আন্তরিকতা যাদের হৃদয় জুড়ে ছড়িয়ে আছে তারা কত ভালো মানুষ ভাবতেই তার অবাক লাগে। এরা কেউ তো তাকে চেনে না! অথচ এই এক মুহূর্তের কথাবার্তায় মনে হচ্ছে কত জনমের পরিচিত সে। কাকাবাবু এই জন্যই তো মজেছিলেন স্যারের প্রেমে!
হামিদ আলী কোন প্রত্যুত্তর না পেয়ে ব্যসত্ম হয়ে বলে ওঠে, আরে থমকে গেলেন যে! আপনার পছন্দ না হোক, শুঁটকি আমার ভীষণ পছন্দ। আপনার জন্য না হয় আম্মাকে বলবো ডিম ভুনা করে দিতে। আম্মার ডিম ভুনাও অসাধারণ, একেবারে জিহবায় লেগে থাকে এক সপ্তাহ।
মেয়েটি এবার লজ্জায় একেবারে লাল হয়ে ওঠে। ফিক করে হেসে ফেলে বলে, শুঁটকি পছন্দ না সে কথা বলেছি নাকি আমি? আমার খুব পছন্দ। আর ভুনা খিচুড়ি তো আমার ফেভারিট খাবার। চলুন।
হামিদ আলী বৈঠকখানার দরজায় নক করে ডাকে, ইসরাত দরজা খোল।
বৈঠকখানায় প্রবেশ করেই মেয়েটি হাত জোড় করে নমষ্কার জানায় ইসরাতকে। ইসরাত ওর হাত দুটো নিজের দু’হাতের মুঠোর ভিতর পুরে ফেলে বলে, বাহ্ খুব সুন্দর তো তুমি। নাম কি তোমার?
- আমি চন্দ্রমল্লিকা। আপনি নিশ্চয়ই ভাবী। আপনিও অনেক সুন্দর। রায়হানের কাছে শুনেছি আপনার কথা। খুব ভালো লাগছে আপনাকে সশরীরে দেখে। আপনি ভালো আছেন তো?
- হ্যাঁ খুব ভালো। তুমি করে বলে ফেললাম কিছু মনে করোনি তো?
- না না কিছু মনে করবো কেন? বরং আমি মুগ্ধ হয়ে যাচ্ছি আপনাদের আন্তরিকতায়। স্যার কোথায়?
আবুল মাস্টার এতক্ষণ ওদের আলাপচারিতা দেখছিলেন খুব মুগ্ধ দৃষ্টিতে। মুগ্ধতার আবেশে হা হয়েছিল তার মুখ। চন্দ্রমল্লিকার মুখে স্যার শব্দ শুনে সচেতন হন তিনি। পুত্রবধু ইসরাত চন্দ্রমল্লিকার কথার জবাব না দিয়ে দৃষ্টি ঘুরিয়ে নেয় তার দিকে। চন্দ্রমল্লিকা তাকে উদ্দেশ্য করে দুই হাত জোড় করে এক প্রকার দৌড়ে আসে তার কাছে। পায়ের কাছে ঝুঁকে পড়ে পদধুলি তুলে নেয় মাথায়। আবুল মাস্টার আবেগতাড়িত হয়ে গেলে কোন কথা বলতে পারেন না। তিনি ডান হাতটা নাড়াতে চেষ্টা করেন, কিন্তু আগের মতোই অল্প একটু উঠিয়েই আবার ঝুলিয়ে দেন। পুত্রবধু ইসরাত কাছে এসে শ্বশুরের হাতটা আস্তে করে তুলে রাখেন চন্দ্রমল্লিকার মাথায়। এবার স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেন আবুল মাস্টার। চন্দ্রমল্লিকা দুই হাত আলতো করে স্যারের হাতের উপর রাখে। স্যারের দিকে তাকিয়ে খুব আবেগঘন কণ্ঠে বলে, আপনার কথা এত শুনেছি স্যার দেখার লোভ সংবরণ করতে পারি নি। আজ আপনার দর্শন লাভ করলাম, পদধুলি নিলাম, আমার জীবনটা স্বার্থক হয়ে গেলো স্যার। আমার পিতৃপুরুষ আপনার কাছে ঋণী, সেই ঋণ শোধবার কোন সুযোগ নেই স্যার, তাই আশীর্বাদ নিতে এসেছি। আমাকে আশীর্বাদ করুন স্যার।
বলতে বলতে চন্দ্রমল্লিকার চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ে। আবুল মাস্টার আবেগতাড়িত হয়ে যান। আবেগের আতিশয্যে কোন কথা বলতে পারেন না। তার ঠোঁট ভাষা প্রকাশের জন্য কাঁপতে থাকে তিরতির করে। পুত্রবধু ইসরাত দ্রুত কাছে চলে এসে শ্বশুরের মাথায় চুলে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে, আববা শান্ত হোন, উত্তেজিত হলে আপনার ক্ষতি হবে। ওকে আশীর্বাদ দিন।
আবুল মাস্টার কাঁপাকাঁপা ঠোঁটে চোখ তুলে তাকান বৌমা’র দিকে। তার চোখ জলে ভরে গেছে। ঘোলাটে দেখছেন তিনি। ডান হাতে আলগোছে চশমাটা খুলে শাড়ির খুঁট দিয়ে শ্বশুরের চোখ মুছে দেয় ইসরাত। একটু শান্ত হন তিনি। চশমাটা আবার চোখে পরিয়ে দিতেই তিনি পূর্ণ দৃষ্টি মেলে তাকান চন্দ্রমল্লিকার দিকে। তার বুকটা ভরে যায়। চন্দ্রমল্লিকা তখনও আকুল দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে। তিনি ধীরে ধীরে বলেন, সুখে থাক মা। নিখিল কেমন আছে?
স্যারের আশীর্বাদে সব পেয়েছি’র আনন্দে চন্দ্রমল্লিকার সমগ্র স্বত্ত্বা রিনিঝিনি করে ওঠে। খুশীতে ডগমগ করে ওঠে তার চেহারা। খুব প্রফুল্ল চিত্তে বলে ওঠে, কাকাবাবু খুব ভালো আছে স্যার। ওনার ছেলে হারান বি.এ. পাশ করেছে গতবার, এম.এ. পড়ছে নরসিংদী কলেজে। আর উনি শুধু ঘাটপার বসেই সময় কাটিয়ে দেন, আর কিছু করেন না। তবে খুব ভালো আছেন।
স্যার, কয়েকদিন আগে কাকাবাবুকে বলেছিলাম আপনাকে দেখে যাব। তখন কাকাবাবু বলেছিল ক’টা দিন পরে যেতে। কাঁচা খেজুরের রস দিয়ে চুইপিঠা বানিয়ে নিয়ে আসতে বলেছিল। কিন্তু আমি তো বাড়ী থেকে আসিনি, তাই আনতে পারি নি। আগামী সপ্তাহে আমি অবশ্যই নিয়ে আসব। আর যদি খুব সকালে আসতে পারি, তাহলে এক হাড়ি খেজুর রস তো আনবই। দেখবেন একটুও ভুল হবে না।
আবুল মাস্টার চন্দ্রমল্লিকার কথা শুনে হাসেন। খুব ভালো লাগে তার। তার মনে পড়ে নিখিলের কথা। যেমন ভাল ছাত্র ছিল সে, তেমনি ডানপিটে। নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ে মাছ ধরা, তরতর করে গাছের মগডালে উঠে পড়া এগুলো তো ছিল তার নিত্যদিনের সাথী। ভরা বর্ষায় কতবার যে উত্তাল শীতলক্ষা সাঁতরিয়ে এপার ওপার করতো তার কোন ইয়ত্তা নেই। পুরো শীতকাল জুড়ে প্রতিদিন সকালে এক হাড়ি করে রস নিয়ে আসতো সে। তাদের ছিল পাঁচ-ছয়টা খেজুর গাছ। এগুলো তো তার বাবা কাটতই, সাথে এলাকার আরো অনেকের গাছে হাড়ি পাততো তার বাবা। সেখান থেকে সে প্রতিদিন এক হাড়ি নিয়ে আসতো তার জন্য। আবার মাঝে মাঝে চিকন চুই পিঠা বানিয়ে কাঁচা খেজুর রসে জ্বাল দিত তার মা। সেই হাড়ি ধরে পুরোটাই নিয়ে আসতো সে। কখনো কখনো বাড়ীতে রস জ্বালিয়ে গুড় বানিয়ে সেই গুড় নিয়ে আসত, ভাপা পিঠা, পাটিশাপটা পিঠা, আরো কত রকম পিঠা যে নিয়ে আসত তার ইয়ত্তা নেই। এই সব কারণে তিনি খুব বকা দিতেন, কিন্তু নিখিল শুধু হাসতো। তার স্ত্রীকে গিয়ে বলতো, ভাবী আমার সাধ্য থাকলে সারা জীবনই খেজুরের রস আর পিডা খাওয়ামু আপনেগো। খালি আশীর্বাদ কইরেন আমারে। আর স্যাররে কইয়েন এগিলার লাইগ্যা যেন আমারে বকাঝকা না দেয়।
তার কথা শুনে হাসতো তার স্ত্রী। বলতো, তরে বকবনা তো কারে বকব? এগিলা করলে পড়ালেহার ক্ষতি অয় না তর? তর স্যারে তো এইল্যেগাই বকাঝকা করে। পাগলামি করছ ক্যা তুই? তর স্যারে কি তর কাছে কিছু চাইছে কোনদিন। তুই আর এমুন করিছ না। তইলে তর স্যারে আর তরে বকব না।
- এহ্ আপনেও দেহি স্যারের লাহান বক্তিতা শুরু করছেন। যাউগগা, স্যারে যেইডা মুন লয় হেইডা কউক গা, আমি এগিলা করমুই, স্যারে না করলেও করমু।’ বলেই দৌড়ে বই-খাতা নিয়ে পড়তে বসতো নিখিল।
এই রকম কত শত স্মৃতি আছে আবুল মাস্টারের এই নিখিলকে নিয়ে তার ইয়ত্তা নেই। আবুল মাস্টারের অস্থি-মজ্জায় মিশে গিয়েছিল নিখিল। তেমনি নিখিলের অস্থি-মজ্জায় মিশে গিয়েছিল আবুল মাস্টার। নিখিলের প্রতি তার স্নেহ-মমতা দেখে অনেকেই তাকে আবুল মাস্টারের ছোট ভাই মনে করে বসতো।
চন্দ্রমল্লিকা তাকিয়েছিল আবুল মাস্টারের দিকে। তখনো সে হাঁটু মুড়ে বসে আছে, আর আবুল মাস্টারের হাত তার মাথার উপর। এই অল্প সময়েই বুঝতে পেরেছে চন্দ্রমল্লিকা- আবেগময় কিংবা উত্তেজক কোন আচরণ করা যাবে না স্যারের সামনে।
আবুল মাস্টার বাস্তবে ফিরে আসেন। পাশে দাঁড়ানো বৌমার দিকে তাকিয়ে হাতের দিকে তাকান। বৌমা শ্বশুরের হাত ধরতে যায়। চন্দ্রমল্লিকা বিষয়টা বুঝতে পেরে নিজেই পরম যত্নে স্যারের হাতটা মাথা থেকে নামিয়ে চেয়ারের হাতলে রাখে। আবুল মাস্টারের মুখে একটা পরিতৃপ্তির হাসি ছড়িয়ে পড়ে। তার বৌমা বুঝতে পারে খুব খুশী হয়েছেন তিনি। বৌমা শ্বশুরের কাঁধের ওপর হাত রেখে খুব আদরের সাথে বলে, আববা আমি ওকে নিয়ে ভিতরে যাই। আপনি একটু বসেন, ঠিক আছে?
আবুল মাস্টার ঘাড় কাত করে সম্মতি দেন। ওরা ভিতরে চলে যায়। আবুল মাস্টার আবার বাইরে তাকান জানালা দিয়ে। বাইরে কুয়াশাটা বেড়ে গেছে আবার। এমন সাদা ধবধবে কুয়াশা নিখিলের খুব পছন্দ ছিল। যেদিন খুব ঘণ কুয়াশা পড়তো সেদিন সে দৌড়ে তার বাসায় চলে আসতো। তাকে ডেকে তুলে বলতো, স্যার তাড়াতাড়ি চলেন আপনেরে হুম মাছ দেখামু।
তিনি বলতেন, হুম মাছ কিরে? হেইডা তো গাঙের মাঝখানে। এই কুয়াশার মইধ্যে তুই আমারে কেমনে দেখাবি ক’ তো?
আরে স্যার চলেনই না। দেখবেন হুম মাছ কেমুন খালি ভাসে আর ডুবে।
এই বলে সে এক প্রকার টেনেই নিয়ে যেতো তাকে শীতলক্ষার পাড়ে। একদম পানির কিনারে তাকে দাঁড় করিয়ে হাতের পোটলাটা মাটিতে রেখেই ঝাঁপিয়ে পড়তো নদীতে। আবুল মাস্টার হা হা করে উঠতেন। আরে আরে করছ কি, করছ কি? ঠাণ্ডা লাইগ্যা মরবি তো। তাড়াতাড়ি ওঠ, আমার হুম মাছ দেহন লাগব না। ওঠ, তাড়াতাড়ি ওঠ।
সে পানিতে ডুব-সঁতারের মধ্যেই স্যারের কথা শুনত আর খিলখিল করে হাসত। হঠাৎ করে আঙুল তুলে দূরে দেখিয়ে বলতো, স্যার ওইহানে হুম মাছ উয়াস ছাইড়া ডুব দিব অহনই, দেইখ্যেন কইলাম।
বলেই ডুব দিত সে। আর কিছুক্ষণ পর সেই দেখানো স্থানে একটা ডিগবাজী খেয়ে আবার ডুব দিত নিখিল। আর তিনি পাড়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হা হা করতে থাকতেন আর ধমকাতেন নিখিলকে।
আবার কোনদিন খুব সকালে তাকে ঘর থেকে টেনে নিয়ে চলে যেতো খেজুর গাছের গোড়ায়। নিজে গাছ বেয়ে উঠে হাড়ি নামাতো আর পরিষ্কার লম্বা পাটকাঠি তার হাতে দিয়ে বলতো, স্যার মন চাইলে এইডা দিয়া খান আর নাইলে গেলাসে ঢাইল্যা দেই।
তিনি খুব মজা পেতেন। কখনো কখনো পাটকাঠি দিয়ে চুমুক দিয়ে রস খেতেন। খুব মজা লাগতো তার। ছেলেটার দস্যিপনা মেনে নিতেন। এত স্মৃতি মনে করতে গিয়ে তার মনটা ছুটে যায় সেই মানুষ গড়ার প্রত্যয়ের দিনগুলোতে।
জানালার বাইরে কুয়াশা আরো ঘণ হয়ে পড়তে শুরু করে। জানালার এক হাত দূরের কিছুও দেখা যাচ্ছে না। আবুল মাস্টার সেদিকে তাকিয়ে থাকেন নিবিড়ভাবে। তিনি ভাবতে থাকেন, এই কুয়াশা ভেদ করে যদি নিখিল রস নিয়ে আসতো, তাহলে খুব মজা করে খেতাম। নিখিল তুই কি আসতে পারিস না?
কথা কয়টি ভাবতে ভাবতেই তিনি অবাক বিস্ময়ে চোখ বিস্ফারিত করে জানালার দিকে তাকান। জানালার বাইরে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছে নিখিল। তার দিকে তাকিয়েই হাসছে সে। হাতে রসের কলসটা উঁচু করে তুলে ধরে নিখিল বলে, স্যার আপনের লাইগ্যা রস লইয়া আইছি স্যার, দরজা খোলেন।
আবুল মাস্টার নিখিলের কথার জবাব দিতে চান, কিন্তু পারেন না। চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াতে চান, পারেন না। নিখিল দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে আছে, অথচ তিনি দরজা খুলতে পারছেন না। ভাবতেই তার খারাপ লাগছে। তিনি প্রাণপণ চিৎকার করে ছেলেকে ডাকেন, হামিদ তাড়াতাড়ি দরজা খোল, নিখিল বাইরে দাড়াইয়া রইছে, হামিদ হামিদ...।
আবুল মাস্টারের এ রকম আকস্মিক চিৎকারে বাড়ীর সবাই হুড়মুড় করে ছুটে আসে বৈঠকখানায়। হামিদ আলী দরজা খুলে দেয় পুরোপুরি। খুব ঘণ সাদা কুয়াশায় ভরে যায় ঘরটা। আর সবাই অবাক হয়ে দেখে একটা সাদা ছায়ামূর্তি ভিতরে ঢুকেই আবুল মাস্টারের টেবিলের উপর একটা কলস রেখে দেয়। তারপর খিলখিল করে হেসে দৌড়ে বেরিয়ে যায় ঘর থেকে।
আবুল মাস্টার খুব আগ্রহ নিয়ে কলসটা দেখতে থাকেন। সবাই ঘটনার আকস্মিতায় হতবিহবল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। এরই মধ্যে কুয়াশা কাটতে শুরু করে। কেউ একজন ঘরের লাইটটা জ্বালিয়ে দেয়। সবাই উৎসুক হয়ে টেবিলের দিকে তাকায়। কলসটা ততক্ষণে অদৃশ্য হয়ে গেছে। কিন্তু টেবিলে তখনো কলসের ভেজা চিহ্ন রয়ে গেছে। আবুল মাস্টার সেদিকে তাকিয়ে ঝরঝর করে কেঁদে ফেলে আর চন্দ্রমল্লিকা তার মাথায় এবং কাঁধে হাত বুলিয়ে দিতে থাকে পরম যত্নে।

[ হুম মাছ = শুশুক মাছ, অনেকটা ডলফিনের মতো। এরা যখন নদীতে ডিগবাজী দিয়েই আবার ডুব দেয় তখন শুধু তার কালো পিঠটাই দেখা যায়। ]
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
সালেহ মাহমুদ সেলিনা ইসলাম : বিশ্লেষণী মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ। খুব ভালো লাগলো, ধন্যবাদ।
ভালো লাগেনি ২৯ জানুয়ারী, ২০১২
সেলিনা ইসলাম বেশ সুন্দর একটা গল্প । খুব ভাল লাগল আসমার পৈত্রিক সম্পত্তি ধরে রাখার কৌশল এবং হামিদ আলী ও তার স্ত্রীর ভক্তিশ্রদ্ধা , শুশ্রূষা দেখে ! তবে শেষে এসে বেশ অলৌকিক রহস্যাবৃত রাখা হয়েছে পাঠককে প্রশ্নবিদ্ধ করার জন্য মনে হয় ! তবে আবুল মাস্টারের মত শিক্ষিত মানুষের এই ভ্রমে বিশ্বাস রাখা একটু ভাবাল ! সবকিছু ছাপিয়ে গল্পের থিম , উপস্থাপনা , ধারাবাহিকতা এবং গল্পের গভীরতা প্রশংসার দাবী রাখে ! শুভেচ্ছা ও শুভকামনা
ভালো লাগেনি ২৯ জানুয়ারী, ২০১২
সালেহ মাহমুদ tani hoqe : আমারো জিভে পানি চলে এসেছে, ধন্যবাদ তানি....।
ভালো লাগেনি ২৪ জানুয়ারী, ২০১২
তানি হক সব ঠিক থাক ..তবে ভুনা খিচুড়ি আর শুটকি মাছ ..তো জালাতন করলো ...
ভালো লাগেনি ২৪ জানুয়ারী, ২০১২
সালেহ মাহমুদ ইসমাইল গনি : যতটুকু পড়েছেন ততটুকুর জন্য ধন্যবাদ। তবে পুরোটা পড়া খুবই প্রয়োজন, না হলে খণ্ডিত মনে হবে।
ভালো লাগেনি ২৪ জানুয়ারী, ২০১২
সালেহ মাহমুদ Md.Iqbal Hossain : আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। আসলে গল্পের থিম হলো শীতের তারুণ্যের দৌরাত্ম। আমরা অনেকেই এর সাথে পরিচিত নই। তাই হয়তো আবুল মাস্টারের ছাত্র নিখিলের তারুন্যের দুরন্তপনা বুঝতে কষ্ট হতে পারে। তবে আরো একবার মনোযোগ দিয়ে পড়লে বিষয়টা আপনার নিকট পরিষ্কার হবে আশা করি। ধন্যবাদ।
ভালো লাগেনি ২৪ জানুয়ারী, ২০১২
সালেহ মাহমুদ রোদের ছায়া : অনেক ধন্যবাদ।
ভালো লাগেনি ২৪ জানুয়ারী, ২০১২
ইসমাইল গনি যতটুকু পড়েছি আমার ভালই লেগেছে ।
ভালো লাগেনি ২৩ জানুয়ারী, ২০১২
মো. ইকবাল হোসেন Every character of this story is so Lively.But i don't understand what's the theme of this story.....Thanks
ভালো লাগেনি ২৩ জানুয়ারী, ২০১২
রোদের ছায়া গল্পের শেষটা ভীষণ মন ছুয়ে গেল ........অনেক ভালো

২৫ এপ্রিল - ২০১১ গল্প/কবিতা: ২৮ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "ছোটবেলা”
কবিতার বিষয় "ছোটবেলা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ ডিসেম্বর,২০২৪