মায়াবী জ্যোৎস্নার ডাক

দেশপ্রেম (ডিসেম্বর ২০১১)

সালেহ মাহমুদ
  • ৮৯
  • 0
  • ৬৪
গুদারা নৌকা থেকে চন্দ্রমল্লিকার হাত ধরে সন্তর্পনে ঘাটে নাম অনভ্যস্ত রায়হান। কঙ্করময় লালমাটির পাড় বেয়ে উঠে যায় উপরে। টোলঘর ছাড়াও আরো অনেকগুলো টঙ দোকান রয়েছে এখানটায়। দুয়েকটা দোকানের ভিতর টিমটিমে আলো জ্বলছে। ঘাটে লোকজনের সাড়া পেয়ে আলো জ্বলতে থাকা দোকানগুলোর ঝাপ খুলতে শুরু করে দোকানীরা। টোলঘরে ষাট পাওয়ারের অনুজ্জ্বল বাতি জ্বলছে। টোলের টাকা দিতে গেলে আধবুড়ো তোলাঅলা চন্দ্রমল্লিকাকে ধমকে দেয়-
- রাখ ছেমড়ি, টেহা দেওন লাগবো না। তুই আজকা এত দেরী করলি কই? তুই না হাইঞ্জার আগেই আইয়া পড়ছ?
- হ কাকা, দেরী অইয়া গেল। বাস পাইতে দেরী অইছিল।
- তুফানের মইদ্যে কই আছিলি?
- মিলগেটের মন্দিরে আছিলাম।
- ও, বাইত যা তাড়াতাড়ি, যা যা।
চন্দ্রমল্লিকা চলে যেতে উদ্যত হতেই তোলাঅলা তাকে থামিয়ে দেয়-
- এই খার খার, তর লগে মেমান এইডা কেডা?
- তুমি চিনবা না কাকা। হের বাড়ী হেই বরগাও। তুফানের মইদ্যে একলগে আটকা পরছিলাম। ঢাহা যাওনের বাস নাই দেইখা ফেরত আইছে।
রায়হান মৃদু হেসে সালাম দেয় লোকটিকে। লোকটি ভালো করে তাকিয়ে রায়হানকে দেখতে দেখতে সালামের জবাব দেয়- আলাইকুম সালাম। বাজানের নাম কি গো?
রায়হানের খুব ভালো লাগে লোকটার এ রকম আন্তরিকতায়। হাত বাড়িয়ে দেয় লোকটার দিকে। বলে-
- আমার নাম রায়হান।
- বরগাও কোন বাড়ীর পোলা গো তুমি?
- মাস্টার বাড়ীর ছেলে আমি। আপনি চেনেন নাকি?
- পূব পাড়ার আবুল মাস্টরের বাড়ীর পোলা তুমি?
- জ্বি, আমি ওনার মেঝো ছেলে।
পরিচয় শুনেই লোকটা লাফিয়ে ওঠে। টোলের মাচা থেকে এক লাফে নেমেই পরম আবেগে জড়িয়ে ধরে রায়হানকে। তুমি আমারে এইডা কি হুনাইলা! তুমি আবুল মাস্টরের পোলা? এত্তো ডাঙ্গর অইয়া গেছো তুমি? তোমার ডাক নাম না কি জানি? টু...
রায়হান ঘটনার আকস্মিকতায় একদম ভ্যাবাচেকা খেয়ে যায়। তার পিতৃপরিচয়ের আবেগে প্রায়ই পড়তে হয় তাকে, কিন্তু এভাবে আবেগের আতিশয্যে জড়িয়ে ধরার ঘটনা আগে কখনো ঘটে নি। রায়হান আলিঙ্গনাবস্থায়ই বলে- জ্বি, আমার ডাকনাম টুকু।
লোকটি আলিঙ্গন ছেড়ে রায়হানের দুই কাঁধ হাত দিয়ে ধরে রেখে ভালো করে দেখে। রায়হান খেয়াল করে লোকটির চোখ টলমল করছে পানিতে। সে বুঝতে পারে তার বাবার সাথে খুব আবেগের সম্পর্ক ছিল এই লোকটির। কিন্তু কি সেই সম্পর্ক? সে জানে না। এই ব্যক্তিকেও কোনদিন দেখেনি আগে। কিসের সম্পর্ক ছিল তাহলে? অনেক কিছুই থাকতে পারে। বাবার সবকিছু সে জানবে এমন তো কথা নেই। আলুথালু কি সব ভাবনারাজি মুহূর্তের ভিতর তার মাথায় গিজগিজ করতে শুরু করে। লোকটি ধরা গলায় বলে- তোমার বাবার অসুখের কথা হুনছি মাইন্নের কাছে। অহন শইলডা কেমুন, বালা নি এট্টু ?
জ্বি, কিছুটা ভালো। হাসপাতালে আর বেশিদীন থাকতে হবে না। ডাক্তার বলেছেন, খুব শিগগিরই বাসায় যেতে পারবেন উনি।
আইচ্ছা ভালা কতা, তুমি অহন কই যাইবা? বাইত যাইবা?
না কাকা, বাড়ী না, আমি ঢাকা যাওয়ার জন্য রওয়ানা দিয়েছিলাম। গুদারা পার হয়ে বৃষ্টিতে আটকা পড়লাম বলেই ফেরত আসছি। এই রাইত নয়টায় তো আর ঢাকার দিকে কোন বাস পাব না। যদি ঢাকা যাওয়ার কোন সুযোগ পাই তাহলে জামালপুর দিয়ে ঢাকা চলে যাব, নাহলে বাড়ী ফিরে যাব।
ও বুচ্ছি, তাইলে আইজকা আর কুনদিকে গিয়া কাম নাই। তুমি আমগ বাইত রাইতডা কাডাইয়া একরাবে বেনবালা ঢাকা যাইতে পারবা। আমার গর তো খালিই পইড়া থাহে, তুমি থাইক্কাই যাও আমগ বাইত।
রায়হানকে কথাগুলো বলে রায়হানের জবাবের কোন অপেক্ষা না করেই চন্দ্রমল্লিকাকে লক্ষ করে বলে- হোন চন্দ্র, তর বাপেরে কবি আমার বড় রাতা মুরগীডা দইরা জব দিতে। আর তর মায় যেন বালা কইরা রান্দে। যা মেমানরে লইয়া বাইত যা, আমি হারানরে বওয়াইয়া থুইয়া আইতাছি।
চন্দ্রমল্লিকা এতক্ষণ অবাক হয়ে রায়হান আর তার কাকার আবেগঘন সাক্ষাৎ নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছিল। সে বুঝতে পারে রায়হানের পারিবারিক ও বংশীয় পরিচয় অনেক উঁচু মানের। তার ভিতর একরাশ শ্রদ্ধা এসে ভর করে। রায়হান আমতা আমতা করে কিছু বলতে যাচ্ছিলো। কিন্তু চন্দ্র’র কাকা ওকে থামিয়ে দেয়। জোর করে বলে- এহন তুমি জামালপুরের দিকে যাওনের কিছু পাইবা না। বাইত গেলেও হাইট্টা যাইতে অইব। হেইডাও অনেক রিস্কের, ডাকাইতের উপদ্রব যা বাড়ছে আইজকাইল। লগে কিছু না পাইলে জানডাই লইয়া যায় গা। তুমি যাও তো, চন্দ্র’র লগে আমার ঘরে যাও। আমি আইতাছি।
রায়হান আর কিছু বলতে পারে না। নিরূপায় হয়ে চন্দ্র’র সাথে হাঁটা শুরু করে।
নদীর ঘাট পার হয়ে কয়েক ঘর পরেই চন্দ্রদের বাড়ী। এই অঞ্চলটায় বেশ কয়ঘর হিন্দু বাস করে। কেউ কেউ স্বচ্ছল, বাকীরা সবাই খুব অসহায়ের মত জীবন যাপন করে। ব্যতিক্রম শুধু চন্দ্রদের পরিবার। তার বাবা আর কাকারা সবাই শি্িক্ষত। সবাই ভালো ভালো চাকরি-বাকরি করে। শুধু তার কাকা কী এক নেশায় টোলের টাকা তুলেই জীবনটা পার করে দিলো, সেটা চন্দ্র-ও জানে না। কাকীমা মারা গেছে বছর দশেক হয়। একমাত্র ছেলে হারান বি.এ. পাশ করেছে এই বছর। এম.এ. ক্লাশে ভর্তি হবে সামনে। পড়ালেখার ফাঁকে ফাঁকে বাবাকে সে রীতিমতো সাহায্য করে। অনেক সময় বই-পত্র নিয়ে বসে যায় টোলের মাচায়।
চন্দ্র’র সাথে যেতে যেতেই সবকিছু শোনে রায়হান। সাগ্রহে জিজ্ঞেস করে- কাকা পড়ালেখা করেন নাই?
- আরে হ্যা, কাকাবাবু বি.কম পাশ করেছে স্বাধীনের কয়েক বৎসর পর। এই ব্যবসা, সেই ব্যবসা করে কোনটাতেই জুৎ করতে না পেরে একদিন এই টোলের মাচায় উঠে বসল। টোলের ডাক যে-ই পাক, তোলার কাজটা উনি কাউকে নিতে দেন না। আর ইজারাদাররাও কাকাকে ছাড়া কিছু বোঝে না।
কথা বলতে বলতে চন্দ্রদের বাড়ী চলে আসে ওরা। চন্দ্র কাকার ঘর খুলে বাতি জ্বালিয়ে বিছানাপত্র ঠিক করে দিয়ে রায়হানের মুখোমুখি দাঁড়ায়। হেসে ফেলে বলে- সবই ভগবানের লীলা। আপনার সেবা করতে পারব ভাবি নি। কাকা-ই সব ব্যবস্থা করে দিলেন। আপনি আরাম করে বসুন, আমি চট করে ভিতর থেকে আসি।
এতক্ষণ পর একা হয়ে যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচে রায়হান। এখানে বিদ্যুৎ আছে। তবে ষাট পাওয়ারের বাতিই দেখা যায় সবখানে। এই ঘরেও ষাট পাওয়ারের বাতি জ্বলছে। সিলিং ফ্যান ঝুলানো আছে উপরে। ঠান্ডা আবহাওয়া বলে ওটা ছাড়া হয় নি। পুরো ঘর সুন্দর করে সাজানো। দেয়ালে কবিগুরুর ছবি, বিদ্রোহী কবির ছবি ছাড়াও নেতাজী সুভাষ চন্দ্র’র ছবি ফ্রেমে বাঁধানো সুন্দর করে। এক পাশে একটা ফ্রেমে পুঁতির কাজ করা ফুলের ছবি সহ কবিতার ক’টি চরণ লেখা। কাছে গিয়ে পড়ে দেখলো-
‘‘ফুটিল বসন্ত ফুল, ভরিল বাগান
আমি যারে ভালবাসি, তার করব দান।’’
এক কোনায় নাম লেখা- কানন বালা। এই ফ্রেমের পাশে একটা ফ্রেমে স্কেচ করা এক নারীর ছবি। ফ্রেমের ওপরে শুকনো ফুলের মালা। কোন নাম-ধাম লেখা নেই। রায়হান অনুমান করে- এটা কানন বালা’র ছবি। রায়হানের মনটা মিষ্টি ভালোবাসার আবেশে ভরে যায়। এই ছবিটা নিঃসন্দেহে কাকীমা’র। কাকা নিঃসন্দেহে খুব ভালোবাসতো কাকীমাকে। যে কারণে আর বিয়ে-থা’র চিন্তা করে নি কাকা। আরো অনেক কিছু ভাবতে শুরু করেছিল রায়হান।
দরজায় কারো সাড়া পেয়ে ফিরে দেখে চন্দ্র একটা ট্রে হাতে করে ঘরে ঢুকছে। রায়হান কুণ্ঠিত হয়ে যায়। শশব্যস্ত হয়ে বলে ওঠে, আরে আরে এসব কি? আপনারা তো আমাকে একেবারে লজ্জায় ফেলে দিচ্ছেন।
মিষ্টি করে হেসে ফেলে চন্দ্র। টেবিলে রাখতে রাখতে বলে- আরে দাদা আপনি আমাদের বাড়ীতে প্রথম এলেন। মিষ্টি মুখ না করালে তো আমাদের অকল্যাণ হবে। নিন, একটু জল পান করুন।
- এই ছবিটা কার? কাকীমার? নারী স্কেচটা দেখিয়ে জিজ্ঞেস করে রায়হান।
- হ্যা কাকীমার। আপনি বুঝলেন কি করে? একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে চন্দ্র।
- এমনি, মনে হলো। আপনিই তো বললেন কাকীমা দশ বছর আগে পরলোকগমন করেছেন। আর এই ছবির ফ্রেমে শুকনো মালা। ঘরটাও কাকার। তাই মনে হলো এ কাকীমার ছবি না হয়ে পারে না।
চন্দ্র মুগ্ধ বিস্ময় নিয়ে রায়হানের দিকে তাকিয়ে থাকে। মনে মনে ভাবে অসাধারণ মানুষ আপনি। ঘরে ঢুকতে না ঢুকতেই একেবারে সবকিছু বুঝে ফেলেছেন। চন্দ্র-র দৃষ্টিতে বিব্রত বোধ করে রায়হান। এই ভাবটা কাটাতেই আবারো বলে ওঠে- কাকীমার নাম কি কানন বালা ছিল?
এবার বিস্ময়ে হা হয়ে যায় চন্দ্র’র মুখ। সে তো রায়হানকে কাকীমার নাম বলে নি। তাহলে জানলো কি করে? বিস্ময়ের ঘোর তার কাটে না। সে উত্তর না দিয়ে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে রায়হানের দিকে। রায়হান বুঝতে পারে বিষয়টা। পরিবেশ হালকা করতে হেসে ফেলে বলে- না মানে, ঐ যে ফ্রেমটার নিচের দিকে কানন বালা নাম লেখা। ওটা দেখে আমার তেমনটাই মনে হলো।
চন্দ্র’র বিস্ময় ভাবটা এবার কেটে যায়। মিষ্টি হেসে উচ্ছ্বসিত হয়ে বলে ওঠে- ওহ দাদা, আপনি সত্যিই অসাধারণ একজন মানুষ। আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম ওই ফ্রেমটার কথা। হ্যা, ওটা কাকীমা’র নামই। কাকীমা নিজ হাতে ওই কর্মটি করেছেন। দাদা, আপনার কল্পনাশক্তি দেখে অবাক হচ্ছি। আপনাকে নমষ্কার দাদা, নমষ্কার। নিন, এবার একটু জল পান করুন। আমি ধন্য হই।

চন্দ্র’র কাকা আসতে আসতে একটু দেরীই হয়ে যায়। ততক্ষণে রায়হানের সাথে এই বাড়ীর সবার পরিচয়পর্ব শেষ হয়ে গেছে। সবাই কৌতুহল নিয়ে দেখতে এসেছে রায়হানকে। চন্দ্র’র বাবা তো মহাখুশী। চন্দ্র’র বাবাও রায়হানের বাবাকে চেনে। রায়হানের বাবা আবুল মাস্টারের গুণকীর্তন করতে করতে উপস্থিত সবাইকে চমক লাগিয়ে দেয়। রায়হান নিজেও অবাক হয়ে যায় চন্দ্র’র বাবার কথা শুনে। চন্দ্র’র বাবা বলে,
- হোন বাবা, আমার দাদা মানে চন্দ্র’র কাকায় তোমার বাবার ছাত্র আছিল। হেই বাষট্টি সনের কথা। তোমার বাবায় এম.এ. পাশ কইরা সোজা চইলা আইল গ্রামে। জামালপুর হাইস্কুলে মাস্টরি শুরু করলো। তহন এই স্কুলের খুব নামডাক আছিল। নদীর হেপারতেও অনেকে পড়তে আইত এইহানে। দাদার ব্রেন আছিল খুব বালা। কিন্তু নাইনে উইঠ্যা কি মনে অইল স্কুলে যাওয়া বন্ধ কইরা দিল। তো অইছে কি, তোমার বাবায় দাদারে খোজতে খোজতে বাড়ীত আইয়া উঠল একদিন। ধরল দাদারে। দাদায় তহন ক্ষেত-খামার লইয়া ব্যস্ত। তোমার বাবায় দাদারে বুঝাইয়া-হুনাইয়া আবার স্কুলে লইয়া গেল। নিজের পকেটের টেহা দিয়া মেট্রিকের ফরম ফিলাপ করাইল। এইডা না করলে দাদার আর পড়ালেহা হইত না। আর দাদার পড়ালেহা না হইলে আমগ গুষ্টিতে কেউ পড়ালেহা করত কিনা কে জানে! বর বালা মানুষ গো তোমার বাপে, বর বালা মানুষ।
চন্দ্র’র বাবার কথাগুলো শুনে খুব ভালো লাগে রায়হানের। গর্বে ফুলে ওঠে তার বুকটা। তার বাবার পরিচয়ের কারণেই কত জায়গায় কত অসাধ্য কাজ পানির মত সহজে হয়ে যায় তা কেবল সে-ই জানে। স্বপ্নালু হয়ে ওঠে রায়হান। গ্রামীন এই নৈশ আড্ডার মধ্যমণি সে, কিন্তু নায়ক তার বাবা আবুল মাস্টার! বিষয়টি এভাবে ভাবতেই তার গা শিহরিত হয়।
চন্দ্র’র কাকা আসতেই আড্ডার পরিবেশ আরো জমজমাট হয়ে যায়। কাকা যে রায়হানের জন্য কী করবে না করবে ভেবে পায় না। ভরপুর নৈশভোজের পর আড্ডা মিইয়ে আসে। চন্দ্র’র কাকা চন্দ্র’কে ডেকে বলে,
- মা রে বাইরে ফকফকা জোছনা। বাজানে তো এমুন জোছনা দেহে নাই মনে অয়। উঠানের চকিডা দহিনের চালায় বিছাইয়া দিতে ক। বাজানরে লইয়া চান্দের আলোয় গোসল করমু আজকা। কি কও বাজান?
বলে জিজ্ঞাসু চোখে তাকায় রায়হানের দিকে। রায়হান আনন্দে শিহরিত হয়। তার কাছে স্বপ্নের মতো মনে হয় সবকিছু। এত আদর, আপ্যায়ন, সৌজন্য, স্নেহ, মায়া, মমতা আর রোমান্টিক সব আচরণ তার কাছে স্বর্গীয় বলে মনে হতে থাকে।

খোলা চাতালে পেতে দেওয়া বড়সড় খাটে চাদড় মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে পাশাপাশি দু’জন, রায়হান আর কাকাবাবু। কাকাবাবুর মাথার পাশে একটা চেয়ার টেনে বসে মাথায়-চুলে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে চন্দ্রমল্লিকা। কারো মুখে কোন রা’টি নেই। কাকাবাবু যেন এ রকম একটি পরিবেশই চাইছিলেন। ধবল জোছনার দিকে মুখ করে তিনি যেন সুদূর অতীতে হারিয়ে গেলেন। বিড়বিড় করে বলতে লাগলেন- জানো টুকু। তোমার বাবায় যদি আমার মেট্রিকের ফরম ফিলাপ না কইরা দিত তাইলে আর আমার পড়ালেহা অইত না। আর আমি করতাম কি, প্রত্যেকদিন সন্ধ্যার সময় স্যারের কাছে যাইতাম গা। স্কুলের দহিন মুরা একটা বাসায় তোমগ লইয়া থাকত স্যারে। স্যারে ধইরা ধইরা আমারে পড়াইত। স্যারে খালি কইত, দেশের পোলাপানগো মানুষ করনের লইগ্যা আমি সরকারি চাকরি না কইরা ইস্কুলে ঢুকছি। তরা যদি না পড়ছ তইলে আমার এহেনে থাইক্কা লাভ কি ক?
আমরা স্যারের কথা শুইন্যা এহেক সময় স্যাররে বোকা ভাবতাম, আবার এহেক সময় পাগল ভাবতাম। তো অইছে কি- হেই আটষট্টি/উনসত্তুর সালে তোমার জন্ম। তুমি একটু ডাঙ্গর অইলে পরে তোমারে আমরাই রাখতাম সারাক্ষণ। তোমারে কান্ধে লইয়া গাঙ্গে যে কত ডুব পারছি তুমি কইতেও পারবা না। তুমি কি এইসব কোনদিন হুনছ তোমার বাবার মুহে?
আপন মনেই প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয় কাকাবাবু। রায়হান তেমনি ঘোরলাগা কণ্ঠে বলে- না কাকাবাবু।
তোমার মারে জিগাইয়া দেইখো, তাইলে হুনতে পারবা। আমি হিন্দু অইলেও স্যারে আমারে কত্ত আদর করত। স্যারের কাছে পইড়াই আমি মেট্রিক পাশ করলাম। আইকম পাশ করলাম দেশ স্বাধীনের আগেই। আর তহনই লাগল যুদ্ধ। আমার স্যাররে তহন দেখতাম খালি ছটফট করতে। স্যারে খালি কইত, হায় হায় আমার স্বপ্নের দেশটা দুই ভাগ অইয়া যাইব? আমরা হিন্দুস্তানের আন্ডারে চইলা যামু? অ মিয়ারা তোমরা যুদ্ধ থামাও। আমার সোনার দেশটারে তামা কইরা দিয়ো না। এহেনদা স্যারের অনেক ছাত্র মুক্তিযুদ্ধে গেল গা। অনেকে পইরা রইল দেশে। স্যারে দেখলাম দিশ হারাইয়া ফালাইল। এহেনদা আর্মিরা এদিকে আইলে স্যারে হেগো ঠেকায়। স্যাররে সবাই খুব মান্য করত। স্যারের কথায় আর্মিরা আর এই এলাকায় ঢুকে নাই। আবার স্যারের মুক্তি ছাত্ররা স্যারের কাছে গোপনে আইলে স্যারে হেগো বুঝাইত- দেহো বাবারা তোমরা দেশটারে তামা কইরা দিয়ো না। আমি যেই সোনার স্বপ্ন বুকে লইয়া তোমাগ পড়াইছি হেইডা মাডি কইরা দিয়ো না। মুক্তিরা স্যারের কথা মনোযোগ দিয়ে শুনত আর ভাবীর রান্ধা ডাইল-ভাত খাইয়া কমান্ডো হইয়া যাইত। স্যারে যদি না থাকতো, তাইলে এই এলাকার একটা হিন্দুও বাইচ্যা থাকতে পারতো না।
হেই স্যারের অবস্থাডা কি অইল দেহ, দেশ স্বাধীন অওনের পর মুক্তিযুদ্ধে যায় নাই বইলা স্যারের বাড়িঘর ভাইঙ্গা লইয়া গেল হেই মেন্দিপুরের ডাকাইত শরফতে। আর তোমার বাবায় জান বাচানের লইগ্যা তোমগ সবতেরে লইয়া ঢাহা চইলা গেল। হেইযে গেলো, আইজও গেলো, কাইলও গেলো। সব কিছু নরমাল হওনের পর আমরা আবার স্যাররে পাইলাম। কিন্তু আগের হেই স্যাররে আর পাই নাই। স্বাধীনের আগের স্যাররে যদি পাইতাম তাইলে এই দেশের পোলাপান একটাও অশিক্ষিত থাকতো না। আর...
কাকাবাবু বিড় বিড় করে কি যেন বলতে বলতে ঘুমিয়ে পড়ে। রায়হানের ঘুম আসে না। তার বাবা সম্বন্ধে অনেক না জানা কথা জেনে তার ঘোর লেগে যায়। বাবার প্রতি শ্রদ্ধার অভিব্যক্তি তার বেড়ে যায় আরো বহুগুণ। পাশ ফিরে দেখলো ঘুমিয়ে পড়েছে কাকাবাবু। আস্তে করে উঠে যায় রায়হান। ধবধবে ফকফকা জোছনা এক মায়াময় পরিবেশ রচনা করেছে চারিদিকে। সে ঘোরে পাওয়া মানুষের মতো হাঁটতে থাকে নদীর দিকে। পাশে কারো উপস্থিতি টের পেয়ে ফিরে তাকায়। চন্দ্রমল্লিকা ঠিক তার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। চন্দ্রমল্লিকা অস্ফুটে জিজ্ঞেস করে- কোথায় যাচ্ছেন?
রায়হান খুব ঘোর লাগা কণ্ঠে বলে, চন্দ্রমল্লিকা এমন ধবধবে জ্যোৎস্না ধোওয়া রাত আর পাবো কিনা জানি না। কাকাবাবু তো জ্যোৎস্নার আলোতে ভিজে ঘুমিয়ে গেছেন। আর আমি জোৎস্নার আলোতে ভিজে বনবাদাড়, নদী তীর আর রাতের নিস্তব্ধতায় মিশে যেতে চাই।
চন্দ্রমল্লিকাও ঘোরে পাওয়া মানবীর মতো বলে- তাহলে আমাকে সঙ্গী করে নাও।
- চলো, আমরা দু’জনে আজ সারারাত নিস্তব্ধ প্রকৃতির সাথে কথা বলবো, আকাশের তারাদের সাথে হেঁটে বেড়াবো আর ঘুমিয়ে থাকা শীতলক্ষাকে জাগিয়ে তুলবো।
- চলো, তবে তাই হোক।
এরপর তারা দু’জন মানব-মানবী জ্যোৎস্না স্নাত স্বপ্নীল মায়ামায় জগতে হাত ধরাধরি করে হারিয়ে যেতে থাকে নিশীথের গহীন থেকে গহীনে। ...
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
সালেহ মাহমুদ সকাল রয় : খুশি হলাম, ধন্যবাদ।
সালেহ মাহমুদ আহমাদ মুকুল : আমি জানি আপনি আগেই পড়েছেন। তারপরও মন্তব্য পেয়ে আরো ভালো লাগলো।
সালেহ মাহমুদ প্রজাপতি মন : ধন্যবাদ, আরো পর্ব আছে, শীত সংখ্যায় সে রকমটাই চেষ্টা করেছি।
সকাল রয় সুন্দর গল্প পড়লাম। ভালো লাগলো
আহমাদ মুকুল গল্পটি পড়েছিলাম অনেক আগে, কী এক ভাবনায় পড়ে মন্তব্যটি করা হয়নি। আপনার চিরাচরিত ঢংয়ে সুগঠিত সুলিখিত গল্প। দেরীতে হলেও সাধুবাদটি জানালাম।
প্রজাপতি মন চন্দ্রমল্লিকার দ্বিতীয় পর্ব পড়লাম, ভালো লাগলো অনেক.
সালেহ মাহমুদ tani hoqe : তোমাকে অনেক শুভেচ্ছা। ভালো থেকো।
তানি হক রায়হানের মত আমার ও ঘোর লেগেছে ..ভাইয়া ..আপনাকে ধন্যবাদ জানাই..খুব খুব ভালো থাকুন ..এই কামনা
সালেহ মাহমুদ Kh Anisur Rahman Joti : ধন্যবাদ।
সালেহ মাহমুদ M.A.HALIM : ধন্যবাদ ।

২৫ এপ্রিল - ২০১১ গল্প/কবিতা: ২৮ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "স্থিতিশীলতা”
কবিতার বিষয় "স্থিতিশীলতা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪