এক বর্ষণমুখর সন্ধ্যায়

বর্ষা (আগষ্ট ২০১১)

যুথিকা Barua
  • ২০
  • 0
  • ৬৫
আষাঢ়-শ্রাবণ বর্ষাকাল। বর্ষাকালে বৃষ্টি হবেই। এটা প্রকৃতির অমোঘ নিয়ম। একে অবরোধ করা মানুষের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। কিন্তু কোনো আনন্দ-উৎসবের প্রাক্কালে বর্ষণের আগমন কেউই কামনা করে না। বিশেষ করে কিশোর-কিশোরী এবং যুবক-যুবতীরা। যখন মন-মানসিকতা বিষাদে ভরিয়ে দেয়। অগত্যা, সাময়িক বাধা বিপত্তি উপেক্ষা করেই প্রকৃতির নিমর্মতাকে কাঁধে চেপে বাচ্চা-বুড়ো-জোয়ান সকলেই এগিয়ে চলে যে যার আপন ঠিকানায়। নিজের গন্তব্যে।

অনেক বছর আগের কথা। সেদিন ছিল রথযাত্রা। রথযাত্রা মানেই রথের মেলা। আর রথের মেলা মানেই তালপাতার বাঁশির অপূর্ব মূর্ছণা, সূঁতোয় বাঁধা কাঠপুতুলের নাচন, ঝাল মুড়ি খাওয়া, নাগর দোলা চড়া, আরো কত কি! তখন আমাদের কত আর বয়স! প্রতিবারের মতো সেবছরও অব্যক্ত আনন্দে আমরা উৎফুল্ল হয়ে উঠি। কত আশা নিয়ে প্রস্তুতি নিয়েছিলাম, বান্ধবীদের সাথে রথের মেলা দেখতে যাবো, ঘুরবো, বেড়াবো, খুউব মজা করবো। কিন্তু সেদিন ঊষার প্রারম্ভেই হাল্কা কূয়াশায় ছেয়ে গিয়ে চারদিক নীরব, নিস্তদ্ধ। গুমোট মেঘাচ্ছন্ন আকাশ। একটু হাওয়া নেই, বাতাস নেই। পশু-পাখীর কলোরব নেই। ভাপসা গরম। সঁ্যাতসঁ্যাতে গন্ধ। চোখে দেখাই যাচ্ছিল না কিছু। অপরাহ্নেই শুরু হয় গুঁরি গুঁরি বৃষ্টি। এলোপাথাড়ী ঝড়। তখন শোচনীয় অবস্থা আকাশের। মনে হচ্ছিল, এক্ষুণিই ঝুপ্ ঝুপ্ করে বৃষ্টি নামবে। কিন্তু গ্রাহ্য করছে কে! তা উপেক্ষা করেই আমরা কিশোরীরা দলবেঁধে হৈ-হুল্লোড় করতে করতে বেড়িয়ে পড়ি রথের মেলা দেখতে। ইত্যবসরে কখন যে বিজলী চলে গিয়েছিল, আমরা কেউই টের পাই নি।

যাচ্ছিলাম শর্টকাট পথ ধরে, একটা ফুটবল খেলার মাঠের উপর দিয়ে। কিছুদূর যেতেই হঠাৎ শুরু হয় শিলাবৃষ্টি। একেবারে চাকা চাকা বরফের টুকরো। পড়ছে টপাটপ আমাদের মাথার উপর। বিড়ম্বণায় অস্থির হয়ে উঠি। কি করি! ফিরে যাবারও কোনো উপায় নেই। দৌড়ে গিয়ে ঢুকে পড়ি নিকটবর্তী একটি প্রাইমারী স্কুলের ভিতরে। তারপরই শুরু হয় মুসলধারে বৃষ্টি। যেন আকাশ ভাঙ্গা বৃষ্টি। সহসায় থামবার কোনো লক্ষণই ছিল না। সেই সঙ্গে গুড়ুম গুড়ুম মেঘের গর্জন, বিদু্যতের বাঁকা ঝিলিক। গাছের ডালপালা ভেঙ্গে মুছড়ে সে একেবারে প্রলয়ঙ্করী বেগে ছুটে চলে দ্বিগ্বিদিকে।

ততক্ষণে ভাটা পড়ে যায় আমাদের আনন্দ-উল্লাসে। শিথিল হয়ে আসে ঘুরে বেড়াবার ইচ্ছা, আবেগ, অনুভূতি। বেড়ে যায় উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা। যার জন্য আমরা কেউই প্রস্তুত ছিলাম না। তন্মধ্যে বিজলী নেই। ফলে অনিবার্য কারণে অচীরেই ঘনিয়ে আসে অন্ধকার। ভয়ে-ভীতিতে বুক ধুক্ ধুক্ করে ওঠে। গলা শুকিয়ে আসে। আকস্মিক অনাকাঙ্ক্ষিত বিরূপ পরিস্থিতির কবলে পতিত হয়ে আমরা শরণাপন্ন হই ঈশ্বরের। সুযোগের সন্ধানে প্রহর গুনতে থাকি, নিরাপদে বাড়ি ফিরে যাবার। ইতিমধ্যে হঠাৎ কর্ণগোচর হয়, মানুষের কোন্দল, কোলাহল, চিৎকার-চেঁচামিচি।

আমরা চমকে উঠি। স্কুলের জানালা দিয়ে গলা টেনে এদিক ওদিক চোখ বুলাতেই হ্যাজাক্বাতির জোড়ালো রস্মি আমাদের দৃষ্টি আর্কষণ করে। মুহূর্তের জন্য মনে হয়েছিল, যেন অথৈ জলে কিনারা খুঁজে পেলাম। দেখলাম, ঐ ফুটবল খেলার মাঠের বিপরীত দিকে অবস্থিত, একটি বিশাল দালান বাড়ির প্রাঙ্গণে প্রচন্ড ভঁীড়। লোকে লোকারণ্য। খুউব হৈ চৈ হচ্ছে। কিন্তু কোনো হেতু বোঝা যাচ্ছে না। আমরা ঘাবড়ে যাই। বিচলিত হয়ে পড়ি। ব্যাপারটা কি? কারো কোনো অঘটন ঘটল না তো! তবু বুকে সাহস এনে কারণ উদ্ঘাটনের জন্য অবিলম্বে আড়ি পেতে শোনবার চেষ্টা করি। অনুমান করে ছিলাম, নিশ্চয়ই কারো মাথায় বজ্রপাত হয়েছে।

কিন্তু না, লোকের কানাঘুষোয় অবগত হলাম, শিশু অপহরণের দায়ে একটি মহিলাকে আটক করে রেখেছে। মনে মনে ভাবলাম, এ আর নতুন খবর কি! দিনকাল কবেই বা ভালো ছিল! অহরহই তো ঘটছে! কিন্তু এমন দুর্যোগের মধ্যেও?

তবু স্বভাবসুলভ কারণে মহিলা চোরকে স্বচোক্ষে দেখবার ইচ্ছাটা আমাদের প্রবলভাবে জেগে উঠল। সম্বরণ করতে পারলাম না। বৃষ্টিটা ধরে আসতেই খানিকটা কৌতূহলে দ্রুত ছুটে গেলাম সেখানে। গিয়ে দেখি, অবাক কান্ড! সে এক নতুন বিস্ময়! একেবারে গল্প, নোবেলের মতো ঘটনা। ময়লা অপরিস্কার ছেঁড়া ফাটা বস্ত্র পরিহিতা একজন মহিলা একহাত ঘোমটা টেনে, কাঁথা জড়ানো একটি ছোট্ট শিশুকে বুকে নিয়ে একহাঁটু জলের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে।
ওর আপাদমস্তক নজর বুলিয়ে দেখলাম, ওর দুইহাত ভর্তি রং-বেরং-এর প্লাষ্টিকের চুরি। পায়ে সঁ্যাতলাপড়া হাওয়াই চটি। নোংড়া ভর্তি হাতে পায়ের বড় বড় নখ। পা-দুটোও ফুলে লাল হয়ে উঠেছে। হ্যাজাকের আলোতে যেটুকু বোঝা গেল, তাতে মনে হলো, বেশ কয়েকদিন জলে ডুবেছিল। আঙ্গুলের ফাঁকগুলিকেও জলে খেয়ে ঘা করে ফেলেছে। বিন্দু বিন্দু রক্তকণাও বোধহয় ঝড়ছিল। কিন্তু মহিলাটিকে খুব অস্বাভাবিক লাগছিল। কিছু বলবার ব্যকুলতায় কেমন অস্থির হয়ে উঠছিল। ঠোঁট কাঁপছিল। চোখদু'টোতেও অাঁতঙ্কে ভরা।
কিছু বুঝে ওঠার পূর্বেই পাড়ার মস্তান গোছের ছেলেরা উত্তেজিত হয়ে বলছে,-"ধর চুলের মুটি, বেটি দু-চার ঘা খেলেই মুখ দিয়ে অনায়াসে বুলি উতরে আসবে!"

কেউ বলছে,-"কূলটা, পাপীষ্ঠা!"

আবার কেউ বলছে,-"পালিয়ে যাচ্ছিস কোথায়? বল্ কোথা থেকে বাচ্চা চুরি করেছিস? কাদের বাচ্চা চুরি করেছিস শীগ্গিরি বল, নয়তো এক্ষুণি তোকে পুলিশে ধরিয়ে দেবো!"

পুলিশের নাম শোনা মাত্রই ভয়ার্ত দৃষ্টি মেলে মহিলাটি থর্ থর্ করে কাঁপতে শুরু করে। ভয়ে আড়ষ্ঠ হয়ে বাচ্চাটাকে শক্তহাতে বুকে চেপে ধরে। কিন্তু বিক্ষিপ্ত জনতার দল নাছোরবান্দা। মারধোর করবার হুমকি দেখায়। অশ্লীল ভাষায় গালিগালাজ করে। রীতিমতো প্রস্তুতি নিয়ে ছেলেরা তেড়ে আসতেই মহিলাটি কাঁন্ন্াজড়িত কন্ঠে চিৎকার করে ওঠে,-"আমি চোর নই বাবু! চোর নই! ও' আমারই বাচ্চা! কত্তকষ্টে নয়টামাস প্যাটে রাইখ্যা অড়ে আমি জনম দিছি! আমিই অড় মা!"

বাচ্চাটাকে সজোরে বাহুবেষ্টনে আলিঙ্গন করে ওর কপালে গালে একটা চুম্বন করে বলল,-"সংসারে আমাদের কেউ নাই গো বাবু, কেউ নাই! সব বন্যার জলে ভাইস্যা গ্যাছে! আমারে দয়া করেন!" বলতে বলতে মহিলাটি হাউ হাউ করে কেঁদে ওঠে। তারপর ধীরে ধীরে একটু একটু করে উন্মোচন হতে লাগল, ওর জীবনের করুন কাহিনী।


মহিলাটির নাম সরলা। অজ্পাড়া গাঁয়ের অতি নিম্নবিত্ত পরিবারের কূলবধূ। জরা-জীর্ণের মতো রোগা শরীর। বয়সের তুলনায় বেশ বুড়িয়ে গেছে। চোখমুখ গর্তে ঢুকে গেলেও খুটিয়ে দেখলেই বোঝা যাচ্ছিল, যৌবনের প্রাক্কালে সরলা কম সুন্দরী ছিল না। ভাগ্যের নিমর্ম পরিহাসে অনাদরে অবহেলায় ময়লার আবরণে চড় পড়ে ওর লাবণ্যময় সৌন্দর্য্য একেবারেই অদৃশ্য হয়ে গেছে। ঘটা করে না হলেও রীতিমতো পুরোহিত এনে শাস্ত্র মতেই ওর বিবাহ হয়েছিল ওদেরই পাশর্্ববতর্ী গ্রামের একটা অশিক্ষিত অসমর্থ দুর্বল লুলা ল্যাংড়া তরুণ যুবক গৌরাঙ্গের সাথে।

কথায় বলে,-"খাঁটি সোনা বেঁকে গেলেও সেটা সোনাই! তার মূল্য কখনো কমে যায় না!" তেমনি একজন পুরুষমানুষ শত কালো কুৎসিৎ কিংম্বা বিকলাঙ্গ হলেও তার পুরুষত্ব কখনোই কমে যায় না। আর গেলেও সরলার মতো মেয়ের তাতে কিইবা এসে যায়। বরং শাপে বরই হয়েছিল। আর তা'ছাড়া, বিমাতা কতৃক অমানবিকভাবে নির্যাতিত এবং লাঞ্ছিত হয়ে অধর্াহারে জীবনযাপন করার চে' লুলা ল্যাংড়া অক্ষম স্বামীর ঘর-সংসার করা ঢের ভালো। এ তো পরম সৌভাগ্য সরলার। বিধাতারও অসীম দয়া। নইলে ওর মতো অজ্পাড়া গাঁয়ের একটা ঘরকুনো আনস্মার্ট, আন্এ্যডুকেটেড্ এবং স্বল্প বস্ত্র পরিহিতা তনয়ার বিবাহ-বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া, জীবনসাথী পাওয়া, স্বামীর সোহাগী হওয়া, তার হৃদয় নিঃসৃত ভালোবাসা পাওয়া, এ কি কম সৌভাগ্যের কথা! স্বপ্নেও তো ভাবতে পারেনি কোনদিন।

গৌরাঙ্গ ক্র্যাচ্ ছাড়া চলতে পারতো না। চলার শক্তি ছিল না। ওর পা-দু'টোই অচল। জীবন ও জীবিকার তাগিদে শুধুমাত্র মৌলিক চাহিদা মেটাতেই ওকে অনেক হিমশিম খেতে হতো। তবু ওর মনের শক্তি ছিল প্রকট। অসাধারণ আত্মবিশ্বাস। ভারসাম্যহীনতায় কখনো ভেঙ্গে পড়েনি। পিছুপা হয়নি। দুঃখ-দৈনতায় তাকে কখনো ঘায়েল করতে পারেনি। বিকলাঙ্গ শরীর নিয়েই গরুর গাড়ির মতো ধিক্ ধিক্ করে ঠেলাগাড়ি টানতো। বাজারে ডাব বিক্রি করতো। বাড়িতেও হাঁস-মুরগীর পল্ট্রি খুলেছিল। সরলাই দেখাশোনা করতো। তা দিয়ে দু'জনের পেট কোনরকমে চলে যেতো। কোনদিন অর্ধাহারেও কাটাতে হতো। তবু কোনো অসন্তোষ, অভিযোগ কিচ্ছু ছিল না। ছিল সুখ, শান্তি। ছিল সরলার অনাবিল মুখের অনিন্দ্য সুন্দর হাসি। যা কখনোও ম্লান হতো না। বাস করতো, খড় -কূটোর ছাউনি দেওয়া ছোট্ট একটি মাটির ঘরে। যেখানে প্রত্যেক বছর বষর্ার জলে ধস্ নেমে গৃহহীন হয়ে পড়ে গ্রামের শত শত অসমর্থ দুর্বল মানুষ। মারাও যায় অনেকে। আর যারা না মরে অর্ধমৃত অবস্থায় বেঁচে থাকে, তারা সর্বস্ব নিঃশ্ব হয়ে এতিমের মতো অন্ন-বস্ত্র এবং আশ্রয়ের সন্ধানে হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়ায় পথেঘাটে, রাজ্যের অখ্যাত কুখ্যাত অলিতে গলিতে, শহরের জনপথে। যারা আমাদের সুশীল সমাজে আজও নিগৃহীত, নির্যাতিত, লাঞ্ছিত, অবহেলিত এবং নিপীড়িত। যাদের নিজস্ব মাটিতে মেরুদন্ড সোজা করে শক্তপায়ে দাঁড়াবার ক্ষমতা থাকে না। আত্মরক্ষা করে শহরের ফুটপাতে কিংবা মফঃস্বল অঞ্চলের নিকটবতর্ী খাল-বিল -নদী-নালার সংলগ্ন এলাকায় গাছের ছালবাকল কিংবা ছেঁড়া বস্তায় ঘেরা পাখীর বাসার মতো ঘুপচি ঘরের কোণে। মূলতঃ যারা মনুষ্যকূলে জন্ম গ্রহণ করেও মানবাধিকার থেকে বঞ্চিত। ভাগ্যবিড়ম্বণায় যাদের পদে পদে অপদস্থ হতে হয়, তিরস্কার, গঞ্জনা শুনতে হয়। যারা দেশের অতি নগণ্য, দেশের নাগরীক হিসেবে কখনো বিবেচিত হয় না। তারা কিভাবে জীবনযাপন করে, জীবিকা নির্বাহ করে, পেটের ক্ষিদে মেটায়, কেইবা রাখে তাদের সে খবর! যেখানে প্রতিনিয়ত প্রবঞ্চিত, লাঞ্ছিত ও নিপীড়িত হয় গৃহহীন, আশ্রয়হীন, সম্বলহীন অগণিত অভূক্ত মানুষের জীবন। যা স্বচোক্ষে না দেখলে গহীন অনুভূতি দিয়ে তা কখনো উপলদ্ধি করা যায় না।


সেবার প্রবল বর্ষণ ও ঝড়-তুফানে সরলার স্বামী, ঘর-সংসার, হাঁস-মুরগী সব জলে ভাসিয়ে নিয়ে যায় অনিশ্চিত মোহনার দিকে। তারা জীবিত না মৃত, তা সরলার জানা নেই। কথায় বলে, -"চাচা, আপন পরাণ বাঁচা!"

বন্যার জলে ভয়ঙ্কর বিপদগ্রস্থ সরলার ভালোবাসার মাটির প্রাসাদখানি যখন টলমল অবস্থা, তখন মন-মানসিকতা ওর প্রতিবন্ধি হয়ে পড়ে। ন্যায়-অন্যায়, বিচার-বিবেচনা করবার মতো কোনো শক্তিই তখন ওর ছিল না। যখন আসন্ন বিপর্যয়ের সম্মুখে পালিয়ে যাওয়াই ছিল সরলার একমাত্র বাঁচবার পথ। নতুবা মৃতু্য অবধারিত।

সরলা নিরুপায় হয়ে সদ্য নবজাত শিশুকে বুকে আলগে একটি কাপড়ের পোটলা সঙ্গে নিয়ে, স্বামী, ঘর-সংসার এবং ওর বৈবাহিক জীবনের বিশ্বাস-ভালোবাসার সকল বন্ধন ছিন্ন করে ওর ছোট্ট ঘুপচী ঘর ছেড়ে নিঃশব্দে বেরিয়ে আসে বাইরের পৃথিবীতে। যে ঘরে জন্ম নিয়েছিল সরলার প্রথম প্রেম, ভালোবাসা। কত আশা বুকে বেঁধে সাজিয়ে ছিল ওর নতুন সংসার। গড়ে তুলেছিল স্বর্গসুখ। কত না স্বপ্নীল আকাঙ্ক্ষা সঞ্চিত করে রেখেছিল ওর মনের মণিকোঠায়। যা ভাগ্যবিড়ম্বণায় অবাঞ্ছিত, অর্থহীণ মনে হতেই হারিয়ে ফ্যালে মনের শক্তি। যখন জীবনের নিষ্ঠুর পরিণতির পূর্বাভাষে বোধগম্য হয়েছিল, প্রকৃতির নিষ্ঠুর নিমর্মতায় আজই বন্যার জলে ভেসে যাবে ওর সাজানো সংসার। ভেসে যাবে ওর দেবতূল্য স্বামী গৌরাঙ্গ। যার ছুটে পালাবারই ক্ষমতা নেই। ওকে যে কোথায় ভাসিয়ে নিয়ে যাবে, কোনো নিশানাই পাওয়া যাবে না। হয়তো লেপটে থাকবে গাছের লতাপাতার সাথে। হয়তো বা দম অাঁটকে সেখানেই মরে পড়ে থাকবে। যাকে শনাক্ত করা কিংবা জীবিত না মৃত তা অনুসন্ধান করবার মতো কোনো সুযোগই আর থাকবে না। হয়তো কোনদিনও আর দেখা হবে না গৌরাঙ্গের সাথে। কখনো জবাবদিহীও আর করতে হবে না। আজই ওর শেষ দেখা।

আশা করেছিল, শহরে এসে কূল-কিনারা একটা নিশ্চয়ই খুঁজে পাবে। মাথা গোঁজার মতো একটুখানি আশ্রয় কোথাও না কোথাও নিশ্চয়ই জুটে যাবে। কোলের সন্তানই ওর একমাত্র সম্বল। যার মুখ চেয়ে জীবনের দুঃখ যন্ত্রণা সব ভুলে যাবে। ভুলে যাবে ওর অতীত। ভুলে যাবে স্বামী গৌরাঙ্গকেও। দুঃখই যার নিত্যসঙ্গী, প্রতিদিনকার খোরাক, লোকের বাড়ি বাড়ি ঝি-কাজ করে অনিশ্চিত জীবনের বাকী দিনগুলি সে নিশ্চয়ই কাটিয়ে দিতে পারবে। কিন্তু মুখে বলা যতটা সহজ, বাস্তব ততই কঠিন।

বলতে বলতে বিকলাঙ্গ স্বামী গৌরাঙ্গের অসহায় মুখখানা চোখের পদর্ায় ভেসে উঠতেই বেদনায় বুকটা মোচড় দিয়ে ওঠে সরলার। হঠাৎ শোকে বিহ্বলে দুইহাতে বুক চাপড়াতে চাপড়াতে বিলাপ করে ওঠে,-"আমি তারে একেলা ছাইড়্যা আইছি। পারি নাই রক্ষা করতে। আমি যে বচন দিছিলাম, সারাজীবন তার পাশে থাকুম, আপদে বিপদে তারে দেখুম, রক্ষা কুরুম। আমি পারি নাই তারে বাঁচাইতে, রক্ষা করতে। আমি বড়ই নিষ্ঠুর, স্বার্থপর। আমারে ক্ষমা করো প্রভু, ক্ষমা করো। আমার বাচ্চাটারে বাঁচাও। অড়ে দয়া করো। আমারে পথ দেখাও।"

কিন্তু সঠিক পথ ওকে দেখাবে কে? সেদিনকার মতো সাময়িক আশ্রয় পেলেও রাতের গভীর নিশি পোহায়ে দিগন্তের প্রান্তরে উষার প্রথম সূর্য্যের সি্নগ্ধ কোমল আলো উদ্ভাসিত হবার পূর্বেই সরলাকে নিরাশ হয়ে শূন্য হাতে বিদায় নিতে হয়েছিল। কোনো সাহায্য, সহানুভূতিই ওর ভাগ্যে জোটে নি। কিন্তু বিপন্ন জীবন নদীর স্রোতের টানে ওযে কোণ্ মোহনায় গিয়ে অাঁটকে আছে, কিভাবে যে জীবিকা নির্বাহ করছে, তা কেউই জানে না। জানবার প্রয়োজনও মনে করেনি। তার কারণ আমাদের সমাজ বড়ই কঠোর, নিষ্ঠুর। কোনপ্রকার অনুদান কিংবা আর্থিক সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে আমরা সকলেই কুণ্ঠিতবোধ করি, পিছুপা হই। যার ফলে সরলার মতো শত শত গৃহহীণ আশ্রয়হীণ সম্বলহীন অসহায় গরীব মানুষেরা আমাদের সমাজে আজও প্রবঞ্চিত, নিগৃহীত। যারা প্রতিদিন প্রতি মুহূর্তে নিমর্মভাবে জীবন পাত করে চলেছে। যারা পেটের দায়ে নিজের মান-ইজ্জত বির্সজন দিয়ে শহরের অখ্যাত কুখ্যাত পল্লীর অলিতে গলিতে বসে ভিক্ষে করছে। কেউ লোকের এঁঠো বাসন, হান্ডি-পাতিলা ধুয়ে মেজে অন্ন যোগাচ্ছে, দু'বেলা পেট ভরছে। কেউ কূলি বিত্তি করে পাখীর ছানার মতো নিজের সন্তানের মুখে আহার তুলে দিচ্ছে। আর কেউ কেউ অর্থের বিনিময়ে নিজেকেই বেঁচে দিচ্ছে দয়া-মায়াহীন, হৃদয়হীন নিষ্ঠুর পাষন্ডের হাতে। কি হবে এদের ভবিষ্যৎ? কে দেবে এদের সাহারা? কে নেবে এদের দায়িত্ব? কি হবে এদের পরিণাম? যার কোনও নিশ্চয়তা নেই।

অতঃপর, সেদিন রথের মেলায় আমাদের আর যাওয়া হয় নি। মুহূর্তের জন্য মনে হয়েছিল, এতক্ষণ আমরা ছবিঘরে বসে সোনালী পর্দায় সরলার জীবন কাহিনীর জীবন্ত প্রতিঃচ্ছবি প্রদর্শণ করছিলাম। ততক্ষণে চারিদিকে ঘন অন্ধকারে ছেয়ে গেছে। ঝিঁ ঝিঁ পোকা ডাকছে। জোনাকীরা উড়ছে। গর্তের ব্যাঙগুলি বাইরে বেরিয়ে এসে গঁ্যাঙর গঁ্যাঙর করে ডাকছে। কিন্তু সরলার, যে এক অসহায় সম্বলহীন, আশ্রয়হীন স্বজনহীন মায়ের বুকের ব্যথার গভীরতা সেদিন নিজের অনুভূতি দিয়ে অনুভব করতে না পারলেও কিঞ্চিৎ মন বেদনায় আচ্ছন্ন হয়ে বিষন্ন মুখে ফিরে এলাম বাড়িতে। বাড়িতে ঢুকতেই ঢং ঢং করে বেজে ওঠে ঘড়ির ঘন্টা। চোখ তুলে তাকিয়ে দেখি, রাত তখন দশ'টা বাজে। ফলে অনিবার্য কারণবশতঃই বাড়ির অভিভাবকের বৈধ শাসন, শিক্ষা এবং তাদের অন্তর্নিহীত প্রতিক্রিয়াও নীরবে হজম করতে হয়েছিল। কিন্তু সেইরাতে দু'চোখের পাতা কিছুতেই আর এক করতে পারিনি। পারিনি মন থেকে তা অপসারিত করতে। মনের অগোচরেই এক ধরণের বেদনাময় অনুভূতির তীব্র দংশণ নদীর ঢেউ-এর মতো বার বার আমার মস্তিস্কের স্নায়ূকোষে এসে লাগছিল।

তারপর রথের মেলা কতবার এলো আর গেল। আর প্রত্যেক বছরই রথযাত্রা এলেই আমার চোখের পর্দায় জীবন্ত হয়ে ভেসে ওঠে, অতীতের সেই দৃশ্যপটের নিরাশ্রয় নিঃসম্বল অভাগিনী জননী সরলার তীব্র আকুতি, মিনতি। কানে বাজে ওর ক্রন্দন, বিলাপ, আর্তনাদ। যেদিন নিজে মা হলাম, সেদিন শরীরের সমস্ত অনুভূতি দিয়ে গভীরভাবে অনুভব করেছিলাম, সর্বহারা সরলার বুকের ভিতরে লালিত সেই কঠিণ যন্ত্রণা। যা আজও আমাকে কাঁদায়, পীড়া দেয়। যা কোনদিনও ভোলবার নয়।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
Arup Kumar Barua গল্পের বুনন ভালো | আরো বেশি ভালো লেখা চাই |
শাহ্‌নাজ আক্তার সরলাদের মত কত জীবন যে সমাজের আশেপাশে রয়েছে , তা আমরা কখনো জানতে ও চাইনি ,, সুন্দর গল্প , হৃদয় বিদারক ,, যারপরনাই কষ্ট লাগছে সরলার জন্য ,, কারণ আমি তো সরলার মতই নারী , এবং মা .....
শামীম আরা চৌধুরী হৃদয় বিদারক। মর্মস্পর্শি একটি কাহিনী। ধন্যবাদ লেখকে
bijoy খুব সুন্দর। ভোট দিলাম।
মামুন ম. আজিজ পছন্দের তালিকায় যুক্ত করলাম। একটানা বলে যাওয়া বর্ননা ধর্মী। এ কারনেই হয়তো মুকুল ভাই বলছেন পাঠক ধরে রাখার মত উপাত্ত নেই। ..কিন্তু যারা বোঝে তারা বোঝে বড় গল্পতো নর‍্যারেটিভই তো হয়। .....শূভ কামনা।
sakil সরলার কাহিনী অনেক রিদয়্বিদারক এবং মর্মস্পর্শী . বেশ সুন্দর গল্প . সেই প্রথম থেকে দেখে আসছি আপনি প্রতি সংখায় লিখে আসছেন . আর হা একদিন আপনার জয় হবে এটা আমি বলতে পারি নিশ্চিন্তে . শুভকামনা রইলো .
বিন আরফান. রথ মেলায় যাওয়ার মজাই আলাদা. আমি প্রতি বছর ই যাই. গাজীপুর রথ মেলায়. এবারেও গিয়েছিলাম গত মাসে. আর সিলেটের শিব বাড়িতেও রথ মেলায় গিয়েছিলাম কয়েক বার. গল্পটি এবারের রথ মেলায় আমার ভ্রমণের সাথে শতভাগ মিলেছে. যেহেতু অতীত কালের ঘটনা নিয়ে লেখা সেহেতু টেন্স প্রয়োগে কিঞ্চিত ভুল ছিল. এছাড়া দারুন. চালিয়ে যান. অসাধারণ ও হয়েছে বটে.
যুথিকা Barua মিজান ভাই, আপনাদের সুন্দর সুন্দর মন্তব্যেই আমি খুশী.. .আমার লেখাটি আপানদের সকলের ভালো লেগেছে জেনে আমারও খুব ভালো লাগছে.. সেই সঙ্গে প্রজাপতি, আমার আমি এবং হালিম ভাইকেও জানাই অনেক অনেক ধন্যবাদ...আমার শুভেচ্ছা রইলো..
প্রজাপতি মন তারপর রথের মেলা কতবার এলো আর গেল। আর প্রত্যেক বছরই রথযাত্রা এলেই আমার চোখের পর্দায় জীবন্ত হয়ে ভেসে ওঠে, অতীতের সেই দৃশ্যপটের নিরাশ্রয় নিঃসম্বল অভাগিনী জননী সরলার তীব্র আকুতি, মিনতি। কানে বাজে ওর ক্রন্দন, বিলাপ, আর্তনাদ। যেদিন নিজে মা হলাম, সেদিন শরীরের সমস্ত অনুভূতি দিয়ে গভীরভাবে অনুভব করেছিলাম, সর্বহারা সরলার বুকের ভিতরে লালিত সেই কঠিণ যন্ত্রণা। যা আজও আমাকে কাঁদায়, পীড়া দেয়। যা কোনদিনও ভোলবার নয়। অসাধারনভাবে ফুটিয়ে তুললেন সরলা আর তার জীবনের করুন কাহিনী. ভালো লাগলো এই প্রয়াস . শুভকামনা রইলো.
amar ami তবু বিশ্সাস এই সরলাদের জায়গা করে দিয়ার মত কিছু মানুষ আছে, যেমন আপনি সরলাকে রেখেছেন গল্পে ..

২৫ এপ্রিল - ২০১১ গল্প/কবিতা: ৯ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "স্থিতিশীলতা”
কবিতার বিষয় "স্থিতিশীলতা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪