একটা ক্ষুধার্ত অন্ধ ভিখারি। ভিক্ষার আশায় পথচারীর দৃষ্টি তার দিকে ফিরাবার জন্য কাতর চিৎকার করছিল। কেহ অন্ধের, কাতরে চিৎকার শুনে করুণা করে তাকে কিছু দিল, কেউ বা অনিচ্ছা স্বত্বেও পকেট হতে একটা পয়সা বাহির করে অন্ধের হাতে দিয়ে আপন পথ ধরল।
অন্ধের মুখ থেকে একই সুরে বার বার ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হতে লাগল-
-একটা পয়সা দিন না!...একটা পয়সা দিন না!....কে যাচ্ছেন? একটা পয়সা দিন না!
অন্ধ যুবক। বয়স অনুমান বাইশ বৎসর। মাথা ভরা ঝাঁকড়া চুল। মুখমণ্ডলে এখনও কিছুটা লাবণ্য রয়েছে। জমিদারের পূর্বের ঐশ্বর্য নষ্ট হয়ে গেলেও তার প্রাসাদটা যেমন পথিকের দৃষ্টিতে পড়ে স্মরণ করে দেয় এটাই জমিদারের বাড়ী, প্রসাদের বিশালতা যেমন মনে করে দেয় জমিদারের বংশধরেরাও জমিদার- অর্থাৎ জমিদারের ভিত্তির উপর দণ্ডায়মান, ক্ষীয়মাণ ঐশ্বর্য যেমন শুধু দণ্ডটাই রেখে যায়,তেমনি এই ভিখারির চেহারাটাও ক্ষুধায়, অত্যাচারে নষ্ট হয়ে গেলেও সূর্যের শেষ রশ্মিটুকুর ন্যায় তার চেহারা ক্ষীয়মাণ সৌন্দযও মনে করে দেয় যে, সে একদিন লাবণ্যময় ছিল। আল্লাহ এই চেহারায় সমস্ত সৌন্দর্যই দিয়েছেন আবার তা কেড়ে নিয়েছেন।
অন্ধের দিকে তাকালে সময় সময় কোন পথিকের মনে হয়, এ হয়তো কোনো জমিদার বা কোনো উচ্চবংশের ছেলে। আবার ভিখারির অসহায় মূর্তির কথা মনে করে, পূর্বের ভাবলক্ষণের জন্য পথিকের মনে হাস্যের খোরাক যোগাড় করে দেয়; ভাবে! ভিখারি কি কখনও জমিদার হতে পারে?
একটা গাছের নিচে ভিখারির আস্তানা। সামনে একটা ছেঁড়া চাঁদর পাতা, আর এখানেই তার বাসস্থান। খাওয়া-দাওয়া যা কিছু এখানেই হয়, আর দিনশেষে এখানেই হয় তার শয়ন। এমনই ভিখারিদের অবস্থা, তাতে সে আবার অন্ধ, অন্ধের সহায় এই জগতে কেহ নয়। সবাই করে ব্যঙ্গ; দয়া কেহ করে না। অন্ধ তখন ক্ষুধায় করুন স্বরে বলছে-
-একটা পয়সা দিন না!...একটা পয়সা দিন না!....কে যাচ্ছেন? একটা পয়সা দিন না!
তখন একজন অন্ধের কাছ দিয়ে যাচ্ছিল। তার কাতর চীৎকারে বিরক্ত হয়ে বললেন-
-জোয়ান ছেলে ভিক্ষা করছ কেন? খেটে খেতে পার না?
-আমি যে, অন্ধ!
-ও অন্ধ! তবে আর বেঁচে আছো কেন, নদীতে ডুবে মরতে পার না? তবে তো সকল সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। অন্ধ হয়ে বেঁচে থাকার এত সাধ কেন?
বলতে বলতে মুখ ভেংচাইয়া পথিক নিজের পথ ধরল।
অন্ধ একটা কাতরোক্তি করল- অন্ধ জনের ক্ষুধা কষ্টের কথা কেউ ভাবেনা..!
তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে পুনরায় কাতর স্বরে বলতে লাগলো-
-একটা পয়সা দিন না!...একটা পয়সা দিন না!....কে যাচ্ছেন? একটা পয়সা দিন না!
কেহ বা পয়সা দিল, কেহ বা ব্যঙ্গ করলো। অন্ধ নিবিকারচিত্তে একটানা 'একটা পয়সা দিন না; কাতর চিৎকারে অন্তরের করুন স্বরে আবেদন জানাতে লাগল। একটা লোক সেখান দিয়ে যাচ্ছিল। সে অন্ধকে দেখে বললো-
-তোমার নাম কি?
নাম জিজ্ঞাসা করাতে চমকিত হয়ে অন্ধ বললো-
-কেন বলুন তো?
লোকটি বললো - শহরে গিয়ে ভিক্ষা কর, অনেক পয়সা পাবে।
শহরের কথায় অন্ধের মুখ যেন কোন এক আলোকে উদ্ভাসিত হয়ে উঠল। সে বললো-
-নিয়ে যাবেন আমাকে?
অন্ধের কথায় বিরক্ত হয়ে পথিক বলল-
-বড় আমার নবাব পুত্তুর, ওকে হাত ধরে নিয়ে যাব; কেন পথ চিনে যেতে পার না?
মনে আঘাত পেয়ে অন্ধ বলল-
-আমি যে অন্ধ!
লোকটি বলল
-কত অন্ধ শহরে যায় আর তুমি যতে পার না?
অন্ধ বলল-
-আমি যে পথ চিনি না!
-পথ চেন না, তবে মর।
বলে পথিক পথ ধরল। অন্ধের মনে হল, আজ যেন কার মুখ দেখে উঠেছি, বারবারই কেবল আজ গঞ্জনা মিলছে। আবার প্রোক্ষণেই,'আমি যে অন্ধ, আমি আবার কার মুখ দেখে উঠবো' এই কথা মনে করে মনে মনে সে তিক্ত হাসি হেসে উঠল।
ধীরে ধীরে জনবহুল পথ জনবিরল হয়ে উঠল। পথিকের পদধ্বনি ক্রমে ক্রমে বিরল হয়ে আসলো, আর তাই শোনা যায় না। ক্ষুধায় অন্ধের কণ্ঠস্বর ধীরে ধীরে ক্ষীয়মাণ হয়ে আসলো।
'একটা পয়সা দিন'-ধ্বনি সত্দব্ধ হয়ে গেল। অন্ধ চুপ করে রইল। বুঝি কোন পথিকের পদধ্বনি শোনা যায়। অন্ধ একবার হাত বারিয়ে বলল-একটা পয়সা দিন না! উত্তর আসিল-পয়সা কি গাছের ফল? অন্ধ চুপ করে রইল। পদধ্বনি দুরে মিলে গেল।
অন্ধ ফিরে এল তার আস্তানায়, সেই বৃক্ষের নিচে। অন্ধ তখন বৃক্ষকে জড়িয়ে ধরে বলতে লাগল-তুমি আমার বন্ধু, তোমার তলায় আমি আশ্রয় পেয়েছি। কত দুঃখে তোমার কাছে এসেছি তাতো কেউ জানে না, কেউ তো তা বুঝে না, কেউ বুঝতেও চায় না।
১৯ এপ্রিল - ২০১১
গল্প/কবিতা:
৫ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ ডিসেম্বর,২০২৪