স্যার ক্লাসে হোম ওয়ার্ক দিয়েছেন। দাওয়ায় বসে তা-ই পড়ছিল অয়ন। ইলেক্ট্রিসিটি নেই, চার্জর লাইটের আলোয় অয়ন গুনগুন করে মুখস্থ করছিল - "তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে। মনে রেখ; এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।" সমগ্র দেশবাসীর উদ্দেশ্যে পল্টন ময়দানে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দেয়া ভাষণে উজ্জীবিত হয়ে দেশের সকল শ্রেণীর মানুষ পাক হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে.... পড়তে পড়তে থেমে যায় অয়ন। বারান্দায় বাবার কিছুটা উত্তেজিত গলা শোনা যায়। "এই সরকার আইস্যা দ্যাশে যে কী শুরু করছে! হিস্টোরি বানাবার লাগছে। ক্যান, মজিব কি এ্যাকলাই দ্যাশ স্বাধীন করছিল? দ্যাশের মানুষ যুদ্ধ করে নাই? তিরিশ লাখ মানুষ মরে নাই?" "হ, দ্যাশটারে মগের মুল্লুক বানাইছে। এমন কইর্যা হিস্টোরি বানাইছে! পোলাপাইনেরা কি শিখবো আল্লাই জানে।" রান্নাঘর থেকে কথা ধরেন মা। মুহূর্তের জন্য হলেও ভাবনার দোলাচলে পড়ে যায় ছোট্ট অয়ন। দুই উৎস থেকে তথ্য আসছে তার কাছে। কিন্তু কোনটা যে ঠিক তা ঠিক বুঝে উঠতে পারেনা। অয়ন ছোট হলেও বঙ্গবন্ধু যে দেশ স্বাধীনের ডাক দিয়েছিল তা সে কয়েকবার শুনেছে অনেকের কাছ থেকে। আর বইয়ে তো সেই কথাই লিখেছে। কিন্তু বাবার কথা শুনে মনে হয়না বাবা বইয়ের কথা সমর্থন করে। তাহলে কোনটা ঠিক? বই নাকি বাবা? দুটোই তো কখনো ঠিক হতে পারেনা। হয় এটা ঠিক হবে নয়তো ওটা ঠিক হবে। কিছুক্ষণ ভাবে অয়ন। তারপর আবার পড়ায় মন দেয়। কারণ পড়া করে যেতে না পারলে স্যার পিঠের ছাল তুলবেন। আবারো গুনগুন করে মুখস্থ করতে শুরু করে অয়ন। কিন্তু প্রশ্নটা তার কাছে প্রশ্নই থেকে যায়। পরদিন সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে আবার পড়তে বসে অয়ন। একটা রচনার অর্ধেক মুখস্থ করতে হবে। রচনার নাম "প্রত্যূষে শয্যা ত্যাগ"। মুখস্থ করতে করতে হঠাৎ খটকা লাগে অয়নের। আচ্ছা "প্রত্যূষে শয্যা ত্যাগ" মানে কী? সামনে পেয়ে যায় আপুকে। ওকেই জিজ্ঞেস করে। "আচ্ছা আপু প্রত্যূষে শয্যা ত্যাগ মানে কী?" " "প্রত্যূষে শয্যা ত্যাগ" মানে সকাল সকাল ওঠা।" আপু কর্কশ করে উত্তর দেয়। সকালবেলা উঠতে দেরি হওয়ার কারণে মা বকাঝকা করছিল। সাথে আপুও ছিল। অয়ন মনে করে সকালবেলা উঠতে দেরি করেছে এ জন্যই ওকে এরকম একটা মানে বলেছে আপু। আসলে "প্রত্যূষে শয্যা ত্যাগ" মানে অন্য কিছু। হঠাৎ আরেকটা প্রশ্ন এসে অয়নের মাথায় উদিত হয়। " আচ্ছা আপু বঙ্গবন্ধু কি দেশ স্বাধীন করেনি?" " বঙ্গবন্ধু দেশ স্বাধীন করছে না কেডায় করছে আমি তার কি জানি। আমি কি ঐ সময় হইছিলাম নাকি।" আপুর আবার ঝাঁঝালো উত্তর শুনে থেমে যায় অয়ন। আর কোন কথা বলতে সাহস পায় না। আবার পড়া মুখস্থ করতে শুরু করে- গুনগুন-গুনগুন। ক্রমে সময় চলে যেতে থাকে। অয়নও ওর মত বড় হতে থাকে। ক্লাস ফাইভ পাশ করে সিক্স পেরিয়ে সেভেনে ওঠে। এর মাঝে নতুন সরকার এসেছে। ঢেলে সাজানো হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস। পাঠ্যবইয়ে তা সংযুক্তও করা হয়েছে। সভ্যতার নির্মম শিকার হিসেবে সেটাও পড়তে হচ্ছে এখন অয়নকে। এখন সে পড়ছে," আমি পশ্চিম পাকিস্তানের আক্রমণের বিরুদ্ধে সকল বাঙ্গালীদের জেগে ওঠার আহ্বান জানাচ্ছি। আমাদের মাতৃভূমিকে স্বাধীন করতে আমরা শেষ পর্যন্ত লড়ে যাব। আল্লাহ সহায় হলে বিজয় আমাদের হবেই, জয় বাংলা।" শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের এই উদাত্ত আহ্বানে সাড়া দিয়ে দেশের সকল শ্রেণীর মানুষ যুদ্ধে নেমে পড়ে..... এবার আরও অনেক বেশি দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়ে অয়ন। সেই যখন ক্লাস ফাইভে পড়তো তখন সে জেনেছে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস। তখন তো ইতিহাসটা এমন ছিলনা। এবার সে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের সাথে সাথে পাঠ্যবইয়ের ব্যাপারেও দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। প্রশ্ন জাগে মনে তাহলে কি বইয়েও ভুল লেখে? ছোট হলেও ও এতটুকু বুঝতে পারে একই সাথে সবগুলোই কখনো সত্য হতে পারে না। যে কারণে ও বুঝতে পারেনা ক্লাস ফাইভে যেটা পড়েছে সেটা সত্য নাকি এখন যেটা পড়ছে সেটা সত্য। পুরনো স্মৃতিটা আবার ওর মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। বাবাও সেদিন ঝেড়ে কেশে উঠেছিল। নাকি তাহলে ওর বাবার কথাই ঠিক। ছোট্ট অয়ন এতগুলো প্রশ্নের জট খুলতে পারেনা। বাধ্য হয়ে এবার ওর স্যারকে প্রশ্ন করে বসে। "স্যার.....দেশ স্বাধীন করছে কে স্যার? শেখ মুজিব না জিয়াউর রহমান স্যার...?" অয়ন যে স্যারকে প্রশ্ন করেছে তিনি বাংলা ক্লাস নিলেও স্বয়ং মৌলভী। অয়নের প্রশ্ন শুনে তিনিও খেঁকিয়ে ওঠেন। "হ্যাগোর মাথায় যে কী পোকা উঠলো দ্যাশ স্বাধীন করবো। ক্যান ভালা আছিলাম না আমরা! চাল- চিনি সব কম দামে পাইতাম। অহন সব জিনিসের দাম বেশি। কাম পায়নি বিধর্মীগোরে লইয়া দ্যাশ স্বাধীন করলো। খালি খালি দ্যাশ স্বাধীন কইর্যা মুজিবও মরলো জিয়াও মরলো।" "স্যার তাইলে দেশ কে স্বাধীন করছে?" আবার প্রশ্ন করার ঝোঁক সামলাতে পারেনা অয়ন। "থাম---তোর অত বোঝন লাগবোনা। বইতে যা আছে তা-ই পড়।" অয়ন রীতিমত দিশেহারা হয়ে পড়ে। আগে শুধু প্রশ্ন ছিল কে দেশ স্বাধীন করেছে শেখ মুজিব নাকি জিয়াউর রহমান। এখন সেখানে নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে - দেশ স্বাধীন করাই নাকি ভুল হয়েছে। আরেকটা প্রশ্ন আছে - স্যার যে বিধর্মীদের কথা বললেন তারা কারা। আবার সেদিন সন্ধ্যার পর দোকানে গিয়েছিল যখন তখন রেডিওতে শুনে লোকজনদের বলাবলি করতে শুনেছিল - বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব নাকি গোপনে স্বাধীনতার বিরোধীটা করেছিল। অনেকগুলো উৎস থেকে আসা অনেকগুলো তথ্যে বিভ্রান্ত অয়ন বোঝার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে কে দেশ স্বাধীন করেছিল আর দেশ স্বাধীন করাই বা ঠিক ছিল কি-না। টিফিনের পর একটা ক্লাস শেষ হয়েছে মাত্র। এমন সময় স্কুল মাঠের দিক থেকে হই-হই শোনা যায়- "মুক্তিযোদ্ধা আইছে, মুক্তিযোদ্ধা আইছে।" অয়ন এখনও কোনদিন মুক্তিযোদ্ধা দেখেনি। হই-হই শুনে সাথে সাথে দৌড় মারে অয়ন মুক্তিযোদ্ধা দেখার জন্য। হেড স্যারের অফিস রুমের সামনে সবাই জটলা করে আছে। ভিড় ঠেলে অয়ন সামনে গিয়ে যাকে দেখল তাতে মুহূর্তেই ওর চোখে পানি চলে এল অজান্তেই। বারান্দায় জবুথবু হয়ে নোংরা লুঙ্গি আর আধা ছেঁড়া পাঞ্জাবী পড়ে বসে আছে একজন বৃদ্ধ লোক। একটা পা নেই। কাছেই পড়ে আছে ক্র্যাচ। নাতনীর বিয়ে দিতে পারছে না টাকার অভাবে। তাই এসেছে সাহায্য চাইতে। আর কান্না জড়ানো গলায় হেড স্যারকে উদ্দেশ্য করে বলছে," মাস্টার সাব হ্যারায় কয় আমি নাকি মুক্তিযুদ্ধ করিনাই। আমি নাকি মিছাই নিজেরে মুক্তিযোদ্ধা কই। তাইলে কন মাস্টার সাব আমার এই পা-ডা, এই পা খান গেল কই। আপনে কন মাস্টার সাব।" পকেটে দশটা টাকা ছিল। সেটা বের করে লোকটার হাতে দিয়ে ভীড় থেকে বের হয়ে আসে অয়ন। ওর মাথায় একটি নতুন প্রশ্ন বিদ্ধ হয়েছে। ওর নানীর কাছে একবার শুনেছিল - যারা ভাল কাজ করে খোদা নাকি তাদের সুখে রাখেন, ভাল রাখেন। আর যারা খারাপ কাজ করে খোদা নাকি তাদের উপর বালা-মুছিবত দিতেই থাকেন। ও অনেকের মুখে শুনেছে যুদ্ধের সময় ওর দাদা নাকি রাজাকার ছিল। এখন ওর দাদা তো অনেক ভাল আছে। পুরো গ্রামের মানুষ ওর দাদাকে মান্য করে। ওর দাদাকে ছাড়া সালিশ-দরবারই হয় না। আবার অর্থ-সম্পদও ওদের কম না। ওর দাদা যদি রাজাকারই হয় তাহলে ওর দাদা এত ভাল আছে কিভাবে? আর এই লোকটা যদি মুক্তিযোদ্ধাই হয় তাহলে তার এমন দশা কেন? এত কষ্ট কেন তার? আবার দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়ে অয়ন। আবারো ও ঠিক বুঝে উঠতে পারে না কে তাহলে মুক্তিযোদ্ধা আর কে তাহলে রাজাকার।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
মোঃ শামছুল আরেফিন
গল্পটি ভাইয়া গত মার্চ মাসেও পড়েছিলাম। তখনই মনকে অনেক আলোড়িত করেছিল। এখন আবার যখন পড়লাম তখন ও তার কমতি ছিল না। আমাদের নতুন প্রজন্মকে সত্যের পথে নিয়ে যাওয়ার জন্য এই গল্পটি বড় একটু উপহার। হ্যাঁ ভাইয়া স্বাধীনতার সঠিক ইতিহাস জানা এবং তা নতুন প্রজন্মকে জানানোর মিছিলে আমি আপনার সাথে আছি ইনশাল্লাহ।
নাজমুল হাসান নিরো
@মো: শামছুল আরেফিন - লেখাটি পড়ে মন্তব্য করার জন্য অনেক ধন্যবাদ কিন্তু স্বাধীনতার সঠিক ইতিহাস জানা এবং তা নতুন প্রজন্মকে জানানোর মিছিলে আপনি আমার সাথে আছেন তো?
মোঃ শামছুল আরেফিন
স্বাধীনতার সঠিক ইতিহাস নিয়ে নবীন প্রজন্মের মাঝে যে দ্বিধা কাজ করছে তা খুব সুন্দর ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন।এই রকম একটি লেখার প্রয়োজন ছিল।ধন্নবাদ।ভাল লাগল অনেক।
ভূঁইয়া মোহাম্মদ ইফতেখার
নাজমুল ভাই, অনেকেই যা করতে পারেনি, আপনি তা করে দেখিয়েছন। চরম সত্যটি উঠে এসেছে আপনার গল্পে। সত্যি কথা বলতে আমরা ছোটবেলা থেকেই এমন এক পরিবেশে বড়ো হই যেখানে নিজের মতামত ও ধ্যান-ধারণাকেই কেবল গুরুত্ব দিতে শেখানো হয়- হোক তা সঠিক কিংবা ভুল। আর প্রতিযোগিতার বাজারে টিকে থাকতে অপরকে যতো পারো খাটো করো- আমরা মূলত এই নীতিতে বিশ্বাসী। আপনার গল্পে যে চিত্রটি ফুটে উঠেছে তা এই জাতীয় চেতনারই ফসল।
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।