ব্যাপারটা প্রথমে এরকমই ছিল। সকলে ধারনা করেছিল রাচু খন্দকার সাপের কামড়েই মারা গেছে। কিন্তু গোল বাধল তখনই, যখন লাশ ধোয়ানোর লোকটি লাশের মুখে এবং হাতে-পায়ে স্কচ টেপের আঠার চিহ্ন দেখতে পেল।
সে দিন হঠাৎ রাত থেকে রাচু খন্দকারকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। সারা রাত গোটা এলাকা, আত্নীয়-স্বজন সব জায়গাতেই খোঁজ করা হল, কিন্তু রাচু খন্দকারের কোন খোঁজ মিলল না। পর দিন দুপুরের কিছু আগে শিয়াল-বেজি শিকার করার একটি সাঁওতাল দল তাকে খুঁজে পায় বিশিলার জঙ্গলে। জঙ্গলের একটা জায়গা নেশা করার জন্য পরিস্কার করে রাখা। সাঁওতালরা সেখানেই দেখতে পায় তাকে। পায়েতে সাপের কামড়ের দাগ। সাপের বিষে গোটা শরীর নীল হয়ে গেছে। চোখ দুটো বিষের তীব্রতায় ঝলসে গেছে একদম।
ওরা খবর দিলেই গোটা এলাকায় হৈ-চৈ পড়ে যায়, সেখান থেকে নিয়ে আসা হয় লাশটাকে। রাচু খন্দকার নেশাখোর মানুষ, নেশা করার জন্য সে কখনো-সখনো এখানে ওখানে যায়। জঙ্গলে যাওয়াটাও অস্বাভাবিক কিছু নয়। আর জঙ্গলে তো সাপ থাকবে এটাই স্বাভাবিক। সুতরাং মৃত্যুটাকে সকলে সাপের কামড়ে মৃত্যু বলেই ধরে নিয়ে দাফন কাফনের ব্যবস্থা করে।
কিন্তু যখনই লাশ ধোয়ার লোকটি লাশের হাতে-পায়ে এবং মুখে স্কচ টেপের আঠা দেখতে পায় তখনই দ্বিতীয় বারের মত হৈচৈ পড়ে যায় এবং সন্দেহ দানা বাঁধে।
রাচু খন্দকারের বড় ভাই সিয়াম খন্দকার তিনি নিজে দেখতে আসেন ব্যাপারটা এবং নিশ্চিত হন। তিনি পৌরসভার মেয়র হলেও যথেষ্ট প্রতাপশালী ব্যক্তি। সাথে সাথে তিনি থানা থেকে ফোর্স আনার ব্যবস্থা করেন। খুব দ্রত থানা থেকে ইন্সপেকশন হয় এবং তারা ঘটনাস্থলের একটা খসড়া ইনকোয়েস্ট রিপোর্ট তৈরী করেন।
“গতকাল রাতে নিখোঁজ হওয়া কাহালু থানা পৌরসভার বর্তমান মেয়র সিয়াম খন্দকারের ছোট ভাই রাচু খন্দকারের লাশ আজ সকালে বিশিলার জঙ্গল নামের একটি জঙ্গলে পাওয়া গেছে। সাঁওতাল একটি দল আজ সকালে তাকে বিশিলার জঙ্গলে খুঁজে পায়। উদ্ধারের সময় লাশটির পায়ে সাপের কামড়ের দাগ এবং বিষে নীল হয়ে যাওয়া শরীর দেখে প্রথমে ধারনা করা হয়েছিল তিনি সাপের কামড়ে মারা গেছেন কিন্তু পরবর্তীতে তার হাতে পায়ে এবং মুখে স্কচ টেপের আঠার দাগ দেখা যায়। এ থেকে ধারনা করা হচ্ছে রাচু খন্দকারকে খুব সম্ভবত বেঁধে রেখে পরিকল্পনামাফিক সাপের কামড় দিয়ে খুন করা হয়েছে।”
প্রাথমিক অবস্থায় থানায় একটি ডায়েরি করা হল। কিন্ত কোন কেস সাজানো গেল না। রাচু খন্দকার নেশাখোর মানুষ, শত্রুর অভাব নেই। কোন রকম চিহ্ন বা সন্দেহ ছাড়া কার উপরই বা কেস চালানো যায়। আগের দিন কাউকে তার সাথে দেখা গেছে এমন দাবিও কেউ করতে পারল না। এছাড়া লাশ যখন উদ্ধার করা হয় তখন শুকনো মাটিতে কারো পায়ের ছাপও উদ্ধার করা সম্ভব ছিল না তার উপর আবার লাশ উদ্ধারের আগেই সেখানে কয়েক শ মানুষের পায়ের ছাপ পড়ে যায় এবং পুলিশ ডিপার্টমেন্টও এতটা শক্তিশালী নয় যে পায়ের ছাপ উদ্ধারের কোন ব্যবস্থা করবে।
রাচু খন্দকারের স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে এটা জানা পর্যন্ত ঠিকই ছিল কিন্তু যখনই খুন ব্যাপারটি মাথায় ঢুকল তখন থেকেই সিয়াম খন্দকারের মাথায় আগুন চড়ে আছে। তিনি ক্ষমতাবলে দ্রুত লাশের পোষ্টমর্টেমের ব্যবস্থা করলেন।
পোষ্টমর্টেমের যা রিপোর্ট এল তা সংক্ষিপ্ত করে সাজানো হলে এরকম দাঁড়ায়:
৩৮ বছর বয়সী রাচু খন্দকারের মৃত্যু হয়েছে বিগত ২৪/৯/২০১১ তারিখ রাত ১:৩০ এর কাছাকাছি সময়ে। সাপের বিষের প্রতিক্রিয়ায় হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুর সময় সাপের বিষের প্রতিক্রিয়ার তার জিহ্বা উল্টে গলায় ঢুকে পড়েছিল যার কারণে তার নিঃশ্বাসও বন্ধ হয়ে যায়। এছাড়া বিষের তীব্রতার কারণে তার দুটো চোখ ঝলসে গিয়েছে এবং শরীরে অল্প পরিমানে ক্লোরোফর্ম এর চিহ্ন পাওয়া গেছে।
যখনই ক্লোরোফর্ম এর ব্যাপারটা জানা গেল তখন আর কারো সন্দেহ রইল না যে ব্যাপারটা খুন। কিন্তু তা হলে কী হবে, খুনির কোন নাগাল বা কোন চিহ্নই পাওয়া গেল না। ভিকটিমের শরীরে মাত্র এক জন ব্যক্তির হাতের ছাপ পাওয়া গেল কিন্তু সেটা লাশ ধোয়ানো ব্যক্তির হাতের ছাপের সাথে মিলে গেল। লাশের শরীরে আর কারো হাতের ছাপ নেই। যা থেকে আন্দাজ করা যায় খুনি হাতে গ্লাভস পরেছিল। যার কারণে তার হাতের কোন ছাপ আসে নি।
খুনির কোন চিহ্ন খুঁজে না পাওয়ায় সিয়াম খন্দকার যেন পাগলপ্রায় হয়ে গেলেন। তিনি প্রানপণে চাইছিলেন খুনির যে কোন একটি চিহ্ন বের হয়ে আসুক। খুব অল্প সময়ের মধ্যে ইন্ডিয়া থেকে দু’ জন ফরেনসিক এক্সপার্ট আনা হল। এবার খুব থ্রোলি লাশের অটোপসি করা হল, কিন্তু অবস্থা তথৈবচ। শুধু নতুন একটি তথ্য এল। তা হল লাশের সাপের কামড়ের জায়গাটিতে পওয়া গেল লোহার অক্সাইড বা ফেরিক অক্সাইডের চিহ্ন যা বিষয়টাকে আরো বেশি ধোঁয়াশা করে তুলল। কারণ ফরেনসিক এক্সপার্টরা বা কেউ এমন কোন সাপের কথা বলতে পারল না যে সাপের কামড়ে আয়রনের চিহ্ন খুঁজে পাওয়া যায়।
এমন অবস্থায় বিষয়টা নিয়ে পুলিশ ডিপার্টমেন্ট, সিয়াম খন্দকার এবং এর সাথে সম্পর্কিত আরো সবাই চরম উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ল এটা না বললেও চলে। সবার মধ্যেই একটা হতাশা দেখা গেল আর বিশেষ করে পুলিশ ডিপার্টমেন্টকে যথেষ্ট লজ্জিত দেখা গেল ব্যাপারটার কোন কুল-কিনারা করতে না পারার জন্য।
ঠিক এরকম সময়েই ঘটনাটায় ডাক পড়ে হরতন দার। হরতন দা ঠিক কোন পেশাদার গোয়েন্দা নয়। শুনেছি হরতন দার ছোটবেলায় এক ঘটনায় হরতন দার এক কথাতেই নাকি দু’ টো লোক চোর প্রমানিত হয়েছিল। সেই থেকেই ছোট-খাট ঝুট ঝামেলায় প্রায়ই হরতন দার ডাক পড়ে। কিন্তু খুনের মত এত বড় একটা কাজে এই প্রথম।
হরতন দা খুব উৎসাহ নিয়ে রাজী হল যেতে। আর হরতন দার সব পাগলাটে কর্মকান্ডের অংশিদার আমি তো সাথী হলাম নিঃসন্দেহে।
সকাল বেলা ঠিক এগারোটার দিকে আমরা রওনা দিলাম কাহালু উপলক্ষ্যে হরতন দার ভাঙ্গাচোরা মোটর সাইকেলটা নিয়ে। মোটর সাইকেলে ভটভট শব্দ তুলে আমরা যখন কাহালু পোঁছুলাম তখন দুপুর গড়িয়ে গেছে।
ঘটনাস্থলে গিয়েই বরাবরের মতই হরতন দা গেল বদলে। কোন আলাপ সালাপের ধারে কাছে গেল না। সোজা লাশ দেখতে চাইল। আর আমি শুধু সাথী হলাম পিছন পিছন।
লাশ রাখা ঘরে গেলাম আমরা। সিয়াম খন্দকার পাওয়ার ফুল লোক, টাকাও আছে যথেষ্ট। লাশ সংরক্ষণ করার জন্য যথেষ্ট ব্যয় করার মত ক্ষমতা যে তার আছে তা লাশের ঘরে গিয়েই বুঝলাম। সম্পূর্ণ আলাদা একটা ঘরে এ্যালয়ের একটা কফিনে সযতনে ফ্রিজ করে রাখা হয়েছে লাশটা। আমাদের সাথে ছিল এক জন পুলিশ কর্মকর্তা এবং ফরেনসিক এক্সপার্ট। ফরেনসিক এক্সপার্ট লোকটি কফিনের ডালাটি খুলে দিলেন। আর পলিমারের ব্যাগ খুলে হরতন দা লেগে গেল লাশ পর্যবেক্ষণ করতে। হাতে গ্লাভস লাগিয়ে আধা ঘন্টা ধরে লাশটা উল্টে পাল্টে দেখল হরতন দা। পুরো সময়টা কারো সাথে কোন কথা নেই। কখনো লাশের হাত, কখনো পা আর কখনো মুখ, নাক, মাথা, পিঠ কোন কিছুই বাদ থাকল না। সব দেখা শেষে শুধু হুঁ বলে শেষ করল হরতন দা।
এর পর আমরা গেলাম স্পটে, য়েখানে রাচু খন্দকার খুন হয়েছে। কানে কানে বলে রাখি, আমাদের লাঞ্চের কিন্তু কোন খবর নেই।
স্পটে গিয়ে হরতন দা আবার শুরু করল পর্যবেক্ষণ। কখনো উপুর হয়ে, কখনো হেলে, কখনো ঘাড় উঁচু করে হরতন দা আরো আধা ঘন্টা সময় নিয়ে স্পটের পুরো জায়গাটার সবগুলো অংশ; গাছ, পাতা, এমনকি পড়ে পড়ে থাকা প্রত্যেকটি পাতাও পর্যবেক্ষণ করল। সব শেষে আমরা ফিরতি পথ ধরলাম। সাথের মাথামোটা ভূড়িওয়ালা পুলিশ কর্মকর্তাটি খুব বাচাল। ফিরতি পথের পুরোটা সময় “কিছু পেলেন?, কিছু পেলেন?” করে হরতন দাকে বিরক্তের একশেষ করতে লাগল। কিন্তু হরতন দা কোন কথা বলল না। ফিরে এলে খাওয়া দাওয়ার আয়োজন হল, এতক্ষণে যে আমার পেটের চোঁ চোঁ ভাবটার একটা শান্তি এল।
সিয়াম খন্দকারের বাড়ি এসে হরতন দা জানাল তার দিন তিন-চারেক এখানে থাকতে হবে। আর কারো কাছে প্রকাশ করা যাবে না যে আমরা গোয়েন্দা, আত্নীয় পরিচয় দিলে আমাদের জন্য অনেক সুবিধা হবে।
আমরা থেকে গেলাম সিয়াম খন্দকারের অনুগত এক ব্যক্তির বাড়িতে। আর শুরু হল হরতন দার আবিজাবি কারবার। কখনো দেখি বেলা বারোটা পর্যন্ত ঘুমাচ্ছে, আবার কখনো দেখি সকাল বেলা আমি ঘুম থেকে না উঠতেই কোথায় যেন চলে গেছে।
আবার একদিন শুনি এলাকার নেশাখোরদের সাথে খাতির লাগিয়ে নাকি রাতে তাড়ির আসরে বসেছে। সেদিন আবার তাকে সকলে গিয়ে ধরে আনতে হল।
ঠিক পঞ্চম দিন ঘটল ঘটনাটা। হরতন দা বাইশ তেইশ বছর বয়সের এক ছেলেকে সাথে করে নিয়ে এল। আগেই অবশ্য আমাকে এস.এম.এস করেছিল ফোর্স রেডি রাখার জন্য। ছেলেটিকে সাথে এনেই বলল একে বেঁধে ফেল। দু’ জন কন্সটেবল একদম তৈরী হয়ে ছিল। সাথে সাথে বেঁধে ফেলল ওকে। ওকে নিয়ে চললাম থানায়। ঘটনার আকস্মিকতায় ছেলেটা বোধ হয় এত বিস্মিত হয়ে গিয়েছিল যে সে কোন কথাই বলতে পারল না।
থানায় এসে ছেলেটা মুখ খুলল,“আমাকে এভাবে ধরে এনেছেন কেন?”
“রাচু খন্দকারকে খুন করার দায়ে।” হরতন দার সংক্ষিপ্ত উত্তর।
ছেলেটা যেন আকাশ থেকে পড়ল। কোন মতেই সে স্বীকার করল না খুনের কথাটা।
“এবার আমি বলি শোন” হরতন দা শুরু করল। “রাচু খন্দকারকে তুমি পাকরাও করেছ কোথাও তার নাকে তুলা মাখানো ক্লোরোফর্ম চেপে ধরে। ওর হাত-পা আর মুখ স্কচ টেপ দিয়ে বেঁধে দিয়েছ। এর পর তুমি তাকে নিয়ে আস বিশিলার জঙ্গলে। ওর জ্ঞান ফেরা পর্যন্ত অপেক্ষা করেছ। আলো জ্বেলে তাকে সময় দিয়েছ তোমাকে চিনতে পারার জন্য। এর পর ওর দুই চোখে তুমি সিরিঞ্জ দিয়ে সাপের বিষ ঢেলে দিয়েছ। বেশ সময় নিয়ে উপভোগ করেছ ওর যন্ত্রনা পাওয়াটা। এর পর ওর হাতের কনুইয়ে নিচের শিরায় তুমি সিরিঞ্জ দিয়ে সাপের বিষ পুশ করেছ। তোমার বিষটা ছিল শাঁখামুটি বা কালাজ সাপের। সব শেষে সবাইকে বিভ্রান্ত করার জন্য ওর পায়ে জং ধরা একটা চিকন পেরেক দিয়ে ফুটো তৈরী করে লাশের টেপগুলো খুলে নিয়ে স্পট থেকে ভেগেছ। আর তোমার হাতে পায়ে গ্লাভস পড়ে নিয়েছিলে যাতে কোন ছাপ না পড়ে তোমার। দেখ তো সব মিলছে কি না? আর হ্যাঁ এবার বল কেন তুমি খুন করলে রাচু খন্দকারকে?”
ছেলেটার নার্ভে শক্তি আছে বোঝা গেল। এর পরও সে স্বীকার করতে চাইল না বা ওকে একটুও বিচলিত মনে হল না।
কি আর করা বাধ্য হয়ে দু’টো ডলা দিতেই হল। পুলিশের ডলা খেয়ে এবার সে মুখ খুলল।
“স্যার আমি যতটুকু সূক্ষভাবে কাজ করেছি তাতে কারও সাধ্য ছিল না আমাকে ধরার। আমি কোন চিহ্নই রাখি নি সেখানে। এরপরও যখন আপনি ধরে ফেলেছেন তখন বলতেই হচ্ছে আপনি খুব বুদ্ধিমান মানুষ। কিন্তু স্যার দয়া করে এটা বলবেন না যে আমি রাচু খন্দকারকে খুন করেছি। বরং এটাই বলা ভাল হবে যে আমি একজন শয়তানকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিয়েছি।” একটু থামল ছেলেটি। আবার শুরু করল।
“প্রায় নয় বছর আগের ঘটনা। আমি আর বাবা জাল নিয়ে যাচ্ছিলাম ইছামতিতে মাছ ধরতে। হঠাৎ রাচু খন্দকারের এক অপকর্ম দেখে ফেলে আমার বাবা। সাক্ষী সরিয়ে দেবার জন্য সেইখানেই আমার বাবাকে জবাই করে মেরে ফেলে। আমি পিছনে একটা ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে পড়েছিলাম যার কারণে আমাকে দেখতে পায় নি। না হলে হয়ত আমাকেও ওরা সেদিন শেষ করে ফেলত।”
আবার দম নিল ছেলেটি।
“আমার মা মারা গিয়েছিল অনেক আগেই। বাবা মারা যাওয়ার পর আমি পুরো এতিম হয়ে পড়ি স্যার। আর বাবা-মার অভাবে এক অনিশ্চিত জীবনে পড়ে যাই আমি। ঠিক তখন থেকেই আমি সংকল্প করি, আমি আমার বাবার মৃত্যুর প্রতিশোধ নেবই; আমার ছন্নছাড়া জীবন যে তৈরি করল তাকে আমি পইপই করে মৃত্যুর স্বাদ বুঝিয়ে দেব। অনেক সময় নিয়ে আমি সুযোগ খুঁজছিলাম, সেদিন আমি সেই সুযোগটা পেয়ে যাই আর তাকে আমি বুঝিয়ে দিই মৃত্যুর স্বাদ।”
আমরা লক্ষ্য করছিলাম কথা বলতে বলতে কখনো ছেলেটার চোখে পানি জমে উঠছে আবার কখনো সে চোখে জ্বলে উঠছে প্রতিশোধের আগুন। ছেলেটা যখন বলা শেষ করল তখন আমাদেরও বেশ কষ্ট লাগল এমন মর্মান্তিক ঘটনা শুনে।
যাহোক ছেলেটাকে লক-আপে পাঠানো হল।
এবার আমরা ঠেসে ধরলাম হরতন দাকে। কিভাবে দাদা এমন অসম্ভব কাজকে সফল করল। হরতন দা যেভাবে বর্ণনা করল তাতে এমন মনে হচ্ছিল যে হরতন দা সেখানে সশরীরে উপস্থিত ছিল। স্বয়ং সিয়াম খন্দকারও পিড়াপিড়ি শুরু করল কিভাবে হরতন দা এটা করল তা জানার জন্য।
হরতন দা বলতে শুরু করল আমাকে উদ্দেশ্য করে, “শোন যে কোন একটা ডেড, তা অনেক কারণেই হতে পারে। সেটা হতে পারে সুইসাইড, এ্যাক্সিডেন্ট, মার্ডার বা স্বাভাবিক মৃত্যু। সম্পূর্ণ ব্যাপারটা জানার আগ পর্যন্ত প্রত্যেকটা ব্যাপারই এমন জট লেগে থাকে যে সেই ডেডটা ঠিক কোন কারণে হয়েছে আগেই বলা যায় না। এজন্য একজন ফাইন্ডারের সব সময়ই উচিৎ সবগুলো বিকল্প সামনে নিয়ে এগুনো। সেটা খুন নাকি আতœহত্যা নাকি এ্যাকসিডেন্ট এটা নির্ধারন করাই তার দায়িত্ব। তবে তা সকল তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করার পর। আমি প্রথমেই ডেড বডির সাপেড় কামড়ের অংশটুকু পরীক্ষা করি। সাপ যেখানে দাত বসায় সেখানে প্রায় এক ইঞ্চি ব্যাসের জায়গা জুড়ে একদম কাল হয়ে যায় বিষে। কিন্তু এই ভিকটিমের যেখানে কামড়ের দাগ সেখানে বিষের প্রতিক্রিয়ার কোন ছিটেফোঁটাও নেই। আর চোখ দুটো বিষে ঝলসে গেছে। কোন সাপের কামড়ে বিষের তীব্রতা যদি এমন প্রখরও হয় যে সাপ এক কামড়ে ১০ এম.জি বিষ ঢেলে দেয় তাতেও কখনো ভিকটিমের চোখ বিষে ঝলসে যাবে না। এটা একমাত্র তখনি সম্ভব যদি তার চোখে বিষ ঢেলে দেয়া হয়। আসলে ওর চোখে বিষ ঢেলে দেওয়া হয়েছিল, তাতে চোখটা অমন ঝলসে গেছে। এ দু’টো দেখেই আমি শরীরে একটা মোটা শিরা খুঁজতে শুরু করি। আমি নিশ্চিত ছিলাম সেখানে কোন সিরিঞ্জের সুঁচের দাগ পাওয়া যাবে। পেলামও তাই। ওর বাম হাতের কনুই এ খুঁজতে গিয়েই দেখি সেখানে সিরিঞ্জের একটা ছিদ্র। যেখান দিয়ে বিষ পুশ করা হয়েছে। এছাড়াও খুনির নাকের মধ্যে তুলোর কয়েকটা আঁশ খুজে পাই আমি। এবার নিশ্চিত হওয়া গেল যে ব্যাপারটা প্রকৃতই খুন।”
একটু থামল হরতন দা। তার পর আবার শুরু করল।
“এবার এস খুনির কার্যপদ্ধতির দিকে। খুনি ভিকটিমের দুই চোখে সিরিঞ্জ দিয়ে বিষ ঢেলে দিয়েছে। তার অর্থ খুনি তাকে প্রচন্ড কষ্ট দিয়ে মারতে চেয়েছে - এবং এটা সে যে সময় নিয়েই করেছে তা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়। খুনি ভিকটিমকে কষ্ট দিয়ে মারতে চেয়েছে। এর একটাই অর্থ হচ্ছে প্রতিশোধ। প্রতিশোধ নেবার জন্যই সে তাকে এভাবে কষ্ট দিয়ে মেরেছে।”
“কিন্তু প্রশ্ন হল খুনি কে? কয়েকটা ব্যাপার লক্ষ্য করলাম আমি। এক. বিষের প্রতিক্রিয়ায় খুনির জিহ্বা উল্টে গলার ভিতর ঢুকে পড়েছিল। এটা কালাজ আর শাঁখামুটি সাপের বিষের লক্ষণ। আর মজার ব্যাপার হল এই দু’টো সাপই এই এলাকায় প্রচুর পাওয়া যায়। খুনির কাছে যেহেতু কালেক্টেড বিষ ছিল সুতরাং খুনি অবশ্যই এই এলাকার।”
“এবার খুনের স্টাইলে দিকে দেখ। প্রতিশোধের কারণে যদি কেউ কাউকে কষ্ট দিয়ে মারতে চায় তবে সাধারনত যা হয়: খুনি ভিকটিমের আঙ্গুলে সুঁচ ফুটিয়ে দেয়, আঙ্গুল কেটে নেয়, চোখ উপরে নেয় বা হাত-পা কেটে নেয়। কিন্তু এর স্টাইলটা সম্পূর্ণ ভিন্ন। এ ভিকটিমের চোখে বিষ ঢেলে দিয়ে চূড়ান্ত কষ্ট দিতে চেয়েছিল এবং এটি একদম অন্যরকম একটা অভিনব ষ্টাইল। এটি একটা বিক্ষিপ্ত রুচির পরিচয় দেয়। এরকম বিক্ষিপ্ত রুচির পরিচয় মেলে তাদের ক্ষেত্রেই যারা সাধারনত সমাজে নিগৃহীত অবস্থায় বড় হয় বা সমাজের সাথে এদের যোগাযোগ থাকে না বিশেষ করে। এটা এমন একজন ব্যক্তিকে নির্দেশ করে যে সাধারণত একা একা চলাফেরা করে আর বিচিত্র কার্যকলাপ করে বেড়ায়। আরেকটা ব্যাপার হল খুনির কাছে অনেক পরিমানে বিষ কালেকশনে ছিল যা সে দিনে দিনে কালেকশন করেছে। যেহেতু এই এলাকায় কালাজ আর শাঁখামুটি সাপ অনেক সুতরাং বিষ যোগাড় করাতে তার কষ্ট হবার কথা না। কিন্তু এখানে একটা জিনিস আমি অনুমান করে নিয়েছিলাম যে ব্যক্তিটি সাপ মেরে সাপের মাথা কেটে নিয়ে সাপের বিষ সংগ্রহ করবে, যেহেতু সে সাপুড়ে হবার সম্ভাবনা খুব কম। আর তাই আমার প্রথম লক্ষ্য ছিল এভাবে সাপ মেরে বা সাপের মাথা কেটে বিষ সংগ্রহ করত এমন কে আছে এই এলাকায়, যেহেতু আমি আগেই নিশ্চিত হয়েছি খুনি এই এলাকারই।”
“এ জন্যই আমি এই এলাকায় থেকে যাই। দিনে রাতে এখানে সেখানে লোকজনের সাথে মিশে আমি তথ্যটা বের করার চেষ্টা করতে থাকি। অবশেষে সেদিন রাতে তাড়ি খাওয়ার এক তালে নেশাগ্রস্ত এক লোকের কাছ থেকে পেয়ে যাই তথ্যটা। পেয়ে যাই কে এই কাজটা করত। এর পর আর একটা প্রমানের অপেক্ষায় ছিলাম। খুনের স্পটটাতে আমি বাঁশের কাটা গোড়ায় শুকনো কালসিটে দাগ দেখতে পাই। আমার অনুমান ছিল ওটা রক্তের দাগ। রাতে আমি ফরেনসিক এক্সপার্টকে নিয়ে গিয়ে সেটার ব্লু-রে ফরেনসিক টেস্ট করে নিশ্চিত হই যে ওটা রক্তই। আর ওটা যে খুনিরই রক্ত তা নিশ্চিত হই কারণ অপটিক্যাল ডিটেকশন মেথড ব্যবহার করে ওটার আশেপাশে কোন পায়ের ছাপ পাওয়া যায় নি। দ্যাট মিনস, খুনি মোজা পায়ে ওখান দিয়ে যাওয়ার সময় বাঁশের গোড়ার আঁচড় লেগে ওখানে রক্তের দাগ পড়েছে। আর মাটি থেকে যে উঁচুতে রক্তের দাগ আছে সে হিসেবে খুনির গোড়ালি থেকে ইঞ্চি তিনেক উপড়ে একটা ক্ষত হয়ে থাকবে। সম্ভাব্য খুনির যখন আমি খোঁজ পেয়ে যাই তখন আমার শুধু এটুকু প্রমান করার বাকী ছিল। আমি সম্ভাব্য সেই ছেলেটিকে যখন পেয়ে যাই তখন তার সাথে গায়ে পড়ে বেশ করে আলাপ জমাই। আর এক ফাঁকে কৌশলে যখন তার পায়ের ঐ ক্ষতটি দেখে ফেলি তখনই নিশ্চিত হয়ে যাই যে খুনি এখন আমার হাতের মুঠোয় এবং ওকে তোমাদের হাতে তুলে দিই। আর বাকী ব্যাপারগুলো যেগুলো আমি ছেলেটিকে বললাম সেগুলো আসলে আমি সব দেখে কল্পনা করে সাজিয়ে নিয়েছিলাম।”
“ব্র্যাভো ইয়াং ম্যন।” হঠাৎ এত জোরে চেঁচিয়ে উঠে টেবিলে থাবড়া দেওয়ার শব্দে আমরা চমকে উঠলাম সবাই। পাশের টেবিলে বসে ছিলেন পুলিশের সেই কর্মকর্তা। হরতন দা তাকে এত দিন পাত্তা না দেওয়ায় তিনি কিছুটা রুষ্ঠই ছিলেন। কিন্তু হরতন দার মুখে কাহিনীটা শুনে তিনি এতটাই উচ্ছসিত যে তিনি উচ্ছাসে আমাদের চমকে দিলেন।
আমার বুকটা যেন ফুলে উঠল। আমাদের দেশেও তাহলে এমন ডিটেকটিভ আছে। হরতন দা আমাদের জন্য গর্ব বৈকি। নিজেরও গর্ব লাগল আমিও বোধহয় সাথে থাকলে এমন অসম্ভব কান্ড করতে পারব কোন সময়।
২৪ জানুয়ারী - ২০১১
গল্প/কবিতা:
১৪ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪