একজন আলোকিত মা

মা (মে ২০১১)

নাজমুল হাসান নিরো
  • ৫৭
  • 0
  • ৬৭
সেদিন আমাদের ঘরে চাল ছিল না। মা রান্না চড়াতে পারে নি। দাদীদের আলাদা সংসার। আলাদা রান্না। দাদীরা বসে ভাত খাচ্ছে। মা আমাকে একটা প্লেট হাতে দিয়ে পাঠাল দাদীর কাছে। আমি প্লেট হাতে নিয়ে দাদীর সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম।
"দাদী একটু ভাত দাও না।"
"দূর হ বজ্জাত। তোর জন্য আমি রান্না করি নাই।"
"একটু ভাত দাও না দাদী।"
"সইর্যা যা কইতাছি। ভাত নিতে আইছে।"
"অল্প একটু ভাত দাও না দাদী।"
দাদী আর সময় ক্ষেপণ করল না। আমাকে ঘাড় ধরে সোজা বাইরে এনে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিল। আমি উপুড় হয়ে পড়ে গেলাম। প্লেটটা হাত থেকে ছিটকে পড়ে গেল। অদূরে মা দাঁড়িয়ে ছিল। আমি গা ঝেড়ে মাকে জড়িয়ে ধরে বললাম,"মা দাদী ভাত দিবে না।"
মুখে আঁচল গুঁজে মা অঝোরে কাঁদতে লাগল। আমি তখন বুঝতে পারি নি মা আমার কেন কাঁদছে। আমি তো তেমন ব্যথা পাই নি। রান্না হয় নি - মায়েরা না খেয়ে থাকতে পারে কিন্তু ছেলের কথা ভেবে মা হয়তো ভেবেছিল মা গেলে না দিলেও আমাকে পাঠালে দাদী তার নাতীর মায়ায় হয়তো আমাকে একটু ভাত দিবে। আমার আর তাহলে না খেয়ে থাকতে হবে না। কিন্তু মার সেই ধারনা মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে।
সেই যে মাকে শেষ বারের মত কাঁদতে দেখা। তারপর মাকে আর কখনো কাঁদতে দেখি নি। এমনকি সেদিনও না। যেদিন মার মত অমন মানুষকে ওরা অসতী সাজিয়েছিল। গোটা গ্রামের মানুষের সামনে অপমান করেছিল, দোররা মেরেছিল। নাক-খত দিয়ে নিয়েছিল। মাথা ন্যাড়া করে ঘুরিয়েছিল গোটা গ্রাম। মাকে তখনও কাঁদতে দেখি নি। মার ঐ অতল গভীর চোখে শুধু কি যেন কী একটা খেলা করত।
আমি যখন প্রাইমারিতে পড়ি তখনকার দিনের কথা। মা রান্না করছিল আর আমি পাশে বসে বসে পিঠা খাচ্ছিলাম। মা আমাকে বলল,"বাবা তুই বড় হয়ে কী হবি বল তো?"
"মা আমি শিক্ষক হব।"
"তোর যা খুশি তাই হোস বাবা। কিন্তু এমন কিছু করিস যাতে তোর সাথে আরও দশটা মানুষ খেয়ে পড়ে ভাল ভাবে বাঁচতে পারে।"
সেই যে প্রথম বলা তা আর শেষ হয় নি কোনদিন। শহর থেকে যতবার বাড়ি গেছি ততবারই মা আমাকে একই কথা শুধু বারবার কানের কাছে বাজিয়ে শোনাত।
"বাবা এমন কিছু করিস যাতে তোর সাথে আরও দশ জন মানুষ ভাল ভাবে খেয়ে পড়ে বাঁচতে পারে।"
আমি মেনে নিতাম মার কথা। কিন্তু সেদিন মার ঐ কথা আমার কাছে প্রহসন হয়ে দাঁড়ায়। যেদিন পুরো গ্রামের মানুষ মার উপর অত্যাচার করল। কাদের জন্য আমি এমনভাবে তৈরি হব? যারা আমার মায়ের মত অমন মাকে অত্যাচার করে তাদের জন্য? যে মা তার ছেলের সাথে আরও দশ জন মানুষের কথা ভাবে তাকে যারা মিথ্যা অসতী সাজায় তাদের জন্য?
ভেবেছিলাম মা হয়তো নির্বাক হয়ে যাবে। আর আমাকে উৎসাহ দিবে না দেশের তরে কিছু করার জন্য, দশ জন মানুষের তরে কিছু করার জন্য। কিন্তু মা আমার ধারনা আগা-গোঁড়া মিথ্যা প্রমাণ করে। একটু সামলে উঠেই আবার আমাকে বলে "বাবা এমন কিছু করিস যাতে তোর সাথে আরও দশ জন মানুষ ভাল ভাবে খেয়ে পড়ে বাঁচতে পারে।"
আমি মাঝে-মাঝে ভাবি একজন মানুষ কি করে পারে। এতটা নির্যাতিত হয়ে তাদেরই নিয়ে ভাবতে। মা কি তাহলে মানুষ? নাকি মহামানুষদের কাতারের একজন?
মার কষ্টের শেষ ছিল না। বাবা বাউণ্ডুলে মানুষ। মদ খেয়ে প্রত্যেকটা দিন মাকে রুটিন করে পেটায়। আরও কত যে মানুষ মার উপর অত্যাচার করে তার ইয়ত্তা নেই। বাবা থেকেও না থাকার কারণে কত জন মাকে হেনস্থা করত! ইচ্ছা হলেই মার গায়ে হাত তুলত। মা সবই মুখ বুজে সহ্য করত নীরবে আর তারপরও আমাকে একটা কথাই বলত, "বাবা এমন কিছু করিস যাতে তোর সাথে আরও দশ জন মানুষ ভাল ভাবে খেয়ে পড়ে বাঁচতে পারে।"
আজ আমি বড় হয়েছি। আস্তে আস্তে বন্ধ করতে পেরেছি মার উপর অত্যাচারের সবগুলো হাত। আর মার স্বপ্ন পূরণ করতে গড়ে নিয়েছি নিজেকে।
মার অনেক আনন্দের দিন আজ। মার স্বপ্ন আজ পূরণ হতে যাচ্ছে। আমি স্কলারশিপে ডক্টরেট করতে যাচ্ছি জাপানে।
ব্যাগ গোছানো শেষ। মা আর ছোট বোনটা বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। আমি বিদায় নিতে গিয়ে কেঁদে ফেলার ভয়ে মাকে ক্রস করে এগিয়ে যাচ্ছিলাম। মা আমার হাত টেনে ধরল। মুখটা কাছে এনে কপালে চুমু খেল। সাথে সাথে আমি হুঁ-হুঁ করে কেঁদে উঠলাম।
"তুই কাঁদছিস কেন বাবা? যখন তখন কাঁদার জন্য এমন নরম করে তো তোকে আমি গড়ে তুলি নি বাবা। তুই শুধু তোর জন্য যাচ্ছিস না তো। তুই পুরো দেশের জন্য সম্মান বয়ে আনতে যাচ্ছিস। এটা তো আনন্দ বাবা। তুই কাঁদবি কেন? যা বাবা যা। আর আমার স্বপ্নটা পূরণ করিস বাবা। ডক্টরেট শেষ হলে যেন ওখানে থেকে যাস না। অবশ্যই দেশে ফিরে আসবি। ফিরে এসে এমন কিছু করবি যাতে তোর সাথে আরও দশ জন মানুষ খেয়ে পড়ে বাঁচতে পারে।"
আমি চোখের পানি মুছে ফেললাম। আমাদের কুঁড়ে ঘরটাকে পিছনে ফেলে চলতে শুরু করলাম মায়ের স্বপ্ন পূরণের উদ্দেশ্যে।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
নাজমুল হাসান নিরো মন্তব্য করার জন্য ধন্যবাদ নাফিস শাহরিয়ার।
নাজমুল হাসান নিরো অনেক ধন্যবাদ হোসেন মোশাররফ ভাই।
হোসেন মোশাররফ মায়ের সপ্ন পূরণের উদ্দেশে (লেখকের ) এ যাত্রা যেন সফল হয় / সে কামনায় ধন্যবাদ আপনাকে ....
নাজমুল হাসান নিরো মন্তব্য করার জন্য ধন্যবাদ অনামিকা।
নাজমুল হাসান নিরো @রাজীব ফেরদৌস - মতামতের জন্য ধন্যবাদ। আসলে বেশ দীর্ঘ সময় ধরে কম্পিউটার বিষয়ে লেখালেখি করার কারণে (যা সবসময়ই বর্ণনামূলক এবং ব্যাখ্যামূলক) আমার লেখায় ম্যাটেরিয়ালেস্টিক একটা ভাব চলে আসছে। যার কারণে কোন লেখায় যথেষ্ট নাটকীয়তা সৃষ্টি করতে আমি ব্যর্থ হচ্ছিলাম। আগের লেখাগুলোতে যা একটু পেরেছিলাম; এই লেখায় এসে পুরোপুরিই ব্যর্থ হয়েছি। শুধু মেসেজটাকেই সম্বল করে লেখাটাকে উপস্থাপিত করেছি। তবে আমার বিশ্বাস যে আগামী কষ্ট সংখ্যার লেখায় আমি এই ম্যাটেরিয়ালিস্টক ধারা থেকে বের হয়ে আসতে পেরেছি।
onamika সত্যি একজন আলোকিত মা !!
Rajib Ferdous আমি ব্যতিক্রম লেখা লিখতে পারি কিনা জানিনা, কিন্তু ব্যতিক্রম লেখা পড়ার জন্য খুঁজি। আপনার এক মন্তব্য থেকে জানলাম, আপনি ব্যতিক্রম লিখতে পছন্দ করেন। এই লেখায় মন্তব্য করার আগে বলে নেই, আমি কিছুটা মামুন ম. আজিজের সাথে একমত। নৈমিত্তিক ব্যপারটাই ঘুরে ফিরে আসলো। অন্যদের হলে কিন্তু বলতাম না। কিন্তু আপনার কাছে যেহেতু ভিন্ন কিছু প্রত্যাশা ছিল। তবে আপনার গল্পের মেসেজ অর্থাৎ একজন "ব্যক্তি মায়ের" "দেশ মার্তৃকার" জন্য যে আকুলতা তার প্রতিকী সম্পর্ক টা কিন্তু আমার কাছে অনেক ভাল লেগেছে। মেসেজ গল্পে থাকেবই। কোন মেসেজ ছাড়া সেটা স্বার্থক গল্প হতে পারেনা। কিন্তু সেই মেসেজটি উপস্থাপনের নাটকীয়তায়, বা ভিন্নতায় একটি গল্প পাঠকের হৃদয়ে স্থান করে নেয়। পড়ার পর মনে হয়, আসলেই তো! ব্যাপারটা তো আমিও জানতাম, কিন্তু এভাবে তো কখনো ভাবিনি। আপনার জন্য শুভ কামনা আমার।
নাজমুল হাসান নিরো আপনাকেও ধন্যবাদ আকাশ ভাই।
Akther Hossain (আকাশ) মা কে নিয়া আমারও অনেক কষ্টের সৃতি রয়েসে যা এখনও আমি অনুভব করি, আমার 'মা' নেই তাই মা কে নিয়া কষ্টের সব লিখা আমাকে মর্মাহত করে// ধন্যবাদ নাজমুল ভাই//

২৪ জানুয়ারী - ২০১১ গল্প/কবিতা: ১৪ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "ছোটবেলা”
কবিতার বিষয় "ছোটবেলা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ ডিসেম্বর,২০২৪