শহরের চাকচিক্যময় বিলাসবহুল ব্যস্ত জীবন ছেড়ে সবেমাত্র গ্রামে পা দিয়েছি। এখনও কিছু করা হয়ে উঠেনি। ভাবছি কিছু একটা করবো। কী করবো! কী করা উচিৎ— এ নিয়ে ভাবছি বেশ কিছুদিন যাবৎ। মারাত্নক দ্বিধা দ্বন্দ্বে ভুগছি। নিজের গ্রাম, বাপ-দাদার ভিটে-মাটি চারদিকে সব পরচিত মুখ। মুখ বললে কম বলা হবে, সবাই কোনো না কোনোভাবে আত্নীয়— রক্তের সম্পর্কের আত্নীয়। ডানে-বামে আছে ছোট ও বড় ফুফুর বাড়ি।
চট্টগ্রাম শহরে একটি বায়িং হাউজে মার্চেন্ডাইজার ছিলাম। মোটা অঙ্কের বেতনও ছিল। ব্যস্ততা ছিল নিত্যদিনের সঙ্গী। যতদিন চাকুরি করেছি সময় কোনদিকে যেত টেরই পেতাম না। দিন মাস বছর চলে যেতো চোখের পলকে। কাস্টমার একটি অর্ডার দিয়ে তিনমাসের সময় সীমা বেঁধে দিতো। অর্ডারগুলো প্লেসমেন্ট ও বুকিং তৈরী করে, কাপড় ও এক্সোসোরিজ আনতে অনেক সময় তিনমাস অতিবাহিত হয়ে যেত। রাজ্যের চিন্তা মাথায় ঘুরতো। কখন প্রোডাকশনে যাবে, কখন শীপমেন্ট হবে। চরম অস্থিরতায় পার হয়েছে সেই দিন-মাস-বছরগুলো। ভাবতে অবাক লাগে। আজ আমার কাছে অখণ্ড অবসর। চিন্তা করার অনেক সময়। নিজের জন্য, দেশের জন্য...
শহর ছেড়ে গ্রামে আসা আমার জন্য মোটেও সহজ ছিল না। রীতিমতো নিজের সাথে, রিতুর সাথে যুদ্ধ করে গ্রামে আসতে হয়েছে।
ভালোবেসে বিয়ে করেছি রিতুকে। আমাদের বিয়েতে রিতুর মা মোটেও রাজি ছিলেন না। রিতুর বাবা নেই। রিতুর বাবার রেখে যাওয়া ব্যবসা-বানিজ্য দেখাশোনা করছে ওর মা। ওর সব বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেন ওর মা। রিতু ডাক্তার। আমি করি প্রাইভেট চাকুরী। রিতুর মায়ের কথা ডাক্তার ডাক্তারকে বিয়ে করবে, না হলে ইঞ্জিনিয়ার। কেন জেনে শুনে আগুনে ঝাঁপ দিবে আমার মতো ক্ষেতকে জীবনসঙ্গী করে? রিতুকে বোঝাতে না পেরে আমাকে ডাকেন তিনি। মানসিকভাবে আমি নিজেকে প্রস্তুত করলাম, তিনি হয়তো বাংলা ছবির মতো আমাকে মোটা অঙ্কের টাকার প্রলোভন দেখিয়ে রিতুর জীবন থেকে সরে যেতে বলবেন। আমি নায়ক শাকিব খান কিংবা রিয়াজের মতো সে প্রস্তাব প্রত্যাখান করলে তিনি হয়তো জীবন নাশের হুমকি দেবেন। আমি জানি— খুব ভালো করে জানি বাংলা ছবির নায়কের মতো জীবন নাশের হুমকির সামনে আমার মতো ছা-পোষা মানুষের দাঁড়ানোর শক্তি-সামর্থ, অর্থবিত্ত কিছুই নেই। তাই মোবাইলের রেকর্ডিং অপশন অন করে রিতুদের বিলাসবহুল রাজকীয় বাড়িতে পা রাখলাম। পণ করলাম, হুমকি দিলে কিছু না বলে সোজা থানায় গিয়ে জিডি করবো।
না, রিতুর মায়ের আচরণে অস্বাভাবিক কিছু ছিল না। ওর মা আমার সাথে মোটামুটি স্বাভাবিক ব্যবহারই করেছেন। টেবিলে দশ-বারো রকমের নাশতা, তারমধ্যে পাঁচ রকমের পিঠা দিয়ে নিজের হাতে আপ্যায়ন করেছেন; যেমনটি শাশুড়ি জামাইদের করেন। আপ্যায়নপর্ব শেষে ভদ্রমহিলা খুব গম্ভীর হয়ে পায়ের ওপর পা তুলে আমার দিকে তাকিয়ে থাকলেন অনেকক্ষণ ধরে। আমি নেতিবাচক পরিস্থিতির জন্য তৈরি ছিলাম।
— ইশতিয়াক ।
আমি চুপ করে থাকলাম। ঝড়ের গতিবিধি বোঝার চেষ্টা করছি। রিতু নেই। রিতু থাকলে নিজেকে এতো অসহায় মনে হতো না। রিতুকে ওর মা আগেই চলে যেতে বলেছেন।
— তোমাদের বিয়েতে আমি রাজি। ভদ্রমহিলা আবার থামলেন। আমি পায়ের নিচে মাটি খুঁজে পেলাম। আমি বিনয়ে পা-জোড়া জড়ো করে গুটিয়ে আনি নিজের দিকে; কচ্ছপের মতো।
— আমি বিয়েতে রাজি না হলেও কিছু যায় আসে না। বাধা দিলে তোমরা কাজী অফিসে গিয়ে বিয়ে করবে। লোক হাসাবে। লোক যখন হাসবেই আমার সামনে হাসুক, আমি দেখি। রিতুকে বিভিন্নভাবে আমি বুঝিয়েছি যে, তোমার সাথে কোনোভাবেই রিতুর যায় না। আর তোমার পরিবার সম্পর্কে আমি যতটুকু জেনেছি তাও বলেছি। তোমার বাবা গোয়েন্দা বিভাগে চাকুরি করতেন। ঘুষ খাবেন না তাই গোয়েন্দার চাকুরি ছেড়ে গ্রামের প্রাইমারি স্কুলে চাকুরি করে জীবন কাটিয়েছেন। আমার তো তোমাকে নিয়ে ভয় হয়— কোনদিন তুমিও সব ছেড়েছুঁড়ে নারী ছেড়ে নাড়ীর টানে নিরুদ্দেশ হয়ে যাও! বিয়েতে বংশপরিচয়ের অঙ্ক কষতে হয়। রিতু তোমাকে পছন্দ করে, ভালোবাসে। এ বয়সের পছন্দ কিংবা ভালোবাসা হলো আবেগ। কাছাকাছি হলেই এসব মোহ-মায়া কেটে যাবে।
রিতুর মায়ের উপস্থিতিতে আমাদের বিয়ে হয়। বিয়ের পর খুব প্রয়োজন ছাড়া উনি কখনও আমাকে কল দিতেন না। এমনকি আমার মায়ের সাথেও 'কেমন আছেন', ভালো আছি'র বাইরে তেমন সৌজন্য দেখাতে প্রয়োজন বোধ করেননি। বিয়ের পর রিতুকে আমি যত দেখেছি তত অবাক হয়েছি। এই মেয়ে কিভাবে আমার সাথে সংসার করছে। ওদের মা-মেয়ের মধ্যে প্রচুর মিল। রিতুর ব্যবহারে আমার মাকে উপেক্ষা করার প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত আমি দেখতে পাই। মাকে কখনও পা ধরে সালাম করতে দেখিনি, মাকে মা বলে ডাকতে তার ভেতর রাজ্যের জড়তা দেখেছি। আমাদের বিয়ে হয়েছে চার বছর। মা কখনো একটি রাত আমাদের বাসায় থাকেননি। যতবার আমাকে দেখতে এসেছেন, দিনে এসে দিনেই চলে গেছেন। অথচ আমার শাশুড়ি এলে দিনের পর দিন কাটিয়ে দেন আমাদের বাসায়। রাত জেগে মা-মেয়ের মধ্যে কত কথা, কত গল্প।
বিয়ের আগে চার বছর চুটিয়ে প্রেম করেছি, বিয়ে করে চারবছর সংসার করেছি। তবু আমার কাছে রিতুকে বড্ড অচেনা মনে হয়। বিয়ের পর অন্তরঙ্গ মুহূর্ত ছাড়া রিতুকে কখনও আমার কাছে 'আমার' মনে হয়নি। এই চার বছরে আমাদের অর্জন জিরো। আমরা দু’জন দু’জনই আছি। রিতু জানায় এত তাড়াতাড়ি সে সন্তান নেবে না। সময় হলে তখন দেখা যাবে। এখন সন্তান নিয়ে ক্যারিয়ার, শরীর কিছুই নষ্ট করতে রাজি নয় সে।
সবদিক বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নিলাম আমি আর শহরে থাকবো না। এত টাকা খাবে কে? এর চেয়ে গ্রামে অসুস্থ মাকে সময় দিলে আমার পাপের বোঝা হালকা হবে। রিতুর সাথে এসব নিয়ে দিনের পর দিন কথা কাটাকাটি হয়, ঝগড়া হয়। কেঁদে-কেঁদে অনেক নির্ঘুম রাত ভোর করছে সে। আমার শাশুড়ী বলেন— মানুষ উল্টো চলতে পারে কিন্তু সময় ও ঘড়ির কাঁটা কখনও উল্টো চলে না। তাই আমাদের সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে চলতে হবে। আমি আগেই বলেছি— রক্তের টান উপেক্ষা করার জো নেই মানুষের। ইশতিয়াকের চিন্তা ধারার সাথে তোর চিন্তাধারায় যোজন-যোজন ফারাক। চার বছর সংসার করেছিস আমি তো ভেবেছি চারদিনও তোরা একসাথে থাকতে পারবি না।
রিতু আমাকে এগিয়ে দিতে বাস স্টেশন পর্যন্ত আসে। বিদায় নিয়ে বাসে উঠতে যাবো এমন সময় রিতু আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকে। বলে— আমকে কখনও ছেড়ে যেও না, প্লিজ! আই কান্ট লিভ উথআউট ইউ, আই উইল ডাই উইথআউট ইউ। বিয়ের আগে রিতুকে অনেকবার বউ বলে ডেকেছি অথচ বিয়ের চার বছরে একবারের জন্যও ডাকা হয়নি বউ সম্বোধনে। এখন খুব ইচ্ছে করছে বলতে, লক্ষী বউ, কেঁদো না। আমি আছি, থাকবো তোমারই। চারদিকে তাকিয়ে দেখি উৎসুক অসংখ্য চোখ ড্যাবড্যাব করে দেখছে আমাদের। লজ্জায় রিতুকে সংযত হতে বলে বিদায় নেই।
মা আমাকে বাবার স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তি বুঝিয়ে দেন। আমার দাদা-চাচাদের গুনবতী বাজারে কাপড়ের দোকান ছিল। তাই মায়ের ইচ্ছে আমি যেন সেই ব্যবসাটা দেখাশোনা করি। অথচ আমি কৃষিভিত্তিক সমাজব্যবস্থার ওপর জোর দেই বেশি।
বাইরে মুষলধারে বৃষ্টি। থেমে-থেমে বজ্রপাত হচ্ছে। মা আমাকে ঘুমানোর তাড়া দিয়ে ঘুমিয়ে পড়লেন। 'সীরাত ইবনে হিশাম' বইটি শেষ করতে আরও তিন পৃষ্ঠা বাকি। বইটি পড়া শেষ হলেই ঘুমিয়ে পড়বো মাকে বললাম।
ঘুমাতে যাওয়ার আগে দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ শুনতে পেলাম। বাইরে প্রচন্ড বৃষ্টি। ঘড়ির দিকে তাকালাম; রাত বারোটা। এতো রাতে কে আসবে? দরজায় কান পেতে বললাম— কে?
—দরজা খোলো ইশতিয়াক। পরিচিত কণ্ঠ। কার কণ্ঠ ঠিক এই মুহুর্তে অনুমান করতে পারছি না।
দরজা খুলে বিস্ময়ে হতবাক আমি। বাইরে আমার বড় চাচা দাঁড়িয়ে আছেন, যিনি আমার বয়স সাত-আট বছর থাকাকালীন মারা গেছেন। বৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে আছেন অথচ চাচার শরীর একটুও ভিজেনি। ঘরের সোফায় বসে জিজ্ঞেস করেন —
আমাকে চিনতে পেরেছিস, ইশতিয়াক?
—জি। আপনাকে দেখতে আমার বড় চাচার মতো লাগছে।
—বড় চাচার মতো নয় আমি তোর বড় চাচাই। আমি আবদুর রাজ্জাক। মৃদু হেসে বলেন— গাধা কোথাকার!
একবার ভাবলাম মাকে ডেকে তুলি। না, মাকে এ মুহুর্তে ডাকা ঠিক হবে না। বিষয়টি আমার কাছে সুবিধার মনে হচ্ছে না। ত্রিশ বছর আগে মারা যাওয়া লোকটি কীভাবে আমার সামনে বসে থাকে! চিমটি কাটলাম নিজেকে নিজে। ব্যথায় দাগ বসে গেছে শরীরে।
বড়চাচা উনার ফ্যামিলি সম্পর্কে জানতে চান আমার কাছে। বললাম— ভালো আছে ওরা।পারভেজ ভাই সিলেটে বিয়ে করেছে, ফিরোজের জন্য পাত্রী দেখছে জোরেশোরে। জেসমিনের বিয়ে হয়েছে অষ্টগ্রামে। একান্নবতী পরিবারে থাকে।
—একান্নবতী পরিবারে অসুবিধা থেকে সুবিধা বেশী। মিলেমিশে থাকার আনন্দই আলাদা। একা থাকার যথেষ্ট সময় পড়ে আছে। মানুষ কবরে একাই থাকে।
আমাদের গ্রামে বড় চাচার নামডাক ছিল। রাজনীতির সাথে ওতোপ্রোতোভাবে জড়িত ছিলেন। এখনও গ্রামের প্রবীণদের সাথে দেখা হলে জিজ্ঞেস করেন— তুমি রাজ্জাকের ভাতিজা না?
বড় চাচা আমাকে নিয়ে তার ছেলেদের দো’তলা বাড়ির চারপাশ ঘুরে দেখলেন কয়েকবার। আমি ওদের সাথে দেখা করতে অনুরোধ করলাম।
—সুবেহ সাদিকের আগে আমাকে আবার গন্তব্যে ফিরতে হবে বলে বড় চাচা হাঁটতে শুরু করেন মসজিদের দিকে। আমাদের পারিবারিক করবস্থানের দিকে। বৃষ্টি আর বাতাসে ছাতা মাথায়ও আমার সমস্ত শরীর ভিজে গেছে। বড় চাচা ছাতার বাইরে নির্বিঘ্নে হাঁটছেন অথচ বৃষ্টিতে একটুও ভিজছে না তার শরীর। ভিজেনি জামা-কাপড়ও।
মসজিদের অযু-খানার কাছে আসতেই ইমাম সাহেব ডাক দিয়ে বলেন— ইশতিয়াক ভাই কী ব্যাপার? আজকে দেখি নামাজের আগে মসজিদে হাজির! বৃষ্টির শব্দে শুনতে পাবো না ভেবে একটু গলা চড়িয়েই বললেন।
ইমাম সাহেবের দিকে একবার তাকিয়ে আমি আমার চারপাশে তাকালাম। জনশূন্য রাস্তা। আমি ছাড়া আর কেউই নেই।
মসজিদে প্রবেশ করে আমি বাইরের দিকে চোখ ঘোরাতে লাগলাম।
— ভাই, আসছেন যখন বৃষ্টি না দেখে তাহাজ্জুদ নামাজটি পড়ে ফেলেন। ইমাম সাহেব আল্লাহ আকবর বলে নিয়ত ধরলেন।
১৩ এপ্রিল - ২০১১
গল্প/কবিতা:
১৭ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ ডিসেম্বর,২০২৪