১.
মাঝে মাঝে ভূত চাপে সাইফুলের কাঁধে। কোনদিন নদীপথে স্বরূপকাঠি, আটঘর কুড়িয়ানা, ঝালকাঠি, বরিশাল কিংবা একেবারেই কাছের কাউখালি। কোনদিন সাইকেলে চেপে ডুমুড়িয়া, টগড়া, নামাজপুর, শংকরপাশা কিংবা নিদেনপক্ষে বলেশ্বরের পাড়। আজ চেপেছে রায়েরকাঠি জমিদার বাড়ির ভূত। একই পাড়ার বাসিন্দা হওয়ায় মশিউর আর বাবুল ওর সবসময়ের সাথী। আমাকেও যেতে হয়। ভেতরে বাস করা পর্যটক মন শান্তি দেয়না। পড়াশুনায় চলে বন্ধাত্ব। আমাদের প্রস্তুতি সেতুকে ঘর থেকে বের করে আনে। এই প্রথম আমাদের সাথে ঘুরতে যাবার বায়না ধরে। পেছন পেছন এগিয়ে আসা ওর মা-ও সায় জানায়। আমি আন্টির চোখের করুণ আর্তিতে দেখি সীমাহীন হতাশার অথৈ তরঙ্গ। শীতের বাতাস হঠাৎ শব্দ করে ঝড়িয়ে দেয় একটি সুপাড়ির খোল। রওয়ানা হই প্রাচীনপুরীর গন্ধে বিভোর হয়ে।
সেতু। আমাদের বয়সী। যে বয়সে আমরা প্রস্তুতি নিচ্ছি এসএসসি পরীক্ষার। রাতের পর রাত না ঘুমিয়ে কখনো পড়ছি, কখনো তাসের আসরে বিভোর থেকে পাড়ি দিচ্ছি সময়ের মোহনা। কিংবা সাইকেলে চেপে হাওয়ায় উড়িয়ে দিচ্ছি সকল অপূর্ণাঙ্গতা। সে বয়সে ও ছুটি নিয়েছে স্কুল থেকে। পড়ার সাথে ছেদ করেছে সব সম্পর্কের বাঁধন। সন্ধ্যেবেলা এ বাড়ির উঠানে আলো জ্বলে উঠলে আসে ব্যাডমিন্টন খেলার নেশায়। ওকে সুযোগ দিতে প্রতিযোগিতা করে সাইফুল আর বাবুল। মশিউর ওকে নিয়ে কবিতা লিখেছে একটি। আমি নির্লিপ্ত যথারীতি।
খেলার বাইরে আড্ডা জমে ভোরে কিংবা বিকালে। উঠে আসে ব্যক্তিক-সামাজিক-রাষ্ট্রিক নানা বিষয়। ক্ষুধা পেলে ইলিয়াসের দোকান থেকে আসে ডিম-পরোটার মায়াবী ঘ্রাণ, কখনো আমার অনভ্যস্ত হাতে চলে সুস্বাদু খাবারের শিল্পকর্ম, আবার কখনো বাবুলদের আনা উপাদেয় খাবারে ঢেকুর তুলি। সেতুও মাঝে মাঝে রাঁধে নিজহাতে। অংকের দায় আর আড্ডার নেশা সাইফুলদের প্রায়ই টেনে আনে। ইদানিং আসছে প্রতিদিন- হয়তো সেতুর টান।
সোবহান হাজীর বাড়ি পাশ কাটাই। ইট বিছানো রাস্তার খানাখন্দ এড়িয়ে সাইকেলগুলো এগিয়ে যায় কিশোর দক্ষতায়। পাশাপাশি চার বন্ধু। বাবুলের সাইকেলে সেতু। পত পত উড়ছে সকলের পরিধেয়। মাঝে মাঝে দুই হাত হাওয়ায় ভাসিয়ে ইকারুসের ডানা নিয়ে উড়ে যেতে চাই সীমানা ছাড়িয়ে। বাবুলের সাবধানবাণী কানে আসে ‘ওড়না ঠিক করে ধরিস, নইলে কিন্তু এক্সিডেন্ট!’
মাসখানেক হল মিশতে শুরু করেছে আমাদের সাথে। তার আগে নাকি ভারত গিয়েছিল বেড়াতে। ঘুরে বেড়িয়েছে এক প্রদেশ থেকে আরেক প্রদেশ। কখনো আজমীর শরীফ, কখনো আগ্রা, কখনো হিমালয়ের হিমেল পরশ গায়ে মাখিয়ে, কখনো সমুদ্রস্নান করে পাড়ি দিয়েছে সময়। এর কিছুই আমার জানার কথা নয়-জেনেছি রায়হানের কল্যাণে। কাঠের এই দোতলা বাড়িতে আমার মতই ওর অধিবাস। অব্যবহৃত দোতলায় কাঠ আর লাকড়ির ভেতরে তেলাপোকা, আরশোলা আর বাদুড়ের নির্ভয় বিচরণ। নীচতলায় দুজন কিশোর। আত্মীয় বলে সেতুদের অনেক খবরই ওর নখদর্পনে। ভাল রেজাল্ট আর রূপের দ্যুতিতে চারপাশ পুড়িয়ে যে এতদিন ছিল আমাদের ধরাছোঁয়ার বাইরে, সে-ই ফিরে এল অন্য এক মানুষ হয়ে। ওর উপস্থিতি আমাদের আড্ডার চেহারা যেমন বদলিয়েছে তেমনি পরিমানও বাড়িয়েছে।
জমিদার বাড়িতে দেখার কিছুই নেই তেমন। ভাঙ্গা দালানে একঘর মানুষের বাস। ছড়ানো ছিটানো ইট, এখানে ওখানে ময়লার স্তুপ, শ্যাওলার দাগ আর বাতাসজুড়ে পুরনো দিনের গন্ধ। সুযোগ পেয়ে কবিতার খাতা খুলে ভাবের জগত পাড়ি দেয় মশিউর। ভাঙ্গা দালানের উপর বসে সাইফুল হেঁটে বেড়ায় অতীতের পথে। আমার মানসপটে ভেসে ওঠে কোন এক বন্দিনী মুখ। নিজের অমতে যাকে বেছে নিতে হয়েছিল এ বাড়ির আয়েসী জীবন। টেলিপ্যাথির সার্থক রূপায়ণে বাবুল গেয়ে ওঠে “সুখে থেকো ও আমার নন্দিনী, হয়ে কারো ঘরণী, জেনে রাখো প্রাসাদেরও বন্দিনী, প্রেম কভু মরেনি।” আমার মনে পড়ে বেবির কথা। বাবুলকে ঘুরিয়ে এখন অন্য কারো সাথে ভাবের সওদা করছে মেয়েটি। সেতু চুপচাপ বসে থাকে গাছের ছায়ায়।
আশাহত সেতু প্রস্তাব করে আরো সামনে এগিয়ে যাবার। কিছুদূর পর মাটির সহজ সরল এবড়ো থেবড়ো পথে চলতে থাকে সাইকেল। দু-ধারে সবুজ মাঠ, কখনো বসতিঘেরা নানা গাছের সাথে নাড়িকেল-তাল-সুপাড়ির ঘন সারি। নদী ছুঁয়ে আসা বাতাস রোদের উত্তাপে বিলায় মিষ্টি মিষ্টি আমেজ। সেতুর কণ্ঠে ভেসে আসে “আজ এই দিনটাকে মনের খাতায় লিখে রাখো, আমায় পড়বে মনে কাছে দূরে যেখানেই থাকো।”
লখাকাঠি বাজার পার হয়ে মূলগ্রাম তারপর তেজদাসকাঠি। দুপুরের খাবারে বিলের টাটকা শরপুটির সাথে জায়গা করে নেয় হরেক ভর্তার উপাদেয় স্বাদ। পথে পথে অবাক লোকগুলো আমাদের দেখে। মাঝে মাঝে কুৎসিত হাসির ফোয়ারা বিব্রত করে। দু-চারটে বাঁকা মন্তব্য কানে জ্বালা ধরালেও আমরা বিভোর থাকি নিজেদের নিয়ে। ফিরতি পথে কচা-নদী তীরের রাস্তা। একটা শিরিষ গাছের নীচে বসে চলে নদীদর্শন। রোদ অনেকটা পড়ে এসেছে। পড়ন্ত এই বিকেলে কচার বুকে ভেসে বেড়াচ্ছে শত শত নৌকা। কেউ মাছ ধরছে, কেউ মানুষ পারাপার করছে, কোনটা হুলারহাটের দিকে যাচ্ছে, কোনটা ফিরে আসছে। দীর্ঘ নিরবতা জুড়ে উপভোগ করতে থাকি প্রকৃতির অপরূপ দৃশ্য।
তখনি ঘটে বিভ্রাট। মশিউর সেতুকে এগিয়ে দেয় একটি কাগজ। ‘তোমার জন্য’। ধীর-কম্পিত হাতে খোলে কাগজের ভাঁজ। আমাদের বড় বড় চোখের সামনে হঠাৎ সহজ হাসি দেয়। টেনশান স্বাভাবিক হয়। মশিউরের কবিতা পড়তে থাকে সেতু। চমৎকার সব শব্দচয়ন-
“বুকে আমার হাজার নদীর ঘন আর্তি,
চরণে লেগেছে সিক্ত পলির উর্বরতা....
শ্যামা সেতুর চোখের তারায় আমার ছায়া!
শিউরে উঠি, মগ্ন হই নিবিড় নির্ভাবনায়।”
পড়তে পড়তে ওর চোখে জমে টলটলে অশ্রুকণা। অবাক হই। বুঝতে পারিনা কান্নার রহস্য।‘বাশারকে ভালবাসি আমি’ ফুঁপিয়ে ওঠে। প্রকাশিত হয় ওর হৃদয়মানিক।
শীতের বিকেল হারিয়ে যায় দ্রুত। গাছের ছায়া বড় হয়ে মিলিয়ে যায় নদীর আঁধারে। জাঁকিয়ে বসা শীত কাঁপাচ্ছে শরীর। ওপারে ধীরে ডুবছে লাল সূর্য। আমরা উঠে পড়ি ফেরার তাগিদে। বাগানে বাগানে ঝিঁঝিঁর কলরব আর নদীর বহতাকে সাথী করে চরাচরে নামে মাগরীবের এলান। সন্ধ্যার ম্রিয়মান আলোয় পার হই হুলারহাট বন্দর।
মশিউরের কথা ভাবি। ও কি সেতুর প্রেমে পড়েছে ? এত অল্প সময়ে ? কত মেয়ে দেখেছি ওর পেছনে ঘুরতে! ভাবতে ভাবতে প্রশ্নটা করে বসি। ‘এরকম কবিতা আমার শত শত। ওর মধ্যে কোথাও যেন আছে চোরাবালি, আমি সে চোরাবালির সন্ধান পেতে চাই। ব্যস আর কিছু নয়।’ ‘কিন্তু বাশার তো মিথ্যা হতে পারেনা।’ ‘পারেনা কেন? সবই পারে।’ আমার কি সাধ্য উদঘাটন করি কবির হেঁয়ালী! নারীর হেঁয়ালী সে-তো সুদূর পরাহত।
পরদিন বিকালে আমার দরজায় কড়া নড়ে। দাঁড়িয়ে সেতু স্বয়ং। সাদা কামিজের উপর শুভ্র ওড়না। ঘন গাছের এ বাড়িতে বিকেল হতেই অন্ধকার জেঁকে বসে। আমি যেন অন্ধকারের ভেতর দেখতে পেলাম শুভ্র মোহন কমনীয় এক পরী। ভেতরে এসে জানায় খুব ভাল লেগেছে আমাদের সঙ্গ। মাঝে মাঝে যদি হারিয়ে যেতে পারত এভাবে! হঠাৎ বেবির প্রসঙ্গ তোলে। বাবুলের জন্য ওর কষ্ট স্পষ্ট হয়। এত ভাল একটি ছেলেকে ছেড়ে যেতে একটুও কাঁপলনা মেয়েটার হৃদয়? সুযোগ ভেবে করে বসি অপ্রিয় প্রশ্নটি আবার ‘কেন তুমি পড়াশুনা ছেড়ে দিলে ?’ ‘আমি এখন আসি’ জানিয়ে দেয় এ প্রশ্নের উত্তর পাবনা কোনদিন।
২.
উদ্দেশ্যহীন চোখে তাকিয়ে আছে সেতু। বারান্দা লাগোয়া সিঁড়ির দুই প্রান্তে বসার দুটো আসন। একটি দখল করে বসে আছে নিপুণ ভঙ্গিতে। আমি ওর দৃষ্টি অনুসরণ করি। সেখানে প্রান্তসীমার কোলজুড়ে বায়সের ওড়াওড়ি। ও কি এভাবে উড়তে চায় ? হারিয়ে যেতে চায় নীল নীল স্বাধীন কোন ভূবনে ? দৃষ্টিসীমা আরো ছোট করে বাড়িটার প্রান্তে নামিয়ে এনে দেখি পাতা ঝড়িয়ে উলঙ্গ-প্রায় একটি আমড়া গাছ মুক কান্নায় দাঁড়িয়ে আছে সর্বাঙ্গে মেখে বিষাদ রোদ।
আমার আগমন সচেতন করে ওকে। খসে যাওয়া ওড়নায় হাতের ছোঁয়া বুলায়। ‘কি দেখছিস?’ আমি কি দেখছি কিছু ? নাকি ভাবছি কোন উত্তরহীন প্রশ্নের সমাধান ? সদ্য গোসল সেরে আসায় মাথা থেকে চুঁইয়ে পড়ছে না-মোছা পানির বিন্দু বিন্দু অবশেষ। হাতে ভেজা লুঙ্গি। উলঙ্গ উর্দ্ধাঙ্গ। রোদের উঠানে ছড়িয়ে দেই ভেজা কাপড়। চুলে কয়েকটি ঝাঁকি দিয়ে বসি অপর প্রান্তের আসনে।
গতরাতের আসর নিয়ে ওর জিজ্ঞাসা বিরক্ত করে। রাত দুটায় বাবা-মাকে ফাঁকি দিয়ে উঁকি দিয়েছে বেড়ার ফাঁকে। বন্ধুদের তাস হাতে দেখে খারাপ লেগেছে খুব। ‘বাবা বলেছেন ভাল ছেলেরা তাস খেলেনা’ ওর চোখ থেকে ঘুমপরীরা তাই পালিয়ে গেছে দূরে কোথাও। সকাল হতেই চলে এসেছে প্রশ্নবানে বিঁধে ফেলার তাড়নায়। অথচ কথায় নেই সহজাত ধার। নির্ঘুম রাতের ক্লান্তি পানিতে ভাসিয়ে না দেয়ায় শব্দ হচ্ছে দুর্বল তরঙ্গে। ‘আমরা হয়তো ভাল ছেলে নই’ ওর চোখ গড়িয়ে নেমে আসে ফোঁটা ফোঁটা অশ্রু।
দুদিন পর অংক করছি সবাই। হঠাৎ খবর আসে সেতুকে পাওয়া যাচ্ছেনা। বিস্মিত চাহনীগুলো বিনিময় হয় ক্ষণিকের জন্য। চার বন্ধু দশদিক ছড়িয়ে খুঁজতে শুরু করি। কোথাও সেতুর দেখা নেই। সিআই পাড়ায় বাশারকে খুঁজতে গিয়ে আবিষ্কার করি ওর অস্তিত্বহীনতা। দ্বিতীয় রাতে সাইফুলরা আমার সাথে থেকে যায়। রাতের সাথে বিষণ্নতাও বাড়ে। আমরা প্রিয়জন হারানোর বেদনা উপলব্ধি করি। অংকের খাতা, তাসের প্যাকেট পড়ে থাকে পাশে। ইলিয়াসের দোকান থেকে আসেনা কোন মায়াবী ঘ্রাণ। প্রত্যেকে হয়ে পড়ি সীমাহীন নিঃসঙ্গ। ‘কোথায় যেতে পারে মেয়েটা?’ আমার উদ্বেগ আতঙ্কে পরিণত হয়ে জানিয়ে দেয় ওর জন্য একটা আসন তৈরি হয়ে গেছে হৃদয়ে।
পরদিন আবারও ব্যাডমিন্টনের আসর বসে এ বাড়ির উঠোনে। রায়হানের বন্ধুরা বলছে মেয়েটা বোধহয় কারো সঙ্গে পালিয়ে গেছে। ‘তবে কি অস্তিত্বহীন বাশারই সব নষ্টের মূল?’ আমার ভাল লাগেনা কিছু। সন্ধ্যার আবছা আলোয় সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়ি। উদ্দেশ্যহীন চলায় কখন যেন পৌঁছে যাই রায়েরকাঠি জমিদার বাড়ি। চিন্তার ক্ষমতা আচ্ছন্ন করে রেখেছে সেতুর অন্তর্ধান। সেদিনের পথগুলো পাড়ি দেবার কথা মনে হয় একবার। আবার কী মনে হতে ফিরতি পথ ধরি। হেঁড়ে গলা ফুঁড়ে বেরিয়ে আসে “ আজ এ দিনটাকে মনের খাতায় লিখে রাখো ” ব্যস এটুকুই। রুদ্ধ গলা থামিয়ে দেয় সুর। নেমে আসে চোখ আর হৃদয়ের মিলিত গলিত আর্তনাদ।
রাতে বিড়ালের চেঁচামেচিতে ঘুম ভাঙে। অব্যবহৃত দোতলা দিন দিন দখলে নিচ্ছে নানা প্রজাতির প্রাণী। নিস্তব্ধ বাড়িতে ওগুলোর গোঙানি আর চিৎকার এনে দিয়েছে ভৌতিক আবহ। এমন সময় ধেয়ে আসে উৎকট গন্ধ। গা গুলিয়ে ওঠে। অনেক কষ্টে চাপি বমির বেগ। সর্বপ্লাবী বিভৎস গন্ধের তোড়ে থেমে যায় বিড়ালের আলাপ। তাস খেলা ছেড়ে চিৎকার করে রায়হান। ‘গন্ধ পাচ্ছিস কোন?’ দ্রুত দরজা খোলার শব্দ হয়। বমি করে একজন। ওদের চিৎকারে জেগে ওঠে সেতুদের বাড়ি। গন্ধের উৎস অনুমান করতে উপরে তাকাই। দেখি- কাঠের ফাঁক গলে ঝুলে আছে ভাঁজ করা কাগজ। হাতে নিই। হিম হয়ে আসে শরীর। সেতুর লেখা।
গন্ধের উৎস খুঁজতে দোতলায় উঠছে কয়েকজন। আমি কোন এক অপার্থিব টানে ভুলে গেছি সব। এই গন্ধের ভেতরও পাচ্ছি সেতুর শরীরের পরিচিত ঘ্রাণ। আস্তে আস্তে কাগজটায় চোখ বুলাই-
“কিরে দোতলা থেকে চিঠি পেয়ে ভড়কে গেছিস? আমি অবশ্য সন্দিহান আদৌ এ চিঠি তোর হাতে পৌঁছবে কিনা ! শোন বোকা, বাশার নামে কাউকে আমি চিনিনা। তোরা যদি আমার প্রেমে পড়িস, এজন্যই ও কথা বলতাম।
তোরা তো জানিস না আমার ক্যান্সার হয়েছে। ভারত গিয়েছিলাম ও জন্যেই। ডাক্তার বলেছে- “লাভ নেই। বাড়ি নিয়ে যান, শেষ দিনগুলো বাড়িতেই থাকুক।” তুই-ই বল, কী লাভ আর পড়াশুনা করে ? চাইনি কেউ করুণা করুক আমাকে। আব্বা-আম্মাও চাননি তা।
ঠিক করেছি বিষ খেয়ে মরে যাব। বাবাকে লুকিয়ে পোকা মারার ঔষধ জোগাড় করেছি। অযথা তোদের মনে মায়া বাড়িয়ে কী লাভ ? শোন, বাবুলকে বলিস ওর মুখের জড়ুলটা আমার খুব প্রিয় ছিল। প্রায়ই চিমটি কাটতে ইচ্ছে করত। আর সাইফুলের উচ্ছলতা মরে যাবার পরও আমাকে স্পর্শ করবে। ওকে বলিস, আমিও ওর মত উচ্ছল ছিলাম অসুস্থ হবার আগে। মশিউর খুব ভাল কবিতা লিখে। আমাকে নিয়ে কবিতা লিখায় কী-যে ভাল লেগেছিল কেমন করে বুঝাই তোকে ! বাসায় ফিরে সারা রাত ওর কবিতা পড়েছি।
তোর ব্যাপারে আমার বলার নেই কিছুই। তোর মত মানুষগুলো বন্ধু নামের কলঙ্ক! পড়াশুনা না করেই ক্লাসে ফার্স্ট হস। কোনকিছুতে সিরিয়াস না অথচ সবকিছুতে ভাল করিস। তোকে শুধু একটা অনুরোধ করব, কাউকে কোনদিন বন্ধু বানাস না। তোকে অনুসরণ করতে গিয়ে বিপদে পড়বে ওরা।
রাগ করলি আমার কথায় ?
একটা মজার কথা বলি শোন, সেদিন রাত দশটায় হঠাৎ মনে হল তোকে এক নজর দেখা দরকার। কোন কারণ ছাড়াই। খুবই খারাপ লাগছিল। কি করব ভেবে পাচ্ছিলামনা। কাউকে কিছু না বলে চলে এলাম তোর ঘরের পাশে। জানালায় দাঁড়িয়ে দেখলাম অংক করছিস। একবারও আমার দিকে তাকালিনা। বাসায় ফিরে সারারাত কেঁদেছি। পরদিন নিজেকে সান্ত্বনা দিলাম- তুই তো জানতিনা আমি এসেছিলাম।
দোয়া করি, পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দরী মেয়ের সাথে তোর প্রেম হোক। প্রেমের কথা বলছি কেন জানিস ? প্রেমের যন্ত্রণাদায়ক সুখ যদি না পাস তাহলে তোর জীবন অর্ধেকই বৃথা। ভাবছিস পন্ডিতি করছি? আসলে কোন এক উপন্যাসে পড়েছিলাম কথাটা, সেখান থেকেই মেরে দিলাম।
একটা কথা বলি। ধর, আজ থেকে পনের বছর পর। তুই একজন সরকারী বড় অফিসার। আমি গেলাম তোর বাসায়। চিনতে পারবি আমাকে ? তোর বউয়ের সাথে কি বলে পরিচয় করিয়ে দিবি ? নিতান্তই পাশের বাড়ির মেয়েটি ?
আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে মিতুল, তুই কি সত্যিই কোনদিন কোন মেয়েকে ভালবাসবি ? হৃদয়ের গভীর থেকে উঠে আসে যে আবেগ সে আবেগে জড়িয়ে নিবি কোন নারীকে ? তোকে আমার রক্ত মাংশের রোবট মনে হয় জানিস!
আর লিখতে ইচ্ছে করছে নারে। শোন, এই চিঠিটা পুড়িয়ে ফেলিস। নইলে আমার মৃত্যুর জন্য তোকে দায়ী করবে সবাই। তবে কি জানিস, যদি ক্যান্সার না হত। যদি বেঁচে থাকার সামান্য আশাও থাকত; আত্মহত্যা করতাম না। তোদের মত বন্ধু যার আছে সে কি কখনো মরতে পারে ? বাবুলটার জন্য খুব মায়া হচ্ছেরে। ও খুব সহজ সরল। ওকে বলিস আমি ওকে কাঁদতে নিষেধ করেছি।
আরেকটা অনুরোধ করব। যদি পারিস আমার ছবিটা নষ্ট না করে রেখে দিস। তোর বউকে বলবি, আমি ছিলাম তোর বন্ধু। কখনো বলবিনা যেন, আমি ছিলাম পাশের বাড়ির একটি মেয়ে।”
৩.
লাশ নামানো হয়েছে। গন্ধ ছড়ানো রোধ করতে নিজেকে জড়িয়ে নিয়েছিল পলিথিনে। তাতে পচন হয়েছে দ্রুত। বিড়ালের ধ্বস্তাধ্বস্তি পলিথিন খসিয়ে বাতাসের পরশ দিয়েছে। খালি বিষের বোতল নিশ্চিত করেছে আত্মহত্যা। ‘কিন্তু এখানে কেন ?’ বয়স্ক একজন জবাব দেয় ‘হয়তো মানুষের চোখ এড়াতে।’ কিছুদিন হল সেতুর মধ্যে অস্থিরতা লক্ষ্য করেন মা-বাবা। চাক্ষুষ মৃত্যুর পথে অতটুকু মেয়ে কতদূর হাঁটতে পারে? সকলকে জানানো হয় ডাক্তার দেখাতে ভারত গিয়েছিল তারা। খবর পেয়ে সাইফুলরা ছুটে আসে। বিনা জানাজায় কবর হয় সেতুর।
আমরা চলে আসি পুকুরপাড়ে। ততক্ষণে হিম তাড়াতে গতদিনের মতই হাজির হয়েছে সকালের সূর্য। জোয়ারের পানি খাল-নালা-বিল পেরিয়ে ঢুকে পড়ছে পুকুরে। বাবুল কেঁদে চলেছে শব্দহীন। সাইফুল উদাস দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আকাশের দিকে। মশিউর পুকুরের পানিতে একের পর এক ঢেলা ছুঁড়ছে। আমি আনমনে শান বাঁধানো ঘাট থেকে খসিয়ে চলেছি শ্যাওলার আস্তরণ।
সেদিনও কচা নদীর ওপারে গ্রাম ছাড়িয়ে সূর্য নামে। সন্ধ্যার আকাশ পাখিদের কলকাকলিতে মুখর হয়। আবারও জোয়ার ভাটায় চলতে থাকে নৌকাগুলো। হুলারহাট থেকে সবগুলো লঞ্চ ঠিকই ছেড়ে যায়। সেতুর জন্য থেমে থাকেনা কিছুই!
সাইফুলরা প্রতি বছর এগারো ডিসেম্বর সেতুকে স্মরণ করে। সেই জমিদারবাড়ি থেকে হুলারহাট হয়ে ফিরে আসে যার যার বাসায়। আমার যাওয়া হয়না কখনো। ওরা জানে, আমি আসলেই বন্ধু নামের কলঙ্ক !
ওরা কখনো জানবেনা, প্রতি রাতে আমার সাথে ঘুরে বেড়ায় একটি লাশ। সন্ধ্যার আঁধার নামতেই আচ্ছন্ন হয়ে পড়ি অন্য কোন জগতের টানে। উপলব্ধি করি কারো পরম যত্নে বুলিয়ে দেয়া হাতের পরশ। কখনো আড্ডা দেই। গল্প করি। চলমান সামাজিক রাষ্ট্রিক বৈকল্যে বিমর্ষ হই। কখনো চটুল কৌতুকে হেসে উঠি। ও আমাকে সংসারী হতে বলে। কিন্তু পনের বছরে জেনেছি আমৃত্যু লাশের বাঁধনে বাঁধা এই জীবন।
১০ এপ্রিল - ২০১১
গল্প/কবিতা:
১২ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪