রুপ নারায়ন বা বৈতরনীর কূলে নয় সবুজ এক চত্বরে জেগে উঠল সে । রোদ্রাক্রান্ত এই বিজন শহর তখন খাঁ খাঁ করছে । লড়াইকৃত কাক আর চড়ুইয়ের দিকে চেয়ে সে প্রশ্ন করল, কেন জাগালে আমায় ? বুকের ভেতর অনেকদিনের জিইয়ে রাখা ‘না থাকারা’ কোন কথার জবাব দিলনা । কেবল একটা দশ এগার বছরের ছোট ছেলে তাকে ঢিল ছুঁড়ে ডাকল, “ পাগল, অ্যাই পাগল ! “ ঝমঝম শব্দে কিছু একটা ভেঙ্গে পড়ল মাথার ভেতর । সে স্পষ্ট তার ভাঙ্গনের শব্দ শুনতে পেল । বিড়বিড় করে “না থাকারা” আবার ফিরে এলো ঠোঁটে । “ মা, দ্যাখো পাগলটা একলা একলা কথা কয় ।“ বালক তার মায়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করল । “ চন্দ্রাহত বালক, আজ তুমি অবিশ্ব্বাসী । জাননা কি ! স্বপ্নও মন ভাঙ্গে নারীর মতন । ফাল্গুন রাতের হেঁয়ালি বিজন তারা বলে গেল তারে ...... সময়গ্রন্থির খুলেছে দ্বার এবার মেটাও তবে ভালবাসার দায় ! “
এই লাইন কয়টিই বিড়বিড় করতে লাগল সে । প্রচণ্ড ক্ষুধার জৈবিক তাড়না তাকে এখন নিয়ে যাবে খাদ্যের সন্ধানে । একটু পরেই দেখা যাবে কোন এক হোটেলের সামনে সদ্য ভাজা পরোটার দিকে লোলুপ চোখে তাকিয়ে আছে সে । ক্যাশে বসা লোকটির দয়া হলে কাউকে বলবে “ পাগলডারে একটা রুটি দিয়া দে । “ না হলে বলবে,” খেদা অইডারে । সক্কালবেলায় যাত্রা নষ্ট ।“ কিছুদিন আগে এমনই এক হোটেলে রুটি চুরি করতে গেলে চায়ের গরম পানিতে পিঠ ঝলসে দিয়েছিল তারা । সেই দগদগে ঘা নিয়ে সে আবার গিয়ে দাঁড়াবে অন্য দুয়ারে । পৃথিবীতে নির্মম মানুষের চাইতে দয়ালু মানুষের সংখ্যা এখনো বেশি । তারপর সে সারাদিন হাঁটবে । এক পথ থেকে আরেক পথে । কোন স্থানেই সে বেশীক্ষণ থাকেনা । অথবা পথ চিনে আগের ঠিকানায় ফিরে আসতে পারেনা । ফিরে আসার দায়ও সে অনুভব করেনা । দিন তারিখ নাম ঠিকানা কিছুই তার মনে নেই । সে শুধু বেঁচে আছে । শুধুই বেঁচে আছে । তবে মাঝে মাঝে খুব অস্থির দেখায় তাকে । বুক পকেট হাতড়ে কিছু একটা খুঁজে বেড়ায় । কোন চিঠি বা স্মৃতি অথবা কোন স্পর্শ । “যেখানে গিয়ে রেল লাইন শেষ হয়ে যায়, আর কোন পথ থাকেনা সেখানে নামার পর তুমি দেখবে কত মানুষ ধীর পায়ে এগিয়ে যাচ্ছে । বিধাতার কাছে কি আর ব্যস্ততা নিয়ে যাওয়া যায় ! আর একটু এগিয়ে গেলেই দেখতে পাবে ধূসর এক পাহাড় মেঘ ছুঁয়ে যাবার স্বপ্নে বিভোর । পাহাড়ের উপর আদিনাথের মন্দির । সামনে অকূল সমুদ্র । সেখানকার পত্র শূন্য দেবদারু গাছটির উপর লক্ষ লক্ষ লাল সুতো বাঁধা, তাতে নাকি মনের আশা পূর্ণ হয় । গাছে সুতো বাঁধার সময় তুমি কি কামনা করবে কবি ? “ বলেই হাসতে হাসতে ভেঙ্গে পড়েছিল এই বুক পকেটের কাছে অদ্ভুত সেই নারী । স্বপ্ন দেখানো নারী ! হৃদয়হীন নারী ! ২ সোডিয়াম বাতির ভূতুড়ে আলোকে গ্রাস করছে বটের পাতা । সবুজ বিহীন ইট কাঠের এই শহরে এখনো কিছু বট অশ্বত্থের গাছ বিস্ময়করভাবে বেঁচে আছে । সে চেয়ে আছে একাগ্রভাবে । চোখ দুটি ক্ষণে ক্ষণে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে আবেশে । তাকে এখন দেখাচ্ছে এক হারিয়ে যাওয়া পুরনো কবির মতন । যে কিনা কবিতার শেষ চরন লিখতে প্রাণপণ ব্যস্ত । সেই কবি যে কবিতা লেখার জন্য একদিন সব ত্যাগ করতে চেয়েছিল । যে কবি হবার জন্য জন্ম নিয়েছে বলে বিশ্বাস করেছিল । তারপর একসময় লিখে সবাইকে ছাড়িয়ে যেতে না পারার ক্রমাগত ব্যর্থতা বা অজানা কোন মানসিক আঘাতে তার চেতনার জগৎ ধীরে ধীরে পাথরের মত জড় হয়ে গিয়েছে । অতঃপর কোন একদিন গৃহত্যাগী জোছনায় পাণ্ডুলিপিদের সৎকার করে সে নিজেকে লুকিয়ে ফেলেছিল সব অকবিদের ভিড়ে বুক পকেটে এক মনভাঙ্গা নারীর শেষ চিঠি নিয়ে । “ কথাগুলো হয়ে গেছে দীর্ঘশ্বাস । প্রতিটি দীর্ঘশ্বাস অজস্র না বলা কথার ফুলঝুরি । প্রতি নিঃশ্বাসে একবার মরি, একবার বাঁচি । জানি চলে যেতে হবে সব ছেড়ে মাটির সাথে সবুজ ঘাসে । “
“পাগল রে ভাই, তোর সাথেই দুঃখের কথা বলি ! “ অনেক ক্ষণ ধরে ফুটপাতে বসে থাকা ভদ্র মতন দেখতে তরুণ ছেলেটা আর নিরব থাকতে পারলনা । হয়তো অনেক অনেক কথা জমে আছে তার মনে । দিনের বেলা, পরিচিত মানুষদের সামনে মুখোশ এঁটে থাকতে থাকতে তার যে ব্যথার পাহাড় জমেছে তা আজ পাগলকে বলেই হালকা হতে চায় । “আমার বাবা মায়ের মধ্যে এতটাই টান ছিল যে একজন মারা যাবার এক সপ্তাহের মধ্যেই আর একজন তার কাছে চলে গেল । আমরা দুই ভাই শিশুকালেই অকূল পাথারে পড়লাম । শেষে ছোট ভাইটাকে আমার চাচা শহরে নিয়া গেল । সে তাদেরকেই মা বাবা বলে ডাকতে শিখল । আমি মামার কাছে গ্রামে বড় হলাম । দেখা সাক্ষাৎ ছিলনা এত বছর তাও ভাল ছিল । আজ হঠাৎ দেখা হয়ে গেল । ভাইটা আমাকে চিনতেই পারলনা । বিশ্বাস কর, আমার বুকের ভিতরটা ওর অচেনা চাহনি রক্তাক্ত করে দিচ্ছে । মৃত্যু সম্পর্কগুলোকে কি ভীষণভাবে বদলে দিয়ে যায় । পাগল জানিস, আমি কতদিন টিনের বাক্সে পয়সা জমিয়েছি বাবুকে ঘুড়ি, লাটাই আর একটা লাল জামা কিনে দেবার জন্য । বাবুর দেখা পাইনি । আজ যখন পেলাম বাবুটা আমাকে চিনতেই পারলনা । মৃত্যু সব বদলে দেয় রে !“ এত কথা বলে যুবক হাঁটুতে মুখ লুকাল হয়তো কান্না গোপন করতে । এতক্ষন চুপ করে সুস্থ মানুষের মত সব কথা শুনল সে । তার মাথায় এখন একটি শব্দ ঘুরে বেড়াচ্ছে “ মৃত্যু ” । এই শব্দটি দিয়েই সে নতুন কোন কবিতা লিখে ফেলতে পারে । চির তারুণ্যের কবির সেই আগের আনন্দ ফিরে এসেছে । লেখার আনন্দ । আহ্ শব্দেরা ! আর একটু অপেক্ষা । প্রসারিত দুবাহুর মধ্যিখানে পৃথিবীটাকে নিয়ে এক্ষনি খেলা শুরু করবে সে মার্বেলের মত । নিজেকে ধ্বংসের আনন্দে মেতে উঠবে সে । কিন্তু মাইক্রোবাসটির চোখ ধাঁধানো আলো জ্বেলে করুণ আর্তনাদ করিয়ে তার একহাত সামনে দাঁড় করিয়ে ঘাম মুছল বেরসিক ড্রাইভার । কুৎসিত শব্দে গালি দিয়ে উঠল তাকে । নাহ হলনা !
পাগলকে নিয়ে এতক্ষন ধরে ঘটতে থাকা এত সব ঘটনার সাক্ষী হয়ে রইল সাত তলার জানালা দিয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে দেখা এবং শখের কবিতা লিখে বিখ্যাত হওয়া আরেক কবি । সে নিশ্চয় এই বিষয়ে দারুণ এক কাব্য লিখতে বসবে আজ রাতেই ।
ফুটপাতে বসা ভারাক্রান্ত যুবক বা সংসারী কবি কেউ জানতে পারলনা এক মুখ দাঁড়ি গোফ আর জটা চুলে আদিম মানুষের মত দেখতে একসময় কবিতা লিখে সাড়া জাগিয়ে নিরুদ্দেশ হওয়া কবি সন্দ্বীপ দে কবিতার জন্য কতটা ত্যাগ করেছে । সে এখান থেকে হেঁটে চলে যাচ্ছে অনেক দূরে , প্রেম ও অপ্রেমে । জীবন প্রাচুর্যে ভরা এই নীল আকাশ আর সবুজ অশ্বত্থের ছায়ায় কবিতা লিখতে সে আর ফিরে আসবে কিনা কারো জানা নেই । [ উৎসর্গ : আমার কবি বন্ধু সন্দ্বীপ দে । কবিতা লেখা থেকে যে নিজেকে বিমুখ করেছে অথবা কবিতা যার উপর বিমুখ হয়েছে । ]
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
নৈশতরী
যে কবি হবার জন্য জন্ম নিয়েছে বলে বিশ্বাস করেছিল । এই লাইন টা আমাকে পাগল করে তুলছে, আমি অস্থির হয়ে যাচ্ছি. বহুরুপি ভাবনা আমার সামনে এসে দাড়াচ্ছে , সত্যি অসাধারণ একটা মজা পাইলাম আপনার গল্প টা পড়ে!!!
কিন্তু অপু এই সংখা অর্থাত বৃষ্টি সংখায় আপনার কোনো গল্প কবিতা নাই কেন ?
তানি হক
একদমই অন্য রকম গন্ধ পেলাম আপুর এবারের লিখায় ..কথাগুলো হয়ে গেছে দীর্ঘশ্বাস ।
প্রতিটি দীর্ঘশ্বাস
অজস্র না বলা কথার
ফুলঝুরি ।
প্রতি নিঃশ্বাসে একবার মরি, একবার বাঁচি ।
জানি চলে যেতে হবে সব ছেড়ে
মাটির সাথে সবুজ ঘাসে । “ অনেক অনেক সুভেচ্ছা ও ধন্যবাদ আপুকে সুন্দর লিখাটির জন্য ...
মিলন বনিক
"পৃথিবীতে নির্মম মানুষের চাইতে দয়ালু মানুষের সংখ্যা এখনো বেশি" "ফিরে আসার দায়ও সে অনুভব করেনা" এরকম আরো কিছু সহজ সরল শব্দ দিয়ে গভীর অর্থপূর্ণ বাক্যগুলো চিরকাল মনে থাকার মত...আপন ডং-এ আপন রং-এ এইতো স্বকীয়তা...অসাধারণ...অসাধারণ
ওবাইদুল হক
আসলেই আপুর লেখায় সব সময় আলাদা একটা রুপ থাকে । সেদিক থেকে বলতে গেলে খুব জটিল কথার ভাব নিয়ে আসছেন । আর লেখার মাঝে যে দু চার লাইন কিবতা পড়ে খুব মুগ্ধ হলাম । ধন্যবাদ আপু আমার জন্য দোয়া করবেন ।
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।